টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব-১০,১১

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১০,১১
লেখা: ShoheL Rana শামী
১০

বাড়ির সামনে একজন পত্রিকার হকারকে থামিয়ে কথা বলছেন জাফর মাস্টার। হাতে তার বাজারভর্তি ব্যাগ। বাজার থেকে ফেরার মুহূর্তে হকারকে থামিয়ে তিনি দুটো পত্রিকা নিয়ে দাম দিলেন। তারপর হকারকে প্রশ্ন করলেন,

‘তুমি তো প্রতিদিন এই পথ দিয়ে যাও, তাই না?’

‘জি স্যার।’

‘বাসা কোথায়?’

‘মোড়ল-পাড়া।’

‘আচ্ছা শুনো, তুমি প্রতিদিন আমার বাড়িতে এই পত্রিকা দুটো দিয়ে যেয়ো, কেমন? এটাই আমার বাড়ি।’ বাড়িটা ইশারা করে দেখালেন জাফর মাস্টার।

‘জি স্যার।’ জবাব দিলো হকার।

‘মাস শেষে একেবারে হিসাব করে পয়সা নিয়ে নিয়ো।’

‘ঠিক আছে স্যার।’ বলেই বিনয়ের সাথে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল হকার। সুফিয়া এগিয়ে এসে বাবার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে গেল। জাফর মাস্টার গায়ের কুর্তাটা খুলে সামনের কক্ষে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাতে লাগলেন। খানিক পর মেয়ের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন, ‘সুফিয়া… সুফিয়া…’

‘হ্যাঁ বাবা, বলো।’ বাবার ডাকে রান্নাঘর থেকে এলো সুফিয়া। জাফর মাস্টার পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, ‘ছেলেটার কথা তো সত্যি হয়ে গেল রে।

‘কোন ছেলে?

‘ঐ রিহান। সে বলেছিল না এই মাসেই ব্রিটিশ সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাবে বার্মা। এই যে, বার্মা দখল করে ফেলেছে জাপানি সেনারা।’

‘কই? দেখি…’ পত্রিকার দিকে মুখ বাড়িয়ে সুফিয়া শিরোনামটা পড়ে নিলো। তারপর বললো, ‘বার্মা তাহলে ব্রিটিশরা নিজেদের দখলে রাখতে পারলো না? কিন্তু বাবা, তুমি কি বিশ্বাস করতে শুরু করেছো, রিহান সাহেব ভবিষ্যত থেকে এসেছেন?’

‘আরে না।’ হাসলেন জাফর মাস্টার। ‘এরকমটা হয় না-কি? এখন চলে ১৯৪২ সাল মাত্র। কেউ কয়েক যুগ পর থেকে কী করে আসবে? ছেলেটার আসলে মাথায় কোনো অসুখ হয়েছে। বাড়িঘর কোথায় সেটাও হয়তো সে জানে না। এখানে সে কার বাসায় না কার বাসায় থাকে। একটা ডাক্তার দেখাবো ভাবছিলাম তাকে, তাও হয়ে ওঠছে না। আচ্ছা, ছেলেটা তো অনেকদিন এদিকে আসে না, সেই যে গেল! কী হয়েছে বল তো?’

‘আমিও তো জানি না বাবা। তুমি একবার খোঁজ নিয়ে আসবে? ঐ যে, ওইদিন যে বাড়িটার সামনে উনাকে আমরা নামিয়ে দিয়েছিলাম ট্যাক্সি হতে, ঐ বাড়িতেই হয়তো থাকেন।’

‘ঠিক আছে। আমি একবার সময় করে দেখে আসবো ওকে।’

‘কিছু হয়ে যায়নি তো বাবা উনার? এমনিতেই কিছু চিনে না এদিকে। তার উপর মাথায়ও অসুখ, দেশের পরিস্থিতিও ভালো না। তুমি আজই একবার খোঁজ নিয় আসো না বাবা?’ সুফিয়ার মন যেন মানছে না।

‘আচ্ছা, বিকেলে যাবো।’

