তার শহরের মায়া 😍,পার্ট_২০,২১

তার শহরের মায়া 😍,পার্ট_২০,২১
Writer_Liza_moni
পার্ট_২০

এখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চললো। কিছুক্ষণ আগেই অনু, তূর্য, মাহির আর তনু এসে পৌঁছেছে তাদের বাবার বাড়িতে।বউ ভাতের ঝামেলা চুকে গেলে নতুন বর বউ কে তাদের বাড়িতে নিতে চায় অনুর বাবা। সাথে তনু কে ও। মেয়েটা যে কয়েক মাস আগে বাড়িতে গিয়েছিল আর যায়নি।তাই দুই মেয়ের জামাই সহ তাদের নিয়ে আসেন অনুর মা বাবা।

তূর্য অনুর রুমে এসে ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো।অনু ওয়াস রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো

শুনুন মিস্টার খাম্বা,
এই টা আমার রুম। আমার বিছানা।তাই ফ্রেশ না হয়ে আমার বিছানায় শোয়া যাবে না।

তূর্য চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।অনুর কথায় এক চোখ মেলে বললো সিরিয়াসলি আমাকে খাম্বার মতো দেখতে লাগে?

লাগে বলেই তো খাম্বা বলে ডাকলাম।
মাত্র ৬ ফুট ১ ইঞ্চি আমি আর তুমি আমাকে এই ভাবে বলতেছো?

ঠিকই তো বললাম ।ভুল বলি নাই তো!
এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে আসেন তারপর আপনার যত ইচ্ছা ততক্ষণ শুয়ে থাকেন। আমি কিচ্ছু বলবো না ।তার আগে আমার বিছানায় আপনার কোন জায়গা নাই।

তুর্য মুখটাকে ছোট বাচ্চাদের মত করে বিছানা থেকে উঠে বসলো। অনু ব্যাগ থেকে তূর্যর জন্য একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার বের করে ওর হাতে দিল। পাঞ্জাবীটা বদলে ফেলেন।

তুর্য অনুর হাত থেকে টি শার্ট আর ট্রাউজারটা নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল ফ্রেস হতে।

অনু বিছানায় বসে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। অনেক ক্লান্ত লাগছে তার। চারদিক থেকে আজানের ধনি ভেসে আসছে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর তুর্য ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলে অনু তার উদ্দেশ্যে বললো
নতুন জামাই নামাজ না পড়লে কিন্তু হবে না নামাজ পড়তে যান।
আমি না আজ একটু বেশিই ক্লান্ত। নামাজ টা রুমে পড়ি এখন? মসজিদে কাল সকাল থেকে যাই?

আচ্ছা ঠিক আছে ।আমি তাহলে নামাজের ওযুটা করে আসি একসাথে পড়ে নিব।

হুম।
অনু ওযু করে বের হলে তূর্য আবার ও গেল ওয়াস রুমে। নামাজের ওযু করতে।অনুর রুমে শুধু মাত্র একটা জায়নামাজ আছে।তাই অনু মায়ের কাছে চলে গেল আরেকটা জায়নামাজ আনার জন্য।

মায়ের কাছ থেকে জায়নামাজ নিয়ে আসার সময় মাহিরে সাথে চোখাচোখি হয় অনুর। তনু কে ডাকার জন্য বের হয়েছিল।
অনু মাহির কে দেখে বিড় বিড় করে বললো
নামাজের ওযু করার পর শয়তান কে দেখলে নামাজ হবে তো?

