ডাকিনী বউ,১ম পর্ব
লেখক:মাসুদ রানা
রাত এখন আর কয়টা বাজে! হয়তো সর্বোচ্চ এগাড়োটা বাজে। কিন্তু রাস্তাঘাট আর আমার এলাকাটা এতোটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেনো?! আশেপাশে কোন মানুষতো দুরে থাক! কোন কুকুরেরো চিহ্ন নেই। আমার এলাকাতো আগে এমন ছিলো না! আগে রাত ১ টা পর্যন্তও মানুষকে রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতে দেখা যেতো। কিন্তু আজ একটাও মানুষ নেই! কিন্তু আজ যে আমার একটা তাজা মানুষের তাজা রক্ত আর মাংস লাগবেই। একটা জীবিত মানুষ বা তার লাশকে যদি বাড়িতে নিয়ে যেতে না পারি তাহলে যে আজ আর আমার কোন রেহাই নেই। হয়তো এই অভিশপ্ত অবস্থাতেই আজ আমার মৃত্যু ঘটবে! আমার হাতের মধ্যে একটা দাড়ালো ছুরি রয়েছে। এখন যদি আমি যেকোন একটা মানুষকেই দেখতে পাই তাহলে সাথে সাথে তার উপর ঝাপিয়ে পড়বো। ছুরির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দেবো তার পুরো শরীর। তার তাজা রক্তমাখা শরীরটা নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে। কোন একজন সেখানে একটা তাজা লাশের অপেক্ষায় ছটফট করছে! সে অপেক্ষায় আছে কখন আমি একটা তাজা লাশ নিয়ে বাড়িতে পৌছাবো! আর সে লাশটাকে রক্ত শুন্য করে ছিরেছিরে খাবে। কিন্তু আমিতো কোন মানুষকেই খুজে পাচ্ছি না। এদিকে আমার চেহারাটা আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছিলো। আমার ঠোঁট বেদ করে দুটো ভয়ংকর দাত বেরিয়ে আসছিলো।
আমার পুরো শরীর বড় বড় লোমে ভরে যাচ্ছিলো। আমার চোখদুটো পুরো রক্ত লাল হয়ে যাচ্ছিলো। আমার জিহ্বা প্রায় পুরোটাই আমার মুখের বাহিরে বেরিয়ে পড়ছিলো। আমাকে দেখতে অনেকটা নেকড়ে মানবের মতোই লাগছিলো। আমার নিজের শরীর থেকেই কেমন যেনো একটা ভয়ংকর বিছ্রি গন্ধ আসছিলো। অবশ্য এটা এখন আমার কাছে একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে। আমি যখনি বাড়িতে লাশ নিতে দেরি করি তখনি আমার সাথে এমনটা হয়। তার রক্ততৃষ্ণা আর মাংসের ক্ষুধা না মিটলে আমাকে সে আর আগের অবস্হাতে ফিরিয়ে দিবে না। তাই আমি এই ভয়ংকর চেহারা নিয়েই পাগলের মতো একটা মানুষকে খুজে যাচ্ছিলাম। যাকে খুন করে তার লাশ আমি বাড়িতে নিয়ে যাবো। কিন্তু মানুষ ভয়ে যদি বাড়ি থেকেই না বের হয় তাহলে আমি আর কি করতে পারি! অবশ্য মানুষের এই ভয় পাওয়ারো একটা যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কারণ গতকাল পর্যন্ত আমি আমার এলাকার মোট ২৩ জন মানুষকে খুন করেছি। তাদের খুন করে তাদের তাজা লাশগুলো আমার বাড়িতে নিয়ে কারো খাবারের ব্যবস্হা করেছি। তাই সেই ২৩ জনকে এলাকার মানুষ এখনো খুজে পায়নি। আর প্রত্যেকটা মানুষকেই আমি ঠিক সন্ধ্যাঁর পর বা রাতে এই ভয়ংকর চেহারায় এসে খুন করেছি। তাই এলাকার মানুষগুলো আর সন্ধার পর বাড়ি থেকে বের হয়না। এইতো গতপরশু দিন আজকের মতো পাগল হয়ে একটা মানুষকে খুচ্ছিলাম খুন করে বাড়িতে নিয়ে যাবো বলে। খুজতে খুজতে রাত প্রায় ১২টা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি কাওকে খুজে পাচ্ছিলাম না । এরপর চোখ গেলো আমাদের এলাকার চৌকিদারের দিকে। সে তখনো রাস্তা পাহারা দিচ্ছিলো। এরপর আমি ধীরে ধীরে