চাঁহাত,পর্ব-৪,৫

চাঁহাত,পর্ব-৪,৫
আরশিয়া জান্নাত
৪র্থ পর্ব

গিটারে টুংটাং শব্দ করছে।মনটা কেমন দোটানায় আজ, না সুখ না দুঃখ তবুও কেমন এক উদাসীনতা।মাঝে মাঝে ভাবি মন না থাকলেই ভালো হতো,না সুখ থাকতো না দুঃখ।
গিটারে সুর তুলেই গাইতে লাগলো আয়াজ,

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে

তোমারে দেখিতে দেয় না

মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না

মোহমেঘে তোমারে

অন্ধ করে রাখে

তোমারে দেখিতে দেয় না

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই

চিরদিন কেন পাইনা?
🎶🎶🎶

চাঁহাতের অবস্থা এখন কিছুটা ভালো।সকালে আঁখি এসে অপরাধীর মতো মাফ চাইলো।ও তো ভাবেই নি চাঁহাতকে সাজালে এতো সমস্যা হবে।এতোদিন ভেবেছে চাঁহাত এমনিই সাজেনা।কিন্তু ওর যে সমস্যাও আছে তা দিলারা পর্যন্ত জানতো না।মেকাপের ফলে স্কিনে পর্যন্ত এফেক্ট হয়েছে।
চেহারাটা কেমন লালচে হয়ে আছে।চাঁহাতের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।সবার দুঃখী দুঃখী চেহারা দেখতে ভালো লাগছেনা।ঐদিকে ফাতেহা বেগম রেগে আগুন তাঁর আদরের নাতনির এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছেন তিনি।তাঁর ধারণা চাঁহাতের উপর নজর লেগেছে।তাঁর চাঁদের মতো নাতনিটাকে এমনিতেই অনেক মিষ্টি লাগে।সে হুজুর এনে পানি পড়া নিয়ে গোসল দিতে বললেন।
বিয়ের অনুষ্ঠানে সবার মাঝে এক ধরনের মন খারাপ কাজ করলো।চাঁহাত সাদামাটা সালোয়ার কামিজ পড়ে এক কোণে বসেছিল।পায়ের যে হাল হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে তাঁর।
বিয়ে বাড়িতে এমন সাধারণভাবে কাউকে বসে থাকতে দেখে চোখ আটকে গেল সামিরের।
সূর্যের হালকা রশ্মি এসে পড়ছে চাঁহাতের মুখে,কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে অন্যদিকে গিয়ে বসলো।
সামিরের মনে হলো তাঁর চোখের সামনে সদ্য ফোঁটা এক মুঠো স্নিগ্ধ শিউলি ফুল মানুষরূপে বসে আছে।এলোমেলো করে বেঁধে রাখা চুলেই যেন তাঁকে অপ্সরা লাগছে।আচ্ছা এটাকেই কি তবে Love at first sight বলে??
সামির নিধির চাচাতো দেবর।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়ছে।বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হলো।গ্রামে দুপুরেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়।।এই ভরদুপুরে বিয়েটা কিছুটা বিরক্তিকর বটেই।তবে যারা সাধারণ ভাবে থাকে তাঁদের জন্য তেমন বিরক্তিকর না।চাঁহাত কিছুটা কষ্ট করে দীঘির ঘাটে গিয়ে বসলো।মানুষের ভীড় এড়িয়ে এখানে বসে থাকাই শান্তির।
সামির চাঁহাতকে ফলো করতে করতে দীঘির ঘাটে এসে পড়লো।ভণিতা না করেই বলল,
হেই আমি সামির।আপনি?
চাঁহাত যদিও কিছুটা বিরক্ত হয়েছে তাও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,হ্যালো।আমি চাঁহাত।
:কনের কি হন?
:ফুফাতো বোন
:ও আচ্ছা তাহলে সম্পর্কে আমার বেয়াইন।
:তাই নাকি?
: হ্যাঁ আমি বরের চাচাতো ভাই।সেই সূত্রে তো এটাই হয়।
:আপনার পায়ে কি হয়েছে?
:এমনি একটু ব্যথা আর কি।
