তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ১৭ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

প্রায় এক মাস কেটে গেল। মীরার পরিক্ষাও শেষ হলো। এরিমধ্যে মীরার বাসায় পাঁচখানা বিয়ের প্রস্তাব আসে। সবাই খুব ভালো ফ্যামিলির। কিন্তু মীরার বাবা রাজি হননি। উনি আগে মেয়ের মতামত জানতে চান, তারপর মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিবেন। কারণ, কিছুদিন আগে মীরার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। মীরাকে প্রশ্ন করার পর সে এড়িয়ে গেছে। মেয়ের যে মত নেই তা তিনি ভালো করেই বুঝে গেছেন। এতো তাড়াতাড়ি সব ভোলা সম্ভব না। এই এক মাসের মধ্যে তুর্যর বাসায় দুইবার যাওয়া হয়েছে মীরার। মামা আর মামিকে দেখে চলে এসেছে। কিছুক্ষণ সময় তুর্যর রুমে কাটিয়েছে।

আজ মিরাজ মীরাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে। বোনের মন ভালো নেই, তাই ভাই তাকে কাশবনে নিয়ে এসেছে। ভাইয়ের মুখে কাশবনের কথা শুনে মীরার যেন খুশির সীমা থাকে না। সে তার আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে পরে ভাইয়ের সাথে চলে আসে কাশবনে। সারি সারি কাশফুল দেখে মীরা ছুটে যায় তাদের মাঝে৷ চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতে থাকে এই সুন্দর প্রকৃতি। মীরার ভাই বিভিন্ন পোজে তাকে দাঁড়াতে বলে। মীরাও তাই করে। ফটাফট অনেক ছবি তুলে দেয় মিরাজ। মীরা খুব খুশি হয়৷ এতদিন চাতক পাখির মতো ঘরবন্দী হয়ে থেকেছিল মীরা। এখন উড়নচণ্ডীর মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হাসছে। ব্যাস! একটা ভাইয়ের কাছে এর থেকে সুন্দর মুহুর্তে আর কি হতে পারে? মীরা দুটো কাশফুল হাতে নিয়ে ভাইয়ের পাশাপাশি হাটে। মিরাজ তখন মীরাকে জিগ্যেস করে, “আহানকে তোর কেমন লাগে মীরা?”
হঠাৎ ভাইয়ের এই প্রশ্নে থমকে যায় মীরা। কি বলা উচিৎ তার ভেবে পাচ্ছেনা সে। মিরাজ আবারও জিগ্যেস করে, “কি হলো? বল কেমন লাগে?”
মীরা এনিয়ে বিনিয়ে বলল, “কেমন লাগবে, তোর বন্ধু। ভালো ছেলে।”
“শুনলাম তুই নাকি আহানের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলিস?”
হকচকিয়ে উঠে মীরা! তার ভাই এসব কোত্থেকে জানলো। কম্পিত গলায় বলে, “কি বলছিস তুই এসব!”
“তুর্যর কাছ থেকে শুনেছিলাম।”
মীরা তাড়া দিয়ে বলে,
“আমি বাসায় যাব ভাইয়া।”
“এতো তাড়াতাড়ি?”
“ভালো লাগছেনা।”
“ভালো লাগছেনা, নাকি আমি আহানের কথা জিগ্যেস করায় এড়িয়ে যাচ্ছিস।”
“তুই কি বলতে চাস ভাইয়া?”
মিরাজ পা থামাল। সাথে মীরাও তাল মেলাল। মিরাজ মীরার দিকে ফিরে বলল, “আমি চাই তুই আহানকে বিয়ে কর।”
মীরা আশ্চর্য হয় খুবই। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় নিমিষেই। ভেতরে অস্থিরতা কাজ করে৷ মীরার শরীর কাঁপতে থাকে ক্রমশ। মীরা বলে, “প্লিজ ভাইয়া, বাসায় যাব। নিয়ে চল আমায়।”
মীরার অবস্থা এমন দেখে মিরাজ ভয় পেল। হঠাৎ কি হলো মীরার? মীরাকে ধরে মিরাজ একটা সিএনজি ডেকে নেয়। মীরাকে সিএনজিতে উঠিয়ে বাসায় চলে যায় মিরাজ।

