তুমি রবে নীরবে,পর্ব ১২,১৩
অপরাজিতা টুয়া
পর্ব ১২
আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লো বাবাই। কাল সারাদিন বাড়িতে ছিলো, যথেষ্ট রেস্ট হয়েছে,ঘুম থেকে উঠেই তাই চটপট রেডী হয়ে নিয়েছিলো।
বেরোনোর সময় দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে প্রতিদিনের মত দাঁড়িয়ে ছিলো স্নেহা, টেবিলের ওপর চাবিটা রাখা, কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই ল্যাচটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ও।
কি বলতে চায় স্নেহা ও জানে, ও চাবি নিয়ে যাবার কথা মনে করিয়ে দিতে চাইছিলো, কিন্তু বাবাই যে ইচ্ছা করেই আর চাবি নিয়ে যেতে চাইছে না সেটা কি একটুও বুঝতে পারছে না ও, প্রতিদিন একই ভুল কেও করে নাকি, হাসি পাচ্ছিলো বাবাই এর। নিচে নেমে একটু তাকাতে ইচ্ছা করছিলো ওপরের দিকে, কিন্তু না, বেশি কিছু দেখানো যাবে না এখনি।
একে তো কাল ওর কথা শুনে থেকে গেছে বুঝে, একটা অদ্ভূত খুশি খুশি ভাব ওর মুখের মধ্যে লক্ষ করেছে বাবাই। ওর ও খুব ভালো লাগছিলো, কেউ এত ছোটো ব্যাপারেই যে এত খুশি হতে পারে আগে ও কোনো দিনই বোঝেনি। সায়ন্তির জন্য তো কত কিছু করেছে আজ পর্যন্ত, তাও ওকে খুশি দেখেনি কোনোদিনও, সব টাই যেনো ওর প্রাপ্য বলেই ভাবে ও, পরশুর ঘটনার পর থেকে মনটা বিরক্ত হয়ে আছে খুব।
স্নেহার এইটুকু চাওয়া তো পূরণ করাই যায়, মাঝে মাঝে এইরকম ছোটো ছোটো কিছু চাওয়া পূরণ করবে বলে ঠিক করে নিলো বাবাই।
দুপুরে, বাড়িতে খেয়ে এসে হসপিটালে ঢুকতেই দেখলো উল্টোদিকের করিডোরে সায়ন্তি দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেই এগিয়ে এলো,
কেমন আছিস আজ? খুব খারাপ লাগছে আমার, আমার জন্যই তোর এত বড় বিপদ হলো।
তাই? সেই জন্যই তো একবারও গত দু দিনে খোঁজ নিসনি আমার। কেমন আছি জানতে চাইলেই জানতে পারতিস তাই না, তোর সঙ্গে দেখা না হলে তো জানতেও চাইতিস না বোধহয়, বলেই নিজের রুমে ঢুকে গেলো বাবাই।
পেছন পেছন সায়ন্তি ও ঢুকে এলো,
শোন না, প্লিজ, আসলে তোকে ফোন করলে যদি তোর বউ কিছু মনে করে তাই, কথাটা আর শেষ করলো না সায়ন্তি ।
আমার বউ আমার হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে না, মেসেজ করতেই পারতিস ইচ্ছা হলে, তোর দরকার মিটে গেছে বোধহয়, এখন ব্যস্ত থাকবো, পরে কথা বলতে ইচ্ছে হলে ফোন করিস,
বলেই বাবাই চেয়ার টেনে মাথা নিচু করে বসে পড়লো একটা ফাইল টেনে নিয়ে, সায়ন্তি ঘর থেকে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আর মাথা তুললো না।
ওকে একটু বুঝতে দিতে হবে, সব সময় প্রয়োজন মিটে গেলেই এই যে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া এগুলো আর বরদাস্ত করবে না ও, মনে মনে ভাবছিল বাবাই। গত দুদিনে ও খুব আশা করেছিলো, সায়ন্তি একবার হলেও ফোন করবে, অন্তত মেসেজ করবে একটা, বার বার মোবাইল খুলে চেক করেছিলো, আর হতাশ হয়েছে বার বার।
এতো বছর ধরে ওকে কম হেল্প করেনি বাবাই, কত টাকা যে দিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই ওর কাছেই, তখন তাও একটা সম্পর্ক ছিলো, অধিকার বোধ ছিলো হয়তো, কিন্তু এখনও যে কেনো ওর কাছেই বার বার টাকার জন্য ফোন করে ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা।
