টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব-০৬,০৭

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৬,০৭
লেখা: ShoheL Rana শামী
০৬

সুফিয়া খাবার এনে সামনে রাখতে রাখতে কিছুটা রাগ নিয়ে তাকালো রিহানের দিকে। তবে কিছু বললো না। রিহান মুখ নিচু করে ফেললো। জাফর মাস্টার খাবারটা রিহানের দিকে আরেকটু এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খাও।’

‘আপনি খাবেন না?’

‘আমি খেয়েছি। তুমি খাও।’

রিহান খেতে বসলো। আজ ঢেঁড়স আর আলু দিয়ে চিংড়ি রান্না করেছে সুফিয়া। সাথে ছিল শিম ভর্তা। শিম ভর্তাটাই রিহানের বেশ সুস্বাদু লাগলো। রিহান মজা করে খেতে লাগলো। বাইরে তখন এক হকার সাইকেলের হর্ন বাজিয়ে ‘পত্রিকা পত্রিকা’ বলে শব্দ করে যাচ্ছিল। জাফর মাস্টার মেয়েকে বললেন, ‘মা, যা তো দুইটা পত্রিকা নিয়ে আয়।’

সুফিয়া দ্রুত বের হলো। জিজ্ঞেস করলো না কোন কোন পত্রিকা নিতে হবে। সে জানে। কিছুক্ষণ পর সে নবযুগ আর বেগম পত্রিকা নিয়ে ভেতরে আসলো। বাবার হাতে দিতে দিতে বললো, ‘দেখো কী লিখেছে বেগম পত্রিকায়। জাপানিরা গত দুদিনে সাত হাজার সেনা আটক করেছে। তার মধ্যে তিন হাজার ব্রিটিশ ভারতের। আহ্, কবে যে থামবে এ যুদ্ধ! পুরো নিউজটা পড়ো তো বাবা।’

জাফর মাস্টার পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রথমে নিউজটাতে চোখ দিলেন। নীরবে পড়তে লাগলেন নিউজটা। রিহান তার মতো করে খেতে লাগলো। এসবে তার মাথাব্যথা নেই। কারণ সে জানে এর শেষ পরিণতি কী হবে। খেতে খেতে হঠাৎ তার গলায় খাবার আটকে গেল। সুফিয়া তখন মাটির একটা কৌটায় পানি ঢেলে রিহানের হাতে দিয়ে বললো, ‘পানি খান। আস্তে আস্তে খান খাবার। তাড়াহুড়া করতে হবে না।’

রিহান পানি পান করে বাকি খাবারটুকু শেষ করলো। তখন জাফর মাস্টার পত্রিকা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলতে লাগলেন, ‘বার্মার রেঙ্গুন শহরটা দখল করে ফেলেছে জাপানিরা। ওরা প্রথমে কাউকারেইক এবং মৌলাম্যায়াইন এই শহর দুটোতে আক্রমণ করেছিল। দুটো শহর সহজেই ওরা নিজেদের করে নেয়। এরপর উত্তর দিকে আক্রমণ চালায়। রেঙ্গুন শহরের দিকে। তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল চীন ও অস্ট্রেলিয়ার সেনারা। পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সেনাদের পাঠায়। কিন্তু তার আগেই জাপানিরা গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্রিজ যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে দখল করে নেয়। ভারতীয় সেনারা গিয়ে আর পেরে ওঠে না ওদের সাথে৷ অনেক সেনাদের বন্দী করে জাপানিরা। বেশিরভাগ ব্রিটিশ ভারতের।’

‘আমার মনে হয় বাবা বার্মা ব্রিটিশ সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাবে। আজ রেঙ্গুন হাতছাড়া হলো। একদিন পুরো বার্মা জাপনিরা দখল নেবে। ওরা দিন-দিন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠছে।’

