ডাকিনী বউ,৯ম এবং শেষ পর্ব
লেখা:Masud Rana
তাহলে কি আমি আবার কোন মায়ায় জড়িয়ে পড়ছি!! কিন্তু ইয়েজেরিন আর মুশকান এখন কোথায় রয়েছে?! যে করেই হোক তাদেরকে আমায় খুজে বের করতেই হবে! কিন্তু এতো দ্রুত এই বাড়িটা এতোটা বদলে গেলো কিভাবে?! নাকি এটাই বাড়ির আসল চেহারা। আর জুলেখা, মুশকান,এই বাড়ির লোকগুলো আর সাধু বাবা আমার কল্পনা ছিলো!!! এরপর আমি প্রায় পাগলের মতো হয়ে বাড়ির এপাশ থেকে ওপাশ ছুটছিলাম। কিন্তু কাউকেই খুজে পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার মস্তিস্ক ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। এরপর আমি আবার দুতালায় নিজের ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকেই ঘরের চারিদিক ভাল করে দেখতে লাগলাম। ঘরটার আসবাবপত্র ঠিক আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু এখন শুধু অনেক পুরোনো আর নোংরা মনে হচ্ছে । এরপর আমি ধুলা মাখা বিছানার উপর চুপ করে বসে রইলাম। হঠাৎ মনে পড়লো আরে এটাইতো সেই ঘর যেই ঘরে জুলেখার উপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়! এই ঘরেইতো এক সময় ডাকিনী পুজো করা হতো। এতোদিন আমি এই ঘরে ছিলাম কিন্তু তখন তো জানতাম না এই ঘরের রহস্য। তাহলে কি এই ঘরের মধ্যেই এই রহস্যের কোন সমাধান রয়েছে?! এইগুলো ভাবছিলাম। হঠাৎ ঘরের পরিবেশটা কেমন যেনো অন্ধকারে ভয়ংকর আর ঝাপসা হয়ে গেলো। হঠাৎ ধমকা বাতাস এসে সজোরে ঘরের দরজাটা আটকে দিলো। আমি ছুটে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করি। কিন্তু দরজাটা কিছুতেই খুলছিলো না। এরপর আমার সামনে ছায়াখেলা শুরু হয়। সেই বৃদ্ধা আর সাধু বাবার বলা ঘটনাগুলো যেনো আমার সামনে আবার প্রতিফলিত হতে শুরু করলো। অনেকগুলো ছায়া মানুষ যেনো আমার চোখের সামনে সেই ঘটনাগুলো উপস্হাপন করছিলো। আমার চোখের সামনে যেনো হঠাৎ স্পষ্ট একটা ছায়া মুর্তি দেখতে পেলাম। ছায়ামুর্তির সামনে একটা ছায়া মানব ধ্যান ধরে বসেছিলো। তার পাশেই ছুরি হাতে একটা ছায়া মানবি দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ ছায়া মানবিটা ধ্যান ধরে বসে থাকা ছায়া মানবের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। সাথে সাথেই ছায়া মানবটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর হঠাৎই ঘরের দরজা খুলে আরো একটা ছায়া মানবির প্রবেশ। সে এসেই দৌড়ে মাটিতে পড়ে থাকা ছায়া মানবের কাছে গেলো। সেই খুনি ছায়া মানবিটা তখনো মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি যেনো ছায়ার খেলাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। এখানে মুর্তির সামনে বসে থাকা ছায়া মানবটা ছিলো জুলেখার স্বামী। ছুরি দিয়ে তাকে বলি দেওয়া ছায়া মানবিটা ছিলো এই বাড়ির ছোট বউ। আর শেষে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করা ছায়া মানবিটা ছিলো জুলেখা। এ যেনো বৃদ্ধার বলা ঘটনাগুলো কিছু কালো ছায়া নাটকের মতো করে আমার সামনে উপস্হাপন করছিলো। এরপর হঠাৎ ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া মানবিটা দৌড়ে বাড়ির নিচে চলে যায়। আমিও তার সাথে ঘরের বাহিরে এলাম। এরপর দেখলাম আরো অনেকগুলো ছায়ামানব দলবেধে আমার দিকে আসছে। আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু তারা আমার শরীর ভেদ করে আবার দুতালার ঘরে চলে গেলো। আমি আবার তাদের পিছু পিছু ঘরটাতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সেই এক দল ছায়া মানব মুর্তির সামনে পড়ে থাকা সেই ছায়া মানবকে জড়িয়ে ধরে থাকা সেই
