তোমার_আমার_চিরকাল🌸 || পর্ব ২৮ || #লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব ২৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

খুব ভোঁরে মীরা ঘুম থেকে উঠে গেল। চারদিকের মসজিদ থেকে তিলোয়াত শোনা যাচ্ছে। আজ একটা বিশেষ দিন। মীরা উঠে আগে আহানকে ডেকে দিল। আহান ঘুমের ঘোরে মীরার হাত টেনে ধরল। মীরা নিজেকে সামলাতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে আহানের উপর পড়ে গেল। নিজের বুকের উপর ভারি কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে আহান চোখ খুলে তাকাল। মীরাকে নিজের এতো কাছে দেখে সে থমকে গেল। দু’জোড়া চোখ এক ধ্যানে একে অপরের দিকে স্থির হয়ে আছে। আহান মীরার গালে তার একটি হাত ছোঁয়াল। মীরা শিউরে উঠল। আহানের চোখে মুগ্ধতা আর মীরার চোখে অস্থিরতা। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে দুজনেই ঘোর থেকে বের হলো। মীরা তাড়াতাড়ি আহানের উপর থেকে উঠে গেল। চুলগুলো হাত খোঁপা করে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দেখল আয়ান দাঁত বের করে হাসছে। মীরা জিগ্যেস করে, “তুমি এতো ভোঁরে? কিছু বলবে?”
“ভাই কি ঘুমে? মসজিদে যাবে না?”
“যাবে বোধয়। ডেকে দিব?”
“হ্যাঁ, ভাইয়ের সাথে যাব। আজ ইদ না! ভাইয়ের সাথে থাকব।”
“তোমরা কি প্রতিবছর ইদ করো?”
“হ্যাঁ। কেন, তোমরা করো না?”
“করি, তবে কিছু কারণে দু বছর করতে পারিনি।”
“জানো, আজ দু দুটো গরু জবাই দেবে। আমরা প্রতিবছর দুটো গরু জবাই দেই। একটা গরিবদের জন্য। অন্যটা আমাদের পাড়া প্রতিবেশী, আত্মিয় ও আমাদের জন্য।”
“ভালো।”
আহান দরজার সামনে এসে বলে, “কি এতো বকবক করছিস তোরা!”
“আরে ভাই। তেমন কিছু না। চল মসজিদে যাই।”
“আমি রেড়ি। চল।”
মীরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আয়ান ও আহান মসজিদে চলে যায়। মীরা নিজেও অজু করে নামাজ পড়ে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ কোরআন তিলোয়াত করে। বিছানার চাদর পালটে নতুন চাদর বিছিয়ে ঝাড়ু দিয়ে দেয়। রুমের সব জিনিসপত্র একটা কাপড় দিয়ে মুছে গুছিয়ে রাখে। আয়ান ও আহান মসজিদ থেকে এসে নিচে গল্প করছে তাদের বাবার সাথে। মীরা নিচে এসে দেখে তারা সবাই বসে আছে। মীরা উঁকি মেরে দেখলো রান্নাঘরে কেউ নেই। মীরা আস্তে করে পা বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ভাবছে সে আজ সবার জন্য চা করবে। কোমরে শাড়ির আঁচল গুজে চা বানানোর কাজে লেগে পড়লো সে। আহানের সৎ মা’র আজ দেখা নেই। মীরা বেশ অবাকই হয়েছে। বাসায় এতো হৈ হুল্লোড়, অথচ ওনার সাড়া শব্দই নেই। মীরা সবার জন্য চা বানিয়ে একটা ট্রে করে ড্রয়িংরুমে সবাইকে দিয়ে এলো। ওরা কথার ফাঁকে ফাঁকে চা খেতে লাগলো। মীরা ভাবলো আহানের মাকে দিয়ে আসা যাক। সে আর একটা চায়ের কাপ সাথে টোস্ট নিয়ে আহানের বাবা মায়ের রুমে গেল। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো মীরা। আয়ানের মা বিছানায় শুয়ে আছে। এতো বেলা হলো অথচ উনি শুয়ে আছেন, তাও আবার কাঁথা মুড়ি দিয়ে! আশ্চর্য লাগলো মীরার। সে একটা টেবিলের উপর চা ও টোস্টগুলো রেখে আয়ানের মায়ের কাছে গেল। কপালে হাত দিলে চোখ উপরে উঠে যায় মীরার। আয়ানের মায়ের ভিষণ জ্বর উঠেছে। উনি ঘনঘন কাঁপছেন। মীরা অস্থির হয়ে পড়লো। আয়ানের মা’কে ডাকতে লাগলো, “মা৷ উঠুন না। আপনার তো অনেক জ্বর।”
ওনার তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। তবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন ক্রমশ। আর কাঁপছেন। মীরা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। চট জলদি জল পট্টি নিয়ে এলো সে। তারপর আস্তে আস্তে জল পট্টি আয়ানের মায়ের কপালে দিতে লাগলো। মীরার এদিকে খুব খারাপ লাগছে। ওনার এমন জ্বর উঠলো। অথচ কেউ জানেও না। জল পট্টি দেওয়ার ফলে কিছুক্ষণ বাদে আয়ানের মা হালকা হালকা চোখ খুলে তাকায়। চোখের সামনে মীরাকে দেখে সে চমকে যায়। মীরা তাকে জল পট্টি দিচ্ছে, এটা দেখে সে আসলেই চমকে যায়। বিড়বিড় করে বলে, “তুমি! কেন করছ আমার সেবা। আমি তো তোমার নিজের শাশুড়ী নই।”
মীরা জবাবে বলে, “ছিঃ মা, এসব কি বলেন। আপনি আমার গুরুজন। আপনার সেবা করাই তো আমার কর্তব্য। আপনি মানুন আর না মানুন, আমি আপনাকে আমার শাশুড়ী মা বলে মানি। বরের সাথে মনোমালিন্য আছে বলে কি আপনার এই অবস্থায় আমি আপনি পাশে থাকব না? এমন অন্যায় আমি করতে পারব না মা। আমি ওনাদের ডেকে দিচ্ছি। ডাক্তার কে কল দিতে হবে।”
মীরা ওখান থেকে উঠে চলে গেল ড্রয়িংরুমে। সবাইকে জানানোর পর আয়ান ও তার বাবা ছুটে চলে যায়। কিন্তু আহান সোফায় বসে থাকে। যেন কিছুই হয়নি। মীরা রেগে যায় আহানের উপর। আহানের পাশে বসে বলে, “সবাই গেল, আপনি এখানে কেন?”
“আমি ডাক্তার নই যে আমি গেলেই উনি সুস্থ হয়ে যাবেন।”
“আজব তো। ওনারা কি ডাক্তার? ওনারা গেলে আপনি যাবেন না কেন?”
“আমি গেলে উনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
“আহান!!!”
“মীরা প্লিজ। জোর করো না আমাকে।”
“ছিঃ ছিঃ। আমি আপনাকে ভালো মানুষ ভাবতাম, আপনি এমন! একটা অসুস্থ মানুষকে দেখতেও যেতে পারছেন না? অনেক খারাপ আপনি।”
মীরা ওখান থেকে দৌড়ে চলে গেল৷ আহান থম মেরে বসে রইলো। মীরা কি কষ্ট পেয়েছে? তার কি যাওয়া উচিৎ? আহান কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর দেখলো বাসায় ডক্টর এসেছে। আহান ডাক্তারের পিছনে চলে গেল আয়ানের মা’কে দেখতে। জ্বরের ঘোরে দরজায় আহানকে দেখে বিশ্মিত হলেন আয়ানের মা। চোখ দিয়ে নোনাপানি বের হচ্ছে। যা’কে তিনি এতোদিন অবহেলা করলেন সে তার অসুস্থতার সময় তাকে দেখতে এসেছে। উনি বুঝলেন কত বড়ো ভুল উনি করেছেন। আহান দরজা থেকে ভেতরে ঢুকে ডক্টরকে জিগ্যেস করে, “কি অবস্থা ডক্টর? ওনার কন্ডিশন এখন কেমন?”
