তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ৩৩ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

অবশেষে সকল প্রচেষ্টার পর ইরার বিয়েটা হলো। সবাই নতুন দম্পতির জন্য দো’য়া করছে। জমজমাট খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠান হয়েছে। চারিদিকে হৈচৈ, মানুষের কোলাহল বিয়ের বাড়ির আমেজটা ধরে রেখেছে। এসবের মাঝে মীরা আর দিবা মেহমানের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনেরই মুড অফ। বিয়ের খাবারও ঠিক মতো খেতে পারেনি। অল্প খেয়েই উঠে যায়। আয়ান দোকান থেকে অনেকগুলো আচারের প্যাকেট নিয়ে আসে। সেগুলো মীরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে দুজনে খেয়ে নিতে। তাহলে আর বমি পাবে না।
সন্ধ্যা হতেই কনে বিদায় শুরু হলো। সবাই জড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা সবাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। মীরা আর দিবাকে ধরেও কাঁদলো। ইরার ব্যাগটা গাড়িতে উঠিয়ে দিল মিরাজ। ইরার মা বাবা সাইমুনের হাতে ইরার হাত উঠিয়ে দিয়ে বলে দেখে রাখতে। ইরাকে গাড়িতে বসানো হলো। ইরা সমানতালে কাঁদছে। বিদায় মুহুর্ত খুব কষ্টের হয়। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। যে বাড়িতে জন্ম নেওয়া হয়, সেখানেই তাদের ঠাঁই হয়না। জগতের নিয়ম যে! আয়ানের বাবা মা ও মীরার বাবা এসেছিল বিয়ে বাড়িতে। ওনারা কিছুক্ষণ থেকে খেয়ে চলে গেছেন।

.
সন্ধ্যার দিকে আয়ান, মীরা আহান বসে নুডলস খাচ্ছিল। বিয়ের পোশাক ছেড়ে সবাই চেঞ্জ করে নরমাল ড্রেস পড়ে নেয়। আহানের খাওয়া শেষ হলে সে উঠে চলে যায়। আহান যাওয়ার পরে মীরা আয়ানকে জিগ্যেস করে। “তুমি দিবাকে প্রপোজ করেছ? দিবা আমাকে সব বলেছে। এভাবে কেউ প্রপোজ করে নাকি?”
মীরার কথা শুনে আয়ান বলে, “আমি সোজা কথা সোজাভাবেই বলতে পছন্দ করি। অন্যান্যদের মতো এতো ডায়লগ মেরে প্রপোজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি এতো আবেগী নই।”
“দিবা কিন্তু বলেছে, তুমি যেন তাকে আর এসব না বলো। ওর এসব ভালো লাগেনা।”
“তুমি কি বললে?”
“আমি বলেছি, আমি তোমায় বুঝাব।”
“তোমার আমাকে বুঝানো লাগবে না। আমি যেমন, আমি তেমনই।”
আয়ান উঠে গেল ওখান থেকে। মীরা আর কিছুই বলতে পারল না। কে জানে আয়ানের মনে কি চলছে।

.
বিয়ে বাড়িতে লোকজনের সমালোচনার জন্য আজ চশমা পড়েনি দিবা। যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে তাকে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তার। ছাদের দোলনাতে বসে মাথায় মুভ দিচ্ছে। মন মেজাজ তার এমনিতেও ভালো নেই। অনেক আত্মিয় স্বজন চলে গেছেন। দিবার খালারা আর মামিরা রয়ে গেছেন শুধু। বাড়িতে লোকজন না থাকায় একটু শান্তি অনুভব করছে সে। চোখে চশমা লাগিয়ে এখন সে দোলনায় দুলছে।
তড়িৎ গতিতে দিবার পাশে এসে বসলো আয়ান। দিবা আয়ানকে দেখে লাফিয়ে উঠল দোলনা থেকে। আমতা আমতা করে বলল, “আ..আপনি!”
আয়ান এক গাল হেসে দিল। দিবার অস্থির লাগছে। আয়ান বলল, “বসো না। উঠে গেল কেন।”
“আপনি নিজেকে কি মনে করেন? আমি আপনার পাশে বসব? পাগল হয়ে যাচ্ছেন নাকি?”
“হ্যাঁ তো। পাগল তো হয়েছিই। সেটা তোমার প্রেমে।”
দিবা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। “প্লিজ এসব বন্ধ করুন। আমার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
“আমার আছে। আমি কোনো দিক দিয়ে খারাপ? আমাকে মেনে নিচ্ছ না কেন?”