এতো করে বাবাই, তাও যেনো ও খুশি হয়না একটুও, বিয়ে করতেও চায়না, আবার বাবাই এর জীবন থেকে সরে যেতেও চায়না পুরোপুরি, কিছুতেই স্থিতু হতে দেয় না ওকে, ইচ্ছা হলে কথা বলে, নিজের দরকারে ফোন করে, কিন্তু বাবাই এর দরকারে কাছে আসেনা তখন।
ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছে বাবাই, কোন একটা দিকও যেনো ঠিক করে ধরে রাখতে পারছেনা ও। আসলে বাবাই যে ওকে কোনো ব্যাপারে না বলতে পারবেনা এটা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সায়ন্তি, সেই জন্যই নিজের মত করে ওকে ব্যবহার করে ও, সেটা বোঝে বাবাইও, তাও জেনে বুঝেও ওকে না বলার মত ক্ষমতা নেই ওর।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে,বাবাই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়লো, আজ একটু তাড়াতাড়ি যাবে, দুদিন শরীর খারাপ ছিলো, তাই স্নেহা চিন্তা করবে, ওকে ইদানিং চিন্তায় ফেলতে আর ভালো লাগে না, বেরিয়ে গেটের কাছে এসে দেখলো, সায়ন্তি দাঁড়িয়ে আছে।
তোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছি, অনেক ক্ষোভ জমে আছে তোর, আজকের সন্ধ্যেটা শুধুই তোর জন্য, দুপুরে খাইনি কিছু, কোথাও খাওয়াতে নিয়ে চল আমাকে, থমকে গেলো বাবাই।
ও তো এখন বাড়ি ফিরবে, স্নেহা নিশ্চয়ই রাতের রান্না করেছে, এখন এই ভাবে যাওয়া কি উচিত হবে, ভাবনার মধ্যেই হাত ধরে টানলো সায়ন্তি।
কি রে কি ভাবছিস এতো, চল, খুব খিদে পেয়ে গেছে,
স্নেহার মুখটা একবার ভেসে উঠলো চোখের সামনে, তাও সেটাকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে হাত নেড়ে ডেকে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সির দরজা খুলে সায়ন্তির সঙ্গে উঠে বসলো ও।
দুজনে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলো প্রথমে।
তুই খেতে চেয়েছিলি তো? চল আমার তাড়া আছে, ফিরতে হবে, এখানে বসবো না আর।
কিসের তাড়া? বউ বসে থাকবে তোর জন্যে? একটু বিদ্রুপের স্বরেই বলল সায়ন্তি।
সেতো থাকবেই, তাইনা? এরমধ্যে অবাক হওয়ার কি আছে,
বিদ্রুপ টা একদম না বোঝার ভঙ্গিতে উত্তর দিলো ও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাতটা বেজে গেছে, স্নেহা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে, স্নেহা কে একটা খবর দেওয়া উচিত পকেট থেকে মোবাইল টা বার করলো বাবাই।
বেশ কয়েকবার বাজার পর ফোন টা তুললো স্নেহা,
কি হলো? ফোন ধরছিলে না কেনো?
তুমি কখন আসবে? কেমন যেনো অন্যরকম শোনালো গলাটা! চমকে উঠলো ও।
কিছু হয়েছে তোমার? উদগ্রীব গলায় বললো বাবাই।
নাহ! সেরকম কিছু না, দেরি হবে আসতে? খুব কষ্ট করে কথা বলছে স্নেহা, মনে হলো ওর।
না, এক্ষুনি আসছি, উঠে দাঁড়ালো বাবাই, সায়ন্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো।
কি হলো? বাড়ি চলে যাচ্ছিস তুই? খেতে যাবিনা?
না রে, আজ আর হবেনা, তুই বাড়ি চলে যা, অন্য আরেকদিন যাবো।
স্নেহার কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই, না হলে ওই ভাবে কথা বলতো না , এক্ষুনি ফিরতে হবে ওকে, মোবাইল টা বার করে একটা ক্যাব বুক করলো ও।
আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবি তো? নাকি?
না, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুই অন্য ক্যাব ডেকে নে, বলেই এগিয়ে আসা ক্যাব টার দরজা খুলে উঠে পড়লো বাবাই।
অপমানিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সায়ন্তির মুখটা আর ঘুরে দেখতে চাইলো না ও, এই মুহূর্তে ওর বাড়ি পৌঁছানোটা অনেক বেশি জরুরী।
চলবে
তুমি রবে নীরবে
পর্ব ১৩
রাস্তাটা যেনো ফুরোচ্ছে না আর,
দাদা, একটু তাড়াতাড়ি চালান, ড্রাইভার কে তাড়া দিলো বাবাই।
মন টা ছটফট করছে খুব, স্নেহার গলাটা একদম অন্যরকম লাগছিলো, কথা বলছিলো যেনো খুব কষ্ট করে, কিন্তু কি হয়েছে কিছুতেই বললো না, বড্ড চুপচাপ ছোটো থেকেই, ভীষণ টেনশন হচ্ছে ওর।
কেনো যে আসতে গেলাম, এখন আফসোস হচ্ছিলো, গাড়িটা জ্যামে আটকে পড়েছে, ছুটে নেমে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। ও কি আর একবার স্নেহা কে ফোন করে দেখবে, নাহ! থাক, ও যা চাপা স্বভাবের কিছুই বলবেনা হয়তো।
ভাবনার মধ্যেই বাড়ি এসে গেলো, নেমেই ওপরের দিকে তাকালো বাবাই, ও এক্ষুনি আসবে বললো তাও স্নেহা ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে নেই, এরকম তো হয়নি কখনো, দৌড়ে লিফটে গিয়ে ঢুকলো ও।
বেল বাজানোর পর থেকে স্নেহার আসা পর্যন্ত সময়টা যেনো অনন্তকাল মনে হচ্ছে, ধৈর্য্য হারাচ্ছিলো বাবাই। স্নেহা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো ও। ডান পায়ের নখগুলো থেঁতলে গেছে একদম।
কি করে হলো? পড়ে গেছো নাকি?
হলুদ গোলাপের টব টা পায়ের ওপর পড়ে গেলো বারান্দায় ধাক্কা লেগে, করুন মুখে বললো স্নেহা।
চলো তাড়াতাড়ি, ঘরে না ঢুকেই স্নেহা কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ও, এক্ষুনি হসপিটালের ইমার্জেন্সী তে নিয়ে যেতে হবে।
হাঁটতে পারবে?, ধরো আমাকে, স্নেহার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে, একটা রিকশা ডাকলো বাবাই।
ধরতে হবেনা পারবো আমি, সেরকম কিছু হয় নি, হসপিটালে যাওয়ার দরকার ছিলো না, এমনই ঠিক হয়ে যেত।
আমি ডাক্তার, না তুমি?
বাবাই এর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো স্নেহা, মিছিমিছি চটিয়ে লাভ নেই, কখন আবার রেগে যায় কে জানে, তাই কষ্ট করে হলেও রিকশায় উঠে বসলো ও।
বাড়ি ফিরে সবে ফ্রেশ হয়ে বসেছিলো, ফোন টা বেজে উঠলো, সায়ন্তির নম্বর দেখেই ফোনটা সুইচড অফ করে দিলো বাবাই। এখন ফোন ধরলেই প্রচুর কৈফিয়ত দিতে হবে, খুব টেনশন গেছে স্নেহাকে নিয়ে, এখন একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আর।
স্নেহা চুপ করে বসে আছে সোফায়, ঘর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলো বাবাই, তার কতটা পায়ের ব্যথায় আর কতটা গাছের শোকে, কে জানে। ও গাছ খুব ভালোবাসে, অনেক কষ্ট করে চারাটা নিয়ে এসেছিলো নার্সারি থেকে, অনেকটাই বড়ো হয়েছিলো গাছটা, বাবাই এর নিজেরও খারাপ লাগছিলো।
