তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ১৮ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

ঝলমলে রোদ্দুর। ভাদ্রের উত্তপ্ত গরম পড়েছে শহরজুড়ে। ঘামে টইটম্বুর অবস্থা সবার। পথের ধারে সাদা কাশফুল শরৎ এর আগমন জানান দিচ্ছে। দূর থেকে কাশবনের দিকে তাকালে মনে হয়, এক পালি মেঘ নেমে এসেছে আকাশ থেকে।
মীরাদের বাসায় সবাই গোল হয়ে বসে আছে। আহানের পরিবার ও মীরার পরিবার দুই পরিবারই উপস্থিত। আহানের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে লাল হয়ে আছে। আহান তার বাবাকে যখন বলে সে বিয়ে করতে পারবে না তার পছন্দ আছে, তখন তার বাবা রেগে তাকে থাপ্পড় মারেন। তবুও আহান একি কথা বলেই গেছে। আহানের বাবা ক্ষমা চাইলেন পাত্রী পক্ষের কাছে। তখন আহান তার বাবাকে মীরার সম্পর্কে বলে। তার বাবা রাগ করলেও আহান বলে, “বোঝার পর থেকে এই প্রথম তোমার কাছে কিছু চাচ্ছি, তাও তুমি দিবে না বাবা?”
আহানের মুখে বাবা ডাক শুনে আহানের বাবা গলে যান। উনি ছেলেকে কাছে টেনে কথা দেন যে উনি আহানের আবদারটা রাখবেন। একা গেলে খারাপ দেখা যায় তাই উনি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। মীরার পরিবারের সাথে কথা বলছেন ওনারা। মিরাজ সাথে সাথেই আছে। ওনারা বিয়ের প্রস্তাব দিলে মীরার বাবা মেয়ের দিকে তাকান। মীরা নিচু হয়ে আছে। মিরাজকে ইশারা দিলে মিরাজ বলে “হ্যাঁ করে দাও। ও কিছু বলবে না।”
মীরার বাবা তাও কিছুক্ষণ ভাবলেন। আহানদের জন্য খাবার রান্না করা হলো। সবাই খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ বসলো। তখন মীরার বাবা সম্মতি জানান। আহান ও মিরাজ খুব খুশি হয়। সেই সাথে মীরার পরিবারের সবাইও। আহানের বাবা খুশি হলেও আহানের সৎ মা মুখ বাঁকান। উনি ইচ্ছে করে এখানে আসেননি। আহানের বাবা জোর করে নিয়ে এসেছেন। আহানও তাকে এখানে সহ্য করতে পারছেনা। ওনারা ঠিক করেন অল্প আয়োজনে বিয়ে হবে। বিয়ে আগামী শুক্রবারেই হবে। হাতে মাত্র চারদিন আছে। এরিমধ্য এতো আয়োজন কিভাবে করবেন ভেবে পাচ্ছেননা মীরার বাবা। তখন মিরাজ বলে সব দায়িত্ব সে নিবে। আহানেরা আর কিছুক্ষণ থেকেই চলে যান। পরিবারের সবাই মীরাকে নিয়ে চিন্তায় আছে, অনেক ঝড় গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। এখন শুভ কিছু হলেই মঙ্গল।

_
বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। বোনের জন্য জানপ্রাণ খাটিয়ে কাজ করছে মিরাজ। দৌঁড়াদৌড়ি ছোটাছুটির মধ্যেই আছে। বিয়ের শপিং প্রায় শেষ। দেখতে দেখতে চারদিনও পেরিয়ে গেছে। আজ সেই মোহনীয় সন্ধ্যা। মীরাদের বাসাটা সুন্দর করে সাজানো হলো। লাল নীল মরিচবাতি দিয়ে বাহিরের অংশ সাজালো, আর ফুল দিয়ে সাজালো বাসার ভেতরটা। গ্রাম থেকে মীরার মামা, মামি, নানি ও কাজিনস এসেছে। তুর্যর বাবা মাকেও বলা হয়েছে। তবে ওনারা আসেননি। পার্লার থেকে দুজন মহিলা এসে মীরাকে সাজাচ্ছে। মীরার দু হাত ভর্তি মেহেদী। আর মধ্যখানে রয়েছে আহানের নাম। তুর্যর মা বাবা আসেননি বলে খুব মন খারাপ মীরার। তারা কি মীরার উপর রেগে আছেন? এদিকে এখনো বরপক্ষ আসেনি। বরপক্ষরা আসবেন মাত্র সাতজন। এভাবেই কথা হয়েছিল তাদের। আহানের বাবা বৌভাত পরে খুব ধুমধামে করবেন। এখন শুধু বিয়ে পড়িয়ে পুত্রবধূকে ঘরে নিয়ে যেতে চান।
লাল রঙা লেহেঙ্গা জড়ানো আছে মীরার গায়ে। ভারী গহনায় সজানো হয়েছে তাকে। পার্লারের লোকেরাও এতক্ষণে তাকে সাজিয়ে দিয়েছেন। মীরা নিজেকে আয়নায় দেখছে। বউ এর সাজে তাকে খুব সুন্দর লাগছে, এটাই দাবি করছে পার্লারের লোকেরা। মীরা চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে আছে। মীরার দুজন বান্ধবী এসেছে। দিবা আর ইরাও মীরার পাশাপাশি আছে। ওরা বিভিন্ন কথা বলে মীরাকে হাসানোর চেষ্টা করছে। তবে মীরার খুব একটা হাসি পেল না।