“বললাম তো এসবে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তাও কেন আমাকে ডিস্টার্ব করছেন?”
“আমি তোমায় ডিস্টার্ব করছি?”
“হ্যাঁ।”
আয়ান দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দিবার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসলো। দিবা ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল। নিজের পিছন থেকে একমুঠো গোলাপ আর একটা টেডিবিয়ার দিবার সামনে ধরে বলল, “আমি তোমায় ভালোবাসি দিবা। প্লিজ অ্যাকসেপ্ট দিস।”
দিবার হাত পা কাঁপছে। এর জন্য নয় যে আয়ান ওকে প্রপোজ করেছে বলে। আয়ানের পিছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে দিবার আত্মা উড়ে গেল যেন। গলা শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে দিবার। পিছনের মানুষটি রণমুর্তি ধারন করে আছে। দিবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ভা..ভা…ভাইয়া!!”
ভাইয়া বলায় আয়ান পিছনে তাকালো। দেখলো মিরাজ দাঁতে দাঁত চেপে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান কিছুটা ভয় পেল। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। মিরাজ রেগে দিবার কাছে এসেই শক্ত করে দিবার হাত ধরলো। দিবা শুকনো ঢোক গিলল। এরপর দিবাকে টানতে টানতে আয়ানের সামনে থেকে নিয়ে গেল মিরাজ। দিবা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে মিরাজকে বলছে। “ভাইয়া আমার কথা শোনো প্লিজ। তুমি ভুল ভাবছ। প্লিজ হাত ছাড়ো আমার লাগছে। ভাইয়া।”
দিবা প্রায় কেঁদেই দিল। মিরাজ ছাদ থেকে দিবাকে নামিয়ে সোজা দিবার মা বাবার সামনে নিয়ে গিয়ে ছাড়লো। উপস্থিত সবাই হতবাক। তবে ওখানে শুধু মীরা আহান ও দিবার মা বাবা ছিল। মিরাজকে রাগান্বিত দেখে দিবার বাবা জিগ্যেস করলো। “কি হলো মিরাজ? ওকে এভাবে টেনে নিয়ে এলি কেন?”
“তোমার মেয়ে যা করে চলেছে, তাতে তোমাদের মান সম্মান আর রাখবে না।”
মীরা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “কি করেছে দিবা?”
“প্রেম করছে।”
দিবার বাবা বলল, “মিরাজ এসব কি বলছিস তুই। দিবা প্রেম করছে!”
“ভাইয়া তুই না জেনে উল্টো পালটা বকছিস।”
“আমি উল্টো পালটা বলছি? তাহলে জিগ্যেস কর দিবাকে। তোর দেবররের সাথে এতো রাতে ছাদে কি করছে ও?”
উপস্থিত সবার চক্ষু চড়কগাছ। দিবার বাবা কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে দিবাকে জিগ্যেস করলেন। “দিবা! মিরাজ যা বলছে তা সত্যি?”
দিবা ভয়ে ভয়ে বলে, “আব্বু, ভাইয়া আমাকে ভুল বুঝছে। আমি কিছু করিনি, বিশ্বাস করো।”
ঠাটিয়ে এক চড় বসালেন দিবার গালে। মীরা মুখে দুহাত দিয়ে তাকিয়ে আছে৷ আয়ানও এসে উপস্থিত হয় এই সময়। দিবাকে তার বাবা চড় দেওয়ায় বুকে গিয়ে লাগে তার।
“তুই আমাদের মান সম্মান ডোবালি?”
আয়ান এগিয়ে এসে বলে, “আংকেল! দিবার কোনো দোষ নেই। ও এসব কিছুই জানে না।”
আহান নিজের ভাইকে বলে, “আয়ান এসব কি? কি শুনছি আমি হ্যাঁ?”
“ভাইয়া, আমি দিবাকে পছন্দ করি। সেই সুবাদে আজ তাকে প্রপোজ করেছি। কিন্তু মিরাজ ভাইয়া দিবাকে ভুল বুঝে নিয়ে এসেছেন। দিবা এসব কিছুই জানতো না। প্লিজ কেউ ওকে কিছু বলবেন না।”
থমথমে পরিবেশ এখন। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে দিবা নিঃশব্দে কাঁদছে। মিরাজ সোজাসাপটা আয়ানকে জানালো। “দিবার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক হতে পারেনা। তুমি ওকে ভুলে যাও।”
আয়ান অসহায় কণ্ঠে বলল, “কেন ভাইয়া?”