‘হুমম, বার্মা দখল হওয়ারই কথা। বার্মার লোকেরা-ই তো ব্রিটিশ সরকার থেকে মুক্তি চায়। ওরা গোপনে সেনাবাহিনী গঠন করে ব্রিটিশদের বিপক্ষে চলে গেছে। জাপানিদের দলে যোগ দিয়েছে। বার্মা দখলের পর জাপানিরা হয়তো ভারত দখলের চেষ্টা করবে।’

‘কিন্তু পারবে না।’ বলে ওঠলো রিহান। ‘ওরা বার্মা দখল করে ফেলবে এই বছরেই। কিন্তু ভারত কখনও দখল করতে পারবে না।’

‘তুমি কেমনে জানো? ভবিষ্যত থেকে জেনে এসেছো না-কি?’ ধমকের সুরে প্রশ্ন করলো সুফিয়া।

রিহান চুপ হয়ে গেল। সুফিয়ার সামনে ভবিষ্যতের কথা বলা নিষেধ। জাফর মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষয়টার সমাপ্তি টানলেন, ‘কী হয় আল্লাহ-ই জানেন। এসব যুদ্ধ-বিগ্রহ আর ভালো লাগছে না। সবাই নিজ নিজ অধিকার নিয়ে একটু শান্তিতে থাকুক। আহ্! আর কতদিন চলবে এই ক্ষমতার লড়াই?

রিহান ঐদিন আর ফিরে যায়নি জাকারিয়া সাহেবদের বাড়িতে। সুফিয়ার কথা রেখেছে সে। বিকেলে সুফিয়াদের বাড়ির উঠোনে বেশকিছু ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে এসে হাজির খেলার জন্য। ওদের উঠোনটা বড়ো। তাই খেলার জন্য বাচ্চা ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন চলে আসে বিকেল হলে। খেলা চলে রাত পর্যন্ত। নানারকম খেলা চলে ওদের ধাপে ধাপে। হাডুডু আর লুকোচুরি খেলা চলে রাতে, শুক্লপক্ষ আর পূর্ণিমার রাতগুলোতে। এখন অবশ্য শুক্লপক্ষ চলছে। তাই খেলা চলবে অনেক রাত পর্যন্ত।

কয়েকটা বাচ্চা এসে সুফিয়ার হাত ধরে টানতে লাগলো খেলার জন্য। সুফিয়া মনে হয় প্রতিদিনই খেলে বাচ্চাদের সাথে। কিন্তু আজ খেলতে লজ্জা পাচ্ছে রিহান আছে বলে। তবুও বাচ্চারা তার হাত ধরে টানতে টানতে বললো, ‘আসো বুবু আসো, তুমিও আসো। তুমি ছাড়া খেলায় মজা পাই না।’

সুফিয়া একবার আড়চোখে রিহানকে দেখে নিতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে সে বাচ্চাদের বললো, ‘তোরা খেল আজ। আমি খেলবো না।’

কিন্তু বাচ্চাগুলোও নাছোড়বান্দা, সুফিয়াকে ছাড়া খেলবে না ওরা। রিহান তখন সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমি আছি বলে যদি কেউ লজ্জায় খেলতে না পারে, তবে আমি ভেতরে যাচ্ছি।’ বলতে বলতে রিহান ঘরের ভেতর চলে যাচ্ছিল। দৌড়ে গিয়ে সুফিয়া তার একটা হাত ধরে বললো, ‘এখানেই থাকুন। আমি কি বলেছি আপনাকে আমি লজ্জা পাচ্ছি?’ কথাটা বলতে গিয়েও সুফিয়ার ঠোঁট জোড়া হালকা কেঁপে ওঠলো। লজ্জা ভাব তার পুরোপুরি কাটেনি। রিহান নরম স্বরে বললো, ‘এখনও তো লজ্জা পাচ্ছেন।’

