জান্নাত,পর্ব :- ০২
Writer :- Kabbo Ahammad
-: আবিদা গেইট থেকে বের হলেই পাশের বাসার গেইট থেকে সেই লোকটা বের হয়। আবিদা তাকে দেখে পুরো অবাক! ও দৌঁড়ে সেই লোকটার কাছে যায়। খুব দামী কাপড়ের লম্বা সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা। মাথায় একটা সাদা টুপি। আর আতরের তীব্র ঘ্রাণ আসছে তার কাছ থেকে। আবিদা আশ্চর্য হয়ে দ্রুত জিজ্ঞাস করলো।
—আপনি এখানে!
লোকটা থমকে যায়। আজও সে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে আছে। আবিদার দিকে তাকায় নি। সে আস্তে করে বললো।
—দুঃখীত আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।
—পারবেনও বা কীভাবে, আমার দিকে একবার তাকালে না চিনবেন। আচ্ছা যাই হোক আমিই বলছি। আমি সেই মেয়েটা যাকে আপনি একটা খারাপ ছেলের হাত থেকে বাচিঁয়েছিলেন। পুলিশে দিয়েছিলেন। মনে পড়েছে?
—জ্বী পড়েছে। আপনি এখন ভালো আছেনতো?
–জ্বী ভালো আছি। আর আমি এখন খুব খুশী জানেন?
—না কেন?
—আসলে আপনাকেই খুঁজছিলাম। এভাবে দেখা হবে ভাবিনি। আপনি কী এই বাড়িতে থাকেন?
—হ্যাঁ আজ সকালে এসেছি।
—বাহ্! এটা আমাদের বাড়ি। আপনার আর আমার বাসা একদম পাশাপাশি।
—ওহ্! আচ্ছা ভালো থাকবেন আমি আসি একটু কাজ আছে৷
—আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার নামটাই তো জানা হলো না। আপনার নাম কী?
—জ্বী আমার নাম কাব্য আহম্মেদ।
—বাহ্! খুব সুন্দর নাম। আমি আবিদা চৌধুরী।
—আচ্ছা। তাহলে আসি আমি ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।
—জ্বী আচ্ছা অলাইকুম আসসাল….
কাব্য চলে যায়। রীতিমতো ভাগে আরকি। আবিদা ঠিক বুঝতে পারছে কাব্য ওর সাথে কথা বলতে কম্ফোর্ট বোধ করছে না। আবিদা কাব্যর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। নূরানী চেহারার এই লোকটাকে দেখলে আবিদা কেন জানি সব ভুলে যায়। এরকম পরহেজগার লোকের সংস্পর্শে আবিদা কখনো আসে নি। আতরের তীব্র ঘ্রাণটা এখনো ওর নাকে লেগে আছে। এ যেন মন ভোলানো ঘ্রাণ। আবিদা এরপর ভার্সিটিতে চলে আসে।
ভার্সিটিতে……
আবিদার বেস্ট ফ্রেন্ড মহিমা আবিদাকে দেখে দ্রুত ওর কাছে ছুটে আসে আর অস্থির হয়ে বললো।
—দোস্ত তুই কই ছিলি? ফেইসবুক, ফোন সব অফ! আর শুনলাম রাসেল নাকি থানায়। তুই ভালো আছিস তো? (মহিমা)
—ক্যানটিনে চল। বসে সব বলছি। (আবিদা)
—আচ্ছা চল চল।
এরপর আবিদা মহিমাকে সব খুলে বলে। মহিমা সব শুনে রাগী ভাবে নিয়ে বললো।
—বেশ হয়েছে। বাস্টার্ডটাকে বেস্ট পানিশমেন্ট দিয়েছিস।
—আমিতো দেইনি। উনি দিয়েছে রে৷
—খুব ভালো করেছে। ইসসস উনি অনেক ভালো রে। আর অনেক বুদ্ধিমান সে।
—শুধু বুদ্ধিমান না রে আল্লাহ যেন তার আপন বন্ধু। খুব পরহেজগার সে৷ আমি মুগ্ধ তাকে দেখে। সে যেন একজন সত্যিকারের পুরুষ।
—ইসসস এরমত একজন যদি জীবন সঙ্গী হতোরে জীবনটা ভালো হয়ে যেত তাইনা দোস্ত?
