তরঙ্গিনী পর্ব-১৬ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী পর্ব-১৬

#আরশিয়া_জান্নাত

ভালোবাসা খুব সুন্দর একটা অনুভূতির নাম। এর সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেকরকম হলেও অনুভূতিটা সবার একই সুতোয় গাঁথা। আরাফ রেবার মনে নিজের ভালোবাসার বীজ রোপন করে যত্নে পরিচর্যা করেছে। তাই রেবাও আরাফের রঙে রঙিন হয়ে আলোড়িত করছে চারপাশ। তার হৃদয়ের জমিনে জলছাপ হয়ে সবুজের সমারোহ গড়ে তুলেছে। সেখানে ফুলের সৌরভে সুরভিত হয়ে একঝাঁক প্রজাপতি উড়তে থাকে। আরাফ অনুভব করে; তীব্রভাবেই অনুভব করে কেন আদম আঃ পার্থিব সকল সুখ পেয়েও অসুখী ছিলেন, কেন ছিল তার এতো উদাসীনতা। নারীদের আল্লাহ সৃষ্টিই করেছেন পুরুষের পরিতৃপ্ততার আধার হিসেবে। পুরুষের রুক্ষ অন্তরে জীবনী দান করার তরঙ্গিনী হিসেবে। হ্যাঁ রেবা তার তরঙ্গিনী। যার প্রতিটি চরণে তার মনে কামিনী ফোঁটে, তার কোমল স্পর্শে সকল ক্লান্তি ক্লেশ ঘুচে যায়।
রেবা খুব ভালো মনের মেয়ে। শান্ত নদীর মতোই তার বিচরণ। নিরবে যখন আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় তার অলঙ্কারের মৃদু শব্দে আরাফের মন ভালো হয়ে যায়, প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

রেবা!

জ্বি

ভালো আছেন এখানে?

বেশ আছি।

শুধুই বেশ?

নাহ।

রেবা?

হুম

আমার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগছে?

হ্যাঁ।

সবসময় এমন হু হা কেন? একটু বিস্তারিত বলা যায় না?

রেবা সবজি কাটা রেখে বলল, এই নিয়ে কয়বার কিচেনে এসে এইসব জিজ্ঞাসা করেছেন বলুন তো? আর কোনো কাজ নেই?

আমার ছুটির দিনে আপনি সারাদিন কিচেনে থাকবেন কেন?

সারাদিন কোথায়? দুপুরের রান্নাটা করতে এসেছি কেবল। আপনি আচ্ছা মানুষ তো!

আমিও আপনাকে হেল্প করি?

নাহ।

কেন?

আপনি কিচেনে থাকলে আজকে দুপুরে আর খাওয়া লাগবে না।

এমন বলেন কেন? আপনি কত লাকি ভাবুন, আপনার বর আপনাকে হেল্প করতে চায়।

জ্বি জ্বি আমি ভীষণ লাকি। এমন হেল্প করে আমার বর কি বলবো,

কি করেছি আমি?

নিজেই ভাবুন না!

আরাফ রেবাকে পেছন থেকে জড়িয়ে আদুরে গলায় বলল, আমার দোষ ছিল না সেটা। আপনার আশেপাশে থাকলেই আমার জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায়। নয়তো আমার রান্না যে খেয়েছে সেই বলেছে হাত বাধাই করে রাখার মতো রান্না করি!

হ্যাঁ জনাব তাই তো, একদম হাত বাধাই করে রাখার মতো রাঁধেন আপনি। হাহা

আরাফ নিবিড় হয়ে রেবার আঁচল গলিয়ে তার কোমল পেটে আলতো করে ছুঁয়ে বললো, এমন ঝনঝন করে হাসতে হয় আপনার?
রেবা হাসি থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। আরাফের হাতের অবাধ্য বিচরণে শিহরিত হয়ে চোখ বন্ধ করে তার বুকে হেলান দিতেই আরাফ তার কাধে গলায় নাক ঘষে গভীর চুমু আঁকতে লাগলো। অনুনয়ের দৃষ্টিতে গাঢ় গলায় বলল, অনেক ভালোবাসি।
রেবার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাধ্যি রেবার নেই। এই মাতাল করা কন্ঠের আকুলভরা আহ্বান এড়ানো অসম্ভব। রেবা আবেগাপ্লুত হয়ে আরাফের বুকে মুখ লুকালো। আরাফ রেবার চিবুক তুলে কম্পিত অধর দখলে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে পেয়ে আলগোছে চুলা অফ করে রেবাকে কোলে তুলে নিলো। রেবা তার গলা জড়িয়ে অবনত চোখে লজ্জায় চিবুক নামিয়ে রাখে।
আরাফ তাকে বিছানায় শুইয়ে ধীর গলায় বলে, রেবা আপনার এই লাজুকতা একদম বুকে বিঁধে জানেন!

রেবা তার কলার চেপে কাছে টেনে বলে, আর আপনি যে আমায় দমবন্ধ করা টাইপ আদরে ভাসিয়ে নেন তার বেলা? আমি না কোনদিন এই অনুভূতির তীব্রতায় মরে যাই!

