ডাকিনী বউ,৪র্থ পর্ব
লেখক:মাসুদ রানা
এরপর আমরা বাসে উঠে গেলাম। আর কয়েক ঘন্টার ইতো ব্যাপার।এরপর আমরা সেই অভিশপ্ত বনের এলাকায় পৌছে যাবে। হয়তো সেখান থেকেই ইয়েজেরিনকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্ত করে আবার ডাকিনী রাজ্যে পাঠানোর উপায় আমি জানতে পারবো।
.
এরপর রাতের অন্ধকারেই বাস চলতে লাগলো। ইয়েজেরিন বাসেই আমার পাশে বসে ঘুমাচ্ছিলো। আমি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আসলেই মেয়েটার মুখের মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের মায়া আছে। তাকে ঘুমন্ত অবস্হায় দেখলে কে বলবে যে এই মেয়েটাই ভয়ংকর এক মানুষ খেকো ডাকিনী!! আমি একবার ভাবছিলাম যে ইয়েজেরিনকে তার ডাকিনী রাজ্যে পাঠাবো না। আপন করে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিবো। কিন্তু এসব ভাবতেই চোখে ভেসে উঠলো ইয়েজেরিনের মানুষকে নির্মমভাবে ছিড়ে খাওয়ার দৃশ্যটা। হয়তো তার এই গুণটার জন্যই আমি আবার তাকে ডাকিনী রাজ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু কিভাবে তাকে ডাকিনী রাজ্যে পাঠাবো!! এর উপায়োতো আমার কাছে জানা নেই! হয়তো বাকি দুটো বই পড়েই এই রহস্যের সমাধান করতে পারবো। কিন্তু সেই বইগুলোই বা বনের কোথায় রয়েছে এটাও আমি জানি না! এইসব ভাবতে ভাবতে ইয়েজেরিনের পাশে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম যখন ভাঙলো তখন আমরা আমাদের গন্তব্য স্হানে পৌছে গেছি। আমি আর ইয়েজেরিন বাস থেকে নামলাম। এরপরেই আমার চোখে পড়লো একটা ঢালু রাস্তা। রাস্তাটা দেখে আমার চিন্তে বাকি রইলো না যে এটাইতো সেই বনে যাওয়ার রাস্তা। আমার ইচ্ছা করছিলো যে এখনি দৌড়ে, বনের ভেতর গিয়ে সকল রহস্যের সমাধান করি।
কিন্তু আমার পাশে যে ইয়েজেরিন রয়েছে!! তাকে জানিয়েতো আর এই রহস্যের সমাধান করা যাবে না! তাই আমাকে প্রথমে একটা থাকার জন্য ঘর ঠিক করতে হবে। যেখানে ইয়েজেরিনকে রেখে আসতে পারবো।কিন্তু এলাকাটা আমার কাছে সম্পুর্ন অপরিচিত। এখানে কোথায় থাকার মতো নিরাপদ ঘর পাওয়া যেতে পারে তাও আমার জানা নেই। এরপর ইয়েজেরিন আমাকে প্রশ্ন করলো:
-আচ্ছা! আমরা এখন কোথায় যাবো?? কি করবো??
– এটাতো আমিও ভাবছি ইয়েজেরিন। আমাদের প্রথমে একটা থাকার মতো নিরাপদ ঘর বের করতে হবে। কিন্তু আমিতো এখানকার কিছুই চিনি না। (আমি)
.
এরপর ইয়েজেরিন কিছুক্ষন নীরব থেকে এরপর আমাকে বলে:
-তাহলে চলো আমার সাথে।
.
এরপর ইয়েজেরিন বনে যাওয়ার রাস্তার ঠিক বিপরীত দিকে থাকা অন্য একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম! আমিই ভালোমতো এই এলাকা চিনি না আর ইয়েজেরিন তো কখনো এই এলাকায় আসেইনি। তাহলে সে আমায় এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!? কিন্তু আমারো কিছু করার ছিলো না তাই ইয়েজেরিনের পিছুপিছু হাঁটতে শুরু করলাম। সেই রাস্তা দিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট হাঁটার পর আমরা একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়িটা দেখে খুব পুরাতন মনে হচ্ছিলো। বাড়িটার সামনে বাড়িটার নাম লেখাছিলো “জাংশন ভিলা”। বাড়িটা দেখেই আমরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আমরা দেখতে পেলাম একটা বৃদ্ধ লোক উঠানে বসে চা খাচ্ছিলো আর পেপার পড়ছিলো। আর তার কিছুটা দুরেই একটা বৃদ্ধা মহিলা ও একটা মাঝবয়সী মহিলা মিলে রান্নাঘরের মাটির চুলায় রান্না করছিলো। আমাদের দুজনকে হঠাৎ ঢুকতে দেখে তারা কিছুটা অবাক হয় এবং আমাদের মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। এরপর সেই বৃদ্ধ লোকটি আমাদের কাছে এসে আমাদের প্রশ্ন করে:
-কারা তোমরা? এইখানে কি চাউ?