বর পক্ষরা এসে গেছে। দিবা ইরা ও মীরার বান্ধবীর ছুটে গেল বর দেখতে। হাতে তাদের ফল, মিষ্টি শরবত। আজ বোনের বর থেকে টাকা উশুল করেই ছাড়বে তারা। মীরা তার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। নিচে কর্ণপাত করতেই আহানকে দেখতে পেল। তাদের বাসার সামনে একটা গেইট সাজানো হয়েছে। ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ফিতা টাঙ্গানো আছে বিধায় ঢুকতে পারছেনা। দিবারা এগিয়ে গেল সে দিকে। শরবত এগিয়ে দিল। আহানের দুজন কাজিন বেশ দুষ্টমি করছিল দিবাদের সাথে। ইরা একটা প্লেটে কাগজের কিছু টুকরো দিল। ওরা সেগুলো ওঠাতেই দেখে টাকার অংক লেখা। ঢোক গিলে একে অপরের দিকে তাকাল তারা। শুরু হলো টাকা নিয়ে যুদ্ধ! মীরা ওদের কাণ্ড দেখে উপর থেকে হাসতে লাগলো। হাসার শব্দ পৌঁছাল আহানের কানে। সে উপরে তাকিয়ে মীরাকে বঁধু সাজে দেখলো। চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। আহানকে দেখেই মীরা চলে গেল রুমের ভেতরে। অবশেষে বিশ হাজার টাকা ক্যাশ দিয়ে আহানরা ঢুকল মীরাদের বাসায়।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকল। এখন বিয়ে পড়ানো হবে। মীরার মাথার উপর একটা লাল পাতলা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে দিল দিবা। ইরা এক হাত ও দিবা অন্যহাত ধরে মীরাকে উপর থেকে নিচে নামিয়ে আনলো। মুখোমুখি বাসানো হলো আহান ও মীরাকে। মাঝখানে টাঙানো হলো সাদা পর্দা। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। সবাই উৎসাহ নিয়ে বিয়ে দেখছে।

অবশেষে বিবাহ কার্য সম্পূর্ণ হলো। পর্দা উঠিয়ে দিল মাঝখান থেকে। মীরাকে নিয়ে বসানো হলো আহানের পাশে। একটা আয়না নিয়ে এসে আহানের সামনে ধরা হলো। মীরার এক বান্ধবী বলল, “কি দেখেন দুলাভাই?”
আহান লজ্জা পেল। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে তার। আয়নার কি দেখল তাতে কি আসে যায়। পাশের মানুষটাকে সারাজীবন চোখের সামনে দেখবে এটাই তো বড়ো প্রাপ্তি। তবুও সবার জোরাজোরিতে আহান মুখ ফুটে বলল, “এক শেহজাদীকে দেখি।”
চারদিকে হুল্লোড় পড়ে গেল।
আহানের কথা শুনে মীরা মাথা ঘুরিয়ে আহানের দিকে তাকাল। চোখ পড়ল চোখে। দুজনের চোখেই রইল মুগ্ধতা।
আজ থেকে দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। দুজনের জীবন একি সুত্রে গেঁথে গেল।