অনু রুমে এসে দেখে তূর্য নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে।অনু তূর্য থেকে কিছুটা পেছনে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।

নামাজ পড়ার পর অনু জায়নামাজ গুলো গুছিয়ে ওয়ারড্রব এর উপরে রাখলো।ড্রইং রুম থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে অনু সেদিকে চলে গেল।

মাহির বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছে। এমন সময় what’s up এ একটা মেসেজ আসে।তুর্য মেসেজটা সীন করে দেখে মাহির টেক্সট দিয়েছে।

তূর্য বাহিরে যাবি ঘুরে আসি চল বাড়িতে কেমন বোরিং লাগতেছে। তূর্য যাবে বলে জানিয়ে দিল।

তূর্য রুম থেকে বের হয়ে ড্রইং রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। কিছু বয়স্ক মহিলা বসে আছেন।অনু আর তনু তাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।

তূর্য কে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বলে উঠলো
এই তো আমার ছোট নাতনির জামাই। এদিকে আসো দাদু ভাই।

তূর্য মুচকি হেসে সবাই কে সালাম দিলো। তার পর গিয়ে মহিলার পাশে বসলো।

বয়স্ক মহিলাটি তূর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন মাশাল্লাহ অনুর জামাই টা তো অনেক সুন্দর। তোদের দুজনকে খুব মানিয়েছে বোন ।সারা জীবন একসাথে থাকিস এই দোয়াই করি।

মাহির সে সময় ড্রইং রুমে আসে।সবাই কে সালাম দিয়ে তনুর পাশে গিয়ে বসলো।

আমার দুই নাতনির জামাই গুলো দেখতে মাশাআল্লাহ।সুখে থাক তোরা সারা জীবন। তূর্যর পাশে অনু কে বসিয়ে দিল অনুর কাকি।

মাহির তূর্য আর অনুর দিকেই তাকিয়ে আছে। তূর্য অনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো একটু বাহিরে যেতাম।

আমি কী করবো?

বুঝেন না? একটু এখান থেকে উঠার ব্যবস্থা করে দিন।

দাদু তোমাদের জামাই বাবুরা একটু বাহিরে যাবেন। এখন ওদের কে ছাড় দাও।

যাও নাত জামাই। ঘুরে আসো। তূর্য আর মাহির উঠে চলে গেল।

তূর্য বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর পর অনু ওকে কল দিচ্ছে। ইচ্ছে করেই এমন করছে অনু।যেন মাহির জ্বলে। মাহির যেন বুঝতে পারে তার দেওয়া আঘাতে সে ভেঙ্গে পড়েনি।বরং তূর্য কে পেয়ে সে অনেক হ্যাপি।

অনু তূর্যকে কল দেওয়ার পর তুর্য ফোন রিসিভ করে বলে আমাকে ছাড়া কি ঘুম আসছে না এতবার কল দিচ্ছ কেন?

শুনেন আপনাকে কল দেওয়ার জন্য আমার বয়েই গেছে। বলছিলাম কি আমার খুব ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে ।আসার সময় আমার জন্য বোম্বাই মরিচের ফুচকা গুলো নিয়ে আসবেন। যদি না আনছেন তাহলে আপনার একদিন কি আমার একদিন দেখে নিয়েন।

ছোটখাটো একটা ধমক দিলা তাই না ?আমি বাসায় আসি তোমার এই ধমকের প্রতিশোধ আমি নিবো শুধু দেখো কি করি।

যা বলছি তাই করেন এত কথা বলিয়েন না তো।
বলেই অনু কল কেটে দিল।

পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই অনু আবার ও তূর্য কে কল দিলো। তূর্য তখন মাহিরের সাথে টং এর দোকানে বসে চা খাচ্ছিল আর কিছু কথা বলছিল।তূর্যর ফোন বেজে ওঠে তুর্য ফোনের স্ক্রিনে অনুর নাম্বার দেখে মনে মনে খুব হাসল ।মেয়েটা যে তাকে এতবার কেন কল দিচ্ছে সেটা আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক তুর্য ঠিকি বুঝতে পারছে।

তূর্য কল রিসিভ করে বললো কি ম্যাডাম আজকে আমার কথা এত মনে পড়ছে কেন?