-আসলে চাচা আমাদের থাকার মতো একটা ভাড়া বাড়ি চাই। আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। তাই আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি। (কিছুটা মাথা খাটিয়ে আমি বৃদ্ধা লোকটিকে উত্তর দিলাম যাতে তিনি আমাদের সন্দেহ না করেন।)
-হুম বুঝলাম। কিন্তু এই এলাকায়তো তোমরা ভাড়া বাড়ি পাইবা না! তয় একটা ব্যবস্হা করা যায়। তোমাদের একটু কষ্ট করতে হইবো আর কি!!
-জ্বী চাচা বলেন কি করতে হবে?
-আমাদের বাড়ির দুই তালায় একটা ঘর খালি আছে। কিন্তু ঘরটা অনেক ময়লা। আসলে অনেকদিন ধইরা ব্যবহার করা হয় নাতো। তোমাদের একটু কষ্ট কইরা পরিষ্কার কইরা থাকতে হইবো আর কি।
.
.
লোকটার এই কথা শুনে আমি একবার ইয়েজেরিনের দিকে তাকালাম। ইয়েজেরিন বললো যে, তার কোন সমস্যা নেই সে এখানেই থাকতে পারবে। আসলে যেখানে ঘর খুজে পাওয়াটাই মুশকিল সেখানে ময়লা ঘর কোন সমস্যাই না। এরপর সেই বৃদ্ধ লোকটি আমাদের দু’তালায় নিয়ে যায় এবং ঘরটার চাবি আমাদের কাছে দিয়ে চলে যায়। ঘরটা খুলতেই বুঝলাম যে ঘরটা আসলেই অনেক দিন ধরে ব্যবহার করা হয় না। পুরো ঘর ময়লা,ধুলাবালি আর মাকরশার জালে ভরা ছিলো। আমি আর ইয়েজেরিন দুজনে মিলে সারাদিন ঘরটা পরিষ্কার করলাম। এরপর দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যাঁ হয়ে গেলো। ঘরটা মোটামোটি থাকার উপযোগি হলো। কিন্তু রাত হতে না হতেই আমার মনে একটা অন্য ভয় কাজ করতে লাগলো। এখন যদি ইয়েজেরিনের আবার রক্ত পিপাসা শুরু হয় তাহলে আমি কি করবো?! হয়তো ইয়েজেরিন এই পরিবারের মানুষদেরো খুন করতে শুরু করবে!
কিন্তু তা হলো না! ইয়েজেরিন সন্ধ্যাঁ হতেই আমাকে বললো যে, সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন সে ঘুমিয়ে পড়বে। ইয়েজেরিনের কথাটা শুনে আমি খুব নিশ্চিন্ত এবং খুশি হয়েছিলাম। যাক! ইয়েজেরিন ঘুমালে রহস্য সমাধানের একটা পথ পাওয়া যাবে! এরপর ইয়েজেরিন ঘুমিয়ে পড়লো।এরপর আমি ভাবলাম যে এটাই ভালো সুযোগ। ইয়েজেরিন এখন ঘুমালে কাল সকালের আগে আর তার ঘুম ভাঙবে না। এর মধ্যেই আমি সেই বনে গিয়ে সেই বইদুটো খুজে আবার বাড়িতে ফিরতে পারবো! কিন্তু এই রাতের বেলায় সেই অভিশপ্ত বনে যাওয়াটা কি ঠিক হবে!! কিন্তু রাতে না গিয়েই বা উপায় কি! দিনের বেলায় হয়তো ঐ বনে অনেক পাহারাদার থাকবে। তাই তখন যাওয়াটা বিপদজনক। আর ইয়েজেরিনের ঝামেলাতো আছেই। তাই ভাবলাম যে, যাই হোক আমাকে আজ রাতেই সেই বনে যেতে হবে। এরপর আমি আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে বাহিরে আসলাম। ঘর থেকে বের হতেই বাড়ির আরো নতুন দুটো মুখের সাথে পরিচিত হলাম। একজন মধ্য বয়স্ক লোক ছিলো। লোকটা সেই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার ছেলে ছিলো। আর একটা ৮-৯ বছরের বাচ্চা মেয়ে ছিলো। মেয়েটা নাকি এই বাড়ির বড় ছেলের মেয়ে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে এই বাড়ির বড় ছেলে আর তার স্ত্রী এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকে মেয়েটি তার দাদা-দাদি আর চাচা-চাচির
সাথে এখানেই থাকে। বাচ্চা মেয়েটার মুখ পুরো মলীন। মেয়েটার চেহারার মধ্যে বিন্দুমাত্র হাসি আনন্দের চিহ্ন নেই! পরনে ছিলো একটা ময়লা ফ্রক আর চুলগুলো কুকরানো এবং এলোমেলো অবস্হায় ছিলো। প্রথম বার বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেই কেনো জানি একটা অজানা মায়া মনে কাজ করতে লাগলো।
বাচ্চা মেয়েটার নাম ছিলো মুশকান।
.
তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম।এরপর আমি তাদের বলে বাড়ি থেকে বের হলাম। তারা জানতে চেয়েছিলো যে আমি এতোরাতে কোথায় যাচ্ছি! আমি তাদের বলেছি যে, এমনি। নতুন এলাকাতো তাই একটু ঘুরে দেখে আসি। তারা আমাকে আটকালো না কিন্তু এটা বললো যে এই এলাকা রাতে মোটেও নিরাপদ না। এরপর আমি রাস্তা দিয়ে সেই বনের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করি। চারিদিকে প্রচুর অন্ধকার ছিলো। মনে হচ্ছিলো যে আমাবস্যা রাত! বাড়ি থেকে আসার আগে তাদের কাছ থেকে একটা হারিকেন নিয়ে এসেছিলাম। হারিকেনের আলোতেই ভয়ে ভয়ে রাস্তা ধরে বনের দিকে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন হাঁটার পরেই আমি সেই বনের সামনে চলে আসি। বনটা দেখেই বুঝতে পারলাম যে বনটা দিনের বেলায় যতটা না সুন্দর, রাতের বেলায় তার থেকে কয়েকগুন বেশি ভয়ংকর। বনটার ভয়ংকরতা যেনো আমার পা চলাকে থামিয়ে দিচ্ছিলো। বুঝতে পারলাম যে আসলেই এতো রাতে বনের ভেতরে যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু আমি নিরুপায়। যে করেই হোক আজ রাতেই আমাকে বনের ভেতর যেতে হবে।
এরপর আর কিছু না ভেবে আমি হারিকেনের আলোতেই বনের ভেতরে ভয়ে ভয়ে প্রবেশ করলাম। কিছুটা পথ স্বাভাবিক ভাবেই অতিক্রম করলাম। এরপর আমার চোখ থেমে গেলো হারিকেনের ঝাপসা আলোতে বনের এক পাশে সাদা কাপড় পরা একটা লোককে দেখে। প্রথমবার তাকে দেখে ভেবেছিলাম এটা আমার চোখের ভুল! এতো রাতে এই গভীর জঙ্গলে কেউ কেনো আসবে?! কিন্তু লোকটার দিকে হারিকেনের আলো ধরতেই বুঝলাম যে এটা আমার চোখের ভুল ছিলো না! আসলেই আমার থেকে কিছুটা দুরে একটা সাদা কাপড় পরা লোক আমার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে ছিলো। লোকটার মুখ তাই দেখতে পেলাম না। কিন্তু লোকটা এতোরাতে এখানে বসে কি করছে! লোকটার সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম একটা বেশ পুরাতন কবর দেখা যাচ্ছে। এবার কিছুটা শান্তি পেলাম। ভাবলাম যে লোকটা হয়তো রাতের বেলা কবর জিয়ারত করতে এসেছে। কিন্তু সে এইভাবে বসে আছে কেনো?! এরপর আমি সেই লোকটাকে ডাক দিলাম:
-এই যে ভাই শুনছেন? আপনি এতোরাতে এই জঙ্গলে কি করছেন? এই যে ভাই? আপনাকেই বলছি!
.