ছায়া মানবিকে টেনে টেনে উপর থেকে বাড়ির উঠানে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর সেই ছায়া মানবির উপর একের পর এক অত্যাচার চলতে থাকে। আমি যেনো আবারো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, এই অত্যাচারিত ছায়া মানবিটাই হচ্ছে জুলেখা। আর বাকি ছায়া মানব গুলো অর্থাৎ যারা এই ছায়া মানবির উপর অত্যাচার চালাচ্ছে তারা এই বাড়ির এবং সমাজের সেই নোংরা নিষ্ঠুর লোকগুলোর ছায়া। এরপর সেই ছায়াগুলো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরিবেশটা আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে, আমার সাথে এসব কি হচ্ছে?! এই ঘটনাগুলোতো আমি জানি! তাহলে সেই ছায়াগুলো এসে আমার সামনে আবার সেই ঘটনাগুলোই উপস্হাপন করলো কেনো?! এরপর আমি আবার দুতালার ঘরটাতে যাই। এইবার বেশ চমকে যাই। ঘরটা আবার আগের মতো সাজানো গুছানো পরিস্কার হয়ে গেছে যেমনটা আজ সকালেও ছিলো। কিন্তু এই স্বাভাবিক পরিবেশে আবার আমার সাথে ছায়া খেলা শুরু হয়ে গেলো। হঠাৎ আমি বিছানায় দুটো ছায়াকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। দুটোর মধ্যে একটা হচ্ছে বড় ছায়া মানবি আরেকটা বাচ্চা মেয়ের ছায়া। আমার মনে হচ্ছিলো এই বড় ছায়া মানবিটা হচ্ছে ইয়েজেরিন আর বাচ্চা ছায়াটা হচ্ছে মুশকানের।এরপর ছায়া দুটি বিছানা থেকে উঠে প্রথমে এই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এরপর এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা
দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তারা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাই শুধু সেই ছায়াগুলোকে অনুসরন করে চলছিলাম। ছায়াগুলো আমাকে সেই অভিশপ্ত বন পর্যন্ত নিয়ে গেলো। এরপর আবার ছায়াগুলো শুন্যে মিলিয়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এগুলোর মানে কি?! ইয়েজেরিন আর মুশকান কি তাহলে এই বনের ভেতরেই রয়েছে?! যদি তারা এই বনে থাকে, তাহলেও এই ছায়াগুলো কেনো আমায় সাহায্য করলো এবং এখানে নিয়ে আসলো?! এই ছায়াগুলো দিয়ে কি ঈশ্বর আমায় সাহায্য করছেন?! নাকি এটা শুধুমাত্র শয়তানের একটা চাল ছিলো?! এটা কি সেই সাধু বাবার সাহায্য ছিলো নাকি আবারো ইয়েজেরিনের কোন ছলনা ছিলো?! কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না! কিন্তু এতোটুকু নিশ্চিত ছিলাম যে নিশ্চই এই বনের ভেতরেই এই সমস্যা গুলোর কোন সমাধান আছে! এরপর ভাবলাম যা হওয়ার হবে! যে করেই হোক আমি এই বনের অভিশপ্ত এলাকায় যাবোই। হয়তো সেখানেই ইয়েজেরিন আর মুশকানকে পাবো!! এরপর যেই বনের ভেতর প্রবেশ করবো ঠিক তখনি আবিষ্কার করলাম যে, আমার পেছনে সাদা কাপড় পরা কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে! তার চোখদুটো রক্ত লাল হয়ে রয়েছে। আমি ভালো করে দেখলাম। আরে! এটাতো সেই সাধু বাবাটাই। এরপর সাধু বাবাকে আমি প্রশ্ন করলাম:
-আপনি ঐ বাড়ি থেকে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন? আপনাকে কোথাও খুজে পেলাম না।
এখন যতদ্রুত সম্ভব আমাকে ইয়েজেরিন আর মুশকানের কাছে পৌছাতে হবে এবং তাদের ধ্বংস করতে হবে। আমার মনে হয় তারা এই বনের ভেতরের অভিশপ্ত জঙ্গলের দিকেই রয়েছে। আপনিতো বলেছিলেন যে ডাকিনীকে ধ্বংস করার উপায় আপনার জানা আছে! তাহলে দয়া করে আমায় সাহায্য করুন!!
