তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৩৪ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে পথ ঘাট। চারদিকে শুধু ধোঁয়া ধোঁয়া। কারো কাছে শীত খুব ভালো লাগে। আবার কারো কাছে বোরিং। কুয়াশায় ঘেরা শীতের সকাল দেখতে দারুণ লাগে। ঘাস ভেজা থাকে শিশিরে। সূর্য উঠলে শিশির ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝরঝরে হয়। দরিদ্র লোকেরা প্রচণ্ড গরমে খড় জড়ো করে এবং আগুন জ্বালায়। প্রাণীগুলিও অসহায় হয়ে পড়ে। শীতের সকাল মানুষের মনের মধ্যে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি করে। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশে তাকালে মন কেমন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। রাত্রির কালো পর্দা সরিয়ে এক রৌদ্র দীপ্ত সোনালী দিন উপহার করে শীতের সকাল। শীত প্রিয় মানুষরা ভোঁরে চাদর গায়ে জড়িয়ে কুয়াশা দেখতে বেরোয়।

ভোঁরে উঠে নামাজ পড়ে সবার জন্য চা করলো মীরা। বাসার কারোই মন ভালো নেই। কারণ আয়ান সেদিন আর বাসায় আসেনি। সেদিন থেকে আজ তিন দিন হতে চললো আয়ানের দেখা নেই। এই নিয়ে বাসার সবার যেমন চিন্তা হচ্ছে, ঠিক এর জন্যে নিজের ভাইকে দোষ দিচ্ছে মীরা। আহান সব জায়গায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আয়ানের বন্ধুদের ফোন দিলে তারা বলে আয়ান তাদের সাথে নেই। তাহলে কোথায় গেল আয়ান? ট্রেতে চা নিয়ে সবাইকে দিয়ে আসে মীরা। আয়ানের মা কেঁদে কেঁদে অস্থির। আয়ান কখনো এমন করে না। কোথাও গেলে বলে যায়, দেরি হল জানিয়ে দেয়। কিন্তু তারপরও সে না বলে কোথাও যায়না। আহানের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। এখন সে কোথায় খুঁজবে আয়ানকে! রুমে এসে আহানকে চা দিল মীরা। আহান ডিউটিতে যাওয়ার জন্য রেড়ি হচ্ছে। শীত পড়েছে প্রচুর। গায়ে একটা চাদর মুড়ে আছে মীরা। ফোনটা হাতে নিয়ে মিরাজকে কল লাগায়। মিরাজ রিসিভ করতেই মীরা বলে, “তুই এবার খুশি হয়েছিস ভাইয়া? তোর সেদিনের ব্যবহারের কারণে আজ আয়ান ঘরছাড়া। কোথায় গেছে, কেমন আছে আমরা কেউই কিছু জানিনা। এর জন্য তুই-ই দ্বায়ী।”
আহান এগুলো শুনে মীরাকে বলে, “মীরা! কি হচ্ছে এসব। মিরাজকে কেন দোষ দিচ্ছ।”
“ওর জন্যই তো আয়ান কষ্ট পেয়ে আর বাসায় আসেনি। জানিনা কোথায় আছে, কি খাচ্ছে।”
মিরাজ অপরাধী কণ্ঠে বলে, “আয়ান সত্যিই বাসায় আসেনি?”
“আমি মিথ্যে বলছি?”
“আমার জন্য তাইনা। স্যরি মীরা। আমি বুঝিনি আয়ান এতোটা কষ্ট পাবে। আমি আয়ানকে বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক করে।”
“তুই তো তোর বোনের কথাও বিশ্বাস করিসনি। আমি বললাম না আয়ান সম্পূর্ণ আলাদা। তুই ভুল বুঝে যা তা শুনিয়ে দিলি৷ এখন কোথায় খুঁজব আমি ওকে?”
“আমি চেষ্টা করব, ওকে খুঁজে বের করার।”
“তার ভাই-ই পারলো না। আবার তুই পারবি!”
“চেষ্টা করে দেখিনা।”
“মীরা থামো না। আমি বের হচ্ছি। বাসায় থেকো।”
মীরা কল কেটে দেয়। আহান যেতে নিলেই বলে, “আয়ানের ফ্রেন্ডদের নাম্বার আছে আপনার কাছে?”
আহান পিছনে তাকিয়ে জবাবে বলে,
“হ্যাঁ, দুজনের আছে। কেন?”
“আমাকে দিন।”
“কি করবে তুমি?”