তার কাছে যাই এবং তার পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করে ফেলি। এরপর ছুরি দিয়ে তার গলাকেটে তার রক্তমাখা শরীর নিয়ে আমি বাড়িতে ফিরি। এরপর গতকাল রাতেও দুজন পুলিশ হাবিলদার এসেছিলো এলাকাটা পাহারা দেওয়ার জন্য। আমি তাদেরো খুন করে তাদের লাশ বাড়িতে নিয়ে যাই। তাদের আগেও আমি আরো ২০ জনকে ঠিক একইভাবে খুন করেছি। অনেকেই আমাকে খুনগুলো করতে দেখেছে। কিন্তু তারাতো আমাকে চিনতে পারেনি। কারণ আমার পুরো শরীর লোমে আবৃত ছিলো এবং আমাকে দেখতে অনেকটা নেকড়ে মানুষের মতো লাগছিলো। তাই আমার এলাকায় এই কথাটা ছড়িয়ে পড়ে যে “এই এলাকায় নাকি নেকড়ে মানুষ এসেছে। সে মানুষকে জানোয়ারের মতো ছিড়ে খায়।” কিন্তু তারা আমাকে চিনতে পারে নি। তাই এই এলাকায় রাতের বেলায় আর কেউ বের হয়না। কিন্তু তারাতো আর জানে না যে আমি কোন নেকড়ে মানুষ না। আমি একটা অভিশপ্ত মানুষ। আর আমি এসব খুন আমার জন্য করিনা। এইগুলো করি আমার বাড়িতে থাকা সেই মানুষ খেকোর জন্য। থাক! এসব কথা। এখন যে করেই হোক আমাকে একটা মানুষের লাশ জোগাড় করতেই হবে।
এতো কষ্ট আর আমার সহ্য হয় না। আমি তৃষ্ণার্থ দৃষ্টিতে মানুষ খুজতে খুজতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। অনেকটা পথ হাঁটার পর একটা কবরস্হানের সামনে এসে দাড়ালাম। ভাবলাম হয়তো কবর পাহারা দেওয়ার জন্য কেউ ভেতরে রয়েছে। তাকেই আজ খুন করে নিয়ে যাবো। কিন্তু কবরস্হানের ভেতরে ঢুকে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পুরো কবরস্হানে একটা মানুষকেও খুজে পেলাম না। হয়তো কবরস্হানের পাহারাদারো আমার ভয়ে আর রাত্রে বেলা এখানে আসে না। কিন্তু আমার প্রচন্ড যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি যে বাড়িতে কোন একজন তৃষ্ণা আর ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছে। এরপর আমার চোখ যায় কবরস্হানের একটা নতুন কবরের দিকে। কবরটা দেখে মনে হচ্ছিলো হয়তো আজ বিকেলেই কেউ এখানে লাশটাকে কবর দিয়ে গেছে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি আসলো। আমার বাড়িতে যে তৃষ্ণার্থ বা ক্ষুধার্থ অবস্থাতে রয়েছে তারতো শুধুমাত্র একটা মানুষের রক্ত আর মাংস চাই। হোক সেটা জীবিত মানুষ খুন করার পর বা কবর থেকে তোলা কোন লাশ। সেটাতো আর তার কাছে কোন ব্যাপার না। তার শুধু শরীরের ভেতরের রক্ত আর মাংস চাই! যেই ভাবা সেই কাজ। সিদ্ধান্ত নিলাম এই কবরটা খুড়ে এই লাশটাকেই আজ বাড়িতে নিয়ে যাবো। তারপর এই লাশটাই তার সকল ক্ষুধা আর তৃষ্ণা মেটাবে। কপালটাও মনে হয় ভালো ছিলো কারণ পাশে তাকিয়েই দেখলাম একটা কোদাল পরে রয়েছে। এখন বুঝলাম আমাকে কি করতে হবে! আমি কোদালটা নিয়ে সেই নতুন কবরটা খুড়তে শুরু করলাম। কবর খুড়তে খুড়তে ভাবছিলাম যেই আমি ছোটবেলায় কাউকে খাটিয়ায় করে লাশ নিয়ে যেতে দেখলেই ভয়ে সেখান থেকে দৌড়ে চলে আসতাম সেই আমিই আজ একটা কবর খুড়ছি লাশ নিয়ে জাওয়ার জন্য। পরিস্হিতি যে মানুষকে কতোটা বদলে দিতে পারে তা আমার ভালো করেই বোঝা শেষ। এবার ধীরে ধীরে কবর খুড়া প্রায় শেষ হয়ে গেলো। কবরটা নতুন ছিলো তাই খুড়তে এতোটাও কষ্ট হলোনা। কবর খুড়া শেষে কতগুলো বাঁশের টুকরা আর পাটি দেখতে পেলাম। পাটিটা সড়াতেই স্পষ্ট কাফনে মোড়া একটা লাশ দেখতে পেলাম। লাশটার মুখের উপর থেকে কাপড়টা সড়ালাম। দেখলাম একটা যুবতী মেয়ের লাশ এটা। হয়তো মেয়েটাকে আগে কখনো দেখিনি। অবশ্য তাতে আমার কি! আমারতো শুধুমাত্র একটা লাশ লাগবে।