.
এরপর সাধু বাবা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না। শুধু ইশারা করে তাকে অনুসরণ করতে বললো। সে বনের ভেতরের দিকে যাচ্ছিলো। আমিও তাকে অনুসরণ করে হাঁটছিলাম। এরপর সে একটা পুরোনো কবরের পাশে এসে দাঁড়ালো। কবরটা দেখে আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কেমন অদ্ভুত ভয়ংকর কবর। সাধু বাবা আমাকে কবরটা খুড়তে বললেন। আমার কাছে তখন কবর খুড়ার মতো কিছুই ছিলো না। এরপর দেখলাম কবর থেকে কিছুটা দুরে একটা গাছের বড় শিকর পড়ে রয়েছে। সেই শিকরটা ব্যবহার করেই কবরটা খুড়তে লাগলাম। যেহেতু কবরটা অনেক পুরোনো ছিলো তাই কিছুটা খুড়ার পর শিকর দিয়ে জোরে কয়েকবার আঘাত করার পর কবরটা ভেঙে গেলো। কবরটার একপাশে একটা গর্তের মতো সৃষ্টি হলো যার মাধ্যমে কবরের নিচে পর্যন্ত অর্থাৎ লাশের কাছে পর্যন্ত যাওয়া যাবে। যদিও জানি যে কবরে কোন লাশ নেই। শুধু একটা কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। কারণ কবরটা অনেক পুরোনো। কবরের ভেতর ঢুকতেই সেই কঙ্কালটাকে স্পর্শ
করলাম। এরপর সাধু বাবা বললো যে কঙ্কালের শরীরে এখনো কিছু অলংকর রয়েছে যেগুলো নষ্ট হয়নি। সেগুলো তুলে নাও। আমি অন্ধকারে ভালোমতো দেখছিলাম না। শুধু কঙ্কালটিকে হাতিয়ে তার গলা থেকে একটা চেইন, দুই কানের দুল এবং দুই হাতের দুইটা চুড়ি পেলাম। এরপর কবর থেকে উঠে আসলাম। সাধু বাবা বললেন যে এই কবরটা আর কারো না। এটাই জুলেখার কবর। জুলেখাকে ঐ অত্যাচারিত অবস্হাতেই জানাজা ছাড়া এখানে গর্ত করে পুতে রাখা হয়। কথাটা শুনেই আমার শরীরটা শিহরে উঠে। এরপর সাধু বাবা বলেন:
-“এই বনের ভেতরের সেই নিষিদ্ধ জায়গাটিতে এখন ইয়েজেরিন আর মুশকান রয়েছে। তারা এখন ডাকিনী পুজো করছে। এই পুজোর মাধ্যমে তারা ডাকিনী দেবীকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। ডাকিনী দেবীর আত্মা মুশকানের শরীরে ভর করবে। এরপর থেকে শুরু হবে মরণ খেলা। আবার এই বনে শুরু হবে বিভিন্ন কালো যাদুর যাদুকরের আসা-যাওয়া।আবার মানুষ ঈশ্বরপুজো বাদ দিয়ে ডাকিনী পুজো শুরু করবে। আবার বলি দেওয়া হবে হাজারো নিষ্পাপ প্রাণের। ডাকিনী দেবী পৃথিবীতে চলে আসলে তখন আর তোর কিছু করার থাকবে না। তাই তোকে প্রথমে জুলেখাকে আটকাতে হবে এই পুজো করা থেকে। মনে রাখবি যে, সে একটা অশরীরী আত্মা। তাই তাকে এই পৃথিবী থেকে বিতারিত এর জন্য জুলেখার ব্যবহৃত সকল জিনিস নষ্ট করে ফেলতে হবে। এই পৃথিবীতে এমন কিছুকে