:ওহ আচ্ছা।গতকাল তো হলুদ ছিল নাচানাচি করে ব্যথা পেয়েছেন বুঝি?
চাঁহাত এর কেন জানি সামিরকে একটুও ভালো লাগছিল না।।এরকম গাঁয়ে পড়ে কথা বলতে আসা ছেলে দুচোখে দেখতে পারেনা সে।মুচকি হাসি দিয়ে ওখান থেকে উঠে চলে আসতে চাইলো কিন্তু সামির আটকে বললো,
আমরা কি বন্ধু হতে পারি?যোগাযোগ করার মতো কোনো আইডি বা নাম্বার কি দিবেন?
:আমার ফোন নেই আইডিও নেই।ধন্যবাদ।
বলেই কোনোরকম সরে এলো ওখান থেকে।সামির মুগ্ধ চোখে তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।সামির এমনিতে খুব শান্ত আর ভদ্র ছেলে।কিন্তু চাঁহাতকে দেখে সব কেমন উলোটপালোট হয়ে গেছে।ইচ্ছে করছে বারবার কথা বলে নিজেকে উপস্থাপন করতে।সুযোগমতো চাঁহাতের বেশ কিছু ছবিও তুলে নিয়েছে।
🌿🌿🌿🌿
বিদায়ের সময় নিধি সবার গলা ধরে কাঁদলো যখন চাঁহাতের ও কান্না পেয়ে গেল।মেয়েদের কি অদ্ভুত জীবন এতো বছর যাঁদের অবলম্বন করে বেড়ে উঠলো তাঁদেরকেই ছেড়ে অন্য পরিবারে চলে যেতে হয়।বিকেলে সবাই মন খারাপ করে বসে রইলো।কাল এই বাড়িটা কতো আনন্দমুখর ছিল আজ কেমন ফাঁকা।।একজন চলে যাওয়ায় যেন সবাই মিইয়ে পড়েছে।চাঁহাত গিয়ে তাঁর বাবাকে বললো,
বাবা আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা।যদিও করতে হয় তবে দুটো অপশন থাকবে।হয় ছেলে সবাইকে নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসবে নাহয় আমি তোমাদের সবাইকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।
ওমর ফারুক মেয়ের এমন কথা শুনে শুকনো করে হাসলেন।তারপর বললেন, ঠিক আছে মামণি আমরা ওরকম বলেই ছেলে দেখবো।কিন্তু এতে কিন্তু সবার সমস্যা হবে।
:কি সমস্যা?
:সবকিছুর একটা রুলস আছে।প্রকৃতিও তাঁর নিজস্ব নিয়মে চলছে।আমরা সমাজে বাস করতে গিয়েও কিছু নিয়ম মেনে চলেছি।এখন তুমি যদি সাধারণ নিয়ম পাল্টে বলো, দিনে আমায় ক্লাস করতে হয় তো সূর্যের তাপ কষ্ট দিচ্ছে।তাই নিয়ম বদলাতে দুটো অপশন হয় রাতে ক্লাস হবে নাহয় সূর্য রাতে চলে যাবে।এটা কেমন হবে বলোতো?
:ইউনিভার্সের সব চেইঞ্জ হবে।আর এটাতো অসম্ভব ও বটে!
:হ্যাঁ।ঠিক তেমনই আমাদের সবার নিজস্ব জগত আছে।কম্ফোর্ট জোন আছে।রুলস অনুযায়ী আমরা মেয়েকে অন্যের বাড়ি পাঠাই,ছেলের জন্য অন্যের মেয়েকে আনি।এভাবেই সমতা হচ্ছে।এখন তোমার মতো সবাই যদি ভাবে চিন্তা করো কেমন বিশৃঙ্খলা হয়ে যাবে?
:হুহ সবাই কেন ভাববে?এটা শুধু আমার ভাবনা।সবাইতো ঠিকই নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে!
:মা গো কেউই নাচতে নাচতে যাচ্ছেনা।এখন প্রযুক্তি সবকিছু হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে বলে মানুষ আগের মতো গাঢ় ব্যথায় জর্জরিত হচ্ছেনা।ভাবছে ফোনে তো কথা হবেই দেখতে চাইলে ভিডিও কলেও দেখা যাবে।তাই মন দুঃখগুলোকে হালকা করে উড়িয়ে রাখছে।
:বাবা তোমার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর থাকে!
ওমর ফারুক মুচকি হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললো,সব প্রশ্নের উত্তর থাকেনা লজিক দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি।

