তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব – ১৫ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৫ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

বাসায় মানুষের সমাগম। ভোঁর হতেই দূর দুরান্ত থেকে মানুষ আসতে শুরু করল তুর্যদের বাসায়। তুর্যর মা তুর্যর লাশের পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদছেন। কিছু মহিলা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যেই তুর্যর দাদার বাড়ি থেকে সবাই এসে পৌঁছেছেন। সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। দিবা আর ইরাও কাঁদছে। বাড়িটা এখন কাঁন্নার শব্দে ভেসে গেছে। চারদিকে আর্তনাদ। মীরার এখনো এসে পৌঁছায়নি। তবে মীরার মা, বাবা, ভাবি ও দাদি এসেছেন। মীরাকে নিয়ে মিরাজ একটু পরেই আসবে। মীরা আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে। অথচ ডক্টর তাকে তিনদিনের বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন। কোনো রকম চিন্তা, মানসিক চাপ নিতে বারণ করেছেন।

সকাল দশটা বেজে দু মিনিট। মীরাকে নিয়ে মিরাজ এসেছে তুর্যদের বাসায়। ইতিমধ্যেই কোরআন তেলোয়াত শুরু করেছেন ইমামরা। মীরা তুর্যর লাশের পাশে চুপচাপ বসে আছে। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তুর্যর মুখের দিকে। মীরার ভেতরে কি হচ্ছে একমাত্র সে-ই জানে। মীরা তুর্যর লাশকে বলল, “কেন এমন করলে তুর্য ভাই? কেন চলে গেলে? কেন আমায় ধোকা দিলে তুমি? বলো। কেন চলে গেলে?”
দিবা আর ইরা এসে মীরাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মীরা কিছুতেই যেতে চায়না।
“ছাড় আমাকে, আমি এখানেই থাকব। তুর্য ভাইয়ের সাথে আমার অনেক বোঝাপড়া আছে। তাকে জবাব দিতেই হবে, সে কেন চলে গেল।”
তখন দিবা বলল, “পাগলামি করিস না মীরা। এখানে সবাই আছে, তুই চল আমার সাথে।”
“আমি যাব না বললাম না!”
এক প্রকার জোরেই বলল কথাটি মীরা। সবাই মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরার সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। মীরা বলল, “তুমি কি ভাবছ তুর্য ভাই? এভাবে চলে গিয়ে তুমি জিতে যাবে? কখনো না৷ আমি তোমায় জিততে দিব না। উঠো বলছি, উঠো।”
মীরার কথাগুলোর মাঝে ওখানে আহান এসে উপস্থিত। আহান মীরার এ অবস্থা দেখে মিরাজের দিকে তাকাল। মিরাজ ইশারা দিয়ে বলল কেউ ওকে থামাতে পারছেনা। আহানের নিজেরও ধারণা নেই সে কি করবে।

ঠিক বারোটা বাজে তুর্যকে কবর দেওয়া হলো। কবরটা তুর্যদের বাসায় পাশেই। তুর্যর বাবা বাসার পাশে জায়গা রেখেছেন তাদের পারিবারিক কবরস্থানের জন্য। সেখানেই তুর্যকে দাফন করা হলো। এখন ঠিক রাত নয়টা। মীরা তুর্যর রুমে বসে আছে। দিবা ও ইরা ঠিক মীরার পাশ ঘেঁষেই বসেছে। মিরাজ মীরার জন্য হাতে করে খাবার নিয়ে আসে। মীরা চুপ করে বসে আছে কোনো কথা বলছে না। মিরাজ মীরার পাশে বসে। খাবারের প্লেটটা মীরার সামনে ধরে বলে, “আয়, খেয়ে নিবি।”
মীরা ছোট করে জবাব দেয়, “খাব না ভাইয়া।”
“তোর শরীর ভালো নেই। খেয়ে ঔষধ খেতে হবে। নাহলে শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হবে। আয় আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
“খাব না বললাম তো। আমার কিছু হবে না।”
“বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মীরা। হা কর বলছি।”
“খাব না।”
এ কথা বলেই মিরাজের হাত থেকে খাবার প্লেটটা ফেলে দেয় মীরা। দূর্ভাগ্যবশত গরম ভাতের প্লেটটা সোজা গিয়ে আহানের গায়ের উপর পড়ে। আহানের পুরো শরীরে ভাত আর সবজির মাখামাখি। মীরা দেখে হতভম্ব। সে তো এটা চায়নি। মিরাজ দৌড়ে গিয়ে আহানের গা ঝেড়ে সব পরিষ্কার করে দেয়৷ মীরার এই কাজের জন্য মিরাজ আহানের কাছে ক্ষমা চায়। মীরা চোখে পানি নিয়ে ওখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। মীরার এমন কাজে আহান ও মিরাজ দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলার আগেই আহানও দৌড়ে বেরিয়ে যায় মীরার পিছু পিছু। মীরা একটা রুমে ঢুকে পড়ে। ওখানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। মীরার কাঁন্নার আওয়াজ পেয়ে আহান ওখানে পৌঁছায়। মীরাকে কাঁদতে দেখে সে পিছন থেকে বলে, “মিস!”