‘আপনার মাথায় সমস্যা ছিল, এখন চোখেও সমস্যা। বেশি দেখেন আপনি। এখানেই থাকুন বলছি।’ বলেই ঘুরে গিয়ে রিহানের আড়ালে মুখ কুঁচকিয়ে লজ্জাভাব কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো সুফিয়া। পরে সাহস নিয়ে বাচ্চাদের বললো, ‘চল, খেলবো। উনি নিজেকে কী ভাবছেন? উনার জন্য আমি খেলবো না না-কি? এই মিন্টু, যা তো তোর মিনুবুকে খেলার জন্য ডেকে নিয়ে আয়।’

মিন্টু নামের ছেলেটা জবাব দিলো, ‘মিনুবু আইতে পারবো না। মিনুবুরে মা কাজ দ্যাছে। পুকুরে গ্যাছে চাউল নিয়া।’

‘হ্যাঁ, বিকেল হলেই ওদের কাজ বেড়ে যায়।’ বলেই আরেকটা মেয়ের নাম ধরে চিৎকার করলো সুফিয়া, ‘ঐ খুশি, খেলবি?’

পাশের বাড়ি থেকে একটা মেয়ের গলায় জবাব এলো, ‘না..আ..আ। রান্না করছি। সন্ধ্যায় আসবো।’

সুফিয়া পুনরায় চিৎকার করে বললো, ‘আসতে হবে না তোর।’

বাচ্চাদের নিয়ে সুফিয়া খেলা শুরু করে দিলো। ইচিং-বিচিং খেলা। সুফিয়া এবং আরেকটা বাচ্চা মাটিতে পা টেনে মুখোমুখি বসে পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটা উচ্চতা তৈরি করলো। সেই উচ্চতার উপর লাফিয়ে পার হতে হবে বাকিদের। লাফানোর সময় কারো পা লাগতে পারবে না ঐ উচ্চতায়। বাচ্চারা ছড়া কাটতে কাটতে লাফ দিচ্ছিলো, ‘ইচিং-বিচিং চিচিং ছা, প্রজাপতি উড়ে যা।’

মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো রিহান ওদের খেলা। বিকেল হলে এরা কী সুন্দরভাবে একত্র হয়ে খেলা করে। এই মুহূর্তগুলো যদি আজীবন একইরকম থাকতো! আফসোস থাকবে না। একটা সময় জীবনটা যান্ত্রিক হয়ে যাবে। এক নজরে চেয়ে থাকলো রিহান সুফিয়ার দিকে। ওকেও মনে হচ্ছে শাড়ি পরা একটা বাচ্চা। শাড়ির আঁচল দিয়ে কোমরটা প্যাঁচিয়ে নিয়েছে সে। খোলা চুলগুলো মাটি স্পর্শ করছে। দুহাত দিয়ে চুলগুলো খোপা করতে করতে সে নজর দিলো রিহানের দিকে। রিহানকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মাথা দুলিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী…ই?’

‘কিছু না।’ হেসে চোখ সরিয়ে নেয় রিহান। সুফিয়া আবার খেলায় মন দেয়। দূরের একটা মাঠ থেকে কিছু ছেলেদের চিৎকার ভেসে আসে। রিহান এগিয়ে যায় দেখতে। সুফিয়াদের বাড়ির প্রবেশপথ হলো টিনের একটা গেইট। গেইটটা পার হয়ে সে দূরের মাঠটার দিকে দৃষ্টি দিলো। অনেকগুলো ছেলে ওখানে ক্রিকেট খেলছে। ওদিকে খেলা ফেলে সুফিয়া দৌড়ে এলো। গেইট দিয়ে মুখ বের করে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছেন না বলে?’

‘কোথাও না। ঐ যে ক্রিকেট খেলছে। ওগুলো দেখছি।’

‘খেলতে পারেন?’

‘খুব পারি।’

‘দাঁড়ান আমিও আসছি।’ বলেই সে গেইট থেকে বের হলো বাচ্চাদেরকে খেলতে বলে। বাচ্চাদের মন খারাপ হয়ে গেল সুফিয়াকে হারিয়ে। আবার শুরু থেকে খেলা শুরু করতে হবে তাদের।

বালির উপর বসায় সুফিয়ার পেছনে ধুলো লেগে গিয়েছিল। ধুলো ঝেড়ে সে রিহানের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আঁচলটা এখনও কোমরে প্যাঁচানো তার। ওভাবেই দেখতে ভালো লাগছে তাকে। তার সকল চঞ্চলতা যেন প্রকাশ পাচ্ছে।

‘আপনার ভবিষ্যতে আছে তো এই খেলা?’

