টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব-১৪,১৫

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৪,১৫
লেখা: ShoheL Rana শামী
১৪

গলাটা বেশ পরিচিত মনে হলো সুফিয়ার। আবারও জিজ্ঞেস করলো সে, ‘কে আপনি?’

‘আমি রিহান।’

নামটা শুনেই চমকে ওঠলো সুফিয়া। অন্ধকারে রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরলো, যেন বহুদিন পর একটা ভরসার হাত খুঁজে পেয়েছে। হাতটা ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। রিহান তাকে শান্ত হতে বলে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার এ অবস্থা কেন? আপনার তো এখানে থাকার কথা না।’

কয়েক মুহূর্ত লাগলো সুফিয়ার নিজেকে সামলাতে। তারপর কী কারণে সে বন্দী হলো খুলে বললো। শুনে রিহান বললো, ‘সাহসীদের কখনও দমে যেতে নেই। আপনি যে বখাটে লোকটার কাছে হার মানেননি এটাই আপনার বড়ো পরিচয়।’ সব মেয়ে এই সাহসিকতা দেখাতে পারে না।’

‘কিন্তু আপনি কেন এখানে?’ জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া।

‘সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলে আমাকে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা আটক করে। আমাকে ওরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। কয়েকদিন প্রশিক্ষণও দেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের উপর আমার আগে থেকেই ঘৃণা জন্মে আছে। একদিন এক ব্রিটিশ সেনাকে খুন করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। পালাতে পারিনি। পালানোর সময় আমাকে পুনরায় আটক করে এই কারাগারে বন্দী করে।’

‘নিয়তি হয়তো এটাই চেয়েছিল। দুজনকে আবার এভাবে মিলিয়ে দিলো। কিন্তু, অন্ধকারে আপনি আমায় চিনলেন কী করে? আমার কণ্ঠও তো শুনেননি।’ বিস্ময় প্রকাশ করে সুফিয়া।

‘আপনার গায়ের গন্ধটা আমার খুব চেনা। আপনাদের ওখানে কাটানো দিনগুলোতে আমি কেবল আপনাকে নিয়েই ভেবেছি। গায়ের গন্ধটাও চিনতে পারি।’

‘তবে বিয়ের কথা বলায় ওভাবে পালিয়ে এলেন যে?’

‘পালিয়ে আসিনি। বরং আপনার কষ্টটা আমার সহ্য হবে না তাই…’

‘আমার কীসের কষ্ট?’

‘বাদ দিন। আজ কত তারিখ বলতে পারেন? এখানে এই অন্ধকারে রাত-দিনের হিসাব করতে পারি না।’

‘বাইরে বের করে না কোনো সময়?

‘খাবারের টাইমে বের করে। আর প্রাকৃতিক কাজে। এই বন্দী-জীবনে তারিখের হিসাব করে কী হবে?

‘আজ আগস্টের ছাব্বিশ তারিখ।’

‘আহ! আংকেলকে আমি কথা দিয়েছিলাম, একমাস পর উনার সাথে দেখা করবো। মানে আগের মাসের দশ তারিখে আপনাদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আফসোস! পারলাম না। আমি তখনও বন্দী ছিলাম। কেমন আছে আংকেল?’

জবাব দিলো না সুফিয়া। হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল সে বাবার কথা শুনে। রিহান ডাক দিলো, ‘কথা বলছেন না যে?’

‘বাবা আর বেঁচে নেই।’ খুব অসহায় শুনালো সুফিয়ার কণ্ঠ। ‘আগের মাসের দশ তারিখেই বাবা মারা যান।’

‘কী বলছেন? আংকেল মারা গেছে?’ চমকে ওঠে রিহান।

‘হ্যাঁ, সেদিন পত্রিকা পড়ে আমাকে ডাক দিয়ে কী যেন বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি। আমি যেতে যেতেই তার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে যায়।’

রিহানের মুখ দিয়ে আর কথা বের হলো না। আংকেলের সাথে আর শেষ দেখা হলো না তার। লোকটা বড্ড ঋণী করে গেল তাকে। তবে সে জানে, আংকেল নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছে তার কথা। রিহান যে ভবিষ্যতের লোক সেটা জেনে তারপর মারা গেছেন তিনি। ঐদিন হয়তো উনি সুফিয়াকে ডেকে এই কথাটা-ই বলতে চেয়েছিলেন, বলতে পারেননি।