মীরা চমকে উঠে। আহান এখানে কিভাবে আসলো? মীরা নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। আহানের দিকে ফিরে তাকায়না। ওভাবেই থাকে। আহান বলে, “যা হয়ে গেছে তার জন্য আমি বা আপনি কেউই দ্বায়ী নই। কিন্তু এভাবে নিজের ক্ষতি আপনি কেন করছেন? আপনি দেখেছেন আপনার পরিবারের অবস্থা? তারা আপনাকে নিয়ে কতটা চিন্তা করে? আপনি খাননি বলে তারা কতটা ছটপট করছে জানেন? আপনি একটা ঘোরের মধ্যে আছেন, তাই আপনার পরিবারের মানুষগুলোর কষ্ট আপনি দেখছেন না। আপনি কি চান তারা কষ্ট পাক? আপনাকে নিয়ে তাদের কি পরিমাণ টেনশন আপনি জানেন? তবুও আপনি আপনার জেদ নিয়েই পরে আছেন। তাদের বিষয়েও ভাবুন। এই যে আপনার ভাই, আপনি জানেন সে কতটা ডেস্পারেট আপনাকে নিয়ে? আপনি এগুলো দেখেন? ঘোর থেকে বের হোন। আমরা কেউই চাইনি তুর্য এভাবে চলে যাক। কিন্তু নিয়তির কাছে হার মানতেই হলো।”
মীরা এতক্ষণ আহানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। মনে মনে আওড়াচ্ছে আহানের সব কথা। ও কি সত্যিই তার পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছে? মীরা অনেক ভাবলো। সে তার পরিবারকে কষ্ট দিবে না। সোজা আহানের সামনে দিয়ে হেটে বাহিরে চলে গেল মীরা। মিরাজ নতুন করে আরও এক প্লেট খাবার নিয়ে আসে। বোনকে তো খাওয়াতে হবে। মীরা তার ভাইয়ের কাছে এলো। কিছু না বলে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। মিরাজ স্তব্ধ হয়ে গেল৷ একটু আগে জেদ দেখালো, আর এখন তাকে জড়িয়ে ধরেছে!
“আ’ম স্যরি ভাইয়া। আমি তোদের কষ্ট দিতে চাইনি।”
মিরাজ মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আরে, কি হয়েছে। কাঁদিস না। দেখি আয়, আমি তোকে খাইয়ে দেই।”
মীরাকে নিয়ে মিরাজ সোফায় বসালো। মীরার মুখের সামনে খাবার ধরলো। তার ইচ্ছে নেই, তবুও ভাইয়ের মুখের হাসির জন্য হা করলো। মিরাজ মীরাকে খাইয়ে দিতে লাগল। খাওয়া শেষ করে ঔষধ নিয়ে আসে মীরার জন্য। নিজের হাতে বোনকে ঔষধ খাইয়ে দেয়। মীরাকে নিয়ে মিরাজের অনেক চিন্তা। ভাই বোনের মাঝে তখন আহান চলে আসে। সে এসে মিরাজের পাশে বসে। মীরা আহানকে লক্ষ্য করেনি। মীরা তার ভাইকে বলে, “আমি তোদের কষ্ট দিতে চাইনা ভাইয়া। আমি চাইনা আমার জন্য কেউ কষ্ট পাক। কিন্তু দেখ, দিন শেষে সবার কষ্টের কারণ আমিই হচ্ছি। তুর্য ভাইকেও আমি কষ্ট দিয়েছি। সে হয়তো আমাকে কখনোই ক্ষমা করবে না। আমি এমন কেন ভাইয়া? কেন সবার ভালোবাসার মূল্য আমি দিতে পারিনা?”