‘হ্যাঁ আছে। আমাদের নিজস্ব একটা দেশ হবে বাংলাদেশ নামে। নিজেদের একটা ক্রিকেট টিম হবে।’

সুফিয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কোমরে দুহাত দিয়ে গম্ভীরভাবে তাকালো রিহানের দিকে। রিহান তার এই আচরণ হুট করে ধরতে না পারলেও পরক্ষণে বুঝতে পেরে বললো, ‘আপনিই তো জিজ্ঞেস করলেন। তাই-ই তো বললাম।’

সুফিয়া এবার গলা ছেড়ে হাসতে লাগলো রিহানের অবস্থা দেখে। হাসতে হাসতে যেন পড়ে যাবে সে। রিহান বোকার মতো চেয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ হেসে সুফিয়া হাসি থামালো। তারপর বললো, ‘আপনি এত ভীতু কেন? আমাকে ভয় পান না-কি?’

‘হুহ! ভয় পাবো কেন? আপনি বাঘ না ভাল্লুক?’

‘বাঘ বা ভাল্লুক কিছুই না, তবুও এত ভয় পান কেন? ভয় পান বলেই তো আপনার সাথে এমন করি।’

রিহান চুপ হয়ে থাকলো। সুফিয়া আবার বললো, ‘ঠিক আছে, বলুন আপনার যত ভবিষ্যতের কথা। আপনার মতো করে বলুন। তবে আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইবেন না প্লিজ।’

‘বলবো না।’ মুখটা গম্ভীর করে ফেললো রিহান।

‘গম্ভীর মুখটা আপনার প্যাঁচার মতো লাগছে।’ বিলের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো সুফিয়া।

‘তাতে আপনার কী?’

‘আমার কী হবে? কিছুই না। জানেন, আমার প্রিয় খেলাও ক্রিকেট। কিন্তু মেয়েদের জন্য এই খেলা নিষেধ। তাই খেলতে পারি না। আমার একজন প্রিয় ক্রিকেটার আছে। কে জানেন?’

‘কে?’

‘রস গ্রেগরি। চিনেন তো?’

‘হুমম, শুনছি নাম। অস্ট্রেলিয়ান।’

‘আপনার প্রিয় ক্রিকেটার আছে?’

‘আছে তো। মাশরাফি, সাকিব, তামিম।’

সুফিয়া অবাক হয়ে তাকালো রিহানের দিকে। নামগুলো সে শুনেনি। ‘এরা কারা?’

‘এরা বাংলাদেশের ক্রিকেটার হবে আমাদের সময়ে এসে। মানে ভবিষ্যতে।’

‘আপনাকে সুযোগ দিয়েছি বলে দেখি থামছেন না। বলেই যাচ্ছেন ভবিষ্যতের কথা।’

রিহান আর জবাব দিলো না। সুফিয়া তখন হাঁটার গতি কমিয়ে বললো, ‘এখান থেকেই দেখি ওদের খেলা। আর না যাই সামনে।’

‘কেন?’

‘আমি মেয়ে। বুঝেন না? ওখানে খেলছে সবাই পুরুষ।’

‘ঠিক আছে।’

বিলের মাঝে একটা আইলের উপর বসলো দুজন। তারপর কিছুটা দূর থেকে ছেলেদের ক্রিকেট খেলা দেখতে লাগলো দুজন মিলে।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-০৭
লেখা: ShoheL Rana শামী