টিকিয়ে রাখা যাবে না যার জন্য জুলেখা আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায়। জুলেখার ব্যবহৃত জামা কাপড়গুলো আগেই সেই বাড়ির লোকগুলো নষ্ট করে দিয়েছিলো। আর এখন শুধু এই অলংকারগুলো নষ্ট করা বাকি। তুমি এই অলংকারগুলো নিয়ে জুলেখার কাছে যাও ঐ বনের ভেতরে। সে যেখানে পুজো করছে সেখানেই আগুনে পুরিয়ে ফেলো এই অলংকারগুলো। মুক্ত করে দাও জুলেখাকে। এরপর আর সে ফিরে আসতে পারবে না এবং ডাকিনী দেবীও পৃথিবীতে আসতে পারবে না।”
.
.
এতোটুকু বলে সাধু বাবা আবার আমার চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি যেনো চোখের সামনে তখন জুলেখার ধ্বংস দেখতে পারছিলাম। এরপর দ্রুত ছুটে বনের সেই অভিশপ্ত অঞ্চলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সাধু বাবার কথাই ঠিক। সেই ইটের ঘরের বাহিরে সেই বিশাল ভয়ংকর ডাকিনী মুর্তিটা রয়েছে। ইয়েজেরিন বিশাল এক অগ্নিকুন্ডলী সৃষ্টি করেছে। এর সামনে সে নানান মন্ত্র পড়ে ডাকিনী দেবীর পুজো করছিলো। তার সামনেই মুশকান চুপচাপ বসেছিলো। তার কিছুটা দুরে আমি কয়েকটা মানুষকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম। তাদের কারোই শরীরের সাথে মাথা ছিলো না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এদের ইয়েজেরিন বলি দিয়েছে পুজো করার জন্য।
এরপর আমি ধীরে ধীরে ইয়েজেরিন এর কাছে গেলাম। ইয়েজেরিন আমাকে দেখেই কিছুটা আৎকে উঠলো। কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সে আবার তার ডাকিনী মন্ত্র পড়া শুরু করলো। এরপর আমি মুশকানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার ইয়েজেরিন কিছুটা রেগে গেলো। এরপর আমাকে বললো:-
-তোমার কি মরার পাখা গজিয়েছে নাকি? আবার মরতে এখানে কেনো চলে আসলে? আমিতো তোমায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। এখানে দেখো ৫টা লাশ পড়ে রয়েছে। এদেরকে কিছুক্ষন আগেই বলি দেওয়া হয়েছে। এরাই সেই লোকগুলো যারা ৯ বছর আগে আমার বিচারের নামে উপহাস করে আমার শরীর ভোগ করেছিলো। এখন তারা ডাকিনী দেবীর কাছে চলে গেছে। কিছুক্ষন পর ডাকিনী দেবী পৃথিবীতে চলে আসবেন। এরপর আবার শুরু হবে ডাকিনী সম্রাজ্র। আমার মুশকানের শরীর হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অলৌকিক শক্তির শরীর! এর পর বলি দিবো পুরো পৃথিবীকে। তুমি যদি তোমার ভালো চাওতো এখনি চলে যা এখান থেকে। নাহলে তোমাকেও আমি এখন বলি দিবো।”
.