বিকেলে জাফর মাস্টার রিহানের খোঁজে জাকারিয়া সাহেবের বাড়িতে এলে, জাকারিয়া সাহেব মাস্টার সাহেবকে রিহানের কক্ষে নিয়ে এলেন। রিহান সে সময় শুয়ে ছিল বিছানায়। তাকে দেখিয়ে জাকারিয়া সাহেব বললেন, ‘এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। বিমানের লেজের ভারি একটা অংশ তার গায়ে পড়েছিল। ভাগ্যিস গাছের শাখায় বাড়ি খেতে খেতে ওটা পড়েছিল, সরাসরি ওর উপর পড়লে ওখানেই মারা যেতো। আমরা চিকিৎসা করেছি। এখন অনেকটা সুস্থ ও।’

জাফর মাস্টার রিহানের পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় হাত বুলাতেই চোখ খুললো সে। মাস্টার সাহেবকে দেখে দুর্বল শরীরে উঠে বসতে চাইলে রিহানকে উনি পুনরায় শুয়ে দিলেন। তারপর একটু শাসনের সুরে বললেন, ‘তুমি কি ছোটো বাচ্চা? ঐ সময় যুদ্ধরত দুটো বিমান তোমার মাথার উপরে। তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?’

রিহান জবাব দিলো, ‘আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম আংকেল, এরকম কিছু হওয়ার পর আমার সময়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কী হলো দেখেন, আমি এখনও আপনাদের সময়েই আটকে আছি। আমি আমার কথাগুলো কাউকে বিশ্বাসও করাতে পারি না। কেন যেন নিজেকে আপনাদের থেকে আলাদা মনে হয়।’

‘তুমি একদম এসব ভাববে না। তুমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে যাবে।’

‘আমি মানসিকভাবে অসুস্থ নয় আংকেল। আমি সত্যিই ভবিষ্যত থেকে এসেছি। এই মাসের শেষের দিকে বার্মা জাপানের দখলে চলে যাবে বলেছিলাম, আপনি পত্রিকায় এসব ব্যাপারে কোনো সংবাদ পেয়েছেন তো?’

‘হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু, জাপানদের শক্তি অনেক বেশি, এটা আগে থেকেই অনুমেয় ছিল যে ওরা বার্মা দখল করবে।’

জাকারিয়া সাহেব এতক্ষণ ওদের কথা কিছুই বুঝেননি। কী নিয়ে কথা বলছে এরা? হা করে চেয়েছিলেন এতক্ষণ। এবার বলে উঠলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝছি না। কী নিয়ে কথা হচ্ছে এখানে? কীসের এই সময়, সেই সময়? কীসের ভবিষ্যৎ?’

‘আমি বুঝাচ্ছি আপনাকে।’ জাফর মাস্টার বোঝাতে লাগলেন জাকারিয়া সাহেবকে। ‘এই যে রিহান, ও বলতে চাচ্ছে ও আমাদের সময়ের কেউ না। ওর জন্ম হবে ভবিষ্যতে। আর ও হবে আপনাদের উত্তরসূরী।’

‘ও তাহলে সেদিন এই মতলব নিয়ে আমার বাসায় ঢুকেছিলে, তাই না? আজ বুঝতে পেরেছি।’ জাকারিয়া সাহেবের কথায় ক্রোধ প্রকাশ পেল। জাফর মাস্টার তাঁকে বললেন, ‘ছেলেটা আসলে ভালো। আপনি ওকে ভুল বুঝছেন। আসলে ও একটু অসুস্থ। আমি ওকে ডাক্তার দেখাবো।’

‘না, না, এই ছেলেকে বিশ্বাস করে আমি ভুল করেছি। ওকে এখনই বের করবো আমার বাড়ি থেকে।’

খবরটা ইতোমধ্যে সারাবাড়ি হয়ে গেল। সবাই এখন এই বিষয়টা নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলো৷ ইউনুস এসে জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে নিয়ে কী যেন বুঝালো। তারপর পুনরায় ওরা ফিরে আসলে দেখা গেল জাকারিয়া সাহেবের মাঝে রাগটা আর নেই। ইউনুস এবার বলে উঠলো, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে। বাবা রিহানকে এখানেই রাখবে। এখানেই থাকুক ও। আমরা মেনে নিলাম ও আমাদের উত্তরসূরি৷’

রিহান অবাক হয়ে গেল। ইউনুস লোকটা তো তাকে পছন্দ করতো না। হঠাৎ তার পক্ষ নিলো কেন? ওভাবে সে জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে নিয়ে কী বুঝালো যে, উনার রাগটুকু জল হয়ে গেল?

পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে এলে সবাই যার যার মতো আবার কাজে লেগে গেল। জাফর মাস্টারও উঠে দাঁড়ালেন। যাওয়ার আগে রিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বললেন, ‘দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে গেলে আমার ওদিকে যেয়ো, কেমন?’

‘যাবো আংকেল।’ রিহানও হাসলো।

জাকারিয়া সাহেবের সাথে বেরিয়ে গেলেন জাফর মাস্টার। রিহান একা শুয়ে রইলো কক্ষে। একটা বাচ্চা শিশুর কান্না শোনা গেল হঠাৎ। রিহান হাসলো। তার পিচ্চি দাদি কান্না করছে। অনবরত কেঁদেই চলেছে। আরেকটা কণ্ঠ ভেসে এলো ওই ঘর থেকে। পিচ্চি দাদির মায়ের কণ্ঠ। বাচ্চাকে সে শান্ত করার চেষ্টা করছে, ‘কাঁদিস না মা, কাঁদিস না আমার সাহারা মা উমমম উমমম উমমম।’

ওরা শেষ পর্যন্ত বাচ্চার নাম ‘সাহারা’ রেখেছে। রিহানের মুখ থেকে শুনে নামটা পছন্দ হয় খিজিরের। তারপর খিজির মেয়ের নাম ওটাই রাখে। তারমানে বলতেই হয়, দাদির এই ‘সাহারা’ নামটা হওয়ার পেছনে তারও অবদান আছে। আচ্ছা, পিচ্চি দাদি এভাবে কাঁদছে কেন? কখন থেকে কেঁদে চলেছে! কোনো সংকেত দিচ্ছে না তো কান্নার মাধ্যমে? ওই সময় ইউনুস কী বলেছিল জাকারিয়া সাহেবকে? পুনরায় মনে হতে ব্যাপারটা মাথা থেকে ফেলতে পারলো না রিহান। অনেকক্ষণ পর তার কক্ষে এলো ইউসুফ। ইউসুফ তাকে দেখে ব্যঙ্গ করে হাসলো। এখনও সে রিহানকে শত্রু মনে করে। ইউসুফকে হাসতে দেখে রিহান জিজ্ঞেস করলো, ‘কী দাদা, হাসছো কেন?’

‘চুপ।’ দুই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো ইউসুফ। ‘কে তোমার দাদা?’

‘তুমিই আমার দাদা।’ মৃদু হাসলো রিহান।

‘বলো, বলো, আরও দাদা বলো আমাকে। শীঘ্রই তুমি টের পাবা।

‘কী টের পাবো?’ ভ্রু কুঁচকালো রিহান।

ইউসুফ আরও কাছে এসে গলাটা নিচু করে বললো, ‘তোমাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেবে বলেছে। তারপর মজা বুঝবা। আমাকে সেদিন পয়সা দিয়ে ফেরত নিছো না? এবার খুব মজা হবে। হা হা হা।’

‘কে আমাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেবে?’ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিলো রিহান।

‘আমার বাবা। বাবাকে বলতে শুনেছি এসব। আমার কমল চাচা আছে না? কমল চাচাকে ব্রিটিশরা খুঁজছে না? কমল চাচার বদলে তোমাকে ধরিয়ে দেবে। হুমম…’ ইউসুফ যেন খুব মজা পাচ্ছে কথাগুলো বলতে পেরে।

‘যাহ্, কমল চাচার বদলে আমাকে কী করে ধরায় দেবে? আমি আর ও এক না-কি?’