—জানি নারে। রাসেলের মতো ছেলেও এই দুনিয়াতে আছে আবার উনার মতো মহৎ মানুষও আছে। সত্যিই উনি ওইদিন না থাকলে আমি শেষ হয়ে যেতাম।
—বাদ দে ওই বাস্টার্ডটার কথা। চল ক্লাস করবি। কতদিন হলো ক্লাস করিয়স না। চল।
—হুম চল। ভালো লাগে না আর এই জীবনটা কোথাও যেন কোন শান্তি পাচ্ছিনা বুঝলি। বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিবে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি।
—সেতো আরো ভালো। হাসবেন্ডকে নিয়ে ঘুরাঘুরি মজা করবি।
—ভালো লাগে না দোস্ত। জীবনের যেন কোন মানে খুঁজে পাচ্ছি না। খুব খারাপ মনে হয় নিজেকে।
—আহ! বাদ দে তো সব। চিল কর৷ আড্ডা মাস্তি কর ভালো লাগবে। আজ রোহানের জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি আছে। আমাদের সবাইকে ইনভাইট করেছে। তোকেও যেতে বলেছে। তুই আর আমি যাচ্ছি ওকে?
—ভালো লাগে না দোস্ত।
—না তোকে যেতেই হবে। নাহলে আমি যাবো না।
—আচ্ছা যা যাবো নে৷
—থ্যাঙ্কিউ। চল ক্লাসে যাই।
—হুম।
এরপর আবিদা ক্লাসে চলে যায়। কিন্তু ক্লাসের লেকচার যেন ওর মাথায় ঢুকে না। কেন যেন শুধু কাব্যর কথাই ওর মাথায় ঘুরছে। তার ভিতর মহিমার একটা কথা ওকে কেমন জানি অবচেতন করে দিচ্ছে। মহিমা বলেছিল, কাব্যর মতো কেউ যদি জীবন সঙ্গী হতো। কথাটা আবিদাকে খুব ভাবাচ্ছে। সত্যিইই কাব্য এমন একজন পুরুষ যাকে দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। কিন্তু পরক্ষণেই আবিদার অপরূপ মায়াবী মুখখানায় অন্ধকার নেমে আসে। কারণ ও ভাবে কাব্য কখনো ওকে তার জীবন সঙ্গী করবে না। কাব্যর চোখে ও খুব খারাপ একটা মেয়ে। আবিদা এসব ভেবে ভেবে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। আর তখন মহিমার ধাক্কায় ওর হুশ হয়।
—কিরে উঠ ক্লাস শেষ তো। এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আছিস কেন?
—না কিছু না চল।
এরপর আবিদা বাসায় চলে আসে। খেয়ে দেয়ে রেস্ট নিয়ে মহিমার জোরাজোরিতে রোহানের বার্থে পার্টিতে যায়। পার্টি শেষে আবিদা আগেই বেড়িয়ে আসে।
ও গাড়িতে উঠতে যাবে ওমনি দেখে কাব্যকে। আবিদা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই স্তব্ধতা মুগ্ধতার। আবিদা দেখে কাব্য একটা বয়স্ক লোককে ধরে রাস্তা পার করে দিচ্ছে। এরপর আবিদা আরো আশ্চর্য হলো। কারণ কাব্য লোকটার হাতে ভালোই টাকা দিয়ে দিচ্ছে। লোকটা নিতে চায় নি তাও দিলো। বৃদ্ধ লোকটা কাব্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে খুব খুশী হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেলো। আবিদার বুঝতে বাকি নেই বৃদ্ধ লোকটা অসহায় গরীব একজন মানুষ। আবিদার চোখে কাব্যর জন্য সম্মান শ্রদ্ধা আর অনেক ভালো লাগা বেড়ে গেলো। আবিদা আড়ালে সরে দাঁড়ায়।
তারপর কাব্য একটা রিকশা নিয়ে চলে যায়। আবিদাও একটা হাসি দিয়ে গাড়িতে করে চলে আসে। বাসায় আসার পুরোটা সময় আবিদা শুধু কাব্যর কথাই ভাবছিলো। ভাবতে ভাবতে অতল বিষন্নতায় হারিয়ে যাচ্ছিলো। আবিদার মন চায় ওর এই সময় যদি কাব্যর মতো বা ঠিক কাব্যই যদি ওর হাতটা ধরতো সারা জীবনের জন্য। আবিদা শুধু ভাবছে আর ভাবছে। এভাবে সেদিন বাসায় পৌঁছে ওর রাতটাও কাব্যর কথা ভেবেই কেটে যায়।
পরদিন খুব ভোরে……..
