বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছি। সারা শরীর ব্যথায় অবশ হয়ে যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র নড়াচড়ার শক্তি নেই। ঘরের মেঝেতে লাল বেনারসি অগোছালো অবস্থায় পরে আছে। বেনারসি দেখেই অন্তরটা কেপে উঠে। ভালোবাসা নামে সেই শারীরিক অত্যাচার। অজান্তে চোখগুলো টলমল করতে শুরু করলো। বুকের ভেতর একরাশ চাপা কষ্টের আর্তনাদ। এখন হয়তো মন খুলে কান্নাও করা যাবে না। আজ নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে। কারণ আজ আমি অন্য এক সম্পর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ। পাশেই উবু হয়ে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছে শায়ান। তার পিঠে নখের দাগ স্পষ্ট। হঠাৎ নজর গেলো বিছানার চাদরের লাল দাগের দিকে। এগুলো তো রক্তের দাগ….সাদা চাদরে রক্তের দাগগুলো স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। পারছি না আর কিছু ভাবতে। ভালোবাসার কি এই প্রতিদান? কি এমন দোষ করেছিলাম? হাজারো কথা ভাবতে ভাবতে গা এলিয়ে ঘুমের জগতে পা বাড়ালাম।
__________________________
আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। সবসময় সকাল ওঠার অভ্যাস আছে। পেটের নিচে অনেক যন্ত্রণা করছে। তারপর সব কিছু উপেক্ষা করে আস্তে আস্তে সাওয়ার নিতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে ব্যালকনিতে চলে গেলাম। ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে। দক্ষিণের শীতল হাওয়া বইছে। অনেক ভালো লাগছে। সকালের বাতাসটা অনেক বিশুদ্ধ। এটা মানবদেহের জন্য অনেক উপকারী। আচ্ছা শায়ান আমার সাথে এমন করলো কেনো? আমরা তো একে অপরকে অনেক ভালোবাসি। আমার জানামতে আমিতো কোন ভুল কাজ করিনি। শায়ান নিজেই তো বলতো আমাকে আমাদের বাসর রাত অন্যদের মত হবেনা আমরা সারারাত গল্প করবো ও আমাকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে যাবে দুজন মিলে চাঁদের আলো দেখব, এত এত স্বপ্ন এত এত আশা সব কি তাহলে বৃথা ও কি আমার সাথে ছলনা করেছে, ওকি আমাকে ভালোবাসে না, ও যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসতো তাহলে কাল রাতে আমার সাথে এরকম আচরণ করতো না। এমন ব্যবহার করার অর্থ কি? তাহলে কি আমাকে এখন আর আমাকে ভালোবাসে না? ৩ বছরের সম্পর্কের পূর্ণতা পেয়েও কি ফলাফল এমন মুমূর্ষু হবে। হঠাৎ দরজার আওয়াজে ধ্যান ভেঙে গেলো। হয়তো শায়ান উঠে গেসে। আমি তাড়াতাড়ি ঘরে গেলাম। যা ভেবেছিলাম শায়ান ওয়াসরুমে গেসে। আমিও সুযোগ বুঝে তাড়াতাড়ি চাদরটা চেঞ্জ করে নিলাম। তারপর তার রেডি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে রান্না ঘরের উদ্দেশ্য বের হলাম। সবার আগে কফি বানাতে হবে। শায়ানের আবার কফি ছাড়া ঘুম ভালোমতো ভাঙে না। কিছু রান্না করতে না পারলেও কফিটা ভালোই বানাই আমি। রান্না ঘরে আমার শাশুড়ী মা চা বানাচ্ছে। মাকে সালাম করলাম।
“আরে বৌমা এসময় এখানে কি?”
“আসলে উনার জন্য কফি বানাতে এসেছিলাম”
“তো তোমার উনি টা কে গো”
“মানে… আসলে…”
“হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। আর তোমার কফি বানাতে হবে না। কাজের লোক আছে ঠিক সময়ে পৌছে দিবে”
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু না চলো আমার সাথে” বলেই হাত ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসলেন।
তখনি শায়ান সিড়ি বেয়ে নামতে বললো, “মাম্মাম আমাকে কফি দাও। মাথাটা অনেক ব্যথা করছে”
আর আমি তো আমার শায়ানকে দেখতে ব্যস্ত। এতো সুন্দর কেন? লাল খয়েরী শার্ট আর কালো জিন্স পরেছে। অল্পতেই অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি তো সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স দিয়েছিলাম। অইটা পরলো না কেন? শায়ান কি কোনো কারণে আমার অপর রেগে আছে?
“হুম খেতে বস, সব দিচ্ছি। কিন্তু এতো সকালবেলা কোথায় যাচ্ছিস?”
“এতো সকাল কোথায়? ৯টা বাজতে চলেছে। আর আমার অফিস আছে”
“বিয়ের পরের দিন কেও অফিস যায়?”
