তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ২৩ ||

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

খুব ভোঁরে আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় মীরার। বিছানা থেকে ঘুমুঘুমু চোখ নিয়ে উঠে বসে সে। বাহিরে এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারে একা বাহিরে যাওয়া যাবে না। মীরা আস্তে করে আহানকে ডেকে দেয়। আহান উঠে যায়। জিগ্যেস করে, “কি হয়েছে?”
“নামাজ পড়ব, অজু কোথায় করব একটু দেখিয়ে দিবেন?”
“অজু করতে তো কল পাড়ে যেতে হবে।”
“চলুন না আমার সাথে। আমার ভয় করে।”
“আচ্ছা চল। আমাকেও মসজিদে যেতে হবে।”
আহান নিজের ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা অন করে। বিছানা থেকে নেমে উঠে চলে যায় বাহিরে। পিছু পিছু যাত মীরা।
অজু করে এসে মীরাকে ঘরে পাঠিয়ে আহান মসজিদে চলে যায়। মীরা ঘরে নামাজ পড়তে থাকে।

.
সকাল আটটার দিকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে যায় মীরা। নামাজ পড়ে শুয়ে ছিল ও। কিন্তু বুঝতে পারেনি কখন ঘুমিয়ে গেছে। অনু মীরাকে ডাকতে আসলে ঘুম ভাঙে মীরার। পাশ ফিরে তাকাতে আহানকে চোখে পড়ল না তার। অনু মীরাকে চোখ ঘোরাতে দেখে মুচকি হেসে বলে, “ভাইয়াকে খুঁজছ?”
থমথমে গলায় বলে, “ক..কই। নাতো।”
“ভাইয়া রান্নাঘরে। পিঠা খাচ্ছে। আসো তুমিও খাবে।”
“কি পিঠা খাচ্ছেন?”
“চিতল পিঠা। পছন্দ তোমার?”
“মাংসের ঝোল দিয়ে খেতে ভালো লাগে।”
“আসো তাহলে। আম্মু মাংস রান্না করেছে।”
“এতো সকালে?”
“হ্যাঁ। আসো, আসো।”

.
গরম গরম চিতল পিঠার সাথে মাংসের ঝোল। একেবারে অমৃত যেন। মীরা পিঠা খাচ্ছে আর চাচির প্রশংসা করছে। সবাই খেয়ে উঠে যাওয়ার পর আয়ান মীরার কাছে এসে বসল। মীরা প্রথমে একটু চমকে উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। আয়ান মীরার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “কেমন ছিল কাল ভুতের আনাগোনা?”
মীরা প্রথমে কথায় ধ্যান দিল না। পরে আয়ানের কথা কানে বাজতেই চোখ থমকাল। তড়িৎ গতিতে চমকে উঠে আয়ানের দিকে তাকালো সে। মস্তিষ্ক শব্দ গঠন করছে। “তার মানে তুমি! তুমিই কাল আমায় ভয় দেখিয়েছিলে?”
আয়ান দাঁত বের করে হাসছে। মীরা রাগে কটমট করতে লাগল। আয়ান বলল, “তুমি তো দেখি ভালোই ভয় পাও। কিভাবে আমার ভাইকে জড়িয়ে ধরলে। ইশ! কি রোমান্টিক সিন ছিল।”
“লজ্জা করে না বড় ভায়ের ঘরে উঁকি দিতে? ”
“এটা কোনো উঁকি দেওয়া হলো? তাছাড়া তুমি খুব ভাগ্যবতী যে আমার ভাইকে পেয়েছ।”
“তুমি এতো অসভ্য কেন? তোমার ভাই তো ভদ্র। আর তুমি বদের হাড্ডি। ভাইকে দেখে শিখতে পারো তো।”
“আসলে কি বলতো। আমি না ভাইয়ের মতো এতো লাজুক নই। তবে একটা কথা কি জানো তো, আমার ভাই অনেক ভালো। কিন্তু ওকে ভালোবাসার মানুষের বড্ড অভাব। আমার মা ওকে ছেলে হিসেবে মানে না। আচ্ছা, তুমি কি পারবে আমার ভাই আর মায়ের মধ্যকার দূরত্ব মিটিয়ে দিতে? পারবে আমার ভাইকে ভালোবাসতে? তুমি ঠকবে না। আমার ভাইয়ের কোনো গার্লফ্রেন্ড বা মেয়ে বন্ধু ছিল না। আমার ভাই কথাও কম বলে। শুধু নিজের কাজ করে। তুমি কি পারবে?”
এক মুহুর্তের জন্য আয়ানকে অন্য মানুষ মনে হলো মীরার। ভাইয়ের জন্য কতটা উদার সে। নিজের ভাই না হলেও ভাইকে কতটা ভালোবাসে সেটা তার কথায় প্রকাশ পাচ্ছে। এই অসভ্য অভদ্র ছেলেটাও বুঝি নরম মনের হয়?
“আমি চেষ্টা করব।”
আয়ানের মুখে খুশির ঝিলিক। মীরার হাত ধরে বলে, “তুমি সত্যি বলছ? তুমি যদি এ কাজটা করো, তাহলে আই প্রমিস; আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করব না।”
মাথা নিচু করে বলল আয়ান। মীরা ফিক করে হেসে বলল, “কিন্তু আমি তোমায় ছাড়ব না। অনেক জ্বালিয়েছ।”
“ছোট ভাই হই না। জ্বালাতেই পারি।”
“আর কখনো উঁকি দিবে না। এটা ভালো নয়।”
আয়ান বলল, “তুমি কি আমায় এতটাও খারাপ ভাবো? আমি উঁকি দেইনি। শুধু তুমি ভয় পেয়েছিলে কিনা তা দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভাইকে জড়িয়ে ধরে দেখে এক দৌড়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এসেছি।”
“তুমি সত্যি বলছ?”
“তিন সত্যি, বিশ্বাস করো। আমার ওরকম মন নেই যে ভাইয়ের ঘরে উঁকি দিব। তোমার সাথে তো মজা করছিলাম।”
এটা বলেই আয়ান চলে গেল। মীরা বুঝলো আয়ান মিথ্যা বলছে না।