এরপর আমি তাকে আর কিছু না বলে সেই কঙ্কাল থেকে পাওয়া অলংকারগুলো বের করি। অলংকারগুলো দেখেই সে ভয়ে আৎকে উঠে। পুজো বন্ধ করে দেয়। এরপর সে আকুতি করে আমায় বলে:
-তুমিতো আমার স্বামী হউ। বিশ্বাস করো এখনো আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। এই অলংকারগুলো আমার কাছে ফিরিয়ে দাও আমি তোমার আর কোন
ক্ষতি করবো না তোমায় মুক্তি দিয়ে দিবো।
.
কিন্তু এবার আর তার ছলনায় আমি পা দিলাম না। আমি একটা একটা করে অলংকার সেই আগুনের কুন্ডলিতে ফেলতে লাগলাম। ইয়েজেরিন ভয়ে চিৎকার আর আর্তনাদ করতে লাগলো। আমি জানি যে আমার ডাকিনী বউ এর জীবনের সমাপ্তি এখানেই ঘটবে। এরপর তার সবগুলো অলংকার আমি আগুনে পুরিয়ে ফেললাম।
.
.
কিন্তু এটা কি হলো?! ইয়েজেরিনেরতো এখন ধ্বংস হওয়ার কথা ছিলো। সাধু বাবার কথামতো তারতো এখন চিরোমুক্তি পেয়ে যাওয়ার কথা ছিলো!! কিন্তু ইয়েজেরিনতো দিব্যি আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে! সে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন ভয়ংকর ভাবে হাসতে থাকে। এরপর আবার ডাকিনী পুজো শুরু করে দেয়। আমি আৎকে উঠি! এটা কি হলো?! আমিতো সাধুবাবার কথামতোই অলংকারগুলো আগুনে পুড়িয়েছি। তাহলে ইয়েজেরিন এখনো ধ্বংস হলো না কেনো?! আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এখন আমার কি করা উচিত! ডাকিনী পুজো প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো।হয়তো আর কিছুক্ষন পরেই ডাকিনী দেবীর আত্মা মুশকানের শরীরে প্রবেশ করবে। তারপরে আমার আর কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু ইয়েজেরিনের আত্মা কেনো এখনো মুক্তি পেলো না! হঠাৎ মনে পড়লো। তাহলে কি মুশকানের জন্য এখনো সে মুক্তি পায়নি! আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো জুলেখার শেষ কথাটা।
সে বলেছিলো যে সে মুশকানের ভেতরেই বেঁচে থাকবে। তার মানে কি মুশকানকে যদি এখন আমি মেরে ফেলি তাহলে কি ইয়েজেরিনো ধ্বংস হয়ে যাবে?! হ্যাঁ হয়তো এটাই হবে। কিন্তু মুশকানতো ডাকিনী কন্যা। তাকে কি সাধারণ ভাবে খুন করা যাবে! যদি এখন আমি তাকে মারতে নেই আর সে না মারা যায় তাহলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। বুঝলাম এতোকিছু না ভেবে আমাকে প্রথমে ডাকিনী দেবীকেই ধ্বংস করতে হবে। না হলে এর কোন সমাধান হবে না। কিন্তু এর উপায়তো আমার জানা নেই। অবশ্য ডাকিনী দেবীকে ধ্বংস করতে হলে আমাকে প্রথমেই তাকে পৃথিবীতে আহ্বান করতে হবে এবং সে যাতে কারো শরীরে প্রবেশ না করতে পারে এটাও দেখতে হবে! আমি জানি যে হয়তো ডাকিনী দেবী আমাদের আশেপাশেই রয়েছেন। এখন শুধু মুশকানের শরীরে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে!! হয়তো আমার আহ্বান বা কথা সে শুনতে পারবে! আমি যদি এখন তাকে নিয়ে উপহাস করি তাহলে নিশ্চই সে আমাকে দ্রুত ধ্বংস করতে মুশকানের শরীর বাদে নিজের শরীরেই উপস্হিত হবেন। এরপর আমি ইয়েজেরিনকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকি:-
.