আরাফ ওর ঠোঁট চেপে বললো, এসব কি কথা হুম? এসব কথা আরেকবার বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।

রেবা তার বুকে লাভ বাইট দিয়ে বলল, এমনিতেও আপনার মতো খারাপ কেউ হবেনা।

তাই না?

হুমম ঠিক তাই।

বেশ তবে খারাপই সই। এমন খারাপ হতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এখন থেকে আমি ভীষণ খারাপ হবো।

এই না,,, আরাফ রেবাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না, গাঢ় আদরের ছাপ আঁকতে শুরু করলো গভীর আবেশে।


মিথিলা মাথা চেপে বসে আছে, রাগে তার মাথায় জাস্ট আগুন ধরে গেছে। তৌকির এতো নীচ হতে পারে এটা সে কল্পনাই করতে পারেনি। একটু আগেই তার তৌকিরের সাথে দেখা হয়েছে। তৌকিরকে দেখে মিথিলা না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল কিন্তু তৌকির তাকে আটকে বললো, আরেহ মিথিলা যে! কেমন আছ?

জ্বি ভালো আপনি?

আমি বেশ আছি। তা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কি খবর? বিয়ে হয়েছে নাকি আইবুড়ি হয়ে বসে আছে আমার আশায়?

মিথিলা পরিহাসের হাসি হেসে বলল, খুব আনন্দ হচ্ছে তাই না? একটা মেয়ের এতোগুলি বছরের প্রেম পায়ে পিষে চলে যাওয়ায় ভীষণ মজা পেয়েছেন মনে হচ্ছে!

মজা না। তবে আফসোস হয় বুঝলে। মেয়েটা দেখতে খারাপ ছিল না, কিন্তু একদম ভেজিটেবল। আমাদের এজ গ্যাপ মাত্র ২বছরের। ছেলেরা ৮০ বছরেও জোয়ান থাকে, কিন্তু মেয়েরা,,

প্লিজ থামুন। আপনার এসব কথা শোনার সময় নেই আমার।

বাব্বাহ রেগে যাচ্ছ দেখি। যাই হোক ওকে দেখেশুনে ভালো লোকের সাথে বিয়ে দাও, অনেক টাকাওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোক আছে। ও ওমন আধবুড়োকে স্যাটিসফাইড করলেও করতে পারে।

আপনি কিভাবে পারছেন এমন অশালীন ভাষায় কথা বলতে? নূর আপনাকে কত ভালোবেসেছে, আপনার জন্য কত ভালো ভালো প্রপোজাল রিজেক্ট করেছে। আর আপনি কি না সেই অপেক্ষাকে হেয় করে কথা বলছেন?

শোনো ওকে এতো ভালোও ভাবার দরকার‌ নেই। ও যদি এতোই ভালো হতো তবে বেকার অবস্থায়ই বিয়ে করতো, তাছাড়া ওর বাপের তো টাকা ছিল। অনায়েসে মেয়ের জামাইকে বিজনেস ধরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু না ছেলের জব লাগবে, জব না থাকলে হবেনা।

আপনি কি ভাবছেন এসব বললে অন্যদের মতো আমিও সিম্প্যাথি শো করবো? চাকরীর অভাবে প্রেমিকের হাত ছেড়ে যাওয়ায় বিধ্বস্ত প্রেমিক আপনি! আহাগো কি দুঃখ আপনার না? অনেক মায়া লাগবে আপনার জন্য? মোটেও না।
আসল সত্যিটা হলো নূর আপনার জবের তোয়াক্কা করেনি, ইনফ্যাক্ট ও নিজে জব করেছে। আপনাকে কতবার বলেছে বাসায় আসুন পরিবার নিয়ে। বাকিটা ও সামলাবে। কিন্তু আপনি আপনার পরিবারকে ওর কথা বলার দুঃসাহস দেখাতে পারেন নি। কাপুরুষের মতো ভেজা বিড়াল সেজে ছিলেন।

Mind your language.

ইশ নিজের বেলা খুব লাগলো না? একটা কথা মাথায় রাখবেন ও আপনার বেলা যতোটা লয়্যাল ছিল আপনি ততোটা ছিলেন না। এটা আর কেউ না জানলেও আপনি জানেন। বিবেকর দংশনে মানুষ একদিন হলেও দংশিত হয়। যারা ঠকে তারা বোকা না, বরং যারা ঠকায় তারাই নির্বোধ। আর শুনুন আপনি গ্রুপে ওর নামে যেসব আজেবাজে কথা ছড়িয়েছিলেন, এতে ওর সাময়িক বদনাম রটেছিল ঠিকই। কিন্তু আপনিও সম্মানীয় হননি। প্রাক্তনকে নিয়ে যে কুৎসা রটায় সে আর যাই হোক ভদ্রলোকের কাতারে পড়েনা। এই কথাটা দেরীতে হলেও সবাই বুঝে। ও আপনাকে মাফ করবে কি না জানি না, তবে আমার বান্ধবীর চোখের পানির দায় আপনাকে অবশ্যই দিতে হবে। Be prepare for the revenge of nature…