“আগে দিন। এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আয়ানের ফোন এখনো বন্ধ। কে জানে ছেলেটা কোথায় গিয়ে বসে আছে।”
“আচ্ছা নাও।”
আহান নিজের ফোন থেকে মীরাকে আয়ানের ফ্রেন্ডসদের নাম্বার দেয়। এরপর আহান মীরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
মীরা আয়ানের দুই বন্ধুকে কল দিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বলে। ওরাও রাজি হয়ে যায়। আয়ানকে পাওয়া যাচ্ছেনা শুনে ওদেরও মন খারাপ। ওরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আয়ানকে খোঁজার।


সকাল নয়টা বেজে পাঁচ মিনিট। নাশতা করে একটু ছাদে ঘোরাঘুরি করতে এসেছে দিবা। ছাদে লাগানো কিছু ফুলের টব আছে। ফুলগাছে সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে। শিশির বিন্দু ভিজিয়ে দিয়েছে ওগুলোকে। দেখতে বেশ সতেজ দেখাচ্ছে। দিবা তার ফোন দিয়ে ফুলগুলোর ছবি তুলে নিল। একটা কাঠগোলাপ ছিঁড়ে নিজের কানে গুঁজলো। ফোনের ক্যামেরার ফিল্টার বের করে নিজের ছবি তুললো। দোলনায় বসতে যাবে এমন সময় ওখানে রাখা টেডিবিয়ার ও একগুচ্ছ গোলাপ ফুল দেখে দিবা থমকে গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। এগুলো তো আয়ানের দেওয়া জিনিসগুলো। কিন্তু এগুলো এখনো এখানে কি করে? আয়ান কি তবে নিয়ে যায়নি? সর্বনাশ! কেউ দেখেনি তো আবার? দিবা ছাদের দরজার কাছে গিয়ে ভালো করে নিচে পরখ করে নিল। আপাতত কেউই আসছে না এখন। দিবা দৌড়ে এসে দোলনার থেকে টেডিবিয়ারটি ও গোলাপগুলো নিল। ওড়না দিয়ে ঢেকে ওগুলো নিয়ে নিচে নেমে গেল। পা টিপে টিপে চারপাশ দেখে দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল। রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানায় চুপ করে বসে আছে দিবা। ওর মাথা কাজ করছে না কি করবে সে এসব নিয়ে? এগুলো সে কেনই বা নিয়ে এলো তাও জানা নেই তার। সুন্দর গোলাপগুলো একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে। দিবা নিজের আলমারি খুলে টেডিবিয়ারটা রেখে দিল। আর গোলাপগুলো নিয়ে নাকে শুকছে। এখনো গোলাপের মন মাতানো ঘ্রাণ রয়েছে। দিবা হুট করেই ওগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। বুক ধড়ফড় করছে তার। মীরার নাম্বারে কল লাগায়। মীরা কিছুক্ষণ পর তা রিসিভ করে। মীরা বলার আগেই দিবা ধুম করে বলে বসে। “দেখ মীরা। তোর দেবরের জন্য এমনিতেও আমার জীবনে অশান্তি লেগে আছে। ওকে বলিস আর যেন কোনো অশান্তি না করে। আমি সবার সামনে খারাপ হতে পারব না।”
মীরা শান্ত হয়ে বলে, “সে থাকলেই তো অশান্তি আসবে। সেদিনের পর থেকে আয়ান নিখোঁজ। আমি জানিনা আয়ান কোথায় গেছে! ফোন বন্ধ তার। অনেক খুঁজেও সন্ধান পাচ্ছিনা। এবার তুই বেশ শান্তিতে থাকতে পারবি। তোর জীবন থেকে সে সরে গেছে।”
মীরার কথা শুনে দিবা সব্ধ! ধাক্কা খেল সে। মীরা কি বলছে, আয়ান মিসিং? দিবা ছোট করে বলে, “উনি বাসায় যাননি?”
“না, বাসায়ও আসেনি। তোদের বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় চলে গেছে আল্লাহ জানেন।”
“কোথায় গেলেন তাহলে।”
“তোকে এতো ভাবতে হবে না। তুই শান্তিতে থাক।”
“মীরা প্লিজ। আমি কোন পরিস্থিতিতে পড়ে এসব বলছি তুই বুঝতে পারছিস না। তোর জীবন আর আমার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। আমি চাইলেই সব হয়না। কিন্তু তুই চাইলে সব পেয়ে যাস।”
“হাসালি। চাইলেই যদি সব পেয়ে যেতাম। তাহলে জীবনে অনেক ইচ্ছাই পূরণ হয়ে যেত। দুঃখ বলতে কিছুই থাকতো না।”
“আমি কি করব মীরা? আমার কিছুই মাথায় আসছে না।”
“নাকে তেল দিয়ে ঘুমা। শান্তির ঘুম হবে। তোর জীবনে তো শান্তি দরকার তাইনা।”
দিবা নিশ্চুপ। কিছু বলার ভাষা নেই তার। মীরা দিবার জবাব না পেয়ে কল কেটে দিল।


বিকেলের দিকে বাসার পাশের একটা রেস্টুরেন্টে আসে মীরা। এখানেই আসার কথা আয়ানের বন্ধুদের। মীরা বোরকা পড়ে এসেছে। কোণার একটা টেবিলে গিয়ে বসে সে। অপেক্ষা করছে আয়ানের বন্ধুদের জন্য। ফোন দিয়ে জাননো তারাও প্রায় কাছাকাছি।
মীরা খাবারের মেনু দেখছে। কিছুক্ষণ পর দুজনে ছেলে এসে ঢুকলো রেস্টুরেন্টে। ওদের মধ্যে একজন কাউকে যেন কল দিল। ঠিক তখনই মীরার ফোন বেজে উঠে। মীরা বুঝে এরাই আয়ানের বন্ধু। মীরা ফোন রিসিভ করে বলে, “একদম শেষের টেবিলে চলে এসো। আমি ওখানেই বসে আছি।”
এরপর কল কেটে দেয় মীরা। ওরা এগিয়ে আসে টেবিলের কাছে। চেয়ার টেনে দুজনেই বসে। মীরাকে সালাম দিয়ে জিগ্যেস করে, “আসসালামু আলাইকুম আপু। কেমন আছেন?”