ওর জন্যে একটা ভালো গোলাপ এনে দিতে হবে মনে মনে ভাবছিল ও। একটা অদ্ভুত গিলটি ফিলিং আসছে ওর, কেনো যে গেলো ও, স্নেহার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না একদম। খুব খারাপ লাগছে এখন, তাও ভাগ্যিস ফোনটা করেছিলো, না হলে তো জানতেই পারতো না, এরকম হটাৎ করে আগে থেকে না বলে কোথাও যাবেনা ঠিক করলো।
রাতে কি কিছু রান্না করতে পারবে স্নেহা, জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবলো বাবাই। ওর খিদে পেয়ে গেছে, বিকেলে তো খেতে গিয়েও কিছু খাওয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত, স্নেহার পায়ের যা অবস্থা, ওর পক্ষে আজ মনে হয় কিছু করা সম্ভব নয়। ও অর্ডার দেবে কিনা ভাবছিলো তখনই স্নেহা খেতে দেবে কিনা জানতে চাইলো।
তুমি রান্না করতে পেরেছো? অবাক হলো বাবাই।
হ্যাঁ, রান্না করেই তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনই তো, কথাটা আর শেষ করলো না স্নেহা, নতুন করে গাছটা মরে যাওয়ার দুঃখটা ফিরে এলো বোধহয়।
তুমি বসো, আমি নিয়ে নিচ্ছি দুজনেরই, রান্না ঘরে ঢুকে গেলো বাবাই।
স্নেহা অবাক হচ্ছিলো, আজ প্রথম দুজনের খাবার বাড়লো বাবাই, একা বসে খেতে ওর খুব খারাপ লাগে, আজ প্রথমবার একসঙ্গে দুজনে খেতে বসেছিলো, খেতে খেতে কোনো কথা না বলেই গম্ভীর মুখে নিজের বাটি থেকে মাংসের মেটে টা ওর পাতে তুলে দিলো বাবাই, চমকে তাকালো স্নেহা, মনে আছে ওর!!
সব খারাপেরই কিছু ভালো দিক আছে বোধহয়, পায়ের ব্যথা আর গোলাপের টব ভেঙে যাওয়ার দুঃখ, দুটোই ক্রমশ ভুলে যাচ্ছে স্নেহা, টবটা ভেঙে ওর পায়ে পড়লো বলেই তো বাবাই এর এই অন্যরকম রূপটা দেখতে পেলো ও।
যে বাবাই কে ছোটো থেকে চিনতো ও, সেই বাবাই কেই যেনো আজকের সন্ধ্যেটায় ফিরে পেয়েছিলো আবার। ছোটো থেকেই মাংসের মেটে ওর খুব প্রিয়, মা বা মামনি আজ পর্যন্ত ওটা ওকে ছাড়া কাউকে দেয়নি কোনোদিনও, বাবাই বা টুয়াও নিজেদের পাতে ভুলবসত কোনোদিনও পড়ে গেলেই ওর পাতে তুলে দিত। আজকে বাবাই এর ওর পাতে মেটে তুলে দেওয়া দেখে বার বার পুরনো দিন গুলোয় ফিরে যাচ্ছিলো স্নেহা।
স্নেহা খুব চমকে গেছে বুঝতেই পারছিল বাবাই। মেটেটা হাতে নিয়েই ওর মনে পড়েছিলো, স্নেহা কতটা ভালোবাসে মেটে খেতে, ওর খুশি মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু কিছুতেই তাকাতে পারলো না ও। সন্ধ্যের পর থেকেই অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরছে ওকে, গত দুদিন ধরে পুষে রাখা রাগটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলো না ও, কেনো যে কিছুতেই কড়া হতে পারছে না ও।
এক একবার করে কড়া হতে চাইছে কিন্তু ঠিক সময়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। সায়ন্তি ওকে মিথ্যে কথা বললো ও বুঝতেই পেরেছিলো সেটা, সকাল থেকে না খেয়ে থাকলে কেউ আর গঙ্গার ঘাটে বসে সময় নষ্ট করেনা, বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে আসবে বলে ভাবছিলো বাবাই, ভালোই হয়েছে তখন স্নেহা কে ফোন করে, এই ঘটনাটা ওকে নিজেকে সংযত করতেও হেল্প করেছে অনেকটাই।
