তুমি রবে নীরবে পর্ব ৫

তুমি রবে নীরবে
পর্ব ৫

বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবাই এর চলে যাওয়া দেখছিলো স্নেহা, একবারও মুখ তুলবে না বাবাই ও জানে,প্রথম প্রথম আশা করতো, এখন কেমন যেনো অভ্যাসের মধ্যেই এসে যাচ্ছে ব্যাপারগুলো।

কালকের পায়েস টা দেবে কি দেবেনা ভেবে দিয়েই দিলো শেষ পর্যন্ত, কি আর করবে ফেলে দেবে হয়তো কালকের মতোই, এমনিতেও তো ফেলে দিতো স্নেহা, তার থেকে না হয় যার নামে বানানো, তার সামনে রাখি একটু বাটিটা, ভেবেই দিয়েছিলো শেষ পর্যন্ত। চুপ করে খেয়ে উঠে যেতে দেখে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো স্নেহা। যাক, সকাল থেকে অন্তত শুরু হয়নি আজ।

বাবাই আবার দুপুরে খেতে আসবে, ততক্ষনে বাড়ির কাজ গুলো সেরে ফেলবে ও, কাজের লোক রাখেনি, এই টুকু তো ঘর, কি করেই বা নিজে সময় কাটাবে তাই সব কাজ নিজেই করে ও।

কাজ করতে করতেই ফোন বাজলো, টুয়া, কি রে আজ মুড কিরকম ছিলো তোর বরের? হেসে ফেললো স্নেহা, পায়েসের বাটি আজ আর ছুঁড়ে মারেনি, যদিও আমি রেডী ছিলাম ঝাঁটা নিয়ে পরিষ্কার করবো বলে,দুই বন্ধুই হেসে উঠলো এক সঙ্গে। এই সময় টুকু ওদের নিজেদের, স্কুলের বন্ধু থেকে নিজেদের বাড়ি, সব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে ওরা।

কাজ করা বন্ধ করে গুছিয়ে সোফায় বসলো স্নেহা,এখন অন্তত ঘন্টা খানেক চলবে এই পর্ব টা। গোটা পাড়ার খবর আর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নেহার নখদর্পণে এসে যাবে টুয়ার কল্যাণে, কার ছেলে, কার মেয়ে কি করেছে, কারা পাড়ায় নতুন এলো, কারা চলে গেলো পাড়া ছেড়ে, এখানে বসেই সব খবর রাখে ও।

কাজের একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই গল্প ছেড়ে ওঠা এখন সম্ভব নয় ওর পক্ষে, আর সারাদিনে তো এইটুকুই কথা বলে ও, বাবাই ঘরে ঢুকলেই তো মুখ বন্ধ করে থাকতে হয় ওকে, এমন কি বাবাই এর ছুটি থাকলে তো ও টুয়ার সঙ্গেও কথা বলেনা খুব একটা, আবার কোন কথায় বাবাই এর রাগ হয়ে যায় কে জানে। টুয়াও ওই জন্যই ফোন করেই বাবাই বাড়িতে আছে কিনা জেনে নেয় আগে।

ফোন রেখে যখন কাজে হাত দিলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। বাবাই এর বাড়ি ঢোকার আগেই শেষ করে স্নান করতে ঢুকে যেতে হবে, বাড়িতে ঢুকে বাথরুম বন্ধ থাকলে খুব বিরক্ত হয় ও।

স্নেহা তাড়াহুড়ো করছিলো, বাসন মাজতে গিয়ে একটা গ্লাস হাত থেকে স্লিপ করলো, পড়ে গিয়ে ভাঙলো ওটা। নিচে বসে বেশ সতর্কতা নিয়েই তুলছিলো ভাঙ্গা কাঁচ গুলো, তাও যেনো কি করে একটা টুকরো হাতে ঢুকে গেলো। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁচটা হাত থেকে টেনে বার করার চেষ্টা করছিল স্নেহা, কাঁচটা বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো হাত থেকে।

কোনো রকমে অন্য হাত দিয়ে টিপে ধরে থেকে রক্ত টা বন্ধ করার জন্য কৌটো খুলে খানিক টা চিনি রক্তের উপর দিয়ে চেপে ধরলো। একটু পরেই রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়ে গেলো, এই সব টোটকা গুলো মায়ের কাছ থেকে শিখেছে ও।