আয়াজের ফোনে চাঁহাতের বেশ কিছু ছবি পাঠানো হয়েছে।চাঁহাতের কাজিনরা তাঁকে ট্যাগ করে ছবি আপলোড করায় হলুদ ফাংশন আর বিয়ের অনেক ছবি কালেক্ট করা সম্ভব হয়েছে।চাঁহাতের মা দিলারাকে দেখেই চমকে উঠলো আয়াজ।
তারপর চিৎকার করে বলতে লাগলো,
আমি পেয়ে গেছি। ইয়েস আই গট ইট।আমি পেয়ে গেছি তোমাকে।আমার সিনড্রেলা আমার অপরিচিতা আমার চাঁহাত।ইয়াহু আমি পেয়ে গেছি তাঁকে।
বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে আয়াজ খুশিতে ওর কান্না পেয়ে যাচ্ছে।সুপ্তি রুমে ঢুকতেই ওকে ধরে ঘুরতে ঘুরতে বললো, আপু আমি পেয়ে গেছি তাঁকে।আমি অনেক খুশি অনেক অনেক অনেক খুশি।
আয়াজের বাবা মা রুমে এসে ছেলের পাগলামি দেখে অবাক হয়ে গেল।তারপর কিছু একটা বুঝে হাসতে লাগলো।তাঁদের হাসি শুনে আয়াজ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো।
আয়েশা ছেলের কান মলে দিয়ে বললো, পেয়েছিস যখন তুলে নিয়ে আয় না।আমরাও দেখি কার জন্য আমার ছেলেটা এতো বছর অপেক্ষা করলো।
সাদমান ছেলের পিঠ চাপড়ে বললো,কেউ যখন মন থেকে কিছু চায় পুরো কায়নাত তাকে সাহায্য করে।
সুপ্তি বললো,আব্বু শাহরুখ খানের ডায়লগটার বাংলা ভার্সন না বলে হিন্দিটাই বলো না দারুণ লাগবে!!
সবাই হোহো করে হেসে উঠলো।

আউটডোর শুটিং এর জন্য তিনমাস বাইরে থাকতে হবে আয়াজকে।চাঁহাতদের আসতে আরো পাঁচ দিন বাকি।ইশ একটা মিরাকেল ঘটতো যদি ,চাঁহাত যদি সামহাও এর আগেই চলে আসতো কতো ভালো হতো!!
ঐদিকে চাঁহাতরা অলরেডি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে…….

চলবে …….

চাঁহাত
৫ম পর্ব
আরশিয়া জান্নাত

:হ্যালো মিস্টার আয়াজ আমি “রাইজিং স্টার” এর রিপোর্টার শান্তা বলছি।
:হ্যাঁ মিস শান্তা।কেমন আছেন?
:ভালো আছি আপনি কেমন আছেন?
:ভালো আছি।
:আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট না করে প্রশ্ন শুরু করি তাহলে?
:হ্যাঁ অবশ্যই
:এই পর্যন্ত আপনার বেশিরভাগ মুভি ব্লকবাস্টার হয়েছে।এটা আসলেই একজন অভিনেতার জন্য দারুণ ব্যাপার।এ নিয়ে আপনার অনুভূতি কি?
:অনুভূতিটা আসলে বলে প্রকাশ করার মতো না।দর্শকরা আমাকে অল্প সময়ে এতো ভালোবাসা দিয়েছে আমি আসলেই কৃতজ্ঞ।তাঁদের ভালোবাসা ছাড়া এটা অসম্ভব ছিল।সত্যি বলতে তাদের এই ভালোবাসাটাই আমাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
:আপনার নেক্সট মুভি “মন পাঁজরে” নিয়ে কিছু বলবেন?
:মুভিটার কাজ এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি।তবে সেখানে নতুন চমক আছে দর্শকদের জন্য।
:আপনার সব নারীভক্তের এক প্রশ্ন আয়াজ আহমেদ এর জীবনের নায়িকা আছে কি না।সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?
:সঠিক সময়ে সবটা জানতে পারবেন।
:ভক্তদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
:একজন অভিনেতার জন্য ভক্তদের মূল্য অনেক বেশি।আমি আমার সকল ভক্তদের বলতে চাই আপনাদের ভালোবাসায় আমি সিক্ত।এভাবেই আমাকে ভালোবেসে যাবেন।আমি চেষ্টা করবো আপনাদের এন্টারটেইন করতে।আক্রমণাত্মক মনোভাব বদলে সেলিব্রিটিদের প্রতি সহযোগী মনোভাব দেখানোটাই কাম্য আসলে।আমাদের দেশে অনেকেই কমেন্টবক্সে আজেবাজে কথা বলে হ্যারেস করার চেষ্টা করে এই মানসিকতা বদলানো উচিত।সমালোচনা করতে বারণ করছি না সেই অধিকার প্রতিটি দর্শকের আছে তবে সমালোচনার নামে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা থেকে যেন বিরত থাকি।সবাই ভালো থাকবেন আর আমার জন্য দোআ করবেন।
:ধন্যবাদ আয়াজ ।আপনি আসলেই খুব জরুরি টপিকে কথা বলেছেন।বর্তমানে এটা আসলেই খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে।আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।আপনার জন্য অনেক শুভ কামনা।
:আপনাকেও ধন্যবাদ মিস শান্তা।