‘আরে, তোমার আর কমল চাচার শরীর তো দেখতে একই-রকম। শুধু চেহারাটায় মিল নাই। ব্রিটিশরা তো কমল চাচার চেহারা মনে রাখেনি।’

‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও।’

‘হু হু, এখন মজা হবে। আমাকে পয়সা দিয়ে তুমি ফেরত নিছো।’ নেচে নেচে বের হয়ে গেল ইউসুফ। তার কথাগুলো বিশ্বাস করলো রিহান। তারমানে ঐ সময় জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে নিয়ে এই কথাগুলো বলেছিল ইউনুস। ইউনুস হয়তো কমলকে বাঁচানোর জন্য আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করেছে, যা জাকারিয়া সাহেব জানতেন না। তাই ঐ সময় জানার পর হঠাৎ কথার ধরন পালটে গিয়েছিল তাঁর। সবাই মিলে এরা রিহানকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো রিহান ইউসুফের প্রতি। ইউসুফ তাকে শত্রু ভেবে উপকারই করে গেল। মনে মনে রিহান বললো, ‘ধন্যবাদ দাদা, অতীতে এসে তোমাকে আমি মার খাইয়েছি, আর তুমি আমাকে অজ্ঞাত অবস্থায় বড়ো বিপদ থেকে বাঁচালে।’

পিচ্চি দাদিকেও ধন্যবাদ দিলো রিহান। ওর কান্না থেমে গেছে এখন। হয়তো কান্নার মাধ্যমে সেও একই সংকেত দিতে চেয়েছিল। নিজের দাদা-দাদি তাকে এভাবে বাঁচিয়ে দিলো! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসলো রিহান। তাকে আজই পালাতে হবে এখান থেকে। কিন্তু কীভাবে পালাবে? দুর্বল শরীর নিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে পালাতে পারবে তো?

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১১
লেখা: ShoheL Rana শামী

রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে রিহান তার ব্যাগটা গুছিয়ে বের হয়ে পড়ে জাকারিয়া সাহেবের বাড়ি থেকে। নিজের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা হয়ে গেছে তার৷ কতটা নির্মম হলে এরা একজনের জায়গায় আরেকজনকে বলি দিতে দ্বিধাবোধ করে না! সে এমনিতেই একটা বিপদ থেকে বের হতে পারছে না, এখন যদি ব্রিটিশদের হাতে গিয়ে পড়ে, তবে আরেক বিপদ। সে ইতোমধ্যে বুঝেছে, কোনো দুর্ঘটনা হলেও তার সময়ে ফিরতে পারবে না। যদি ভাগ্য চায়, তবেই ফিরতে পারবে, যেভাবে ভাগ্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

নিস্তব্ধ রাস্তায় কোনো পরিবহন চলছিল না সেই সময়। গ্রাম এলাকার মানুষ একটু রাত হতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে রিহান হেঁটেই জাফর মাস্টারদের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দুর্বল শরীর নিয়ে হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। অনেকটা হাঁটার পর সে হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দ পেলো। একটা প্রাইভেট কার ছুটে আসছে। রিহান রাস্তায় দাঁড়িয়ে লিফট চাইলো। থামলো গাড়িটা।

‘কী চায়?’ ড্রাইভিং সিট থেকে একজন প্রশ্ন করলো।

‘একটু লিফট পাবো, স্যার? একটু চর-আলগীতে নামিয়ে দেবেন?’

‘চর-আলগী এটা কোথায়?’

‘ঐ তো সামনে, কয়েক কি.মি দূরে।’

‘দুঃখিত, লিফট দেয়া যাবে না।’

তখন পেছনের সিট থেকে একজন বললেন, ‘তুলে নাও ওকে, সামনে নামিয়ে দিয়ো।’

‘কিন্তু স্যার, লোকটাকে দেখুন, কেমন অদ্ভুত লাগছে। গাড়িতে তুললে কোনো বিপদ হবে না তো? তাছাড়া আমরা এভাবে বের হয়েছি কেউ জানে না।’