আরও একদিন গ্রামে থাকার পর মীরারা আজ চলে যাবে শহরে।
সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে তারা। দাদির কাছে আসতেই দাদি মীরার হাত ধরে হাসিমুখে বলে, “আল্লাহ যদি আমায় বাঁচায় রাখে, তাইলে যেন আমি খুব তাড়াতাড়ি আমার পুতির মুখ দেখতে পারি।”
মীরা দাদির কথা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। লজ্জায় আবার চোখ নামিয়ে ফেলে। আয়ান কথাটা শুনে ঠোঁট চেপে ধরে আহানকে চোখ মেরে দেয়। আহান রেগে আগুন। ও ঝাটার শলা খুঁজতে থাকে আয়ানের জন্য। আয়ান তা বুঝতে পেরেই দৌঁড় দেয়। আহান আয়ানের পিছনে ঝাটার শলা নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। এটা দেখে উপস্থিত সবাই হেসে কুটিকুটি। মীরা পুরো তাজ্জব বনে যায় আহানের কাণ্ড দেখে! অনু মীরাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। বলে, “তোমায় খুব মিস করব ভাবি। আবার এসো।”
মীরা মুচকি হেসে বলে, “কেঁদো না অনু। আমি আসব তো।”
আহানের চাচি মীরার জন্য তিনটা বোয়ামে জলপাই আচার, চালতার আচার ও কুলের আচার দিলেন। মীরা আচার দেখেই খুশি হয়ে গেল। চাচিকে সালাম করে বলল, “আপনি অনেক ভালো চাচি। খুব মনে পড়বে আপনার কথা।”
“আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো মা। ছেলে আমার বড্ড সাদা সিধে!”
“চিন্তা নেই চাচি। আমি আছি সবসময় ওনার পাশে।”
এরপর সবাইকে সালাম করে মীরা চলে গেল বাড়ির মেইন রাস্তার দিকে। সবাই চলে গিয়েছিল। শুধু সে সবার শেষে গেল। আহানদের গাড়িতে উঠে ওরা সবাই শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

.