আয়াজ ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে কোচে হেলান দিয়ে বসে রইলো।আজকাল চোখ বন্ধ করলেই চাঁহাতের মুখটা ভাসে।অবশ্য আগেও সবসময় সে ই তাঁর ভাবনাতে ছিল সেই কিশোরী চেহারায়।
আয়াজ তখন সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অবসর সময় পার করছে।তাঁর ছোট মামা আরিফ ঢাকায় এসে তাঁকে চিটাগং বেড়াতে নিয়ে যায়।পাহাড় এ ঘেরা শহরটিকে বেশ ভালো লাগে আয়াজের।বাটালি হিল,পতেঙ্গা বীচ,নেভাল,সিআরবি,ফয়েজলেক সহ সিটির মোটামুটি সব জায়গায় বেড়ানো হয়ে গেছে তাঁর।
সেখানেই তাঁর চাঁহাতের সাথে দেখা।দুই বেনী করা স্কুল ইউনিফর্মে থাকা মেয়েটি আইসক্রিম খেতে খেতে মনের সুখে হাঁটছিল।
:স্যার আপনার কফি।
মেরাজের ডাকে ধ্যান ভাঙে আয়াজের।আয়াজ কফি হাতে নিয়ে বললো,
নেক্সট শিডিউল কি?
:আজকে আপনার মেডিক্যাল চেকাপ আছে।ওখান থেকেই শুটিং স্পটে যেতে হবে।
:মিস চাঁহাতের আর কোনো খবর দিয়েছে?
:হ্যাঁ স্যার।মিস চাঁহাত আজ ক্লাস জয়েন করেছেন।
:হোয়াট?? তাঁর না আরো চারদিন পর আসার কথা? আগে বলোনি কেনো ডেম ইট।
:স্যরি স্যার আসলে মনেই ছিল না।
:যে করেই পারো মিস চাঁহাতের সাথে আমার মিটিং ফিক্সড করো।নাহয় আমি এখুনি ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হবো।
:স্যার প্লিজ পাবলিক প্লেসে আবার যাওয়ার দরকার নেই আমি উনার সাথে আপনার পার্সোনাল মিটিং এর ব্যবস্থা করছি।
:Do it fast.
মেরাজের ঘাম ছুটে গেছে।বড় অভিনেতার পিএ হওয়া যে কত্ত প্রেশারের।মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করি।শুধুমাত্র আয়াজকে অনেক ভালোবাসে বলে এই চাকরিটা করে যাচ্ছে।এর আগে সে কাজ করতো কো-এক্টোর ফয়সাল এর পিএ হয়ে।কো-এক্টোর হলেও কি অহঙ্কারে তাঁর মাটিতে পা পড়তো না।অথচ আয়াজ এতো বড় এক্টোর হওয়া সত্ত্বেও মিনিমাম অহঙ্কার নেই।সবসময় মেরাজের পরিবারের খোঁজ খবর নেয়।বিপদে আপদে সাহায্য করে।এখনের যুগে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর বটে!