এই শুনেন আপনার কথা মনে পরার কোন কারণ আছে? আমার দরকার পড়ছে তার জন্য আমি আপনাকে কল দিছি। এত কথা শোনান কেন হ্যাঁ? তখন একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম ।আমার জন্য আসার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবেন। ঝাল খেলে আবার পরে আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে ।তখন আমি আইস্ক্রিম কই থেকে পাবো?তাই একসাথে আসার সময় নিয়ে আসবেন।
মনে থাকবে তো? ভুলে গেলে কিন্তু আজকে বাড়িতে জায়গা দেবো না।

তুর্য মুচকি হেসে বলল হ্যাঁ গো মেঘুপাখি,অবশ্যই মনে থাকবে ।তুমি বলছো মনে না থেকে কী পারে?
মাহির চুপ করে তূর্যর কথা শুনছে।চা খাচ্ছে না।অনু কল কেটে দিল।

কীরে ভাই চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো খা?

মাহির তূর্যর কথায় হকচকিয়ে গেল। তার পর চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে বললো খাবো না। ইচ্ছে করছে না।

তূর্য মনে মনে খুব হাসলো।অনুর কথায় আর মাহিরের মুখের ভঙ্গিমা দেখে।চা শেষ করে উঠে বললো মেঘুপাখির জন্য ফুচকা আর চকলেট নিয়ে যেতে হবে।

মাহির ভ্রু কুঁচকে বললো
মেঘুপাখিটা আবার কে?

আমার একটা মাত্র আদরের বউ।অনুমেঘা।তাই আমি ওকে মেঘুপাখি বলেই ডাকি।

ওহ।

তূর্যর ডাকা মেঘুপাখি নামটা শুনে অনুর বুকের মাঝে ধক করে উঠল।অনু হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নিজের মনেই বিড় বিড় করলো নামটা।মেঘুপাখি,,,

নামটা অনুর মন ছুঁয়ে গেল।
.
.
তূর্য সবার জন্য ফুচকা আর আইস্ক্রিম কিনে নিয়ে আসলো। মাহির তনুর জন্য একটা চকলেট কিনে আনলো।

অনু কে ড্রইং রুমের সোফায় বসে থাকতে দেখে তূর্য মুচকি হেসে অনুর হাতে ফুচকা আর আইস্ক্রিম ধরিয়ে দিয়ে কানে কানে বললো এতো বার করে বলেছে আমার বউটা আমি না এনে পারি?

অনু কিছু বললো না। রান্না ঘরে গিয়ে প্লেটে সব গুলো ফুচকা সাজিয়ে নিয়ে আবার ড্রইং রুমে আসলো। বড়রা যেহেতু এত ঝাল খেতে পারবে না তাই অনুর মা তাদের জন্য চা বানিয়ে আনলেন।

অনু ঝাল ঝাল ফুচকা খেয়ে এখন হা হু করছে। তূর্য অনুর হাতে আইস্ক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বললো আর একটু ঝাল দিবো ফুচকায়?

অসভ্য লোক।অনুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।অনু রুমে চলে গেল।ওয়াস রুমে গিয়ে বমি করে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
তূর্য অনুর পাশে এসে বসে অনুর হাত ধরে বললো

বেশি খারাপ লাগছে?ডাক্তার আনবো?

আরে না। আমি একটু বেশিই ঝাল খেয়ে ফেলেছি।
মাহিরের দিকে তাকিয়ে অনু ফুচকায় ঝাল বেশি দিয়ে ফুচকা টাকে মাহির ভেবে ইচ্ছে মতো চিবিয়ে খেয়েছিল। শয়তান কে খাইলে কি আর হজম হবে? এই জন্যই অনু বমি করেছে।
.
.
সবাই ঘুমিয়ে আছে।অনুর ঘুম আসছে না। বিছানা থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহিরে সবাইকে সে যতটা হাসি খুশি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে ভেতরে কিন্তু সে এতটা হাসি খুশি নেই। মাহির কে যতবার দেখে ততবারই তার অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে সে।

তূর্য ও ঘুমায়নি।পাশ ফিরে অনু কে না পেয়ে উঠে বেলকনিতে যায়।অনু কে উদাসীন ভাবে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো

ঘুমাও নি কেন?