রিহানের গায়ে জলের একটা ফোঁটা পড়লে সে হাতড়ে সুফিয়ার চোখ মুছে বললো, ‘সাহসীরা কাঁদে না। আচ্ছা, আপনি আমাকে বলতে পারেন, সেদিন পত্রিকায় কি কাজী নজরুলের কোনো খারাপ সংবাদ ছাপিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘ওটা বলতেই ঐদিন আংকেল আপনাকে ডেকেছিল।’

‘সত্যি তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু, পত্রিকার সংবাদটা আপনি কী করে জানেন?’

রিহান চুপ করে থাকে। সুফিয়া পুনরায় বলে, ‘আপনি বারবার বলেন না, আপনি ভবিষ্যত থেকে এসেছেন? আপনি ভবিষ্যতের হোন বা না হোন, আপনাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় এখন। আমার মাথায় হাত রাখারও কেউ রইলো না আর।’

‘আপনি জানেন, এই কারাগারের ছোটো ছোটো কক্ষগুলোতে কাদের রাখা হয়?’ জিজ্ঞেস করলো রিহান।

‘না।’ অস্ফুটে জবাব দিলো সুফিয়া।

‘যাদেরকে ওরা ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেবে, তাদেরকে এখানে রেখেছে ওরা।’

‘আপনি কী করে জানেন?’

‘কারণ, অনেক মৃত্যু দেখেছি এখানে। আমি যে বাড়িতে থাকতাম, জাকারিয়া সাহেবদের, ঐ বাড়িতে কমল নামে এক লোককে ব্রিটিশরা খোঁজ করেছিল মনে আছে? বলেছিলাম।’

‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

‘কমলকে ওরা আটক করে এখানে এনেছিল। তিনদিন আগে ওর ফাঁসি হয়েছে। আমি নিজ চোখে ওর ফাঁসি দেখেছি।’

‘আমাদেরও ফাঁসি হবে?’

‘হুমম, তবে আপনার ফাঁসি হতে দেরি হবে। আমার হয়তো খুব তাড়াতাড়ি হবে ফাঁসি। ক্যাম্পে ব্রিটিশদের একটা আদালত আছে। ওখানে ফাঁসির রায় দেয়া হয়।’

সুফিয়া হালকা কেঁপে উঠলো কথাটা শুনে। নিজের ফাঁসি হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু রিহানের ফাঁসি হবে শুনে ভেতরটা তার ‘হু হু’ করে ওঠলো। নিজেকে সামলিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘অনেকেই তো নির্দোষ। তাদেরও ফাঁসি হবে?’

‘হ্যাঁ হবে। তাদের একটাই দোষ, তারা ব্রিটিশদের মতের বিপক্ষে। এখানে আদালতটা কেবল নামেই। ন্যায়-বিচার এখানে হয় না।’

সুফিয়া আর কিছু বললো না। তবে সেই থেকে রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে, ছাড়ার নাম নেই। ছাড়লেই যেন রিহান আবার হারিয়ে যাবে বহুদূরে।

রাতের খাবার দিতে এলো দুজন গার্ড। একজনের হাতে একটা মশাল, অন্যজনের হাতে খাবার। রাতের খাবারটাই কেবল ওরা কক্ষে এসে দিয়ে যায়। সকালে আর দুপুরে বন্দীদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় খেতে। খাবার রেখে একজন বেরিয়ে গেল, অন্যজন মশাল ধরে পাহারা দিচ্ছিল। মশালের আলোতে রিহান এবং সুফিয়া পরস্পরকে দেখলো। তবে গার্ডকে বুঝতে দিলো না ওরা পরস্পরের পরিচিত। সুফিয়া ভালো করে দেখে নিলো রিহানকে। বন্দী থাকতে থাকতে মুখভর্তি দাড়ি হয়েছে তার। চোখগুলো অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। আর অনেকটা শুকিয়ে গেছে সে। তার এমন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হলো সুফিয়ার। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। খাবারটা টেনে নিলো দুজনে। তারপর শেকল বাঁধা অবস্থায় খেতে লাগলো। ধীরে ধীরে খেতে লাগলো দুজন। যেন মশালের আলোতে পরস্পরকে আরেকটু বেশি সময় নিয়ে দেখতে পারে। খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই তো আবার বদ্ধঘরে অন্ধকার নেমে আসবে। আবার পরস্পরকে দেখতে পারবে সেই সকালে ব্রেকফাস্টের সময়। খেতে দেরি হচ্ছে দেখে গার্ড তাগাদা দিলো, ‘দ্রুত খাও।’