আয়ান ও তার বাবা হা করে আহানের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা সত্যি আহান তো? ডাক্তার বললেন, “আমি প্রেস্ক্রিপশনে সব ঔষধ লিখে দিয়েছি। আশা করি রাতের মধ্যেই জ্বর কমে যাবে। এগুলো ওনাকে খাওয়াবে।”
এই বলে ডাক্তার আহানের হাতে প্রেস্ক্রিপশনটা ধরিয়ে দিল। আহান চুপ থেকে বলে উঠল। “তোমরা থাকো, আমি দেখি ঔষধগুলো পাই কিনা। আজ ইদের দিন, ফার্মেসী বন্ধও থাকতে পারে। চেষ্টা করব ওনার ঔষধ গুলো নিয়ে আসার।”
এই বলে আহান প্রস্থান করে।


সকাল নয়টার দিকে মীরার ফোনে একটা কল আসে। মীরা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তার ভাই মিরাজ কল দিয়েছে। মীরা খুশি হয়ে রিসিভ করে কথা বলে। মিরাজ জিগ্যেস করে, “কেমন আছিস?”
“ভালো, তোরা?”
“সবাই ভালো। কি করছিস? আহান কোথায়?”
“উনি একটু বাহিরে।”
“গরু জবাই দেওয়া শেষ?”
“হ্যাঁ। তোমাদের?”
“এইতো মাত্র করলো। তোর কথা খুব মনে পড়ছে। এইতো রমজানের ইদটা তুই আমাদের সাথে ছিলিস। কিন্তু কোরবানির ইদে তুই বাসা ছাড়া। অন্য কোথাও, অন্য পরিবেশে। খুব খারাপ লাগছে বোন। কষ্ট হচ্ছে তোর? আহান তোর খেয়াল রাখে?”
“আরে কি বলছ। কষ্ট কেন হতে যাবে। কোনো কষ্ট হচ্ছে না।”
“আহানের সৎ মা তোকে কিছু বলে? একদম কান দিবি না ওনার কথায়। ওনার থেকে দূরে দূরে থাকবি।”
“ভাইয়া! থাকনা এসব। উনি গুরুজন হোন। প্লিজ। এসব কথা বলো না।”
“তো আসছিস তো এখানে?”
“দেখি, রাতের দিকে ওনাকে বলব নিয়ে যেতে।”
“আচ্ছা, অপেক্ষায় থাকব।”
মীরা ফোন কেটে দিল। শাশুড়ী অসুস্থ। এখন সব কিছু তাকেই সামলাতে হবে। মীরা নিচে এসে দেখে আয়ান কিছু মাংস নিয়ে এসেছে। মীরাকে বলল এগুলো রান্না করতে। ইদ উপলক্ষে বাসায় দুজন মহিলা রেখেছেন আহানের বাবা। তারা মাংসগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল। মীরা রান্নায় পাকাপোক্ত নয়। সে ইউটিউব দেখে গরুর মাংস রান্নার রেসিপি দেখে রান্না করতে থাকে। মহিলা দুজন রুটি বানাচ্ছেন। কোরবানির ইদে গরুর মাংস খাওয়া যাত্রা করা হয় রুটি দিয়ে। মীরা চুলোর আগুন অল্পে রেখে কিছু হালকা নাশতা নিয়ে আয়ানের মা’কে খাওয়াতে গেল।

ইদে মীরার পাঁচটি ড্রেস হয়েছে। তবে এই পাঁচটি ড্রেসের মধ্যে একটা হচ্ছে শাড়ি। যেটা আহান মীরাকে দিয়েছে। আর বাকি চারটে ড্রেস আয়ান, মিরাজ, মীরার বাবা ও মীরার শ্বশুর মশাই তাকে গিফট করেছে। মীরা এগুলো পেয়ে খুব খুশি হয়ে যায়। এরা সবাই তাকে কত ভালোবাসে। এগুলোর মধ্যে এখন কোনটা পড়বে সেটাই ভাবছে মীরা। সবগুলোই খুব সুন্দর। মীরা আহানের দেওয়া শাড়িটি বেছে নিল। আজ সে এটাই পড়বে। দুপুরের দিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই নিজের রুমে রেস্ট নিতে গেল। আজ সবাই মীরার রান্নার প্রশংসা করেছে। মীরা সত্যিও ভাবেনি যে তার প্রথম তৈরি করা খাবার সবার এতো ভালো লাগবে।
আহান বিছানায় শুয়ে ছিল। মীরা বারবার ঘেটে ঘেটে আহানের দেওয়া শাড়িটি দেখছিল। ভ্রু কুচকে আহান মীরাকে জিগ্যেস করল, “পছন্দ হয়নি? এতো ঘেটে ঘেটে দেখছ যে! চেঞ্জ করে আনব?”