‘সমস্যা নেই, তুলে নাও। লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছে। গাড়িতে তোলার আগে ব্যাগটা চেক করে নাও।’

‘ঠিক আছে স্যার।’

কথা-বার্তায় বোঝা গেল পেছনের লোকটা কোনো ভিআইপি। লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে বাইরে। হয়তো কোনো প্রয়োজনে বা কাজের ফাঁকে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে। লোকটার চেহারা দেখা গেল না। ধুলাবালি থেকে রক্ষার্থে মুখে মাস্ক পরে আছেন তিনি। রিহান ব্যাগটা এগিয়ে দিলো ড্রাইভারের দিকে। ড্রাইভার ব্যাগ চেক করতে করতে বললো, ‘স্যার, সন্দেহজনক কিছু নেই। কিছু কাপড়চোপড়, একটা ডায়েরি, আর কী একটা যন্ত্র আছে।’

‘কী যন্ত্র?’ প্রশ্ন করলেন পেছনের লোকটা।

‘মোবাইল স্যার, মোবাইল। এটা দিয়ে কথা বলা হয়।’ জানালো রিহান।

‘ঠিক আছে, ওর জিনিস ওর ব্যাগে রেখে দাও। ওকে গাড়িতে তুলে নাও।’ নির্দেশ দিলেন পেছনের লোকটা। মোবাইল জিনিসটা কী, এটা দিয়ে কীভাবে কথা বলা হয়, এসব ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন না। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত মনে হচ্ছে তাঁকে। রিহান ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলে, গাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো। নির্জন রাস্তা পেয়ে ছুটতে লাগলো গাড়ি। হঠাৎ পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘গাড়ি থামাও। সামনের বাঁ পাশের চাকাটা থেকে বাতাস বের হচ্ছে। চাকাটা চেঞ্জ করো।’

আশ্চর্য হয়ে গেল রিহান। গাড়ি তো ঠিকই আছে। সুন্দর গতিতে ছুটছে। বাতাস বের হবে কেন? কোনো শব্দও তো হচ্ছে না।

গাড়ি থামালো ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে চেক করলো সে। তারপর বললো, ‘জি স্যার, চাকাটা থেকে বাতাস যাচ্ছে। এখনই চেঞ্জ করে দিচ্ছি।’

ড্রাইভারের কথা শুনে চমকে তাকালো রিহান পেছনের লোকটার দিকে। ‘স্যার, আপনি কী করে জানলেন একটা চাকা থেকে বাতাস বের হচ্ছে? আর ঐটা যে সামনের বাঁ পাশের চাকা, এটাই বা কী করে বুঝলেন?’

‘নাম কী তোমার?’ পেছনের লোকটা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন। রিহান নিজের নাম বললে উনি পুনরায় বললেন, ‘জীবনে চলতে গেলে চারপাশটা অবজারভেশনে রাখবা। বুঝলে তো যুবক?’

‘তা রাখবো। কিন্তু স্যার, কতটা অবজারভেশন করলে না দেখেই, না শুনেই বলে দেয়া যায় ঠিক ঐ চাকা থেকেই বাতাস বের হচ্ছে?’

‘শুনো রিহান, তুমি গাড়িতে উঠার পর সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট ব্যালেন্স ছিল। তোমার আর আমার ড্রাইভারের একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি এক ইঞ্চি বাঁ দিকে কাত হয়ে গেছো। আর আমি হালকা সামনে ঝুঁকে গেছি। পুনরায় আমরা আগের ব্যালেন্সে আসলে সব ঠিকই থাকতো, কিন্তু আগের ব্যালেন্সে ফিরিনি আমরা, তাই সহজেই বুঝলাম বাঁ পাশের চাকাটা থেকে বাতাস বের হচ্ছে।

‘কিন্তু, কীভাবে এতটা নিখুঁতভাবে বললেন স্যার? আমি বা আপনার ড্রাইভার কেউ তো টেরই পাইনি।’

‘ঐ যে বললাম, অবজারভেশন?’