তারপরও আরও অনেকক্ষণ লাগলো ওদের খাবারটা শেষ করতে।

বদ্ধ কক্ষে আবারও অন্ধকার নেমে এলে সুফিয়া পুনরায় রিহানের হাতটা শক্ত করে ধরে থাকলো। সারারাত এভাবেই কাটালো দু’জন।

সকালে দুজনকে শেকল পরা অবস্থায় কক্ষ থেকে বের করা হলো ব্রেকফাস্টের জন্য। তখন সুফিয়া দেখলো এখানকার আসল চিত্র। শত-শত বন্দী এখানে অসহায়ভাবে জীবন কাটাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে-পায়ে শেকল পরা। এদের প্রত্যেককে হয়তো ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। সামনে একটা বড়ো মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটা ফাঁসির মঞ্চ সাজানো। কে জানে এই পর্যন্ত ঐ ফাঁসির মঞ্চটা কতজন নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। এই যে শেকল পরা লোকগুলো এখন খেতে এসেছে। কার ভাগ্য কখন কাকে ওখানে নিয়ে যায় কে বলতে পারে?

বন্দীরা এখানে কখনও তৃপ্তিভরে খেতে পারে না। সকালে তো চলে নামেমাত্র খাবার। হালকা নাস্তা। একটা রুটি দুজনকে ভাগ করে খেতে হয়। ব্রিটিশরা হয়তো খাবার দেয়ার সময় চিন্তা করে, ‘যারা মরবে, তাদেরকে এত খাবার দিয়ে লাভ কী?’

রিহান এবং সুফিয়াকে একটা রুটি দিলো। রিহান অল্প একটু ছিঁড়ে নিয়ে প্রায় পুরোটা সুফিয়াকে দিয়ে বললো, ‘এখানে না খেয়ে থাকতে থাকতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, আপনি খান এটা।’

‘কিন্তু, আপনি না খেলে আমার কষ্ট হবে। শরীরের খুব খারাপ অবস্থা হয়ে গেছে আপনার।’ বললো সুফিয়া।

কৃত্রিম হেসে রিহান বললো, ‘এখানে আর আমার সৌন্দর্য কে দেখবে বলুন? ঐ ফাঁসির মঞ্চে যে কোনো সময় ডাক পড়তে পারে আমার।’

রিহানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সুফিয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। শেকলসহ দুহাত তুলে চোখ মুছে বললো, ‘ওভাবে বলবেন না। অনেকদিন পর আপনাকে পেয়েছি, এত তাড়াতাড়ি হারাতে চাই না।’

‘নিজেকে সংযত করুন। ব্রিটিশরা আশেপাশে ঘুরছে। আমরা পরস্পরের পরিচিত জানলে অন্য কক্ষে নিয়ে যাবে আপনাকে।’ সাবধান করলো রিহান।

সুফিয়া তখন মাথা নিচু করে খেতে লাগলো ধীরে ধীরে। একজন ব্রিটিশ অফিসার হাতে একটা লিস্ট নিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পর। এই লিস্টটা বন্দীদের জন্য কোনো কাগজের লিস্ট নয়, এটা যেন মৃত্যুদূত। আর অফিসারটা আসা মানে কারও না কারও মৃত্যু কার্যকর হবে। অফিসারটা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লিস্টে চোখ বুলালেন। সবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপতে লাগলো। আজ উনি কার নাম ধরে ডাকবেন? কাকে তুলে নেবেন ফাঁসির মঞ্চে? খাবার আর মুখ দিয়ে গেল না কারও। অফিসারটা ইংরেজিতে ডাক দিলেন, ‘কয়েদি নং ৯৭’