অনেক হৈচৈ, হাসি মজার পর এখন এলো বিদায় মুহুর্ত। সবার অস্রুসিক্ত নয়নে মীরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মীরা সবাইকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল৷ বাবা, মা, ভাই, ভাবি, দাদি, নানি, দিবা, ইরা সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল সে। সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে ভাই বোন দুজনেই। একমাত্র বোনকে বিদায় দিতে গিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে গেছে মিরাজ।
মিরাজ মীরার হাত আহানের হাতে উঠিয়ে দিয়ে বলল, “আমার প্রাণভোমরাকে তোর হাতে তুলে দিলাম। কষ্ট যেন না পায়। যত্ন নিবি।”
এরপর মীরাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিল মিরাজ। গাড়ি নিয়ে আহানরা আগে একটু দূর থেকে ঘুরে আসবে। তারপর বাসায় আসবে। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় একটা অসুবিধায় পড়ল। যেমন সুবিধা, তেমনি অসুবিধা।

মীরা অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আহানকে বলল, “এখানে একটু দাঁড়ান প্লিজ।”
মীরার কথা শুনে আহান গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থামার পর মীরা নেমে যায়। আহান পিছন থেকে বলে, “কোথায় যাচ্ছেন?”
আহানও নেমে যায়। মীরা একটা বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আহানও মীরার পিছনে এসে দাঁড়ায়। মীরা বাসার কলিংবেল চাপে। আহান ভালো করে পরখ করে দেখে এটা তুর্যদের বাসা। দরজা খুলে দেয় তুর্যর মা। মীরাকে কণে সাজে এখানে আসতে দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। ভেতরে তুর্যর বাবাও আছেন। মীরা সোজা ভেতরে ঢুকে যায়। মীরার মামি বলেন, “তুই এতো রাতে এখানে কি করছিস? বিয়ের কণে এতো রাতে এখানে সেখানে ঘুরলে ক্ষতি হয় মা। তুই বাসায় যা।”
মীরা বলল, “আমি কেমন স্বার্থপরের মতো বিয়ে করে নিয়েছি তা তুর্য ভাইকে বলতে এসেছি মামি।”
“পাগল হয়েছিস? এতো রাতে তুই কবরে যাবি? তাও আবার এই সাজে?”
“কোনো সমস্যা হবে না মামি।”
“খবরদার! আমি তোকে যেতে দিব না ওখানে।”
“কিছু হবে না দেখে নিও।”
মীরা বাহিরে চলে গেল। তুর্যর কবরের কাছে গেল। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “এটাই তো চেয়েছিলে না? দেখো, আমি কতো সুখে আছি। শুধু আমার সুখ দেখার জন্য তুমিই নেই। স্বার্থপরের মতো বিয়ে করে নিয়েছি বলে কষ্ট পেয়েছ? তুমিই তো একা রেখে চলে গিয়েছ, এবার তুমি খুশি তো?”
আহান পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। মীরার মামা মামিও আছেন। মীরা চোখ মুছে কবরের কাছ থেকে চলে আসে। মামা মামিকে সালাম করে। বলে, “এই স্বার্থপর মেয়েটাকে একটু দোয়ায় রেখো মামি মামা। তোমাদের দোয়া ছাড়া সে সফল হবে না।”
তুর্যর মা বললেন, “স্বার্থপর কেন বলছিস মা? তুই সুখে থাক এটাই তো আমরা চাই। তুর্যর কথা বেশি মনে পড়বে বলে তোর বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি। আমাদের ক্ষমা করিস মা”
“ছিঃ তোমরা কেন ক্ষমা চাইছ? ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিৎ।”
তুর্যর বাবা মীরার মাথায় হাত রেখে বলেন, “সুখী হও মা।”
আহান তুর্যর মা বাবাকে সালাম করে। তারপর মীরাকে নিয়ে চলে যায়।


আহানদের বাসার সামনে এসে থামে গাড়ি। মীরাকে নিয়ে আহান ভেতরে ঢুকে। আহানের সৎ মা মিষ্টি আর শরবত নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রথমে আহানকে খাওয়ান, তারপর মীরাকে। আহানের সহ্য না হলেও চুপ করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সহ্য করে নেয়।
মীরাকে নিয়ে আহান তার রুমে চলে যায়। আহানের রুমটা সাজানো হয়েছে জমজমাট করে। চারদিকে গোলাপ আর বেলির সুভাষ ছড়াচ্ছে। আহান মীরাকে বলে, “আপনি এই ভারী লেহেঙ্গা আর গহনাগুলো ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। কতক্ষণ আর এগুলো গায়ে রাখবেন? সুতি শাড়ি থাকলে পড়ে নিন। আমি আসছি, আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি।”
আহান চলে গেল। মীরা গহনাগুলো খুলে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here