অনু ভাবলেশহীন ভাবে তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো যারা ঠকায়,যারা স্বার্থপর দিন শেষে তারাই ভালো থাকে তাই না?

কে বলেছে? সময়ের ব্যবধানে কোনো না কোনো সময় তারা তাদের কর্মের ফল ঠিক পায়।ভালো কাজের ফল ভালো আর খারাপ কাজের ফল খারাপ। মানুষ ক্ষমা করে দিলে ও প্রকৃতি কিন্তু তাদের ক্ষমা করে না।

আপনি জানেন আমার ভালোবাসার মানুষটি কে? গতকাল রাতে তো বলতে দেন নি।আজ শুনবেন তার কথা?মে মানুষটা আমাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে সেই মানুষটির কথা। শুনবেন?

তূর্য মুচকি হেসে অনুর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো
আমি জানি সে কে। তার সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক ছিল।সে তোমাকে ঠকিয়েছে।সব কথাই আমি জানি।

অনু অবাক হলো। আপনি সত্যি জানেন?

হুম। মাহির তোমাকে ঠকিয়েছে বাজি ধরে।তার জন্য আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না।

অনু মলিন কন্ঠে বললো বার বার আঘাত পেতে চাই না। বিশ্বাস করতে এখন খুব ভয় করে। এখন কেউ বিশ্বাসের মূল্য দিতে পারে না।

কাচ যে ভাঙ্গে তার কোনো ক্ষতি হয় না।যে জোরা দিতে যায় সেই কাঁচের টুকরোতে হাত কেটে রক্ত খরন হয়।

অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?

তুমি আমার লিগেল ওয়াইফ।তার উপর আমার ছোট।তাই তুমি করেই বলবো।

আমি চাকরি করতে চাই। নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে চাই।

তূর্য মুচকি হেসে বললো আমার বউ হয়েছো বলে কী আমি তোমার স্বপ্ন পূরণে বাধা দিবো?এমন হাসবেন্ড আমি না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে আসো। এতো দিন নিজের ইচ্ছায় অনেক রাত জাগছো। এখন থেকে তোমার আর রাত জাগা হবে না। ঘুমাতে আসো।

অনু তূর্যকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে।

চলবে,,, 🍁

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_২১
#Writer_Liza_moni

তুর্য ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবারও অনুর দিকে ফিরল। অনুর উদ্দেশ্যে বললো
মেঘুপাখি আরেকবার বিশ্বাস করতে পারো কাউকে। কথা দিচ্ছি কোনদিনও কষ্ট দিব না তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা কখনোই করব না।

অনু তুর্যের চোখে চোখ রেখে বলল
ভীষণ ভয় হয় যে, কাছের মানুষগুলোকে বদলে যেতে দেখেছি। বন্ধু-বান্ধব যে মানুষগুলো খুব কাছের হয় তাদেরকে দেখেছি স্বার্থের জন্য ঠকাতে। মাসের পর মাস বছরের পর বছর দিনের-পর-দিন কত সুন্দর নিখুঁত অভিনয় করেছে তারা ।তাদের জন্য যে অন্যদের বিশ্বাস করতে ভীষণ ভয় করে ।তবে যদি মন চায় কথা দিচ্ছি আর একবার না হয় কাউকে বিশ্বাস করবো ।যদি সেই মানুষটা সঠিক হয় তাহলে তার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে দিব।

ঘুমাতে আসো। আর রাত জেগো না। শরীর খারাপ করবে ।কিছু মানুষ জীবনে আঘাত দেওয়ার জন্য আসে। আর সেই আঘাতই আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে।যদি সে আঘাত আমরা না পেতাম তাহলে জিবনে মানুষ চিনতে শিখতে পারতাম না। আমাদের কাছের বন্ধুবান্ধব আমাদের ভালোবাসার মানুষ ওরাই তো আমাদের আঘাত দিয়ে থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য। ধন্যবাদ দাও তাদের যাদের জন্য তুমি আজ এত শক্ত করে নিজেকে গড়ে নিয়েছো।আপন মানুষদের কাছ থেকে যদি আঘাত না পেতাম তাহলে আমাদের জীবনটা জীবনী হত না। আঘাত ছাড়া জীবন কে কি জীবন বলে?