– “হাহাহা ইয়েজেরিন! তুমি অনেক মুর্খ আর বোকা। নাহলে কি এইরকম একটা মুর্খ দেবীর পুজো করতে তুমি?! আমার মনে হয় শয়তানী শক্তির সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে তোমার ডাকিনী দেবী। তারতো কোন দৈব শক্তিই নেই। সে আর পৃথিবীতে কিভাবে রাজত্ব করবে?!
সেতো একটা সাধারণ মানুষের সাহায্য ছাড়া চলতেই পারে না। মানুষরা যদি এই ডাকিনীর জন্য বলি না দিতো তাহলেতো তোমার ডাকিনী কবেই মারা যেতো?! আর এখন তো তোমার মতো একটা সাধারণ মানবীর কাছে সাহায্য নিয়ে, মুশকানের শরীরকে ব্যবহার করে সে পৃথিবীতে আসতে চায়। তোমার ডাকিনী দেবী দুর্বল, মুর্খ আর বোকা। তাকে এর আগেও একবার এই বন থেকে বিতারিত করা হয়েছিলো। এখন আবার নির্লজ্বের মতো সে এখানে ফিরে আসতে চায়। সে যদি আসলেই শক্তিশালী হতো তাহলে সে এখন নিজের ভয়ংকর চেহারা নিয়েই এই পৃথিবীতে আসতো এবং আমার মোকাবেলা করতো। কিন্তু সে এই পৃথিবীতে তার শক্তি প্রদর্শনে অপারক। হাহাহাহাহাহাহা। মূর্খ দেবী ডাকিনী!!”
.
আমার কথাগুলো শুনে রাগে ইয়েজেরিনের চোখ রক্ত লাল হয়ে গেলো। সে আমায় ভয় দেখাতে চাইলো। সে বললো যে “ডাকিনী দেবী রেগে যাচ্ছেন সে নিজের শরীরে পৃথিবীতে আসলে তোমাকেই প্রথমে খুন করবে।” আমিতো এটাই চাইছিলাম। আসলেই ডাকিনী দেবী আমার কথাশুনে রেগে গেলেন। এরপর ডাকিনী দেবীর আত্মা মুশকানের শরীরে প্রবেশ না করে তার নিজের মুর্তিতেই প্রবেশ করলেন। আমার সামনে থাকা ডাকিনী মুর্তির চোখদুটো রক্ত লাল হয়ে গেলো। তার মুখ ভেদ করে চারটি ভয়ংকর দাত বেরিয়ে আসলো। তার শরীর ক্রমসো রক্ত লাল হয়ে যাচ্ছিলো। ডাকিনী মুর্তিটা যেনো একটু নড়তে শুরু করলো। আমি বুঝলাম ডাকিনী দেবী পৃথিবীতে চলে এসেছে!! হঠাৎ রাতের আকাশে যেনো সূর্য দেখা গেলো। পুরো রক্ত লাল সুর্য। হঠাৎ আকাশের রংটাও লালচে হয়ে গেলো। পরিবেশটা অনেক ভয়ংকর হয়ে উঠলো। ইয়েজেরিনো কিছুই বুঝছিলো না। সেও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবকিছু দেখছিলো। এরপর আমার ভয়কে যেনো আরো বাড়িয়ে দিলো ডাকিনী দেবী। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম হাজার হাজার ছায়ামানব আর ছায়ামানবি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম তারা কি আমায় মেরে ফেলবে! এইদিকে ডাকিনী দেবীর মুর্তি আরো ভয়ংকর রুপ ধারণ করলো। আমি বুঝতে পারলাম যে ডাকিনী দেবী এই মুর্তির ভেতর ভর করেছে! মানে ডাকিনী দেবী তার নিজের চেহারায় পৃথিবীত ফিরে এসেছে। এখন সে সবার প্রথমে আমায় খুন করবে। এইদিকে সেই ছায়ামানুষ গুলো আমাদের অনেক কাছে এসে আমাদের ঘিরে দাড়িয়ে রইলো। আমি মুশকানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইয়েজেরিন আমার থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার দিকে ভয়ংকর ভাবে ডাকিনী মুর্তিটা হেঁটে আসছিলো। আমার পাশেই সেই আগুনের কুন্ডলী। হয়তো এখানেই আমাকে নিক্ষেপ করা হবে। ছায়ামানুষগুলো আমাদের ঘীরে দর্শকের মতো তখনো দাঁড়িয়ে ছিলো। ডাকিনী মুর্তি আমার অনেক কাছে চলে আসছিলো। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভয়ে আমার মস্তিস্ক অবশ