মীরা আহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি একটু বেশিই কথা বলেন। আমি বলেছি যে আমার পছন্দ হয়নি?”
“কিছু তো বলোনি। বুঝব কি করে।”
“আপনার এতো বুঝে কাজ নেই। শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভাবছি বিকেলের দিকে এটা পড়ে ওই বাসায় যাব।”
“ঠিকাছে যেও।”
“আপনি যাবেন না?”
“আমি গিয়ে কি করব?”
“কি করবেন মানে? আমার সাথে যাবেন। ইদের দিন মানুষ শ্বশুর বাড়িতে যায়না। তাছাড়া ওটা কি শুধু আপনার শ্বশুর বাড়ি নাকি। আপনার বন্ধুরও বাড়ি। আপনি না গেলে আমি কিভাবে যাব?”
“যেতেই হবে?”
“হ্যাঁ।”

বিকেল গড়িয়ে এলো। মীরা আহানের দেওয়া শাড়িটি পড়ে রেড়ি হতে লাগলো। আলমারি থেকে গয়নার বক্সটা বের করে তার থেকে একটা সিমপল গহনা নিয়ে গলায় জড়ালো। চুলে খোঁপা করব তাতে গাজরা লাগিয়ে দিল। কানেও স্বর্ণের এক জোড়া ঝুমকো পড়েছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ও চোখে গাঢ় কালো কাজল দিয়েছে। দুহাত ভর্তি কাচের চুড়ি পড়েছে। নিজেকে বারবার আয়নায় দেখছে। আহান বাইরে গিয়েছিল। মাত্র এসেছে বাসায়। রুমে ঢুকতেই থমকে যায় সে। মীরাকে দেখে। অপলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে মীরার দিকে। মীরার সৌন্দর্য আহানকে আকর্ষিত করছে। মীরা চমকালো আহানকে দেখে। তার অদ্ভুত দৃষ্টি মীরাকে নার্ভাস ফিল করাচ্ছে। আহান ধীর পায়ে মীরার দিকে এগিয়ে আসলো। আহান যত এগিয়ে আসছে মীরার হৃদ-স্পন্দন ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আহান মীরার একদম কাছে চলে আসলো। মীরার দুহাত ধরলো তার দুটো হাত দিয়ে। আহানের গতিবিধি মীরা বুঝতে পারছেনা। তারা দুজনে এখন কাছাকাছি, হাতে হাত, চোখে চোখ। মীরা গভীর দৃষ্টি ফেলেছে আহানের চোখে। কি অদ্ভুত আহানের চোখ দুটি। যেন কতশত মায়া জমে আছে ওই চোখে। চোখে চোখ রেখে ভাব বিনিময় করছে দুজন। আহান একটুপর নিজের চোখ বুজলো। একটু ঝুকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে মীরার দিকে। মীরা স্থির, তবে ভেতরে উথাল পাথাল ঢেউ বইছে তার মাঝে। আহান নিজের ঠোঁটজোড়া ছোঁয়ালো মীরার নরম ঠোঁটে। অতঃপর ঠোঁটে ঠোঁট। বাকরুদ্ধ মীরা! আহানের পথ অনুসরণ করে নিজেও চোখ বুজলো। দুজনে হারিয়ে গেল দূর অজানায়। তাদের ভালোবাসার রাজ্যে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here