আপনি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।

অনুর কথায় তুর্য মুচকি হাসলো।
আসলে পরিস্থিতি আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে এই সমাজে বাঁচতে হয় ?কিভাবে এই মানুষগুলো এই পরিস্থিতি এই ধরেন কিছু খারাপ সময় শিখিয়েছে কিভাবে জীবন গড়তে হয়?

অনুর মনে সেই কখন থেকে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো তুর্য কিভাবে মাহিরের কথাটা জানে ?তাই অনু তূর্য কে বলল একটা কথা বলব?

তূর্য মুচকি হেসে বলল হ্যাঁ অবশ্যই একটা কেনো একশটা বলবেন কোন মানা নেই।

আমার আর মাহির সম্পর্কের কথা কি মাহির নিজে আপনাকে বলেছে?

না ও বলেনি। ও চেয়েছিল সবার কাছ থেকে কথাগুলো আড়াল করে রাখতে ।অতীত গুলো কে ঢেকে রাখতে চেয়েছিল।

তাহলে আপনি কিভাবে জানেন আমাদের সম্পর্কের কথা ?ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল অনু।

আসলে যেদিন মাহিরের বাসর রাত ছিল সেদিন তুমি আমাদের বাড়ির ছাদে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছিলে কান্না করতে করতে ।চিৎকার করে বলেছিলে মাহিরের কথা। আমি ছাদে ছিলাম। তোমার মতই আমার অতিরিক্ত মানুষের ভিড় পছন্দ না। কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই আমি ছাদে চলে গিয়েছিলাম খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির বয়ে আনা ঠান্ডা বাতাস খাওয়ার জন্য । অন্ধকারে ঢাকা ছিল ছাদ।তাই তুমি আমাকে দেখতে পাওনি ।আমিও প্রথমে তোমাকে দেখিনি। হঠাৎ তোমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনে কে দেখার জন্য সে দিকে
যেতেই মাহির কথা শুনে থমকে যাই। মাহির মে এত নিচু মন মানসিকতার মানুষ আমি সেদিন জেনে ছিলাম।
তার পরের দিন তুমি যখন ছাদে মাহির কে ডেকে পাঠিয়েছিলে আমি দরজার আড়াল থেকে তোমাদের কথা শুনে ছিলাম।যদি ও এটা ভালো দেখায় না। কিন্তু আমি তো সিআইডি তাই রহস্য উন্মোচন করতে ভালোই লাগে।

অনু কী বলবে খুঁজে পেলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।মাঝে বালিশ দিয়ে বর্ডার দিয়েছে। মানুষকে উপর থেকে দেখতে অনেক টা মাকাল ফলের মত লাগে।উপরে কত সুন্দর।আর ভেতরে মাকাল ফলের চেয়ে বিশ্রী।কে জানে হয়তো তূর্য ও মাহিরের মত।বলা তো যায় না।একই রক্ত তাদের।

প্রথম প্রথম তো মাহির কতই না ভালো মানুষের মুখোশ পরে ছিল।তিন বছরে একটু ও ক্ষয় হয় নি সেই মুখোশের।আর কাছের বন্ধু বান্ধব গুলো ও কী এক অদ্ভুত উপায়ে ঠকালো।ঠকেছি যে সে ঘা টা ও তো এখন ও শুকায়নি। তাহলে আমি নতুন করে কী ভাবে অন্য কাউকে বিশ্বাস করবো?যদি শেষ মেষ সে ও ঠকায়? জীবন বড় অদ্ভুত।