“কারণ তুমি, তোমার পরিবার।”
“আমার পরিবার কি করেছে?”
“তোমার পরিবারের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।”
এবার মীরা রেগে গেল তার ভাইয়ের উপর। বলল, “বাহ্ ভাইয়া বাহ্! কি সুন্দর তোর বিবেক বুদ্ধি। কি সুন্দর তোর বিবেচনা। আমি ইম্প্রেস হলাম। আমার বলতে লজ্জা লাগছে তুই আমার ভাই!”
“মীরা!!”
“চুপ। আয়ানের পরিবারের ঠিক নেই? অথচ নিজের বোনকে তো তুই দিব্বি তার ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিস। তখন আহানের পরিবারের কথা মাথায় এলো না?”
“আমি আহানকে দেখে তোকে ওর হাতে তুলে দিয়েছি। পরিবার দেখে নয়।”
“তাহলে এখন কেন আয়ানের বেলায় ওর পরিবারকে টানছিস তুই?”
“আয়ানের মা আহানের উপর যা করেছে আমি কিভাবে সব ভুলে যাব। তারই তো ছেলে আয়ান। মা যেমন ছেলেও তো সেই স্বভাবেরই হবে তাইনা! দিবার এতো বড়ো সর্বনাশ আমি করতে পারব না।”
আয়ান থমকে গেল। তার মায়ের জন্য তার স্বভাব চরিত্র মিয়ে প্রশ্ন তুলছে মিরাজ? সে তো কখনোই তার ভাইকে হিংসা করেনি। তারপরও এতো দ্বিধায় মানুষ থাকে কি করে! আয়ান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “স্যরি মিরাজ ভাইয়া। আমি আর আপনাদের কারো সামনে আসব না। আর না দিবাকে নিয়ে কোনো কথা বলব। আপনি ঠিক-ই বলেছেন, মা যেমন ছেলেও তেমন স্বভাবের হবে। চলে যাচ্ছি আমি। ক্ষমা চাইছি আপনাদের কাছে, যদি আমার কারণে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে স্যরি।”
আয়ান চোখে পানি নিয়েই বেড়িয়ে পড়লো ওখান থেকে।
“আয়ান।”
“আয়ান।”
মীরা ও আহান একসাথে ডেকে উঠলো আয়ানকে। কিন্তু আয়ান শুনলো না। চলে গেল। আহান এবার মুখ খুললো। সে মিরাজকে বলে, “এতক্ষণ কিছু বলিনি তোকে। তোর মনে এমন ধারণা কেন জন্ম নিল যে আয়ান তার মায়ের মতো? আয়ান তার মার থেকে অনেক ভালো। তুই আয়ানকে চিনতে পারিসনি। আমার ভাইটা আজ তোর কারণে কষ্ট পেয়েছে। তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি মিরাজ।”
মীরা বলে, “আমি আয়ানকে কথা গিয়েছিলাম, দিবাকে ওর হাতে তুলে দিব। বাবা মাকে বলব যেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এখানে আসে। কিন্তু তুই এটা কি করলি ভাইয়া? আয়ানের মতো এতো ভালো ছেলেকে তুই কষ্ট দিলি? ওকে দেখে কি তোর এমন মনে হচ্ছে? তোর সাথে আমার আর কোনো কথা নেই ভাইয়া। আহান, গাড়ি দেখুন, আমরা এক্ষুনি বাসায় যাব।”
মীরা আর আহান দুজনেই প্রস্থান করে। মিরাজ জড়বস্তুর মতো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। দিবার বাবা মায় বুঝতে পারছেন না ওনারা কি করবেন! এদিকে দিবার বেশ খারাপ লাগলো। সে এমনটা কখনোই চায়নি। মিরাজ ভুল বুজে আয়ানকে কষ্ট দিল।

মীরা নিজের ও আহানের সব জিনিসপত্র নিয়ে লাগেজ এ ঢুকিয়ে নিল। আহান একটা সিএনজি ডেকে নিল। দিবার মা ও বাবা বার বার অনুরোধ করলেন যেন তারা থেকে যায়। কিন্তু মীরার জেদ। সে যাবেই যাবে। মীরার মা’কেও কড়া ভাষায় কথা বলেছে মীরা। ভাইয়ের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না এটাই সে বলে এসেছে। তারা দুজন কোনো কথা না শুনে চলে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here