নিজের নাম্বারটা শুনে একজন শেকল পরা বন্দী কান্নায় ভেঙে পড়লো ওখানে। তাকে ধরে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা টানতে টানতে নিয়ে গেল ফাঁসির মঞ্চে। তাঁর চিৎকার কারও হৃদয় স্পর্শ করলো না। একটু পর তার শেকলটা খুলে ফাঁসির জন্য প্রস্তুত করা হলো। সুফিয়া বাকিটা আর দেখতে পারলো না। ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে কক্ষের দিকে হাঁটতে লাগলো। শেকল পরায় দ্রুত পা চালাতে পারলো না। তাকে অনুসরণ করলো রিহান। একটু পর জোরে একটা আর্তনাদ এলো ফাঁসির মঞ্চ থেকে। সুফিয়ার সারা শরীর কেঁপে ওঠলো।

একজন গার্ড ওদের দুজনকে আবার তাদের কক্ষে ঢুকিয়ে বাহির থেকে বন্ধ করে দিলো। ভেতরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুফিয়া। রিহান তাকে আলতো করে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। অন্ধকারে সুফিয়া রিহানের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘এসব আমি আর দেখতে পারবো না। আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।’

রিহান কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। সুফিয়াকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে নিজেকে সে শক্ত রাখলো। বললো, ‘ধৈর্য ধরুন। শক্ত হোন। আপনি এখন থেকে মনোবল হারালে, আমিও দুর্বল হয়ে পড়বো আরও।’

সুফিয়া আরও কিছুক্ষণ কেঁদে চললো। একটু পর কক্ষের দরজা খোলার শব্দ হলে চোখ মুখ মুছে পুরোপুরি শান্ত হলো সে। একটা মশাল হাতে ভেতরে ঢুকলো একজন গার্ড। গার্ডটা বাঙালি। তবে ব্রিটিশদের চাটুকার। সে এসে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘রিহান সাহেব, আপনি প্রস্তুত থাকুন। দুপুরের খাবারের পর আপনাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ আপনার রায় হবে ওখানে।’

গার্ড পুনরায় চলে গেল কথাটি বলে। থমকে বসে পড়লো রিহান। কী রায় হবে সে জানে। সবারই তো একই রায় হয়। সুফিয়াও থমকে গেল। রিহানের হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলে গেল এই লোকটা? কী বলে গেল?’ চিৎকার করে ওঠলো সুফিয়া। বদ্ধ ঘরে প্রতিধ্বনি হলো সেই চিৎকারের।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১৫
লেখা: ShoheL Rana শামী

কোনো জবাব দেয় না রিহান। সুফিয়াকে টেনে বসায় সে পাশে। সুফিয়া নীরবে কেঁদে চলেছে। রিহান অন্ধকারে তার চোখের অশ্রু মুছে বলে, ‘আমাদের এখন ভেঙে পড়লে হবে না। শান্ত হোন। শুনুন একটা কথা বলি।’

‘বলুন।’ নিজেকে সামলালো সুফিয়া।

‘আজ একজনের ফাঁসি হয়েছে। তার কক্ষটা হয়তো খালি হয়েছে। আপনাকে তার কক্ষে নিয়ে যেতে পারে।’

‘না না, আমি যাবো না। আমি ওখানে মরে যাবো গেলে।’

‘শুনুন, শক্ত হোন। এতদিন এই বন্দী জীবনে ভাবতাম- যা হবার হবে, সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিবো। ওরা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে আপত্তি নেই। কিন্তু, আপনাকে এখানে পেয়ে আমি মত বদলে নিয়েছি।’

রিহানের হাত শক্ত করে ধরে সুফিয়া। রিহান দম নিয়ে গলায় জোর দিয়ে বলে, ‘আমি ওদের হাতে আপনাকে একা ছেড়ে দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলবো না।’

‘তাহলে? কী করবো আমরা?’ রিহানের কথায় যেন ভরসা খুঁজে পায় সুফিয়া।

রিহান জবাব দিলো, ‘পালাবো এখান থেকে। আপনার জন্য আমি সব ঝুঁকি নেবো। অন্য কক্ষে নিয়ে গেলে একদম ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে যেকোনো সময় নিতে আসবো। আপনি কি একা ভয় পাবেন?’