মাহির এসে অনুর এক পাশে শুয়ে পড়লো। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার। কিছুক্ষণ পরেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো দুজন।
.
.
হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে দরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মাহির। গা থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে।মাথার উপরে ফ্যান চলছে ফুল পাওয়ারে।
পাশ ফিরে তনু কে দেখে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।
তনু মাহির কে ছেড়ে চলে গিয়েছে।সারা জীবনের জন্য। এমন একটা স্বপ্ন দেখে মাহিরের হার্ট বিট অনেক টা বেরে গেছে। বিছানা থেকে নেমে টেবিলের উপরে রাখা জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে ডগডগ করে খেয়ে নিল।

তনুর পাশে এসে বসলো।তনু শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মাহির তনুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বললো আমাকে ক্ষমা করো তনু। আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমি তোমাকে ছাড়া একা মুহূর্ত ও থাকতে পারবো না। খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। আমি জানি না অনুর জন্য আমার কেন কোনো ফিলিংস আসে নি? আমি সত্যিই জানি না। শুধু ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো।কী থেকে কী হয়ে গেল আমি বুঝতে পারলাম না।
সারা রাত আর মাহিরের দুই চোখের পাতা এক হয় নি।
.
.
প্রতিদিনকার মত ফজরের আজানের ধ্বনিতে অনুর ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ঘুম চোখে শোয়া থেকে উঠে বসলো।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো তূর্য ঘুমিয়ে আছে। তূর্যর ঘুমন্ত মুখ দেখে অনুর কেমন জানি এক অন্যরকম অনুভুতি মনে দোলা দিয়ে গেলো।কী সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে। মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকে ফেলছে। আবার শান্ত হয়ে পড়ছে।অনু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না। উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ওযু করে এসে ফজরের নামাজ পড়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমাচ্ছে।

অনু বিড় বিড় করে বললো
লোকটা এখনো ঘুমিয়ে আছে আযান দিয়েছে সে খবর নেই।

তুর্য ডাকতে গিয়ে মনে পড়লো কাল রাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে। এখন যখন ঘুমাচ্ছে ঘুমোক।

অনু রুম থেকে বের হয়ে আসার সময় আবার কী ভেবে যেনো পেছনে ফিরে তূর্য কে ডাকতে লাগলো।

এই যে শুনছেন উঠুন। ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। নামাজ পড়ে আবার ঘুমাইয়েন। কিচ্ছু বলবো না। নামাজ না পরলে মনে আল্লাহ তায়ালার ভয় থাকবে না।আর মানুষকে কষ্ট দিতে বা কোনো খারাপ কাজ করতে ও ভয় হবে না। আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করুন। তিনি সব দেখছেন। একদিন তিনি সব পাপের শাস্তি দিবেন। তখন কিন্তু কেঁদে ও কুল কিনারা পাবেন না।

তূর্য ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো
উঠতেছি। আমি নামাজ কাজা করতে চাই না।আর এমন বউ পাওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কয়জন বউ আছে এমন?

এত কথা বলিয়েন না উঠে নামাজ পড়ে নিন।
তূর্য উঠে ওয়াস রুমে চলে গেল।অনু রুম থেকে বের হলো না। বেলকনিতে চলে গেল সকালের বিশুদ্ধ পাহাড়ি বাতাস অনুভব করতে।

তূর্য ওযু করে এসে ফজরের নামাজ পড়ে নিলো।অনু কে রুমে দেখতে না পেয়ে বেলকনিতে গেলো।

আমার একটা ইচ্ছে আছে পূরন করবেন? নির্দ্বিধায় বলল অনু।

তুর্য মুচকি হেসে বলল অবশ্যই পূরণ করবো। বলো কী ইচ্ছে?

এই সকালের সুন্দর আবহাওয়ায় পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে যাবেন? খুব ইচ্ছে করছে।

তূর্য মুখটা কে মলিন করে বললো ঘুম পাচ্ছে যে?

ওহ আচ্ছা তাহলে আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

অনুর কথায় তুর্য মুচকি হাসলো। তূর্য অনুর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তূর্য কে এত কাছে দেখে অনু চোখ বড় বড় করে তাকালো।

তূর্য অনুর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনুর উদ্দেশ্যে বললো আমার মেঘুপাখি আমাকে তার একটা ইচ্ছের কথা জানিয়েছে আমি কী তা পূরণ না করে পারি?

