তোমার প্রণয় নগরে,সূচনা পর্ব

তোমার প্রণয় নগরে,সূচনা পর্ব
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

— “আরসাল ভাইয়া আমার সাথে জোরজবরদস্তি করার চেষ্টা করেছে।এই দেখো আমার জামাটাও ছিঁড়ে ফেলেছে !”

এতটুকু বলে শব্দ করে কেঁদে উঠল কিশোরী সায়রা।কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে উৎসব মুখর পরিবেশটা শুনশান শোকে রূপান্তরিত হলো। সবার হাস্যউজ্জ্বল মুখশ্রীতে মুহূর্তে গম্ভীরতা এঁটে এলো ।সবার নজর সায়রার দিকে।ফর্সা মুখশ্রীতে রক্তিমা আভা ছেয়ে । নাকের ডগা লাল টকটকে।অঝোর কান্নায় চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ছুঁতে যেন রক্ত ঝরা শুরু হবে।সাথে সাথে মুনতাহা খানম সায়রা কে জড়িয়ে ধরে। ডান হাতের হাতার দিকে তাকাতে আহনাফ খাঁন লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে নিলো ।সায়রার জামা বাহু থেকে অনেকটা ছিঁড়ে গেছে।আহনাফ খাঁন ক্রোধে চোখ মুখ শক্ত করে থমথমে বসে রইল।একমাত্র ছেলে আরসাল থেকে কখনো এমন কিছু আশা করেননি তিনি।সায়রা আহনাফ খাঁনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাহির আহমেদের বড় মেয়ে।আহনাফ খাঁনের কোন মেয়ে নেই ,সায়রা তার মেয়ের থেকে কোন অংশে কম নয়। ছেলের এমন নিম্ন কাজকে কিছুতে মেনে নিতে পারছেনা আহনাফ সাহেব । বরাবর- ই আরসাল আহনাফ খাঁনের গর্ব ! পরম স্নেহের সন্তান।কিন্তু আরসাল এমন কিছুও করতে পারে, তা উনার ধারণার বাহিরে ছিল।ততক্ষণে আরসাল দোতালার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে।চোখমুখ থমথমে চুল কাপড় এলোমেলো অগোছালো। কিছু বলতে উদ্যত হবে আরসাল ,তার পূর্বে আহনাফ খাঁন সজোরে আরসালের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ।আরসাল থতমত খেয়ে যায়।কিছুতে ্যেন বিস্ময় কাটছে না তার।হল রুম জুড়ে শোরগোল বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি।সব দেখে সায়রা ভয়ে মুনতাহার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। আহনাফ খাঁন দ্বিতীয়বার হাত উঁচু করতে।সায়রার মা সিন্থিয়া এসে বাঁধা দেয়। আহনাফ খাঁন তখনো ক্রোধে থরথর কাঁপছে।গলা উঁচিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল ,

— “ছাড়ো ভাবি! আজ ওর সব পুরুষত্ব বের করবো । সায়রা আমার নিজের মেয়ের থেকে কোন অংশে কম নাকি? ওর সাহস হলো কি করে সায়রার সাথে এসব করার ? ”

আরসালের দিকে আবারো তেড়ে আসতে মাহির আহমেদ বাঁধ সাজল ।বন্ধুকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে নত স্বরে বলল,

— “শান্ত হ! তোর এতো উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়! শরীর খারাপ করবে”

— “শান্ত হবো? ওর সায়রাকে এতোই যখন পছন্দ ছিল ,তাহলে একবার বাড়িতে জানাল না কেন? এমন জঘন্য কাজ কেন করল।মেয়েটা এখনো কিশোরী ,মাত্র পনের বছর বয়স । দুনিয়া দারির হাবভাব কোনকিছু তার বোধগম্য নয়।বাচ্চা মেয়ে্র সাথে এমনটা কি করে করতে পারল? ওর বিবেক বুদ্ধি কি মরে গেছে? ”