_
বিকেল গড়িয়েছে। আছরের আজান দিচ্ছে মসজিদে মসজিদে। দুপুরে খাওয়ার পর মীরা একটু ঘুমিয়েছিল। মাত্র উঠল। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে হাত মুখ ধুয়ে অজু করে নিল। নামাজ আদায় করে নিচে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। মাথাটা কেমন যেন ধরে আছে তার। সোফায় বসে মা’কে বলল রঙ চা বানিয়ে দিতে। তার মা স্নিগ্ধাকে বললেন মীরাকে যেন রঙ চা বানিয়ে দেয়। তিনি নামাজ পড়তে গেলেন। স্নিগ্ধা চা বানালো। দু কাপ চা নিয়ে মীরার কাছে এলো। মীরাকে এক কাপ দিয়ে অন্য কাপ চা নিয়ে মীরার পাশে বসলো। মীরা চায়ে একটু চুমুক দিয়ে তার ভাবির উদ্দেশ্যে বলল, “তুমি এখন চুলোর কাছে যেও না। এখন একটু সাবধানে থেকো।”
মীরার ভাবি মুখ গোমড়া করে বলল, “তোমরা সবাই আমাকে কি পেয়েছ বলতো? আমাকে মা কাজই করতে দেয়না। এভাবে বসে থাকতেও আমার ভালো লাগে না। সামনেই আমার ফাইনাল পরিক্ষা। এখানেও তোমার ভাইয়ের কড়া নিষেধ একা যেন না যাই। কোথায় যাব?”
“তোমার ভালোর জন্যই সবাই বলছে। আমাদের পুচকুটা আগে আসুক। তারপর তোমার যা মন চায় করো। কেউ বাঁধা দিবে না।”
“আমার পরিক্ষাটা দেওয়া জরুরী।”
“তা বেশ তো, ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যাবে। এতো ভয় পাচ্ছ কেন? মন দিয়ে পড়বে।”
“একটা কথা বলব মীরা।”
“হ্যাঁ বলো।”
“তোমার পছন্দের কেউ আছে?”
মীরা থমথমে গলায় বলল, “কি বলছ ভাবি এসব। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“না, এমনি।”
“আমি যাই ভাবি। ভালো লাগছেনা।”
মীরা চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়াল। এমন সময় দরজার তার ভাইকে দেখল। তার ভাইয়ের হাতে একটা কার্ড। ভাইয়ের মুখটা মলিন হয়ে আছে। মিরাজ এগিয়ে আসলো মীরার দিকে। মীরার হাতে কার্ডটা দিল। মীরা দেখলো এটা বিয়ের কার্ড। মীরা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করল, “কার বিয়ের কার্ড এটা ভাইয়া?”
“আহানের।”
আহানের বিয়ের কথা শুনেই মীরা পিলে চমকে উঠে। আপনা আপনি হাত থেকে কার্ডটা পরে যায় ফ্লোরে। নির্বাক হয়ে ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে সে। মিরাজ বলে, “অবাক হচ্ছিস না? আমিও অবাক হয়েছিলাম, যখন ও আমাকে এটা ধরিয়ে দিয়ে বলল ওর বিয়ে। আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারিনি। আহান বলল ওর বাবা অনেকদিন ধরেই বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল, কিন্তু ও এড়িয়ে গেছে। পরে বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছে।”
মীরা ছোট করে বলল, “অহ্।”
মীরা ওখানে আর এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে থাকল না। নিজের রুমে চলে গেল। সোজা দরজা বন্ধ করে দিল। স্নিগ্ধা মিরাজকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “কি হয়েছে বলো তো।?”
“জানি না। হোক যা হাওয়ার। আমি আর এসবের মাঝে নেই।”
এই বলে মিরাজও চলে গেল ওখান থেকে।

_
রাতের দিকে সবাই যখন খাবার টেবিলে, তখন মীরার বাবা বলেন মীরার জন্য আরও একটা প্রস্তাব এসেছে। মীরার বাবা কিছু বলার আগেই মীরা বলে, “তাদের হ্যাঁ বলে দাও বাবা। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
মীরা উঠে চলে গেল ওখান থেকে। সবাই অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মীরার বাবা বলেন, “মীরার কি কিছু হয়েছে মিরাজ?”
“তোমার মেয়ের মাথার ঠিক নেই। বাদ দাও এসব।”
“কি হয়েছে সেটা তো বলবি।”
“এখন এসব বলে লাভ নেই। অনেক কিছুই ঘটে গেছে।”
“মীরার সাথে কথা বলে সব ঠিক কর। কি জন্য মেয়েটার মন খারাপ দেখ।”
“হুম।”