অনু হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো আপনার তো ঘুম পাচ্ছে।যান গিয়ে ঘুমান।

তূর্য মুচকি হেসে অনুর হাত টা আরেকটু চেপে ধরে বললো ঘুম তো আমার সেই কখন চলে গেছে। আমি তো শুধু মজা করে বলে ছিলাম। বলেই তূর্য অনুর মুখে একটা ফুঁ দিল।

অনু চোখ বন্ধ করে নিল। কেমন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেছে তার শরীরের প্রতিটি শিরায়।

.
অনু আর তূর্য বের হলো আশে পাশে হাঁটার জন্য। মাহিরের ঘুম না আসায় মাহির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। নিচে অনু আর তূর্য কে হাঁটতে যেতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাতের স্বপ্ন টা দেখে মাহিরের মনে অশান্তি বাসা বেঁধেছে। কোনো কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা সে।

তনু ঘুম থেকে উঠে বিছানায় মাহির কে না পেয়ে কয়েক বার ডাক দিল। মাহির বেলকনি থেকে রুমে এসে তনুর উদ্দেশ্যে বললো
আমাকে কোনো দিন ছেড়ে যে ও না তনু। তাহলে আমি মরে যাবো।

হঠাৎ মাহিরের এমন কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝলো না তনু। ঘুম থেকে উঠে কী বকছো এই সব? মাথা ঠিক আছে? কেন যাবো আমি তোমাকে ছেড়ে?

মাহির তনু কে জড়িয়ে ধরে বললো দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম।তাই ভয় হচ্ছে।তনু মুচকি হেসে মাহিরের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো যাবো না কোনো দিন।

.
পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছে অনু আর তূর্য। চাকমা সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মাথায় কলার ঝুড়ি নিয়ে বাজারে দিকে যাচ্ছে।

কোথা থেকে একটা চাকমা মেয়ে এসে অনু কে জড়িয়ে ধরলো।অনু ও মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো
আমাকে তো ভুলেই গেছো।

তোমাকে কী করে ভুলি আপু। শুনলাম তুমি বিয়ে করে নিয়েছো?

হুম। ঠিক শুনেছো। মেয়েটা গলা উঁচু করে অনুর পেছনে তাকিয়ে বললো ওনি আমাদের জিজু হয় বুঝি?

তূর্য মুচকি হেসে বললো হুম। আপনার এই আপুর একটা মাত্র আদরের জামাই।

অনেক সুন্দর। আচ্ছা আমি আসি। বাজারে মা অপেক্ষা করছে। দুজন কে খুব মানিয়েছে। শোনো অনু আজ সন্ধ্যায় তোমার বাড়িতে যাবো। মেয়েটা চলে গেল।

অনু কে কিছু বলার সুযোগ দিল না।
তূর্য অনুর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো
এই মেয়েটাকে দেখতে অনেকটা বাঙালি আর অনেক টা চাকমার মতো লাগলো কেন?

ওর মা চাকমা।বাবা বাঙালি।তাই দেখতে এমন হয়েছে।

ভালোবেসে বিয়ে করেছেন ওনারা?

মেয়েটা তো তাই বলে ছিল।

মেঘুপাখি তোমার ইচ্ছে তো আমি পূরণ করলাম। আমার একটা ইচ্ছে কী এখন তুমি পূরণ করবে?

অনু হাটা থামিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে বললো
কী ইচ্ছে?

সামনের ঐ টং এর দোকান থেকে এক কাপ চা খাবেন আমার সাথে?

অনু ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো
খাওয়া যায়।

তূর্য খুশি হলো।আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দুজনে বেঞ্চে বসলো।এত সকালে দোকান টা খোলা দেখে অবাক হলো অনু।

দোকানদার কে জিজ্ঞেস করল
আজ এত সকালে দোকান খুলেছেন কেন?কোনো উৎসব আছে?