লোকটা আমার থেকে কিছুটা দুরেই বসেছিলো। কিন্তু আমার কথার কোন উত্তর দিলো না সে! লোকটা তখনো এমনভাবে বসেছিলো যে মনে হলো সে আমার কথা শুনতেই পায়নি। এরপর আরো কয়েকবার লোকটাকে একইভাবে ডাকলাম। কিন্তু লোকটা কোন সাড়া
দিলো না। এরপর অনেকটা বিরক্ত হয়েই হারিকেন নিয়ে লোকটার দিকে এগোতে থাকলাম। লোকটার দিকে যতোই এগোচ্ছিলাম ততোই আমার হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছিলো। একটা অজানা ভয় মনে কাজ করছিলো। এরপর যেতে যেতে আমি ঠিক লোকটার পেছনে এসে দাঁড়ালাম। কেমন যেনো একটা বিছ্রি গন্ধ আসছিলো লোকটার শরীর থেকে। লোকটার কাছে গিয়ে লোকটাকে আবার ডাকলাম। এবার যেনো লোকটার ধ্যান ভাঙলো। লোকটা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর হঠাৎ ভয়ংকর ভাবে হাসতে হাসতে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। হারিকেনের আলোতে লোকটার চেহারা দেখে আমি ভয়ে আৎকে উঠলাম। আসলে লোকটার দু’টো চোখ ছিলো না। দেখে মনে হচ্ছিলো চোখ দুটো পচেঁ গিয়েছে। এরপর লোকটার পুরো শরীর দেখে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। লোকটার পুরো শরীরের মাংস তখনো পঁচে গলে গলে মাটিতে পড়ছিলো। লোকটার শরীরভেদ করে অনেক হাড় বেরিয়ে ছিলো। এবার লোকটার কাপড় দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, সে একটা কাফনের কাপড় পরে আছে। ভয়ে আমার হাত-পা আর রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। এরপর লোকটা তার দুই হাত আমার দিকে প্রসারিত করে দিয়ে আমাকে বলতে লাগলো:-
-তুমি কে ডাকিনী বিদ্যার বাকি বইগুলো খুজে পেয়েছো?! আমাকে একটু সাহায্য করো!
.
এই বলেই লোকটা আমার দিকে এগোতে লাগলো। আমি লোকটাকে হাঁটতে দেখে ভয়ে হারিকেন তার দিকে ছুরে দিয়ে অন্ধকারেই পাগলের মতো দৌড়াতে শুরু করলাম। আমি নিজেও জানতাম না যে আমি কোথায় যাচ্ছি! আমার মাথায় তখন একটা কথাই ঘুরছিলো। যে করেই হোক এই ভয়ংকর লোকটা থেকে আমাকে বাঁচতেই হবে। আমি ছুটছিলাম আর মনে হচ্ছিলো যে আমার পিছু পিছু সেই লোকটাও আসছে। কিন্তু আমি অন্ধকারে পেছনে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না। আমি বুঝতে পারলাম যে আমি বনের অনেক গভীরে চলে এসেছি। এরপর একটু থামলাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়লো বনের এক পাশে আলো জ্বলছে। আমি আলোটা দেখে চমকে উঠলাম। বনের এতো ভেতরে এটা কিসের আলো!! তাহলে কি রাতে এখানে কেউ থাকে! এরপর ধীরে ধীরে সেই আলোর দিকে এগোতে থাকি। অবশেষে যেখানে আলো জ্বলছিলো সেখানে চলে আসলাম। আলোটা একটা ইটের ঘরের ভেতর থেকে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো ভেতরে কেউ রয়েছে!
এরপর সেই আলোতেই চারিদিক দেখতে লাগলাম। আমার কাছে জায়গাটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ চোখে পড়লো দুরে দুটো খড়ের ঘর রয়েছে। এবার আর আমার বুঝতে বাকি রইলো না। আরে! এটাতো সেই জায়গাটা যেখান থেকে আমি সেই অভিশপ্ত ডাকিনী বিদ্যার বইটা পেয়েছিলাম। আর এই ইটার ঘরটাতো তখন তালা দেওয়া ছিলো! কিন্তু এখন খোলা আছে এবং আমার মনে হচ্ছিলো যে ভেতরে কেউ আছে! আর আলোটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো যে এটা আগুনের আলো। মানে ভেতরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে! এরপর আমি কিছুটা ভয় কাটিয়ে সেই ঘরের ভেতর ঢুকলাম। ঢুকেই একটা কালো বর্ণের ভয়ংকর বিছ্রি চেহারার মুর্তি দেখে চমকে উঠলাম। মুর্তিটা বেশ বড় ছিলো। মুর্তির পায়ের কাছেই একজন লোক চোখ বন্ধ করে বসে ধ্যান করছিলো। লোকটাকে দেখে সাধুর মতো লাগছিলো। আমার উপস্হিতি বুঝতে পেরেই সে চোখ খুললো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো:
-চুপ করে মেঝেতে বসে পড়। কোন কথা বলিস না!
.