সব মিলিয়ে স্নান সেরে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গেলো স্নেহার, বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো বাবাই ফিরে এসেছে, হসপিটালের জামাকাপড়ে ও ঘরে ঢুকতে পছন্দ করেনা, তাই বাথরুমের উল্টোদিকের দেওয়ালে হেলান দিয়েই স্নেহার বেরোনোর জন্য ওয়েট করছে, মুখটা শুকিয়ে গেলো ওর, এইরে যা ভয় পাচ্ছিলো তাই হলো, কি মরতে যে ও অতক্ষণ ধরে গল্প করতে গেলো, এবার থেকে আগে কাজ কর্ম সেরে তবেই ফোন করবে মনে মনে ঠিক করে নিলো ও।

বাড়িতে বসে থাক, স্নান সেরে রাখতে পারো না? কড়া গলায় বলল বাবাই,

স্নেহা কোনো উত্তর দিলোনা,ও চুপ করে থাকা টাই বেস্ট বলে বুঝে গিয়েছে এখন, কথায় কথা বাড়ে শুধু।

স্নেহাকে চুপ করে থাকতে দেখে আর কোনো কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে গেলো বাবাই, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ও। পুজো টা দিয়েই খেতে দেবে ভেবে ঘরে রাখা ওর ছোট্ট ঠাকুরের সিংহাসন টার দিকে এগিয়ে গেলো।

নিজের বারান্দা থেকে তোলা ফুলেই ও পুজো করে, এর একটা আলাদাই আনন্দ আছে, সুন্দর করে বসে বসে ফুল দিয়ে সিংহাসন টা সাজিয়ে দেয়, ওর খুব ভালো লাগে এই কাজ টা করতে, খুব যত্ন নিয়ে ও করে এগুলো।

কিন্তু আজ আর হাতে সময় নেই, বাবাই ফিরে এসেছে, তাই এই পর্ব টা আজ খুব তাড়াতাড়ি সারছিলো। রাত্রে শোয়া বাদে সচরাচর বাবাই বাড়িতে থাকলে বেড রুমে ঢোকে না ও। কেমন যেনো অস্বস্তি হয় বাবাই এর মুখোমুখি হতে, ওকে দেখলেই মুখে একটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বসে থাকে বাবাই, স্নেহার ওই দৃষ্টি টা খুব অপমানজনক লাগে, খুব ছোট মনে হয় নিজেকে, তাই এড়িয়েই চলে ও।

বাবাই এর খাবার টেবিলে রেখে দূরে রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো,সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে বিরক্ত হয় ও, কিন্তু কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করতে গেলেও তো দাঁড়াতেই হয়, তাই দূরে দাঁড়িয়েই লক্ষ রাখে স্নেহা।

ডাল শেষ করে মাছের ঝোলের বাটি টা তুলে নিয়ে স্নেহার দিকে তাকালো বাবাই, দাঁড়িয়ে দেখলো স্নেহা, এই তাকানোর মানে ও বোঝে, ভাত লাগবে আরও, কিন্তু মুখে একটা কথাও বলবে না, এর আগে দু একবার নিজে কিছু না বলে অপেক্ষা করে দেখেছে ও, বাবাই ভাত না নিয়েই উঠে গেছে, অথচ জিজ্ঞেস করলে তখন হ্যাঁ বলে, তাই এখন আর অপেক্ষা করে না স্নেহা, ভাতের হাঁড়ি টা সামনে নিয়ে এসে হাতায় করে দু হাতা ভাত তুলে দিতেই বাবাই ডান হাত টা থালার ওপর ছড়িয়ে দিল, মানে আর লাগবেনা, সামনে থেকে সরে গেলো স্নেহা।

দুটো মানুষ একই বাড়িতে কোনো কথা না বলে প্রায় এক মাসের বেশি কাটিয়ে ফেলেছে, কিন্তু এই এক মাসে বাবাই এর রুটিন টা মোটামুটি বুঝে ফেলেছে ও, তাই আগে যেটুকুও কথা বলার দরকার পড়তো সেটুকুও এখন আর দরকার পড়েনা, সব কিছু নিজের মত করেই গুছিয়ে রাখে স্নেহা।

তাই কোনো কথা না বলেও বাবাই দিব্যি ওর সুযোগ সুবিধা গুলো পেয়ে যায়, শুধু মিসবিহেভ টা বন্ধ করে না ও, সেটা চলতেই থাকে, স্নেহার যেকোনো খুঁত খুঁজে বার করার চেষ্টা করে সব সময়, একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই মুখে একটা বিরক্তি ভাব নিয়ে আসে, মন টা খারাপ লাগে স্নেহার, এত কিছু করেও যে কেনো বাবাই একটুও খুশি হয়না বুঝতে পারেনা ও।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here