“আরে বুঝতে হবে দ্যা গ্রেট শায়ান চৌধুরী বলে কথা। যে চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র মালিক। বুঝলে শায়েলা? তোমার ছেলে তো আমাকেও ছুটি দিয়ে দিয়েছে”
“তোমার শরীর এমনেই ভালো না, পাপা। তাই তোমার অফিস যাওয়া নিষেধ”
“আহা কি বলিস এগুলো। তোর বাবা এখনো অনেক ইয়াং আছে। তাই তো সবগুলো চুল পাক ধরে গেসে” বলেই শাশুড়ী মা হাসতে লাগলো। সাথে শায়ানও তাল মিলিয়ে হাসছে। শায়ানও হাসতে পারে নাকি? ৩ বছরের রিলেশনে ৩ বার হাসতে দেখসি কি না সন্দেহ আছে।
“বৌমা তোমার হাত দুটো এদিকে দাও”
আমি কোনো কথা না বলে আমার হাত দুটো তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম ওনি দুটো বালা আমার হাতে পরিয়ে দিলো।
“এগুলো আমার শাশুড়ি মা আমি যখন বউ হয়ে এবাড়িতে এসেছিলাম তখন আমাকে দিয়েছিল, আজ আমি এ বালা দুটো তোমাকে দিয়ে আমার ছেলে বউ হিসেবে তোমাকে স্বীকৃতি দিলাম, সংসারের সব দায়িত্ব তোমাকে দিলাম, এখন থেকে এটা আমার সংসার না তোমার সংসার, তুমি তোমার সংসার দেখে রেখো মা”
আমি আমার শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। সবাইকে অনেক খুশি কিন্তু শায়ানের মুখটা কেমন জানি হয়ে গেলো। অনেকটা গম্ভীর টাইপ। আমার প্রতি বিরক্তি স্পষ্ট।
“মাম্মাম তুমি কি চাও আমি না খেয়েই চলে যাই?”
“সেটা হবে কেনো? এইতো নে খাওয়া শুরু কর”
সবার সাথে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে সব গুছিয়ে রাখলাম। পরে ঘরে গিয়ে শায়ানকে খুজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। পরে জানতে পারলাম। শায়ান নাকি অফিসে চলে গেসে। শায়ান কি আমাকে একবারো বলে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ মনে করলো না? শায়ানের এমন ব্যভার যে আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আমি তো এই শায়ানকে ভালোবাসি নি। খাটে হেলান দিয়ে বসে বসে সব চিন্তা করছি। যে শায়ান ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে আমার খবর নিতো, তার এই অবহেলা কীভাবে মেনে নিয়ে পারি? এমন হাজারো কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে বিলীন হয়ে গেলাম।
__________________________
সন্ধ্যা হয়ে গেসে। শায়ানের এখনো কোনো খবর নেই। ধুর কোন কিছুই ভালো লাগছে না শায়ান অফিসে যে গেল একটা ফোন ও করলো না কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছে একদিনে ভাবা যায় এগুলো। আমি মন খারাপ করে বসে আছি তখন আমার ননদিনী শায়না আসলো।
“সরি ভাবী আমার বান্ধবী অনেক অসুস্থ ছিল হাসপাতালে ভর্তি ছিল তাই তোমাদের বিয়েতে আমি থাকতে পারিনা তুমি কি আমার সাথে রাগ করে আছো?”
“আরে না আমি একদমই রাগ করিনি”
“তাহলে এভাবে মন খারাপ করে বসে আছো কেনো? বাবা-মায়ের জন্য খারাপ লাগছে কি?”
“একটু একটু লাগছে”
“শোনো মন খারাপ করে বসে থেকো না তো আসো আমরা দুজন মিলে ছাদে যাই”
“এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখন ছাদে যাব”
“আরে সন্ধ্যে হয়েছে তো কি হয়েছে, আসো ছাদে গিয়ে দুজন আড্ডা দেই”
“তোমায় ভাই চলে আসলে আমাকে যদি না দেখে রাগ করবে হয়তো”
“ওহহো সেটা নিয়ে তুমি একদমই চিন্তা করো না আমি ভাইয়াকে বলব আমাদের ভালো লাগছিলো না তাই আমরা দুজন ছাদে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম ”
“আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে চলো”
আমার মন টা ভালো হয়ে গেলো শায়নার এমন এমন কথা বলছে যা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ। আমি হাসচ্ছি তার মধ্যে শায়না আমাকে বলল, “এত হেসোনা তো, এমা তুমি এত বড় হা করে হাসতেছো তোমার মুখে তো ইঁদুর ঢুকে যাবে”
” ইঁদুর কখনো কারো মুখে ঢুকে (ওর কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে বললাম)
“ভাবি তাড়াতাড়ি ঘরে চলো আকাশের অবস্থা বেশি ভালো না হয়তো বৃষ্টি আসতে পারে বৃষ্টিতে ভিজলে তো তোমার আবার সমস্যা”
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি হ্যাঁ আকাশের এমন অবস্থা বৃষ্টি যেমন এখনি নেমে পড়বে।
“শায়না তাড়াতাড়ি আসো ঘরে চলে যাই”
________________________
আমরা দুজনই ঘরে চলে আসি। শায়না ওর ঘরে চলে যায়, আমি ঘরে এসে দেখি শায়ান রাগে ফুঁসছে, শায়ানের রাগ করার কারণটা আমি বুঝতে পারলাম না, ওর চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না মনে হচ্ছে এখনি আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খাবে, আমি ভয়ে ভয়ে ওর দিকে একপা দুপা করে যাচ্ছি, ও হঠাৎ করে আমার হাত ধরে……..
তোমাকেই_চাই
সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_জান্নাতুল_মাওয়া_মাহিমুন
চলবে কী?
গল্পটা কী সবার ভালোবাসার যোগ্য?