বাজখাঁই চিৎকার করে আহনাফ খাঁন বলে উঠল।বাড়িতে হৈচৈ বিশ্রী এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।সায়রার বাবা মা শান্ত থাকলেও তার চাচারা ভীষণ রাগান্বিত।আদরের ভাতিজীর সাথে এমন আচরণ? কোন দিন মেনে নিবে না । ভীষণ ক্ষিপ্ত তারা।আরসালের ফুপু চাচারাও কম নয় ,এমন ঘটনার কথা শোনার পরও তারা আরসালকে সাঁই দিচ্ছে। পরিস্থিতি ধীরেধীরে প্রতিকূলের দিকে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সায়রার বাবা মা আরসালের বিরুদ্ধে টু শব্দ পর্যন্ত করেনি।বরং উনারা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত ।পরিস্থিতি অনুকূলে আনার চেষ্টায় সবার সামনে আহনাফ খাঁন জোরগলায় ঘোষণা জানালো “এই রাতেই আরসাল সায়রার এংগেজমেন্ট হবে।আরসাল দেশে ফিরলে সায়রা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের বিয়ে! ”
আহনাফ খাঁনের এমন ঘোষণায় সবাই চুপ ।সেই সাথে ভীষণরকম অবাকও বটে ।সব থেকে বেশি অবাক সায়রা নিজে। কিছুতে তার বিস্ময় কাটছেনা যেন। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
কি থেকে কি হচ্ছে এসব!
ছোট থেকে আরসালকে সায়রার ভীষণরকম অপছন্দ ।এর পেছনে অবশ্য কারণ অনেক।কিন্তু মুখ্যকারণ হলো আরসালকে সায়রার মা ভীষণ আদর করে।যা সায়রার মোটেও পছন্দ না।আরসাল সায়রার সম্পর্ক অনেকটা সাপ বেজীর ন্যায় ।
আরসাল সায়রাকে ছোট থেকে কড়া শাসনে রেখেছে।কখনো কোন স্বাধীনতা দেয়নি ।এমনকি বন্ধুবান্ধব বাছাইকরণটাও আরসালের পছন্দ অনুযায়ী হতো।সায়রার ভীষণ রাগ হতো। এতো কিসের অধিকারবোধ তার?
এতো অধিকারবোধ ,এতো শাসনে সায়রা হাঁপিয়ে উঠে।মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে আরসালকে তার মোটেও পছন্দ না। ভীষণ অসহ্য লাগে। আরসাল আগামীকাল চারবছরের জন্য কানাডায় পড়াশোনার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।সেই সুবাদে বাড়িতে ছোটখাটো একটা গেটটুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে।সায়রা ভেবেছিল এই বুঝি তার মুক্তি মিলবে ।আরসাল নামক আপদটা তার ঘাড় থেকে নামবে। সে মুক্ত পাখির মত খোলা আকাশে ডানা মেলবে।কিন্তু কে জানত এমন অঘটন ঘটবে?
বাড়ির আর কেউ না জানুক সায়রা তো জানে আরসালের উপর যেই অন্যায় আরোপ লাগানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ।সব সময়ের মত আজও আরসাল সায়রার সাপ বেজীর লড়াই চলছিল।এমন সময় লোডশেডিং হয়।চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে যায়।ছোট থেকে সায়রার অন্ধকারে ফোবিয়া।সামান্য অন্ধকারে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।এই ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমটায় সায়রা বিচলিত হয়ে পড়ে।চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।আরসাল সায়রাকে সামলানোর জন্য এগিয়ে আসতে।সায়রা ভয়ে দূরে সরে যেতে নেয়।এক সময় দুজনের ধস্তাধস্তির ভেতর সায়রার জামার হাতা ছিঁড়ে যায়।ততক্ষণাত বিদ্যুৎ চলে আসে।পুরো ঘর আলোয় ভরে যায়।এসব কিছু আরসালের কারসাজি ধরে নিলো সায়রা।সায়রাকে ভয় দেখানোর জন্য সে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে।আরসালের নালিশ করতে বড় বাবার (আরসালের বাবা) কাছে চলে যায়।কিন্তু কে জানত সায়রার বলা দু’বাক্য তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে! সত্যিটা বলতে যেয়েও থেমে যায় সায়রা।
তার কিশোর সরল মনে গভীর ভয় ডুকে গেছে।এখন সবাই সত্যি জানলে তাকেই ঝেঁকে ধরবে।মায়ের কড়া বকুনি শুনতে হবে।তাই আর ঘাটলো না।চুপ করে থাকাটা শ্রেয় মনে করল সায়রা।

এসব কিছুর মাঝে থম মেরে থাকে আরসাল।সে ভীষণরকম হতভম্ব।কেউ একবার তার মতামত জানার প্রয়োজনবোধ করল না? কি হয়েছিল কেউ একটিবার জিজ্ঞাস করল না?
তিক্ত এক অভিমান নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে রইল।
সেই রাতে সায়রা আরসালের এংগেজমেন্ট হলো।আংটি পড়ানোর সময় একবারের জন্যও আরসাল সায়রার দিকে তাকাল না।সারাক্ষণ চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল।আংটিটাও বেশ জোর খাটিয়ে রাগ জেদ নিয়ে পড়াল।আংটি পড়ানোর সময় সায়রার হাতে আরসালের নখের গাঢ় আঁচর পড়ল। চাপা আর্তনাদ করে উঠল সায়রা ,কিন্তু এতে আরসালের বিন্দু পরিমাণ ধ্যান নেই।আংটি পড়িয়ে সোজাসুজি উঠে যায়।রাগ অপমান শরীরে সুঁইয়ের মত বিঁধছে তার।পুরো দুনিয়া বিষের ন্যায় মনে হচ্ছে।এতো অপমান! এতো ঘৃণা! আগে কোনদিন হয়নি তার। সেই রাতে নিজের ঘর থেকে আর বের হলো না আরসাল।সারারাত প্রচণ্ড ভাংচুর করল।ভাংচুরের শব্দ পাশের রুমে থাকা সায়রার কান অবধি ঠিক পৌঁছিয়েছে।সায়রা বেশ বুঝল।রুমের কোন কিছু আর আস্ত অবশিষ্ট নেই।সবকিছু ভাঙাচুরা অর্ধাংশ!
জড়সড় হয়ে কোনরকম নির্ঘুম ভীতিকর রাত পাড় করল সায়রা।ফজরের আজান পড়তে আরসাল ব্যাগপত্র গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ।যদিও ফ্লাইট বিকেলে ,সে ভোর সকালে বিনাবাক্যে বাড়ি থেকে বিদায় নিলো।যাওয়ার আগে অবশ্য একবার মায়ের রুমে এসেছিল । মাকে সালাম করে সায়রার দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।ঐ দৃষ্টিতে কি ছিল! রাগ? জেদ? ঘৃণা? নাকি বিরাট কোন প্রলয়ের আগমন বার্তা!

ভালোবাসা ঠিক ততক্ষণি মধুর সুন্দর যতক্ষণ তা ভালোবাসায় সীমাবদ্ধ থাকে।যখনি সেই ভালোবাসা ঘৃণা প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হয় তখনি বিনাশকারী প্রলয় নামে!

চলবে কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here