রাত নেমেছে। জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলোতে সুফিয়াদের বাড়ির উঠোনে চলতে লাগলো খেলা। হাডুডু খেলা। এবার শুধু বাচ্চারা না। কিশোর, যুবতী এমনকি এ বাড়ি ও বাড়ির বউরাও এসে হাজির খেলতে। চলছে পুরোদস্তুর খেলা। জাফর মাস্টারের সাথে বাইরে চেয়ার নিয়ে বসে খেলা দেখছে রিহান। সবাই খুব মনোযোগী আজ খেলায়। হয়তো নতুন এই অতিথিকে দেখানোর জন্যই সবার মনে খেলায় ভালো পারফরম্যান্স করার একটা তাগাদা চলছে। নতুন অতিথির চোখে ভালো খেলোয়াড় হতে হবে তো! খেলার সময় সুফিয়া একেবারে বাচ্চা হয়ে যায়। এত দৌড়াতে পারে মেয়েটা। জাফর মাস্টার এবার শুরু করলেন খেলাধুলার উপকারিতা নিয়ে বেশকিছু কথা। মাস্টার মানুষ, লেকচার দেয়াটাই স্বাভাবিক।

‘বুঝছো রিহান মিয়া, এই যে বাচ্চারা খেলে, এতে অনেক উপকার হয়। খেলাধুলা বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়োদেরও প্রয়োজন। এতে শরীরের পাশাপাশি মনও ভালো থাকে। এই যে এরা দৌড়াদৌড়ি করছে, ওদের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। এতে কি শুধু শরীরের ময়লা বের হচ্ছে? না, এতে মনের ময়লাও বের হয়। মন পরিষ্কার হয়। খেলাধুলার পর পড়ালেখা করলে, পড়া খুব মনে থাকে।’

রিহান চুপচাপ শুনছিল। কিন্তু, কোনো প্রত্যুত্তর না করলে হয়তো খারাপ দেখায় ব্যাপারটা। তাই বললো, ‘জি আংকেল। খেলাধুলার উপকারিতা আসলে শেষ করা যাবে না। খেলাধুলা মানুষকে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা করে।’

‘আমার বয়স কত জানো এখন?’

‘কত?’

‘ষাট। আমাকে কি ষাটের বয়সী মনে হয়?’

‘না, এখনও শক্ত সামর্থ্য তরুণ মনে হয়।’

‘এগুলো খেলাধুলার ফল। খেলাধুলা মানুষের বার্ধক্য দেরিতে আনে।’

‘যদি এসব খেলাধুলা একসময় হারিয়ে যায় আংকেল?’

জাফর মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। খানিক দম নিয়ে বললেন, ‘তখন আর কী হবে, মানুষের শরীরের সাথে সাথে মস্তিষ্কের বিকাশটা পিছিয়ে পড়বে, স্মরণ-শক্তি কমে যাবে, রোগ-বালাই বাড়বে। আর অল্প বয়সে বার্ধক্য নেমে আসবে জীবনে।’

জাফর মাস্টারের কথা শুনতে শুনতে রিহান নিজের যুগ আর এই যুগের পার্থক্যগুলো অনুধাবন করতে লাগলো। অতীতের এই যুগটাতে মানুষের মধ্যে কত মিল ছিল, একতা ছিল। এই মিল-মহব্বত ধীরে ধীরে লোপ পাবে একটা সময়ে এসে। মানুষ একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। মোবাইল নামক যন্ত্রটার সাথে বানিয়ে নেবে নিজস্ব এক জগত।

বাড়ির ভেতর হঠাৎ ‘খুট খুট’ শব্দ হলো। মাস্টার সাহেব উঠে ভেতরে গেলেন। রিহানও পিছুপিছু গেল ভেতরে। ঘরের লাইট জ্বালানো ছিল। তাই স্পষ্ট দেখা গেল, এক লোক ঘরের ভেতর ঢুকে চাল চুরি করছে। মাস্টার সাহেবকে দেখে লোকটা থতমত খেয়ে ভয় পেয়ে গেল। ত্বরান্বিত হয়ে চালগুলো পুনরায় রেখে মাস্টার সাহেবের পাশে লুটিয়ে পড়লো লোকটা। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লো, ‘মাস্টার সাব, মাস্টার সাব, মাফ কইরা দ্যান। ঘরে খাওনের কিছু ছিল না, তাই চুরি করবার আইছি।।’