স্নেহার ওই রকম গলা না শুনলে তো ও বসেই থাকতো বোধহয়। নিজের ওপরেই বিরক্তি আসছিলো ক্রমশ, লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখটা বন্ধ করলো ও।
গত দুদিন ধরে ঘটে চলা ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে ক্রমশ, আজ স্নেহার জন্য ওর এত টেনশন হলো কেনো? কেনো এইভাবে ও সব ফেলে দৌড়ে এলো? সবটাই শুধু কর্তব্যের খাতিরে? কর্তব্যের মধ্যে একটা বাধ্যবাধকতা থাকে, কেউ তো ওকে বাধ্য করেনি আসতে, এমনকি যদি ও ফোন না করতো, স্নেহা তো নিজে থেকে জানাতো না কখনও, তাহলে কিসের টানে ছুটে এলো ও, আজ সারাটা পথ যা টেনশন করেছে ও, এত টেনশন ও আজ পর্যন্ত কখনো করেনি।
শুধু মনে হচ্ছিলো বাড়ি গিয়ে ও স্নেহাকে সুস্থ দেখবে তো, যদি স্নেহার সত্যিই খুব খারাপ কিছু হতো, নাহ! আর ভাবতে পারছেনা, নিজের ব্যবহার নিজের কাছেই বড্ড অচেনা ঠেকছে আজকাল।
আর মেয়েটাও বড্ড অদ্ভুত, একবার নিজে থেকে ফোন করে জানাতে পারলো না, ও না আসা পর্যন্ত এই ভাবেই বসে থাকতো, রাস্তায় নেমে আমাকে ধরো বলে ও হাত বাড়িয়ে দিলো, তাও ওকে না ধরেই নিজে নিজেই কষ্ট করে রিকশায় উঠলো, কবে ফুলশয্যার রাতে একদিন রাগের মাথায় কি বলেছে, আমার কাছে আসবে না, সেটাই ধরে বসে আছে আজ পর্যন্ত। এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু স্নেহা আসলে খুব জেদী ছোটো থেকেই, জানে বাবাই।
কম বছর তো ও চেনেনা স্নেহাকে, ও চুপচাপ থাকে সব সময়, কিন্তু নিজের জায়গা থেকে একচুলও সরেনা কোনোদিনও। এতদিন ধরে যখন খারাপ ব্যবহার করেছে, তখনও ও নিজের কাজ করেই গেছে মুখে কোনো কথা না বলেই, এখন যখন ও এগিয়ে আসতে চাইছে, স্নেহা কিন্তু ওর জেদের জায়গা থেকে সরেনা একটুও, নিজের প্রয়োজন হলেও ও বাবাই কে ডাকবেনা, ওকে নিজেকেই বুঝে নিতে হবে সেটা, তাই আজ স্নেহার গলার স্বরেই বুঝে গিয়েছিলো ও, নিয়েই ডিসিশন নিয়ে ছিলো ফেরার, এত জেদও ভালো নয়, কিন্তু স্নেহাকে বলে লাভ নেই কোনো সেটা জানে বাবাই।
মা কে যে স্নেহা কেনো ফোন করেনা, এখন বোঝে ও, মা হয়ত ভাবে স্নেহা খুব ব্যস্ত সংসারে, কিন্তু আসলে যে মায়ের ওপর অভিমান জমে আছে সেটা ও বুঝতে দিতে চায়না, এগুলোই ওর জেদের প্রকাশ। এগুলো এখন বুঝে গেছে বাবাই, ওর খুশি, ওর দুঃখ, ওর এক্সপ্রেশন দেখেই বোঝা যায়, সেই এক্সপ্রেশানগুলো ও এখন বুঝতে পারে, না হলে মুখে তো বেশি কথা বলেনা খুব একটা।
সেদিন যখন ওকে হসপিটালে যেতে বারণ করলো, তখন না গেলেই ভালো হতোর বাইরে একটাও কোনো এক্সট্রা কথা বললো না। যদি বাবাই না শুনতো, তাও ও চুপ করেই থাকতো, কিন্তু আর অনুরোধ করতো না, এটাও একটা অন্যরকমের জেদ, ঝগড়া করলে তার সাথে ঝগড়া করা যায়, কিন্তু চুপ থেকে জেদ দেখালে, সেই জেদ বুঝে নেওয়া খুব কঠিন, এত কিছু নিজে থেকে বুঝে নিতে পারবেনা ও, মনে মনে রাগ হচ্ছে এবার।
ওকি এবার স্নেহার অসুবিধাগুলো নিজের কাজকর্ম ছেড়ে বাড়িতে বসে বোঝার চেষ্টা করবে নাকি সব সময়!! নিজে থেকে কিছু অন্তত বলবে তো, আজ যদি ও না আসতো নিজে থেকে বুঝে তাহলে? বেশ একটা অভিমান হচ্ছে এখন স্নেহার ওপর, ও একবারও ডাকতে পারলো না আমাকে!!
চলবে