লোকটি দাঁত কেলিয়ে বললো আজ চাকমা, মারমা এদের একটা নৃত্য অনুষ্ঠান হবে।আর আজ তো বাজার বার।তাই এত সকালে দোকান খুলেছি।

আজ যে বাজার তা অনুর একদম মাথায় ছিল না।অনু তূর্যর উদ্দেশ্যে বললো
শুনুন আজকে আপনি আর দুলাভাই মিলে বাজার করবেন। বাবার বুকের ব্যাথা বেরেছে। রাতে মা বলে ছিল।

আচ্ছা করবো। সমস্যা নাই।

তার পর তূর্য আর অনু গরম গরম চা শেষ করে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বাড়িতে এসে দেখে তনু আর মা মিলে নাস্তা বানাচ্ছে।অনু ও তাদের কাছে চলে গেল। সাহায্য করার জন্য।

তূর্য সোফায় বসে মোবাইলে গেমস খেলতে শুরু করলো।
.
অনু কে দেখে তনু দুষ্টুমি করে অনুর কানে কানে বললো
আমার দেবরের সাথে রোমান্স করতে বাহিরে গিয়ে ছিলি রুমে জায়গা ছিল না?

শুন আপু কোনো রোমান্স টোমান্স করতে যাইনি। এমনিতেই হাঁটতে গিয়েছিলাম।

বুঝি,বুঝি।

দুই বোন কী ফিস ফিস করিস?

না মা কিছুনা।
.
নাস্তা করে দুই জামাই চলে গেল বাজার করতে। মাহির কে দেখে তূর্য কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল।তিন চার দিন ঘুমায় নাই বলেই মাহির কে কেমন গান্জা খোর গান্জা খোর লাগছে তূর্যর কাছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। মুখটা আর ও বেশি শুকিয়ে গেছে।

বাজার থেকে আসার সময় তূর্য মাহিরের উদ্দেশ্যে বললো
তোর এই হাল কেন?

আমার আবার কী হয়েছে?

আমি সেটা তোকে জিজ্ঞেস করছি।কী হয়েছে তোর ?

না কিছু না। আমার আবার কী হবে?

না হলেই ভালো।
.
.
সন্ধ্যার দিকে সেই মেয়েটা সহ আরো কিছু চাকমা মেয়ে অনুদের বাড়িতে আসে।অনুর মায়ের কাছে আবদার করে বসে
অনু , তূর্য আর মাহির ,তনু কে নিয়ে তাদের আয়োজিত নৃত্য অনুষ্ঠানে যাবে।

অনেক বলার পর সবাই রাজি হয়। ওদের চার জন কে নিয়ে যা তারা।

অনুষ্ঠানের ওখানে অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।তার দিকে মশালের আগুনের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে।

চাকমা মেয়েটার নাম
মিহিলাচিং।

সে অনু আর তনু কে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দিয়ে গিয়ে বললো
আজ একটু চাকমা সাজো। আমাদের মাঝে মিলিয়ে যাও।

তনু আর অনু মুচকি হেসে তৈরি হয়ে নিল।
অনু চাকমাদের পোশাক পড়ে বের হয়ে আসে। চুল গুলো ও তাদের মত করেই বাঁধে।

তূর্যর চোখ অনুর দিকে পড়তেই তূর্য তার হার্ট বিট কয়েকটা মিস করলো। চাকমা পোশাকে, চাকমা লুকে অনুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।

তনু ও বের হয়ে আসে।
মাহির তনুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
বাঙালি কে কী আর চাকমা লুকে এতো মানায়?

অনুকে দেখেছো? মাশাআল্লাহ। আমার বোনকে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগছে। তূর্য কী করে তাকিয়ে আছে দেখো।
মাহির অনুর দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। সত্যি অনু কে অনেক সুন্দর লাগছে।

ঠিক যেন কোনো এক পাহাড়ি কন্যা।

চলবে,,, 🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here