মীরা বিবর্ণ, শব্দহীন হেসে জবাব দেয়। “এইতো। বাসায় এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, ভালো থাকি কি করে বলো।”
“আমরা কেউই বুঝতে পারছিনা না কোথায় যেতে পারে আয়ান।”
“আচ্ছা, আয়ান ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে?”
“হ্যাঁ, সবসময় সে ট্যুরে যেতে চাইতো। বিশেষ করে ওর বেশ প্রিয় হচ্ছে সমুদ্র। এইতো লাস্ট আমরা কক্সবাজারে গিয়েছিলাম।”
“তা তোমরা মোট ক’জন বন্ধু?”
“পাঁচ জন। আমরা তিনজন ছেলে আর দুজন মেয়ে।”
“ওদের সাথে কথা হয়েছে? ওরা জানে আয়ান সম্পর্কে?”
“ওরা কেউ কিছুই জানে না।”
“তোমরা কোন রিসোর্টে উঠেছিলে?”
“লং বিচ।”
“ওই রিসোর্টের নাম্বার আছে তোমাদের কাছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু কেন? মানে আপনি কি কিছু ভাবছেন?”
“আমার মনে হয় একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। কে বলতে পারে আয়ান হয়তো ওখানেই গেছে।”
“ওকে আপু। এই নিন নাম্বার।”
“দাও।”
মীরা ওদের থেকে নাম্বার নিয়ে নেয়। তারপর ওদের জন্য কিছু অর্ডার দেয়। নিজের জন্য একটা জুস অর্ডার করে সে। খেতে খেতে মীরা বলে, “আয়ান সম্পর্কে কতটুকু জানো তোমরা। ও তোমাদের সাথে কেমন ছিল?”
“আয়ান খুব হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে৷ আমাদের মধ্যে কারো মন খারাপ বা কোনো সমস্যা থাকলে আয়ান সলভ করে দেয়। আয়ান প্রাণপণে চেষ্টা করে সবাইকে হাসিখুশি রাখার৷ খুব মজা করতে ভালোবাসে।”
“বাহ্। আচ্ছা, আমি বিল মিটিয়ে দিচ্ছি। এখন আমায় যেতে হবে। ধন্যবাদ তোমাদের।”
“ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই নেই আপু। এটা আমাদের কর্তব্য। আয়ানের খোঁজ পেলে জানাবেন।”
“অবশ্যই।”
মীরা নিজের পাস নিয়ে বিল মিটিয়ে চলে যায় বাসায়। নিজের রুমে এসে দেখে আহান এসেছে। পুলিশের পোশাকটা একটা দড়ির মধ্যে শুকাতে দিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মীরা নিজের বোরকা টা খুলে নিল। মাথা ব্যথা করছে তার। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখের পাতা কাঁপছে। কপালের রগ টনটন করে ব্যথা করছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। আহান ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে মীরা বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে। আহান মীরার পাশে এসে বসে। কপালে হাত দিলে মীরা চোখ খুলে। আহান জিগ্যেস করে, “অসুস্থ? কোথায় গিয়েছিলে?”
“আয়ানের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটা রিসোর্ট এর নাম্বার নিয়ে এসেছি, আপনি একটু কল দিয়ে খোঁজ নিন তো যে; আয়ান ওখানে আছে কিনা।”
“পরে দেখব। এখন তুমি একটু উঠো। চা খাবে? আদা দিয়ে চা বানিয়ে দেই?”
“এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমি ঠিকাছি।”
“মাথা ব্যথা করছে না?”
“একটু করছে।”
“তুমি শুয়ে থাকো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। আর কি খাবে?”
“আপনি শুধুই ব্যস্ত হচ্ছেন, আমি আর কিছুই খাব না।”
“আচ্ছা।”
আহান গেল চা বানাতে। এদিকে ব্যথায় ছটপট করছে মীরা। বিছনায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here