তৌকির হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করলো। মেয়েটার ঝাঁজ আছে বলতে হয়, সে তাকে রেবার মতো ঠান্ডা ভেবে ভুল করেছে। কোথায় ভেবেছিল এখনো বুঝি ওকে বলবে, রেবার সঙ্গে কথা বলে একটু সান্ত্বনা দিতে মেয়েটা যেন মুভ অন করে। তা না কিসব শুনিয়ে গেল। আচ্ছা রেবার খবর নেওয়া উচিত। মেয়েটার কি হাল এখন?
ম্যাসেজের টোন বাজতেই ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার স্ত্রী রাইসা একটা লম্বা লিস্ট পাঠিয়েছে। মেয়েটার চাহিদার শেষ নেই। রোজ একগাদা জিনিস লাগে। তৌকির খানিকটা রুক্ষ মেজাজেই সুপারশপে ঢোকে।

মিথিলা পানি খেয়ে দম নেয়। তৌকিরের সাথে এই প্রথম সে এতো রুড হয়ে কথা বলেছে। আগে সবসময় ভাইয়া বলে সম্মান করলেও এখন তাকে দেখতেও রুচিতে লাগে। যে প্রাক্তনের বেস্টফ্রেন্ডের সামনেই এভাবে বলে অন্যদের সামনে না জানি কিভাবে বলতো!

তাইতো শেষদিকে নূর চেনা পরিচিত সকল ব্যাচমেটদের থেকে আড়ালে চলে গিয়েছিল। তৌকির নূরের ক্লাসমেট থেকে শুরু ভার্সিটির সবার কাছে ওর নামে যা তা বলেছে। গার্লস গ্রুপেও কম গসিপ হয়নি। নূরকে গোল্ড ডিগার, মিচকা শয়তানসহ কত বিদঘুটে নিকনেইমেই না ডেকেছে সবাই! ঐদিনগুলোর কথা মিথিলা সহজে ভুলবে? ভালোই হয়েছে তৌকিরের মতো ফালতু ছেলের সাথে নূরের বিয়ে হয় নি। এই বদ নূরের কদর করতে পারতো না।

“তৌকির ব্যাটা তুই জানোসও না নূর কত ভালো একটা বর পাইছে, ওর বরের জুতার যোগ্যও তুই না।”

উফফ রাগের মাথায় বলাই হয়নাই নূরের কত ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। ওর কথিত মধ্যবয়স্ক জুটে নাই। বরং তৌকিরের চেয়ে অনেকগুণ সুদর্শন ছেলেই ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ওর যত্ন করে। যে বা** সরকারী চাকরি করে মারেম্মা!! জমিনে পা-ই পড়েনা। আসলেই খালি কলসির ডগর ডগর বেশি।

মিথিলার বড় ছেলে মাহীন চিৎকার করে বলল,আম্মু দেখো তোমার মেয়ে আমার বেডে রং ফেলে দিছে। ওরে তুমি মারো।

মিথিলা বুকে ফু দিয়ে বলল,তোরা আমারে শান্তি দিবি না। দুইটা অজাত জন্ম দিছি আমি। ওহ আল্লাহ আমারে তুমি তুইলা নাও।

তুলি অস্পষ্ট ভাষায় বলল, আম্মু তুমিতো অনেক মোতা, লশি ছিলে দাবে,,,

মিথিলা কিড়মিড় করে মেয়েকে বললো, তোর বাপ মোটা, তোর চৌদ্ধগুষ্টি মোটা। আমি মোটা না।

হেহেহে

মিথিলা মেয়েকে কোলে তুলে আদর করে বলল, আমার মাটা কি সুন্দর হাসেগো, আমার কলিজার টুকরা টুনটুনি পাখি।

মাহীন গাল ফুলিয়ে বলল, তুমি বোনকেই ব ভালোবাসো,ও দোষ করলেও আদর করো।

নাহ বাবা, তুই তো আমার সাত রাজার ধন। আমার রাজা ছেলে। যা এখন দুজন গিয়ে খেলা কর, অনেক কাজ বাকি আমার।

পিহুর জন্য বেশ‌ কিছু পাত্র দেখা হলেও মনমতো মিলছিল না। তবে এবার যে সমন্ধটা এলো তাতে সবাইই মোটামুটি আশাবাদী। সব ঠিকঠাক থাকলে বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা ফাইনাল করা হবে। এসব নিয়ে বাড়িতে মোটামোটি হৈচৈ পড়ে গেছে। আরাফ অবশ্য বলেছে সময় নিয়ে আগে খোঁজখবর নেওয়া হোক তারপর যা হবার হবে। এখুনি তাড়াহুড়ো করতে হবেনা। তাছাড়া তার প্রজেক্টের কাজ এখনো শেষ হয়নি,ক’টা দিন বাদে হলেই ওর সুবিধা হয়।

অফিসে কাজের ফাকে ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ে তাদের বিয়ের এক বছর পূরণ হতে চলেছে। দেখতে দেখতে বছর গড়িয়ে গেল একসঙ্গে চলার! আচ্ছা রেবাকে কি সারপ্রাইজ দেওয়া যায়? রেবার কি মনে আছে এই বিশেষ দিনটার কথা??

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here