জাফর মাস্টার লোকটাকে ধমকালেন না। উল্টো আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। আর চিৎকার করো না। লোকজন এসে পড়বে।’

লোকটা এবার কান্না কিছুটা থামিয়ে বললো, ‘বাচ্চা দুইডা গতকাইল থেইকা না খাইয়া রইছে মাস্টার সাব। হাতেও কোনো কাম কাজ নাই। কী করবো কন।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার যত খুশি চাল নাও ওখান থেকে। কোনো দরকার হলে আমার কাছে চাইবে। চুরি করো না, কেমন?’

‘ঠিক আছে মাস্টার সাব।’ বলেই এক থলে চাল নিলো লোকটা। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ঘর্মাক্ত সুফিয়া। আবারও ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। জাফর মাস্টার মেয়ের উদ্দেশ্যে নরম স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘ঠিক করিনি মা?’

সুফিয়া হাসলো। মাথা কাত করে বাবার সাথে সম্মত হলো। এমন বাবার মেয়ে কি আর অমত হতে পারে?

‘আপনার মেয়ে আপনার মতোই দয়ালু হয়েছে আংকেল।’ বলে ওঠলো রিহান। লোকটা চলে গেল সুফিয়াকে পাশ কাটিয়ে। সুফিয়ার দিকে তাকালো রিহান। প্রশংসা গায়ে মাখলো না সে। এতক্ষণ খেলে হাঁপিয়ে ওঠেছে। ঘনঘন বুক উঠানামা করছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে নীল ব্লাউজটা ভিজিয়ে তুলছে। কপালের ঘাম মুছে এগিয়ে গেল সে অন্য একটা কক্ষে। তারপর বাবার একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি এনে রিহানের দিকে বাড়িয়ে বললো, ‘নিন, পরে নিন এগুলো।’

‘আংকেলের কাপড়? আপনি আজ আমাকে রেখে দিবেন জানলে আমার ব্যাগসহ আনতাম। ওখানে আমার কাপড় আছে। লুঙ্গিও আছে।’

‘আপনারগুলো না এনে ভালোই করেছেন। এখানে যতদিন আছেন, বাবারগুলোই পরুন।’

‘ঠিক আছে।’ কাপড়গুলো হাতে নিলো রিহান। ‘আপনি তো ঘেমে একেবারে গোসল হয়ে গেছেন?’

‘আপনিও খেলবেন না-কি মেয়েদের সাথে?’

‘না, না, আপনারাই খেলুন।’

‘ঠিক আছে, এগুলো পরে বাইরে আসুন। আর শুনুন, কোনো মেয়ের দিকে নজর দিয়ে লাভ নাই। ওখানে বেশিরভাগ এ বাড়ি ও বাড়ির বউ।’ বাবাকে বের হয়ে যেতে দেখে শেষের কথাটা গলা নিচু করে বললো সুফিয়া। তারপর হেসে বের হয়ে গেল।

ভোর হতেই কোলাহল নেমে এলো গ্রামে। রিহান ইতোমধ্যে গ্রামের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। ভোর বেলায় ঘুম ভাঙে তার। ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হতেই চোখে পড়ে বাচ্চারা দলবেঁধে মক্তবে যাচ্ছে। সুফিয়াকে কোথাও দেখা গেল না। জাফর মাস্টার বাইরে চেয়ার নিয়ে বসে কুরআন পড়ছেন। রিহানকে দেখে বললেন, ‘রিহান মিয়ার ঘুম ভাঙছে না-কি? যাও, ওখান থেকে নিমগাছের একটা ডাল ভেঙে দাঁত মেজে নাও। তারপর পুকুরঘাটে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসো।’

বাধ্য ছেলের মতো রিহান শুনলো জাফর মাস্টারের কথা। রাতে ঘুমটা ভালোই হয়েছে আজ। দুহাত প্রসারিত করে আড়ষ্ট ভাবটা কাটালো।তারপর নিমগাছ থেকে একটা ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুরে গেল। বড়ো একটা পুকুর। ওখানে সুফিয়াকে পাওয়া গেল। ঘাটে বসে সে চাল ধুচ্ছিল। রিহানকে ওদিকে আসতে দেখে সে বললো,

‘নবাব সাহেবের ঘুম ভাঙলো তবে?’