এরপর কাফনে মোড়া লাশটাকে কাধে করে কবরের উপর উঠলাম। এরপর আবার কবরটাতে পাটি,বাঁশের টুকরা ফেলে মাটি দিয়ে ভর্তি করে দিলাম। এমনভাবে কবরটাতে আবার মাটি দিলাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে কবরটা আবার খুড়া হয়েছিলো। কারণ কেউ বুঝলেই হয়তো সন্দেহ করবে যে নেকড়ে মানুষটা হয়তো এখন আবারো কবর খুঁড়ে লাশ চুরি করা শুরু করে দিয়েছে! তাহলে আবার আমার কবর খুঁড়ে লাশ নেওয়াটাও ভেজাল হয়ে যাবে। এরপর কবরে মাটি দেওয়া শেষে লাশটা
কাধে করে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত হেঁটে আসছিলাম। হঠাৎ কেনো যেনো একটা অজানা ভয় মনে কাজ করছিলো। কাঁধে একটা কাফনে মোড়া লাশ!! এরপর ধীরে ধীরে নিজের বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম। এরপর আশেপাশে খুব ভালো করে দেখতে লাগলাম যে কেউ আমাকে লাশটা নিয়ে ঘরে আসতে দেখলো কিনা! হয়তো আমার এই ভয়ংকর চেহারা দেখে কেউ আমাকে চিনবে না। কিন্তু কেউ যদি দেখে যে আমার বাড়িতে একটা নেকড়ে মানুষ লাশ নিয়ে ঢুকছে তাহলে তারা নিশ্চিতভাবে আমাকে সন্দেহ করবে। তাই খুব সতর্কতার সাথে ভালো করে চারিদিকে দেখে এরপর লাশটা নিয়ে নিজের ঘরের সামনে গেলাম। এরপর দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে দিতে ডাকলাম:
-ইয়েজেরিন? ইয়েজেরিন? আমি এসেছি তোমার স্বামী। তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি দ্রুত দরজাটা খুলো!
.
ইয়েজেরিন হয়তো আগে থেকেই দরজার সামনে পাগলের মতো একটা লাশের অপেক্ষায় দাড়িয়ে ছিলো। আমি তাকে ডাকার সাথে সাথেই সে দ্রুত দরজাটা খুলে দেয়। এরপর আমি দ্রুত লাশটা নিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজাটা আটকে দেই। ইয়েজেরিন আমার কাধে কাফনে মোড়া লাশটার মুখ দেখে আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে যায়। সে আগে থেকেই একটা ছুরি হাতে লাশ কেটে খাওয়ার অপেক্ষায় বসে ছিলো। আমি লাশটা মেঝেতে রাখতে না রাখতেই সে দ্রুত লাশটার
উপর ঝাপিয়ে পড়ে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ইয়েজেরিন খুশি হওয়াতে আমার ভয়ংকর শরীর আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলো। যদিও জানি যে এই স্বাভাবিকতা শুধু ক্ষনিক সময়ের জন্য।
.
.
আসলে ইয়েজেরিন হলো আমার স্ত্রী। কিন্তু সে কোন স্বাভাবিক মেয়ে না। সে এই দুনিয়ার কেউ না। ইয়েজেরিন হলো একজন ডাকিনী। সে ডাকিনী রাজ্য থেকে এসেছে। আমি এই পর্যন্ত যতগুলো মানুষকে খুন করেছি তাদের সবাইকেই খুন করেছি ইয়েজেরিনের রক্ত তৃষ্ণা আর তাজা মাংসের ক্ষুধা মেটানোর জন্য। আমিও একজন স্বাভাবিক ছেলে ছিলাম। কিন্তু এই স্বাভাবিক জীবন থেকে এই অভিশপ্ত জীবনে প্রবেশ করা, একজন ডাকিনী মেয়েকে বিয়ে করা, তার জন্য খুন করা এবং সমাজকে লুকিয়ে তার সাথে সংসার করার পেছনও একটা বড় গল্প রয়েছে।
চলবে