‘না, আমি সারাক্ষণ আপনাকে অনুভব করবো ঐ কক্ষে। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন তো এখান থেকে?’

‘সেটা জানি না। তবে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো।’

সুফিয়ার ভয়টা কাটতে লাগলো রিহানের কথা শুনে। আলতো করে মাথা রাখলো সে রিহানের কাঁধে।

দুপুরে খাবারের সময় আবার সব শেকলপরা বন্দীরা এক হলো বাইরে। এবার খেতে দিলো ভাত আর অল্প একটু ডাল। সামনের মাঠে কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ফাঁসির মঞ্চটা অপেক্ষা করছে নতুন কোনো অতিথির আশায়। রিহানের খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। কয়েকজন সেনা এসে তার উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে ডাকলো, ‘কয়েদি নং ১১৭।’

রিহানের খাবার আর মুখ দিয়ে গেল না। সুফিয়াও থমকে গেল। ভয়ে ভয়ে তাকালো সে রিহানের দিকে। রিহান চোখ টিপে ভরসা দিলো তাকে। তারপর উঠে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলো ব্রিটিশ সেনাদের দিকে। সুফিয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু স্বরে সুফিয়া বললো, ‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।’

ক্যাম্পে ব্রিটিশদের একটা বড়ো দালান তৈরির কাজ চলছে। এজন্য তারা বাইরের কোনো শ্রমিক নিয়োগ করেনি। বন্দীদের কাছ থেকেই পুরো শ্রমটা ওরা আদায় করে। খাবার শেষে সুফিয়ারও ডাক পড়লো। কখনও এত কঠিন কাজ করেনি সে। আজ তাকে ইট ভাঙতে হচ্ছে বসে বসে। অনেকক্ষণ ইট ভাঙার পর যখন একেবারেই হাঁপিয়ে উঠলো, তখন একটু পানি চাইলো সে। একজন ব্রিটিশ সেনা তাকে অল্প একটু পানি এগিয়ে দিয়ে শরীরে অশ্লীলভাবে হাত দিলে সুফিয়া ‘থু’ করে একগাদা থুথু ছুড়লো তার দিকে। ব্রিটিশ সেনাটা তখন রেগে গিয়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় বসালো সুফিয়ার গালে। হাত থেকে নিচে পড়ে গেল পানি। তৃষ্ণা আর মেটাতে পারলো না সে।

সন্ধ্যার আগে আগে কাজ থেকে বিরতি নিতে পারলো সব বন্দীরা। সুফিয়াও চলে এলো কক্ষে। ততক্ষণে রিহানও চলে এসেছে আদালত থেকে। যা ভেবেছিল সে তাই হয়েছে। আদালতে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। রায় শুনে রিহান নিজেকে সামলাতে পারলেও, সেই থেকে কেঁদে চলেছে সুফিয়া। রিহান তাকে কাঁদতে নিষেধ করে বললো, ‘আপনি এভাবে কাঁদলে আমিও মনোবল হারিয়ে ফেলবো। আমাদের পালাতে হবে, মনে আছে তো?’

‘যদি পালাতে না পারি, তবে তো মৃত্যুদণ্ড দেবে।’

‘পালাবো। আমি আজ আদালতে যাওয়ার সময় পুরো পথটা দেখে এসেছি। বন্দীদের সবার শেকল পরা, তাই রাতে খুব বেশি পাহারা থাকবে না।’ বলতে বলতে রিহান সুফিয়ার দুহাত ধরলো। সুফিয়ার হাতে বড়ো বড়ো ফোসকা অনুভব করে জিজ্ঞেস করলো, ‘এসব কী করে হলো আপনার?’