‘আমি তো তাড়াতাড়িই ওঠলাম ঘুম থেকে।’

‘এটাকে তাড়াতাড়ি ওঠা বলে? আরও ভোরে ওঠবেন, যখন একটু একটু করে আলো ফুটবে। তখনকার হাওয়া গায়ে লাগাবেন। স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।’

‘আমার কি স্বাস্থ্য খারাপ?’

‘শুধু শরীরটা থাকলেই কি স্বাস্থ্য ভালো থাকে? ভেতরের রোগ কি আর দেখা যায়? ঠিক আছে, মুখ ধুয়ে আসুন আপনি।’ বলেই সুফিয়া চাল ধোয়া শেষ করে চলে যেতে লাগলো। রিহান ঘাটে বসে কুলি করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর সুফিয়া আবার এলো পুকুরঘাটে। চুলোয় চাউল বসিয়ে এসেছে সে। বাবা বাজারে যাওয়ার জন্য বাজারের ব্যাগটা খুঁজলে, সুফিয়া বাবাকে একটু বসতে বলে এদিকে চলে এসেছে। রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘এই যে স্বাস্থ্যবান, হয়নি আপনার এখনও? বসে বসে ঝিমোচ্ছেন কেন?’

‘ঝিমোচ্ছি না তো। মুখ ধুচ্ছি দেখেন না?’

‘তাড়াতাড়ি আসুন। বাবার সাথে বাজারে যাবেন।’

‘কে? আমি?’

‘তো আর কে আছে এখানে?’

‘আমি কখনও বাজার করিনি।’

‘আপনি না ঐ বাসায় বাজার করে দেন? মিথ্যা বলবেন না। তাড়াতাড়ি করুন। দেরি হয়ে গেলে পঁচা মাছ নিয়ে ফিরতে হবে।’

‘ঠিক আছে। আপনি যান। আসছি আমি।’

সুফিয়া চলে এলো। রিহান হাত-পা ধুয়ে আরও কিছুক্ষণ পর এলে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলো সুফিয়া তার দিকে, ‘নিন, হাত-মুখ মুছুন।’

রিহান তোয়ালেটা হাতে নিলো। এটা গতকালের সেই তোয়ালেটা, যেটা সুফিয়া তার চুলে প্যাঁচিয়েছিল। তোয়ালেটা দিয়ে রিহান হাত মুছলো। মুখ মুছতে গিয়ে অনেকক্ষণ চেপে ধরলো মুখে তোয়ালেটা। সুফিয়ার যেন গন্ধ লেগে আছে এটাতে। মিষ্টি একটা গন্ধ। রিহান তোয়ালেটা মুখ থেকে সরাচ্ছে না দেখে সুফিয়া টান দিয়ে নিয়ে নিলো। তারপর বাবার উদ্দেশ্যে বললো, ‘বাবা, বাজারের ব্যাগটা উনার হাতেই দিয়ো। খুব স্বাস্থ্যবান উনি।’

জাফর মাস্টার হাসলেন। বললেন, ‘বেচারা ছেলেটাকে আর জ্বালাস না। চলো রিহান, বাজার থেকে ঘুরে আসি।’

‘চলুন।’ বেরিয়ে গেল দুজন বাজারের উদ্দেশ্য। বেশি দূরে না বাজারটা। হেঁটেই যাওয়া যায়। মাস্টার সাহেবের পোশাক পরে হাঁটতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছে রিহানের। নিজের যুগে এই পোশাকে হাঁটলে লোকজন হা করে চেয়ে থাকতো। পাগল বলে টিটকারি করতো। যেমনটা এখন এই যুগের লোকেরা করছে রিহানের পোশাক নিয়ে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পোশাকেও পরিবর্তন আসে।