হয়ে আসছিলো!! আমি জেনে গেছিলাম যে এখন আমার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। ঠিক সেই সময়ে ছায়ামানুষগুলোকে ভেদ করে আমার পাশেই এসে হাজির হলো সেই সাধু বাবা! আমি তাকে কিছু বলতে যাবো ঠিক তার আগেই সে আমায় চিৎকার করে বললো:
-এটাই সুযোগ। ধ্বংস করে ফেলো জুলেখা এবং ডাকিনী মুর্তিটাকে। এই আগুনের কুন্ডলীতেই ধ্বংস হবে তারা। এটা মন্ত্রপুতো অগ্নীকুন্ড। এটা যেকোন কিছুকেই ধ্বংস করতে পারে। এক ঢিলে দুই পাখিকে মারো। ইয়েজেরিনের আত্মা এখনো মুক্তি পায়নি মুশকানের জন্য। আর এই ডাকিনী দেবীর জীবনও এখন মুশকানের শরীরে আছে। নিক্ষেপ করো মুশকানকে এই অগ্নীকুন্ডলীতে। ধ্বংস করে ফেলো ডাকিনী দেবী এবং তার ডাকিনী সম্রাজ্যকে।”
.
আমি যেনো এবার সকল সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলাম! আমার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। আমি আগেও ভেবেছিলাম যে মুশকানের জন্যই হয়তো এই সকল অভিশাপ এখনো বেঁচে আছে! সাধু বাবার কথাটা শুনে ডাকিনী দেবীর মুর্তি থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। ইয়েজেরিনো আৎকে উঠলো। মুশকান তখনো ধ্যান ধরে সেখানে বসেছিলো। এরপর আমি আর বেশিকিছু না ভেবে মুশকানকে তুলে ছুড়ে মারলাম সেই অগ্নীকুন্ডলীতে। সাথে সাথে চারিদিক যেনো হঠাৎ নীরবতায় ছেয়ে গেলো। ছায়া মানুষগুলোও যেনো অবাক হয়ে নীরবতা উপভোগ করছিলো।
হঠাৎ নীরবতা ভেঙে এক বিকট চিৎকার দিলো সেই ডাকিনী মুর্তিটা। সাথে সাথে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো ডাকিনী মুর্তিটা। ইয়েজেরিনো চিৎকার করতে করতে শুন্যে মিলিয়ে গেলো। মুশকানকে আগুনে ছুড়ে মারতে আমার অবশ্য কিছুটা কষ্ট হয়েছিলো। কারণ সে তো নিষ্পাপ ছিলো। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই হাজার হাজার ছায়ামানুষগুলো আমার দিকে সিজদাহরত অবস্হায় বসে রইলো। এরপর সেই সাধু বাবা আমার কাছে এসে আমাকে বললো:
“এই ছায়া মানবগুলো ডাকিনী পুজারী না। এইগুলো সেই নিষ্পাপ প্রাণগুলো যারা এই ডাকিনীর জন্য অভিশপ্ত হয়েছে বা মারা গেছে। এরা আজ এখানে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছিলো। এরাই এখানে এসে ডাকিনীর শক্তিকে আরো দুর্বল করে দিয়েছিলো এবং কালো শক্তিদের তোমার কাছে আসতে বাধা দিচ্ছিলো। যার ফলে তুমি সহজে ডাকিনীকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তুমি এদের ঈশ্বর হয়ে গেছো। ডাকিনীকে ধ্বংস করার সাথে সাথে তার সব শক্তি তোমার হয়ে গেছে। এখন তুমি অনেক শয়তানী শক্তির মালিক। তুমি যা বলবে তাই ঘটবে এখানে। তুমি চাইলে এখনো শয়তানী শক্তিকে জীবিত রাখতে পারো এবং সেই শক্তির মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর মানুষের উপর রাজত্ব করতে পারো। এখন তোমার আদেশই হবে এই ডাকিনী রাজ্যের নিয়ম। ”
.