রিহান এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। একটা লোক এতটা মেধাবী কী করে হতে পারে? রিহান তার পুরো জীবনে হয়তো এতটা মেধাবী লোক দেখেনি।

চাকা বদলিয়ে পুনরায় উঠে বসলো ড্রাইভার। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘পেছনে যিনি বসে আছেন, তাঁকে চিনছেন তো?’

‘না, কে উনি?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিহান।

‘উনার সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই, তাই এতটা অবাক হচ্ছেন। উনি খুবই দূরদর্শী এক লোক। উনার পরিচয়টা না হয় অজানাই থাকুক।’

রিহানের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। এমন এক মেধাবী লোকের সাথে তার দেখা হলো অতীতে এসে, আর সে তাঁর পরিচয়টা জানবে না?’

‘কোথায় নামবে তুমি?’ পেছন থেকে প্রশ্ন এলো।

‘আরেকটু সামনে স্যার।’ জবাব দিলো রিহান।

‘নিজ বাড়ি নিশ্চয়ই এখানে নয়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, একটু দ্বিধায় আছো।’

‘জি স্যার। আপনি তো মেধাবী লোক। আপনাকেই বলি আমার কথাটা। কেউ তো বিশ্বাস করে না আমাকে।’

‘বলো শুনি।’

‘আমি আপনাদের এই সময়ের কেউ না। ভবিষ্যত থেকে এসেছি।’

চমকে উঠে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। কিন্তু, এতটাও চমকালেন না পেছনের লোকটা। তিনি ড্রাইভারকে ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে বলে রিহানকে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘ভবিষ্যত থেকে এসেছো? কোন সাল থেকে?’

‘২০১৭ সাল স্যার।’

‘আচ্ছা, তুমি জানো বাংলার প্রধানমন্ত্রী কে এই সময়ে?’

‘মানে আপনাদের এই ১৯৪২ সালে?’

‘হ্যাঁ।

রিহান ইতিহাসের ছাত্র ছিল। তাই একটু কী যেন ভেবেই বললো, ‘বাংলার প্রধানমন্ত্রী এখন শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক নিশ্চয়ই। আরও এক বছর তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।’

‘আর এক বছর পর কে হবেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী?’

‘খাঁজা নাজিমুদ্দীন।’

রিহানের কথাগুলো লোকটা বিশ্বাস করলো কি-না বোঝা গেল না। হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না তিনি। একটু পর গাড়ি থেকে নেমে গেল রিহান। তাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি যখন চলে যাচ্ছিল, তখন পেছনের লোকটা মুখ বের করে মাস্কটা নামিয়ে বললেন, ‘ভালো থেকো যুবক।’

চেহারাটা চিনতে পারলো রিহান। এই চেহারাটা অনেকবার বইয়ের পাতায় দেখেছে সে। যিনি ‘বাংলার বাঘ’ নামে পরিচিত। স্বয়ং শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে একই গাড়িতে চড়ে এসেছে রিহান! বিশ্বাস করতে পারছে না সে। উনার মেধার পরিচয় সে বইয়ে পড়েছে, আজ যেন স্বচক্ষে দেখলো।

‘স্যার স্যার’ বলে ডাক দিলো রিহান কয়েকবার। গাড়িটা ক্রমশ দূরে সরতে লাগলো।

জাফর মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে দরজায় টোকা দিলে ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে দরজা খুললেন মাস্টার সাহেব। রিহানকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এ কী! রিহান তুমি এত রাতে?’

রিহান সব খুলে বললো মাস্টার সাহেবকে। শুনে উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ভেতরে এসো। কিছু খেয়েছো?’

‘হ্যাঁ, খেয়েছি।’

‘এখন তবে ঘুমাও। সকালে কথা হবে।’

সকালে রিহানের ঘুম ভাঙলো পানির স্পর্শ পেয়ে। সুফিয়া এসে মুখের উপর পানির ছিটকা দিয়ে বললো, ‘এই যে, ওঠুন।’

চোখ খুলে রিহান আড়মোড়া ভাঙলো। রাতে সুফিয়ার সাথে দেখা হয়নি তার। তখন সে ঘুমিয়ে ছিল। এখন তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি। চোরের মতো আমাদের বাসায় কে প্রবেশ করতে বলেছে?’