‘ইট ভাঙতে দিয়েছে ওরা আজ সারাদিন। ফোসকা পড়ে গেছে হাতে।’

‘শুধু আজ রাতটা ধৈর্য ধরুন। আজ হয় ওদের হাতে মরবো, নয়তো পালাবো এখান থেকে।’

‘আমি আপনার সাথে মরতেও রাজি আছি।’

কক্ষের দরজা খোলার শব্দ হলো। দুজনেই চুপ হয়ে গেল তখন। ভেতরে প্রবেশ করলো দুজন গার্ড। ওরা এসে সুফিয়াকে আলাদা কক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করলো। রিহান জানে ওরা সুফিয়াকে কোন কক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা বের হয়ে গেলে অন্ধকারে বসে বসে রিহান পরবর্তী পরিকল্পনার ছক আঁকতে লাগলো।

রাতে খাবার দেয়ার জন্য এলো দুজন গার্ড। যথারীতি, একজন খাবার রেখে চলে গেল, অন্যজন মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকলো। রিহান চুপচাপ খাবার খেতে লাগলো। তখন গার্ডটা বললো, ‘অনেকদিন ধরে তোমাকে এই কক্ষে পাহারা দিচ্ছি। এবার মনে হয় নতুন কোনো বন্দী আসবে তোমার জায়গায়। শুনলাম, তোমার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে।’

গার্ডের দিকে ঘৃণাভরে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো রিহান। তার মাথায় এখন অন্য পরিকল্পনা ঘুরছে। গার্ডকে উত্তেজিত করা যাবে না এই মুহূর্তে। নিজেও শান্ত থাকার চেষ্টা করলো। খাওয়া শেষ হলে গার্ড বেরিয়ে যেতে চাইলে, রিহান পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘আমি একটু বের হবো।’

‘কেন?’ ঘুরে প্রশ্ন করলো বাঙালি গার্ড।

রিহান ইশারায় বুঝালো প্রাকৃতিক কাজে বের হতে হবে। গার্ড নিশ্বব্দে বের হয়ে গিয়ে এক মিনিট পর আবার ফিরে এলো। রিহানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আসো। শেষবারের মতো জ্বালিয়ে নাও আমাকে। কয়েকদিন পর তো জ্বালানোর জন্য আর তুমি থাকবা না মিয়া।’

প্রত্যুত্তর করলো না রিহান। গার্ডের পিছুপিছু সে হেঁটে চললো। শৌচাগারটা মাঠের ও-প্রান্তে। সেখানে পৌঁছতে কয়েক মিনিট লাগলো। তারপর গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘শেকলের বাঁধনটা একটু হালকা করে দিন।’

গার্ড হেসে বললো, ‘দুঃখিত! ভেতরে তো হাতের কাজও আছে মনে ছিল না।’

‘হুমম।’ অস্ফুটে শব্দ করলো রিহান।

গার্ড রিহানের হাতের শেকলটা আরেকটু হালকা করলো। রিহান শৌচাগারের দিকে একপা বাড়িয়ে পুনরায় গার্ডের দিকে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। লোহার শেকলটা গার্ডের গলায় প্যাঁচিয়ে জোর বাড়াতে লাগলো। গার্ডের মুখ দিয়ে ‘গোঁৎ’ করে একটা শব্দ বের হলে কেবল। একটু পর ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। রিহান সাবধানে তাকে নিচে শুয়ে দিয়ে হাত থেকে চাবির গোছাটা নিলো। তারপর শেকলের বাঁধনটা পুরো খুলে ফেললো। মশালটা আগেই নিভে গেছে গার্ডের হাত থেকে পড়ে। অন্ধকারেই রিহান নিজের কাজ চালাতে লাগলো। গার্ডের পোশাকটা খুলে নিয়ে নিজে পরলো। তারপর মুক্ত বাতাসে জোরে একটা শ্বাস টেনে ছেড়ে দিয়ে, মুখটা নিচু করে হাঁটতে লাগলো কক্ষের দিকে। করিডোরে এসে পৌঁছালে একজন ব্রিটিশ সেনা তাকে থামালো। কিন্তু সন্দেহ করলো না গার্ডের পোশাক দেখে। গার্ড বা বন্দীদের চেহারা এরা মনে রাখে না। বন্দীদেরকে নির্দিষ্ট একটা নাম্বার দিয়ে ডাকে এরা। যেমন রিহানের নাম্বার ১১৭। ব্রিটিশ সেনাটা রিহানকে একটা আলিশান কক্ষে নিয়ে গেল। তারপর নরম বিছানায় শুয়ে রিহানকে ইংরেজিতে তার শরীরটা টিপে দিতে বললো। রিহানও যেন এই সুযোগটা চেয়েছিল। বাধ্য ভৃত্যের মতো সে ব্রিটিশ সেনার গা টিপতে লাগলো। একপা দূরে পড়ে আছে কিছু বৈদ্যুতিক তার। ভবনটাতে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ চলছে। এখনও সংযোগ আসেনি, তাই মশাল জ্বেলেই আঁধার কাটানো হয়। পা দিয়ে বৈদ্যুতিক তারগুলো টেনে নিলো রিহান। তারপর হাতে তুলে নিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ব্রিটিশ সেনার গলায় প্যাঁচিয়ে জোরে টান দিলো। কেবল মুখ দিয়ে তার জিবটায় কয়েক ইঞ্চি বের হতে পারলো। এরপর অসাড় হয়ে গেল ছটফটিয়ে। রিহান আবারও পোশাকটা পালটিয়ে নিলো। গায়ে ব্রিটিশ সেনার পোশাক থাকলে কাজটা সহজ হবে তার। পোশাকটা পরে সে ব্রিটিশ সেনার বেশ ধরে হাঁটতে লাগলো সুফিয়াকে উদ্ধার করতে। সবকিছু সে এমনভাবে করছে যেন হাতে সময় খুব কম।