মীরা তার রুমে বসে আছে। মিরাজ গিয়ে মীরার পাশে বসল। বলল, “হঠাৎ বিয়ের জন্য এতো উঠে পড়ে লেগেছিস কেন?”
“চোখের কাটা হয়ে গেছি সবার। দূরে গেলিই শান্তি।”
“এসব কি কথা মীরা? তুই আবার কার চোখের কাটা হয়ে গেলি?”
“কারো না।”
“আহানের বিয়ের কথা শুনে মন খারাপ?”
“সে আমার কে হয় যে তার বিয়ে বলে আমার মন খারাপ হবে?”
“আমি জানি তুই আহানকে পছন্দ করিস।”
“তাতে কি ভাইয়া?”
“স্বীকার করছিস তাহলে আহানকে তুই পছন্দ করিস?”
“পছন্দ শুধু এক তরফা হলে হয়না। বিপরীত মানুষটারও সম্মতি প্রয়োজন।”
“আহানের সাথে কথা বলব?”
“আমি আর অশান্তি চাইনা ভাইয়া। যা হচ্ছে হোক।”
“কিন্তু আমি আমার বোনকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারব না।”
“তুর্য ভাইও কষ্ট পেয়েছে। আমি নিজের সাথে লড়াই করতে করতে হাফিয়ে গেছি ভাইয়া।”
মিরাজ রেগে আহানকে কল দিল। মীরা কাঁদছে। মিরাজ ধমকের সূরে আহানকে বলল, “আমার বোনকে কষ্ট দিয়ে তুই খুব সুখেই আছিস তাইনা?”
“মানে! মিরাজ কি হয়েছে?”
“আমার বোন যে তোকে পছন্দ করে তা তুই জানিস?”
আহান চুপ করে রইলো। মিরাজ আরও জোরে ধমক দিয়ে বলল, “বলবি তুই?”
“হ্যাঁ জানি।”
“তুই পছন্দ করিস না আমার বোনকে?”
“জানি না।”
“কথা ঘোরাবি না আহান।”
“হ্যাঁ করি।”
“তাহলে কেন বলিসনি আমায়। কেন অন্যজনকে বিয়ে করছিস?”
“কিভাবে তোকে বলতাম বল? যদি বলি তোর বোনকে আমি পছন্দ করি, আর তুই যদি রেগে যাস। আমাদের বন্ধুত্ব যদি শেষ হয়ে যায়? সে ভয়ে বলিনি। তাছাড়া তুর্য ভাই মীরাকে ভালোবাসে। আমি কিভাবে তাদের মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াই বল?”
“প্রকাশ তো করতে পারতিস অন্তত। তাহলে আমার বোনটা এতো কষ্ট পেতো না। তোর বিয়ের কথা শুনে নাওয়া খাওয়াই ভুলে গেছে। কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। আমিও দেখি তুই আমার বোনকে কাঁদিয়ে কিভাবে বিয়ে করিস।”
মিরাজ টুক করে কলটা কেটে দিল। মীরা কেঁদে কেঁদে বলল, “কেন বললি ভাইয়া এসব? কেন অশান্তি বাড়াচ্ছিস? প্লিজ থাম। আমি আর পারছিনা। তুর্য ভাই কেন চলে গেল বলতো। তাহলে আর এদিন দেখতে হতো না।”
“চুপ! বেশ করেছি যা করেছি। এবার দেখ তুই ও কিভাবে ছুটতে ছুটতে আসে।”

আহানের বাসা থেকে মিরাজদের বাসার ব্যবধান মাত্র পাঁচ মিনিট। আহান যেন দৌঁড়ের উপর দিয়ে এলো। মীরাজের বাসায় ঢুকতেই মুখোমুখি হয় মীরার মায়ের সাথে। মীরার মা হেসে আহানের সাথে কথা বলেন। আহান জিগ্যেস করে মিরাজ কোথায়। মীরার মা মীরার রুম দেখিয়ে বলল উপরে আছে। আহান দেরি না করে ছুটে গেল সেখানে। দরজায় নক করল। দরজা খুলে দিল মিরাজ। আহানকে দেখে বলল, “কেন এসেছিস? সব তো শেষ করেই দিয়েছিস। তাহলে কেন এলি?”
মিরাজের কথার পাত্তা না দিয়ে আহান ভেতরে ঢুকে গেল। আহান দেখল মীরা নিঃশব্দে কাঁদছে। মিরাজ দরজা বন্ধ করে আবারও জিগ্যেস করল, “আমি তোকে বলছি। কেন এলি তুই?”
আহান এবারও জবাব দিল না। হাটু গেড়ে মীরার সামনে বসে পড়ল। অপরাধী কণ্ঠে বলল, “আ’ম স্যরি মিস। আমি জানতাম না আপনি আমায় এতটা পছন্দ করেন। আমিও আপনাকে পছন্দ করি। কিন্তু বলতে পারিনি কারণ, মিরাজের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে। আমার সুখ দুঃখ ভাগ করার মতো ওই একজনই তো আছে। তার সাথেই যদি আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে আমি কিভাবে থাকব বলুন? ক্ষমা করবেন আমায়। আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। দিনের পর দিন আপনাকে ইগনোর করেছি। কখনো আপনার মনের অবস্থা বুঝিনি। কিন্তু কি করব বলুন, আমার কিছু করার ছিল না যে। কিন্তু আমি এখন সব শুধরে নিব।”
“কিভাবে শুধরাবি তুই?”
মিরাজের কথায় পিছন ফিরলো আহান। বলল, “বিয়েটা ভেঙে দিব।”
মোরা ফোস করে রেগে উঠে বলল, “বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয় মিস্টার যে বললাম আর ভেঙে দিলাম। একটা মেয়ের জীবন আপনি এভাবে নষ্ট করতে পারেন না।”
“আমি কারো জীবন নষ্ট করছিনা। বরং তাকে বাঁচাচ্ছি। এমনিতেও আমাকে বিয়ে করলে সে কখনোই সুখি হতো না। তারচেয়ে এটাই ভালো। আমায় আর কিছু বোঝাতে আসবেন না আপনি মিস।”
আহান চলে গেল ওখান থেকে। মিরাজ একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। বোনের পাশে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here