হঠাৎই আবিদার ঘুম ভেঙে যায়। চোখে মেলে তাকিয়ে দেখে অন্ধকার। তবে দিনের আলো বের হবে হবে বলে। আবিদার যে ঘুম ভাঙলো ও তার উৎস খুঁজতে লাগলো। অসম্ভব সুন্দর মন মুগ্ধকর সুরেলা কণ্ঠে কেউ কুরআন তিলোয়াত করছে। তার সুরের জোরেই আবিদার ঘুম ভাঙলো। আবিদা এই মধুর তিলোয়াত কে করছে খুঁজে দেখে ওর পাশের বাসার ঠিক ওর জানালার সামনে কাব্য তার রুমে বসে কুরআন শরীফ তিলোয়াত করছে। আবিদা পর্দা সরিয়ে জানালা একটু ফাঁকা করে কাব্যকে কুরআন পড়তে দেখছে আর শুনছে। কাব্যরর প্রতি টানে যেন আবিদার বুক ফাটিয়ে দিচ্ছে। আবিদার চোখ দিয়ে কেন জানি টপটপ টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। আবিদা কাঁদছে আর কাব্যর কুরআন তিলোয়াত শুনছে। এতো মধুর তিলোয়াত যে আবিদার মন প্রাণ সব শান্ত হয়ে গিয়েছে।
এভাবে প্রায় ৫/৬ দিন চলে যায়। আবিদা খুব ভোরে উঠে জানালার পাশে বসে কাব্যর কুরআন তিলোয়াত শুনে। ও যেন এই মধুর সুরের মায়ায় পড়ে গিয়েছে। কাব্যর এই মধুর তিলোয়াত না শুনলে আবিদার ভালো লাগে না। সব কিছু কেমন জানি লাগে। এভাবেই আবিদার দিন যাচ্ছিলো আর ও কাব্যর প্রতি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছিলো। ভালো লাগা ভালোবাসায় আর অনেক সম্মানে পরিণত হচ্ছিলো।
কিন্তু হঠাৎ একদিন……
—আবিদা অনেক দিন হয়েছে আর না। কাল আমার বন্ধুর ছেলে তোকে দেখতে আসবে। তুই রেডি থাকিস।(আবিদার আব্বু)
আব্বুর কথা শুনে আবিদা মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে পড়ে। তাহলে কাব্য? ওতো কাব্যকে ছাড়া থাকতে পারবে না। না এটা অসম্ভব। তারপর আবিদা ওর বাবার কাছে গিয়ে অসহায় ভাবে বললো।
—বাবা আমি তোমাকে অনেক সম্মান করি এবং ভালোবাসি। কিন্তু আমি তোমার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করতে পারবোনা। (আবিদা)
—কিহহ! কেন? (রাগী কণ্ঠে)
—কারণ আমি একজনকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। এবার আমি কোন খারাপ ছেলেকে ভালোবাসিনি। বাবা আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমার তাকে চাই ই চাই। সারা জীবন এর জন্য।
—আবিদা, আমার মান সম্মান সব তোর উপর। তুই কি বলছিস! আমি আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছি। আর তুই এরমধ্যে কাকে ভালোবেসেছিস? (অনেক রেগে গিয়ে)
—আহ! শান্ত হও আবিদার বাবা। (আবিদার আম্মু)
—বাবা তুমি যদি তাকে একবার দেখো তুমি চোখ সরাতে পারবে না। মা সে এত্তো পরহেজগার, সে যেন আল্লাহর খুব কাছের। আমি তার সাথে আমার জীবনটা জড়াতে চাই। তার আলোতে আমার অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করতে চাই। আমাকে একটা সুযোগ দেও। একবার তার সাথে আমার কথা বলো। আমি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবোনা। কখনো না৷
—এটা কি তোর শেষ কথা আবিদা? (আব্বু)
—হ্যাঁ। (আদিবা)
—তাহলে জোর করে হলেও আমি আমার বন্ধুর ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিবো।
—তাহলে আমিও আমার জীবন দিয়ে দিব। হয় উনি আর নাহয় কেউ না।
—আবিদা….(চিৎকার করে উঠলো আর আব্বু)
—আহ!