রাতের দিকে আহানের ভিষণ জ্বর উঠে। বিছানায় শুয়ে কাঁপতে থাকে সে। জ্বরের ঘোরে কথাও বলতে পারছেনা। মীরা অপরপ্রান্তে মুখ করে বই পড়ছিল, সে জানতো না আহানের গায়ে জ্বর। আহান মীরাকে একবারও ডাকেনি। কোনো টু শব্দটিও করেনি। অন্যদিকে মুখ করে রাখায় আহানের ছটপটানি মীরার চোখে পরেনি। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মীরা বই পড়া বন্ধ করে দিল। বইটি এক পাশে রেখে মীরা আহানের দিকে তাকাল। আহানের চোখ বন্ধ। মাথাটা বালিশ থেকে একদম নিচে। কেমন যেন জড় হয়ে শুয়ে আছে আহান। মীরার খটকা লাগল, এমন তো হয়না কখনো। মীরা আহানের কাছে গিয়ে ওকে ডাকতে লাগল। “শুনছেন? এই যে! শুনুন না। উঠুন না। ঘুমালেন নাকি!”
মীরা আহানের মাথা ধরে বালিশের উপর উঠিয়ে দেয়। সাথে সাথেই সে চমকে যায়। আহানের গায়ে মারাত্মক জ্বর! এ জ্বর নিয়ে উনি কিভাবে বসে আছেন?
মীরা আহানকে আবার ডাকে, “শুনছেন। উঠুন না। আপনার গায়ে তো অনেক জ্বর।”
আহান আস্তে করে চোখ খুলে তাকায়। মিটিমিটি করে চোখের পলক ফালায় সে। মীরা উত্তেজিত হয়ে বলে, “আপনাকে তো এক্ষুণি জল পট্টি দিতে হবে। আপনি অপেক্ষা করুণ আমি নিয়ে আসছি।
আহান বাঁধা দিয়ে জ্বর কণ্ঠে বলে, “এতো ব্যস্ত হবে না। কিচ্ছু হয়নি আমার।”
“জ্বরে শরীর পুঁড়ে যাচ্ছে, আর আপনি বলছেন কিচ্ছু হয়নি। আমি আপনার কথা শুনব না।”
মীরা ধুরমুরিয়ে উঠে গেল। প্রথমে গেল রান্না ঘরে। একটা বোলে পানি নিয়ে সে রুমে এলো। তারপর একটা রুমাল খুঁজে বের করল। আহানের কাছে এসে আহানের মাথায় জল পট্টি দিতে লাগল৷ আহান জ্বরের ঘোরে মীরাকে আবোল তাবোল প্রশ্ন করতে লাগল। ঘাবড়ে যায় মীরা। আহান বকতে বকতে এক পর্যায়ে চুপ হয়ে যায়। মীরা জল পট্টি দেওয়া বন্ধ করে আহানের দিকে তাকায়। আহানের কোনো সাড়াশব্দ নেই। চোখ বন্ধ করে আছে। মীরা অনেকবার আহানকে ডাকলেও আহান কোনো জবাব দেয়না। মীরা ভিষণ ভয় পায়। আহান সেন্সলেস হয়ে গেছে। এখন কোথায় যাবে ও আহানকে নিয়ে? কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর এখনো কমেনি। চোখের কার্ণিশে পানি চলে আসে মীরার। ঠোঁট চেপে ধরে কাঁন্না আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে। একবার ভাবে আয়ানকে ডাকবে। কিন্তু ও যদি এখন বিরক্ত হয়! মীরা আবারও আহানকে ডাকতে থাকে। “ইনিস্পেক্টর সাহেব। প্লিজ উঠুন না, আমার খুব ভয় হচ্ছে আপনাকে নিয়ে। চোখ খুলুন না।”
মীরার চোখের পানি বাঁধা মানলো না আর। গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। অনেক ভেবে সে আয়ানের ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। বোল আর রুমালটি খাটের নিচে রেখে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দোতলায় চারটা ঘর। কিন্তু কোনটা আয়ানের ঘর সেটা আন্দাজ করতে পারছে না। সাহস নিয়ে একটা রুমের দরজায় কড়া নাড়ে সে। কয়েকবার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দেয়। চোখের সামনে আয়ানকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে মীরা। আয়ান ঘুমের চোখে মেজাজ দেখিয়ে বলে, “এতো রাতে কি চাই?”
“তোমার ভাইয়ার জ্বর। সেন্সলেস হয়ে গেছে। প্লিজ একটু আসবে?”
আহানের জ্বর শুনেই আয়ান আর স্থীর থাকে না। মীরাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে যায় আহানের কাছে। মীরাও আসে পিছু পিছু।
আয়ান আহানের কাছে বসে আহানকে ডাকতে থাকে। কোনো শব্দ নেই আহানের। জ্বর চেক করে দেখে অনেক। দ্রুত থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে আয়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। একশো সাত ডিগ্রি জ্বর উঠেছে আহানের। আয়ান মীরাকে তাড়া দিয়ে বলে, “ভাইয়াকে এক্ষুণি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। একশো সাত ডিগ্রি জ্বর শরীরে। কিভাবে সুস্থ থাকবে ও! তুমি যাবে আমার সাথে?”
“যাব। চলো।”
মীরা একটা মাস্ক পড়ে নেয়। আয়ান কিছু টাকা পয়সা নিয়ে নেয় নিজের সাথে। আহানের কাছে এসে আহানকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে পড়ে। তারপর মীরাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় আহানকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। মীরা ভয়ে আল্লাহর নাম জপ করছে৷ মনে মনে দোয়া করছে আল্লাহ যেন আহানকে সুস্থ করে দেয়। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে মেয়েটা। আয়ান দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here