প্রতিটা কক্ষে একজন করে গার্ড থাকে। সুফিয়ার কক্ষের সামনেও একজন গার্ড হাতে মশাল ধরে ঝিমোচ্ছে। রিহান গিয়ে তাকে ইংরেজিতে দরজা খুলতে বললো। গার্ড দ্রুততার সাথে আদেশ পালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কোনো সন্দেহ করলো না। গায়ের পোশাকটা দেখেই সে ব্রিটিশ সেনা ভেবে নিয়েছে। এরাও সব কক্ষের বন্দীর খবর রাখে না, কার চেহারা কেমন।

গার্ড দরজা খুলে দিলে ভেতরে প্রবেশ করলো রিহান, কিন্তু ভেতরের কক্ষটা খালি দেখে চমকে উঠলো সে। এবার সে উত্তেজিত হয়ে বাংলায়, জিজ্ঞেস করলো, ‘এই কক্ষে একটা মেয়ে ছিল, সে কই?’

রিহানের মুখে বাংলা শুনে সন্দেহ হলো গার্ডের। ভীতি কণ্ঠে গার্ড জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কে?’

রিহান সজোরে ঘুষি চালালো গার্ডের মুখে। একইসাথে পা চালালো দু’পায়ের মাঝখানে। পরপর দুটি আঘাত সামলাতে পারলো না গার্ড। চিল্লানোর সুযোগও দিলো না রিহান তাকে। একহাতে তার পুরো শরীরটা শক্ত করে ধরে, অন্য হাত দিয়ে গলা চেপে ধরলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘মেয়েটা কোথায় বল?’

‘বলছি বলছি। গলাটা ছেড়ে দেন।’ চোখ মুখ দিয়ে পানি বের হলো গার্ডের। রিহান তার গলায় চাপ কমালো। গার্ড তখন বললো, ‘মেয়েটাকে একজন ব্রিটিশ সেনা নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে।’

‘কেন নিয়ে গেছে?’ গলায় পুনরায় একটু চাপ বাড়ালো রিহান। গোঁৎ করে ঢোক গিলে গার্ড জানালো, ‘খারাপ উদ্দেশ্য হতে পারে। দুপুরে দেখেছিলাম মেয়েটা ঐ ব্রিটিশ সেনার মুখে থুথু মারছিল। তখন রেগে গিয়েছিল ঐ ব্রিটিশ সেনা।’

রিহানের সারা শরীরে যেন আগুন ধরে গেল এবার। গলার চাপ আরও বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনদিকে নিয়ে গেছে ওকে, বল?’

গার্ড ইশারায় দেখিয়ে দিলে রিহান তার ঘাড়টা মটকে দিয়ে ধাক্কা দিলো। তারপর দ্রুত বের হয়ে পড়লো ঐ গার্ডের হাত থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে। সুফিয়ার কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে বাঁচাতে হবে।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here