মিরাজ শান্ত হয়ে জবাব দিল। “তোর জন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছেনা। তোর অবস্থা দেখে সবার খারাপ লাগছে। নিজেকে এভাবে দোষারোপ করিস না। আর রইলো তুর্যর কথা! যে তোর ভাগ্যে থাকবে, তাকে তুই অবশ্যই তোর জীবনে পাবি। কিন্তু তুর্য তোর ভাগ্যে ছিল না। তাই তুর্যর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক হয়নি। এখানে তুর্যকে কষ্ট দেওয়ার কি হলো? আমি যতদূর জানি তুই তুর্যকে সবটা জানিয়েছিস। তাই তোর কোনো দোষ নেই।”
“আমি এখন কি করব ভাইয়া?”
“তুর্যর জন্য দো’য়া কর। আমরা কেউই তুর্যকে ভুলে থাকতে পারব না। কারণ তুর্য আমাদের চোখের মণি ছিল। আর তোর ভালো বন্ধু।”
মীরা এইবার আহানকে লক্ষ্য করল। আহানকে দেখেই সে উঠে গেল। ভাইকে বলল, “আমি তুর্য ভাইয়ের রুমে যাচ্ছি ভাইয়া। রাতে ওখানেই ঘুমাব।”
মিরাজ বাধা দিয়ে বলে, “তুই আজ ওখানে ঘুমাবি না মীরা।”
মীরা ভ্রু কুচকে বলল, “কেন?”
“আমি বারণ করেছি তাই। তুই আজ তোর ভাবির সাথে ঘুমাবি। ওই রুমে আজ আমি আর আহান থাকব।”
“কিন্তু ভাইয়া আমি ওখানে থাকতে চাই।”
“আমি বারণ করেছি না?”
ধমকের সুরে বলল মিরাজ। মীরা আর কিছু বলল না। ওখান থেকে চলে গেল। মীরা যাওয়ার পর আহান মিরাজকে জিগ্যেস করল, “তুর্যর রুমে থাকলে কি প্রব্লেম?”
মিরাজ একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। বলল, “মীরা ওখানে থাকলে বারবার তুর্যর কথা মনে পড়বে। না ঘুমিয়ে তুর্যর ব্যবহার করা জিনিসগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে। হয়তো মীরাকে নিয়ে লেখা কোনো বিশেষ ডায়েরিও পেয়ে যাবে। তখন সেসব পড়ে তুর্যর কথা ভেবে খুব কাঁদবে। আমি আমার বোনের কান্না আর সহ্য করতে পারব না। তাই ওকে বারণ করেছি।”
“অহ্।”
“তুই মীরাকে কিছু বলেছিস? যার জন্য ও আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়?”
“তেমন কিছুই বলিনি।”
“যা-ই বলিস। তোর জন্য আজ ও খেয়েছে। নাহলে ওর জেদের কাছে হেরে যেতাম। বোন আমার খুব জেদি। ধন্যবাদ তোকে।”
“আমি তাহলে যাই।”
“কোথায় যাবি?”
“বাসায়।”
“তোর কানে কথা যায়নি? আজ আমি আর তুই তুর্যর ঘরে থাকব।”
“ওনার ঘরে আবার আমি কেন?”
“থাকবি, দরকার আছে।”
“কিন্তু বাসায়…”
“একদিন বাসায় না গেলে কি হয়? তুই কি ডাকাতি করছিস?”
“নাহ। আসলে বাবা জানেন না।”
“ছেলে বড়ো হয়েছে, তার ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই? স্বাধীনতা নেই?”
“আচ্ছা থাকব। এতো কথা বলিস কেন?”
“আয় তুই।”
আহান মিরাজের সাথে তুর্যর রুমে চলে গেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here