রিহান ভেবেছিল সে আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে ওঠেছে। কিন্তু বাজারে এসে তার ধারণা পালটে গেল। ইতোমধ্যে মানুষের অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে গেছে। জাফর মাস্টার রিহানকে নিয়ে বাজারে ঘুরে ঘুরে মাছ কিনলো, সবজি কিনলো। তিন আঁটি শাকও কিনলো, লাল শাক। ফেরার সময় দেখলো একটা ছোট্ট মেয়ে গাঁদা ফুলের মালা বিক্রি করছে। রিহান দাম জিজ্ঞেস করলে জানালো মালা প্রতি এক পয়সা। রিহান জাফর মাস্টারের দিকে চেয়ে ইতস্তত করে বললো, ‘আংকেল, এক পয়সা পাবো আপনার কাছে?’

‘কেন?’

‘মালা কিনবো। সুফিয়ার খোপায় মানাবে মালাটা।’

জাফর মাস্টার হেসে রিহানের হাতে দশ পয়সা দিয়ে বললেন, ‘বাকিগুলো তুমি রেখো। খরচ করবা।’

রিহানও হাসলো। পকেটে যখন চাহিদার অতিরিক্ত পয়সা এসে গেল, তখন খরচ করতে মানা নাই। দুই পয়সা দিয়ে সে দুইটা মালা কিনে নিলো। তারপর ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলো সুফিয়ার চুলের খোপায় কেমন দেখাবে এই মালা।

বাড়িতে যখন ফিরলো, রিহান অবাক হয়ে গেল সুফিয়ার কাণ্ড দেখে। রিহান রাতে তার শরীর থেকে যে শার্ট-প্যান্ট খুলে রেখেছিল, ওগুলো সুফিয়া যত্ন করে ধুয়ে রোদে শুকোতে দিচ্ছে। রিহান বাজারের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘এ কী করলেন আপনি? আমি ধুতে পারতাম তো এসে।’

‘এখন সমস্যাটা কী হলো?’ গম্ভীর মুখে কথাটি বলে রিহানের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিলো সুফিয়া। ভেতরে কী কী আছে দেখতে দেখতে বললো, ‘দুজন মিলে বাজারে গেছেন, পঁচা মাছ সবজি আনলে আজ দুজনের খবর আছে।’

‘সব ঠিক আছে। দেখেশুনে নিছি আমরা।’ বলেই রিহান জাফর মাস্টারের দিকে নজর দিলেন। মাস্টার সাহেব এরই মধ্যে কিছুটা দূরে একটা লিচু গাছের চারায় পানি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রিহান নিচু স্বরে সুফিয়াকে বললো, ‘আপনার জন্য দুইটা মালা আনছি। গাঁদা ফুলের মালা।’

সুফিয়া বাজারের ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছিল। রিহানের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো। তার দিকে ঘুরে মৃদু হাসলো সে। কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘মালা আনছেন?’

‘হুমম… এই যে।’ সুফিয়ার হাতে মালা দুটো দিলো রিহান। খুব খুশি দেখালো তাকে। নেড়েচেড়ে মালাজোড়া দেখতে দেখতে বললো, ‘পয়সা কোথায় পাইছেন?’

‘আংকেল থেকে নিছি।’

‘বাবা থেকে নিছেন?’ চাপা স্বরে হাসলো সুফিয়া। কী মিষ্টি লাগছে এই মুহূর্তে তাকে। এই খুশি চেহারাটাতে সুফিয়াকে কয়েকগুণ সুন্দর লাগলো। হঠাৎ হাসি থামিয়ে, সুফিয়া মালা জোড়া রিহানকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘নিজ হাতে খোপায় পরিয়ে দিতে পারবেন? তবেই নিবো।’

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here