তোমরা শান্ত হও৷ কি বলছিস আবিদা এসব! আচ্ছা যা তোর পছন্দের ছেলের সাথেই তোর বিয়ে হবে। (মা)
—আবিদার মা…!(বাবা)
—দেখো মেয়ে যেখানে খুশী থাকবে সেখানেই ওর বিয়ে দিতে হবে। ওর মতের বাইরে বিয়ে দিলে ও কখনো শান্তি পাবে না। (মা)
—তাহলে আমার কোন মূল্যই নেই তোমাদের কাছে। (বাবা)
—আছে বাবা আছে। কোটি কোটি বার আছে। বাবা প্লিজ একবার দেখা করো তুমি ওর সাথে।(আবিদা)
—আচ্ছা বল কে?
—আমাদের পাশের বিল্ডিং এ মানে হাবিব আঙ্কেলের বাড়িতে একজন হুজুরটাইপ ছেলেকে দেখেছো? সবসময় পাঞ্জাবি টুপি পরে থাকে?
—হ্যাঁ সেতো বেশ এলেমদার। খুব ভালো একটা ছেলে। সেদিন আমাকে সালাম দিয়েছে। ওর চেহারায় নূরানী একটা ভাব আছে। খুব শান্তি পেয়েছি ওর সাথে একটু কথা বলে। তাহলে ওই এলেমদার ছেলেকে তুই পছন্দ করিস?
—হ্যাঁ বাবা৷
—তাহলে আর চিন্তা করিস না। ওর সাথেই তোর বিয়ে হবে। আজ রাতে আমি আর তোর মা ওর বাসায় যাবো। দেখি ওর বাবা মা কি বলে। আশা করি না করবে না৷
—থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ বাবা। (অনেক খুশী হয়ে)
—হয়েছে যা।
—তোমরা বাবা মেয়েরা পারও। (মা)
তারপর রাতে……
আবিদা অধীর আগ্রহে বসে আছে সোফাতে। সেই ৮ টায় সময় গিয়েছে ওর বাবা-মা এখন ১০ টা বাজে। কিন্তু এখনো আসে নি তারা৷ আবিদা অস্থির হয়ে আছে। কেমন এক আশ্চর্য উত্তেজনা কাজ করছে। আবিদা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। তখন হঠাৎই কলিং বেল বেজে ওঠে। আবিদা দৌঁড়ে দরজা খুলে। আবিদা দেখে ওর বাবা-মার মুখে কোন হাসি নেই। একদম ফ্যাকাসে হয়ে আছে। আবিদার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলছে অজানা এক ভয়ে। ওর বাবা-মা সোফায় এসে দুম করে বসে পড়ে৷ আবিদা দরজা দিয়ে দ্রুত তাদের সামনে এসে কিছু বলবে তার আগেই ওর বাবা বলে উঠললো।
—দেখ মা তুই কাব্যকে ভুলে যা। কাল আমার বন্ধুর ছেলের সাথে তোর বিয়ে ফাইনাল করে আসবো।
আবিদা স্তব্ধ হয়ে যায়। ও কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো।
—কেন বাবা কি হয়েছে? সে না করে দিয়েছে?(আবিদা)
—না করার আর কিছু নেই। তুই নিজেই কাব্যকে বিয়ে করতে চাইবি না৷(বাবা)
—মানে! কি বলছো বাবা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।(আবিদা)
—মা আবিদা, তুই কি কাব্যর সব জানতি?(মা)
—কি জানবো মা? বলো?… চুপ করে আছো কেন? বলো? বাবা তুমি বলো। প্লিজ চুপ করে থেকো না। বলো…
—কাব্যর ৫ বছরের একটা মেয়ে আছে…(জোরে বললো আর বাবা)
—কিহহ! (আশ্চর্য হয়ে)
আবিদা ঠাস করে সোফার উপর বসে পড়ে।
ওর নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ওকি ঠিক শুনলো? কাব্যর একটা মেয়ে আছে! তাও ৫ বছরের!
.
.
চলবে…………