আমি আর কিছু না বলে চুপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। সাধু আবার চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসলেন। আমি একবার সেই সাধুর দিকে আরেকবার সেই ভয়ংকর মুর্তির দিকে তাকাচ্ছিলাম। আমার মনে কেমন যেনো একটা আশা জন্মাতে শুরু করলো। আমার মনে হলো আমাকে এই ডাকিনী অভিশাপ থেকে এই সাধুই
বাঁচাতে পারবে। প্রায় ১৫ মিনিট ধ্যানের পর সাধু আবার চোখ খুললেন। এরপর আমাকে প্রশ্ন করলেন:
-কি সমস্যা তোর? এতোরাতে মরতে এই জঙ্গলে এসেছিস কেনো? তোর কি চাই? (সাধু)
-বাবা! আমি বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আমি ডাকিনী অভিশাপে অভিশপ্ত। আমার সঙ্গে বাড়িতে একটা ডাকিনী থাকে। আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন। (আমি)
-ডাকিনী! আর তোর বাড়িতে! তোর সাথে থাকে?! এটা কি করে সম্ভব! বিষয়টা একটু খোলসা করে বলতো দেখি!
.
.
এরপর আমি সাধু বাবাকে সব কথা খুলে বলি। সাধু বাবার উপর আমার পুরোপুরি বিশ্বাস চলে এসেছিলো। তাই তার কাছে কিছুই লুকালাম না। তাকে সব সত্য কথা বলে দিলাম। সেই কয়েকমাস আগে এই বনে শিক্ষা সফরে আসা, এই নিষিদ্ধ জঙ্গলে প্রবেশ করা, এই কুড়েঘর থেকে ডাকিনী বিদ্যার বইটা নিয়ে যাওয়া, ডাকিনীকে পৃথিবীতে আহ্বান করা, ডাকিনীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, তার রক্ত নেশা, এই পর্যন্ত তার জন্য ২৭ টা খুন করা সব কথা আমি সাধু বাবাকে বললাম। উনি কথাগুলো শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। আমি ভাবলাম এবার হয়তো তিনি আমায় সাহায্য করবেন। কিন্তু এরপর উল্টো তিনি হাসতে শুরু করলেন। হাসতে হাসতে মুখে একটা গম্ভীরতা ভাব এনে আমায় যা বললেন:
-মুর্খ বালক! কি বলছিস এসব! ডাকিনী দেবী তোর আহ্বানে তোর বাড়িতে এসেছে?! আবার তোকে বিয়ে করে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে?! হাহাহাহা। হাসালি আমায়। আমি ৪৩ বছর ধরে ডাকিনী পুজা,তপস্যা করে আসছি তাও ডাকিনীর দেখা পেলাম না। আর তুই এক ঘন্টা মন্ত্র পড়েই ডাকিনী দেবীকে পৃথিবীতে নিয়ে আসলি! তুই মুর্খ। তোর সাথে কোন অশরীরী আত্মা ছলনা করেছে। তুই যে বর্ণণা দিলি তা মোটেও কোন ডাকিনীর হতে পারে না। আর বোকা! ডাকিনীরা কখনো অভিশপ্ত হয় না। তাদের কাজই হচ্ছে মানুষকে অভিশপ্ত করা। আর তারা অন্যের সাহায্য নিয়ে মানুষের রক্ত আর মাংসের ক্ষুধা মেটায় না। তারা নিজেরাই অনেক অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়। তারা নিজেদের শিকার নিজেরাই করে। কোন মানুষের সাহায্য নিতে হয় না। আর তোর সাথে যে থাকে সে যদি সত্যিই ডাকিনী হতো তাহলে তোকেও এতোদিন বাঁচিয়ে রাখতো না। আর ডাকিনীদের মনে কোন মায়া-ভালোবাসা থাকে না। আর শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোরতো প্রশ্নই উঠে না! আর তাদের চেহারার মধ্যে সৌন্দর্য্যের ফোটা বিন্দুমাত্রও নেই। তারা ভয়ংকর রুপে পৃথিবীতে আসে। এই মুর্তিটা দেখ! অনেকটা এরকম দেখতে হয় ডাকিনীরা। তাহলে বুঝলিতো তোর ঘরে কোন ডাকিনী থাকে না। হয়তো তুই যার সাথে থাকিস সেকোন ছলনাময়ী অশরীরী!
.
সাধু বাবার মুখে এই কথাগুলো শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম! কি বলছেন এসব সাধু বাবা! তার মানে ইয়েজেরিন কোন ডাকিনী না?! সে একটা অশরীরী আত্মা ! কিন্তু সে তাহলে আমার সাথে কেনো ছলনা করলো?! আর সেদিন ডাকিনী মন্ত্র পড়ার পরেই বা কি করে সে আসলো?! আর এতগুলো খুনই বা কেনো করালো আমাকে দিয়ে। তার আসল পরিচয়টাই বা কি?! এর উত্তরগুলো আমাকে জানতেই হবে!এরপর
চলবে