সাধু বাবার কথাশুনে শরীরে
যেনো একটা অদ্ভুত শক্তির উপস্হিতি অনুভব করলাম। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ বলে মনে হলো । এরপর আদেশ হিসাবে বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করলাম:
– “ধ্বংস হোক ডাকিনী এবং তার সম্রাজ্য। ধ্বংস হোক ডাকিনী বিদ্যাসহ এই পৃথিবীতে যতো রকম কালো যাদুর বিদ্যা রয়েছে সব। ধ্বংস হোক ডাকিনী সহ আরো সব কালো যাদুর পুজারীরা। ধ্বংস হোক ইয়েজেরিন এর মতো হাজারো অভিশপ্ত অতৃপ্ত অশরীরী আত্মা। মুক্তি পাক এই বনে বন্ধী হাজারো নিষ্পাপ আত্মা এবং ছায়া মানুষগুলো। জীবন ফিরে পাক আবার সেই সকল মানুষগুলো যারা তাদের জীবন বলি দিয়েছিলো এই ডাকিনীর জন্য। জুলেখা আবার ফিরে পাক তার সাধারণ জীবন। মুশকান স্বাভাবিক ভাবেই দেখুক পৃথিবীর আলো। আমি আবার যাতে ফিরে যাই আমার স্বাভাবিক জীবনে। ”
.
.
আমার এই আদেশের পর হঠাৎ চারিদিকে ভয়ংকর বিকট শব্দ হতে থাকে। আমার চোখের সামনেই হাজার হাজার ছায়ামানব আর ছায়া মানবি মিলিয়ে গেলো শুন্যে। মানে তারা মুক্ত। সূর্য এবং আকাশ ফিরে পেলো তার আগের রুপ। চারিদিকে ডাকিনীর কোন চিহ্নও দেখা গেলো না। এরপর আমার চোখগুলো লেগে আসছিলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
.
এরপর যখন চোখ খুললাম নিজেকে আবিষ্কার করলাম আবার নিজের সেই ঘরে যেখানে আমি ছোটবেলা থেকে থাকি। আমার কাছে সেই বন, অভিশপ্ত
বই, ইয়েজেরিন বা জুলেখা, সেই খুনগুলো করা, জাংশন ভিলা, মুশকান, সেই বাড়ির বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তাদের ছেলে এবং ছেলের বউ,সাধু বাবা, ডাকিনী দেবী সবকিছু যেনো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। এরপর আমি ঘর থেকে রাস্তায় বের হতেই অনেক মানুষের সাথে দেখা হলো যাদের আমি আগে খুন করেছিলাম। তারমানে তারা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম যে আসলেই ধ্বংস হয়ে গেছে সব ডাকিনী বিদ্যার রহস্য এবং আমার ডাকিনী বউ। সমাপ্ত হলো মাসুদ রানার গল্পের ডাকিনী বউ নামে আরো একটা অধ্যায়ের।
সমাপ্ত