‘চোরের মতো না তো। আংকেল দরজা খুলে দিয়েছিল।’

‘আমি তো দেখিনি। তাই চোরের মতোই ঢুকেছেন। যাইহোক, ওঠুন। খাবার খাবেন। ইশ! আপনার কপালটা তো অনেকটা কেটে গেছে।’

‘ঐ যে, ঐদিন বিমানের অংশ পড়েছিল…’

‘শুনেছি বাবার কাছে। এর বিচার পরে হবে। এখন ওঠুন তো…’

‘বিচার? কীসের বিচার?’

জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল সুফিয়া।

অবশ্য পরে এটা নিয়ে আর কথা বলেনি সুফিয়া। সুযোগই পাইনি সে। সারাদিন ব্যস্ত ছিল। পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল তাকে সেদিন। সারা ঘরে মেহমানে ভরে গিয়েছিল। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে কয়েকটা ভাবি এসে সুন্দর করে সাজিয়েছিল সুফিয়াকে। তখন তাকে এত বেশি সুন্দর লেগেছিল, পাত্রপক্ষ আর অপছন্দ করতে পারেনি। অবশ্য আগে থেকে ওরা পছন্দ করেই এসেছে। পাত্রের বাবা জাফর মাস্টারকে বাজারে পেয়ে সুফিয়াকে নিজের ছেলের বউ করার প্রস্তাব করে। এর আগেও অনেকবার একই প্রস্তাব করেছে। মাস্টার সাহেব অনেকবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও এবার আর না করেননি। বয়স তো কম হয়নি সুফিয়ার। বারো-তেরো বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেখানে সুফিয়ার বয়স এখন আঠারো প্রায়। সুফিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে জাফর মাস্টার একা হয়ে পড়বেন, তাই এতদিন বিয়ে দেননি। তবে এখন আর নিজের কথা ভাবেননি উনি। মেয়ের কথা ভেবেছেন। হঠাৎ উনার কিছু হয়ে গেলে সুফিয়ার কী হবে? তাই এবার বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন।

পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর, বিকেলে একটু অবসর পায় সুফিয়া। তখন সে ক্লান্ত ছিল। কারও সাথে কথা না বলে নিজ কক্ষে গিয়ে শুয়ে পড়ে। জাফর মাস্টার একবার গিয়ে মেয়েকে প্রশ্ন করেন, ‘পাত্র পছন্দ হয়ছে মা, তোর?’

সুফিয়া শুধু উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ বাবা।’

জাফর মাস্টারের পাশেই ছিল তখন রিহান। সুফিয়ার মুখে ‘হ্যাঁ’ শব্দটা শুনে, কেমন যেন খুশি হতে পারলো না সে। বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। তবে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে সুফিয়াকে? নাহ্, সেটা অসম্ভব। দুজন তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মানুষ।

সুফিয়ার সাথে রিহানের আবার কথা হয় পরদিন সকালে। হকার থেকে পত্রিকা নিয়ে এসে রিহান সুফিয়ার হাতে দেয়। সুফিয়া তা ফেরত দিয়ে বলে, ‘বাবাকে দিয়ে আসুন।’

‘আংকেল তো গাছে পানি দিচ্ছেন…’

‘এসে তারপর পড়বে। ওখানে রাখুন, টেবিলে।’

‘আপনার কি মন খারাপ?’

‘না, মন খারাপ হবে কেন?’ কৃত্রিম হাসলো সুফিয়া।

‘আমার বিচার করবেন না? কী যেন বিচারের কথা বলছিলেন সেই সময়’

‘থাক ঐ বিচার। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। ওভাবে খামখেয়ালি আর হবেন না। আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবাকে একটু দেখে রাখবেন। কী সৌভাগ্য তাই না? আমারও বিয়ে হবে, আপনিও এলেন। বাবা একজন সঙ্গী পাবে আমি না থাকলে।’ দূরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুফিয়া।

[[চলবে….]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here