🌿🌿🌿
ক্যাম্পাসের মাঠে বসে নোট করছে চাঁহাত।কতগুলি ক্লাস মিস হয়েছে।ইরা আর নীলয় পাশে বসেই গল্প করছে।
ইরাঃ চাঁহাত তুই কত কিছু মিস করলি জানিস?ক্যাম্পাসে আয়াজ আহমেদ এসেছিল।নুশু তো মরি মরি অবস্থা।ভীড়ের একদম সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।দেখ দেখ তোকে দেখানোর জন্য ছবি তুলে রেখেছি।
চাঁহাত এক পলক তাকিয়ে বললো,হু
:শুধু হু?
:তো আর কি বলবো?
:সেটাই তোর থেকে রিয়েক্ট আশা করাই বোকামি।
নীলয় হেসে বললো,সেটা তো জানা কথা।কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপারই তো বলিনি তোদের।শুনলাম সে নাকি কার খোঁজে এসেছিল!
ইরা:কই আমাকে তো বললেনা?
:আরে ভুলে গেছিলাম বলতে।তাছাড়া এটা সিক্রেট রাখতে বলেছে।
:ও আচ্ছা।
:হুম।নুশু কে বলিস না আবার।সেতি পুরো ক্যাম্পাস করবে।
তখনই নুশু এসে হাজির
:এই তোরা কি বললি? আমি কি পুরো ক্যাম্পাসে করবো?
ইরা থতমত খেয়ে বললো,আরে চাঁহাতের ছবিগুলি দেখিস নি?যে ঠিকঠাক চুল বেঁধে ক্লাসে আসে না, সে কি সুন্দর সেজেগুজে হলুদ ফাংশন এটেন্ড করেছে।
:সত্যি নাকি কই দেখি?
ইরা চাঁহাতের ছবিগুলি দেখাতে লাগলো।
নুশুঃ চাঁহাত তুই আসলেই অনেক সুন্দর।কি মিষ্টি লাগছিল তোকে।
চাঁহাত মাথা উঠিয়ে বললো,সেজন্যই তো মৌমাছি এট্যাক করেছে।মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছি।
:মানে?
ইরা পাশ থেকে বললো,
আমাদের গুণধর চাঁহাত এর নারীবিদ্বেষী শরীর ।সেখানে নারীসুলভ যাই ব্যবহার করা হবে তাঁর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সবাই হোহো করে হেসে উঠলো।
চাঁহাত ভ্রু কুঁচকে বললো,নে নে তোরা আরো বেশি করে মজা নে।

ওমর ফারুক কিছুটা অবাক হয়ে বসে আছেন,অভিনেতা আয়াজের পিএ কি বলছে এসব!সে নাকি চাঁহাতের সাথে পার্সোনালি মিট করতে চায়,কিভাবে সম্ভব।চাঁহাত আজীবন ল্যাব প্র্যাকটিক্যাল করে করেই পার করেছে তাঁর জানা মতে মুভি পর্যন্ত দেখেনি।নাট্যশিল্পেও কোনো এক্টিভিটিস নেই।তবে কোন সূত্রে চেনে বা দেখা করতে চাইছে!!সে পড়েছে বিরাট বিড়ম্বনায় না পারছে হ্যাঁ বলতে না পারছে না বলতে।এতো বড় ফিল্মের হিরোকে কেউ মানা করতে পারে?
:দেখুন আপনি এতো চিন্তিত হবেন না।স্যার অনেক ডিসেন্ট মানুষ।তাঁর উপর ভরসা রাখতে পারেন।তাছাড়া স্যার আপনাদের বাসায় আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু এতে আপনাদের ই সমস্যা হতো।বোঝেনই তো মিডিয়ার ব্যাপার স্যাপার।
:হ্যাঁ সেটা বুঝতে পারছি।আচ্ছা আমি আমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জানাবো।
:দয়া করে আজ ই জানাবেন।সে অনুযায়ী স্যারের টাইমটা ম্যানেজ করতে হবে তো
:আচ্ছা।
🌿🌿
চাঁহাত খুব স্বাভাবিক ভাবে মেরাজকে ফোন করে বললো, আপনার হিরো কে বলুন রাতে বাসায় আসতে।আমি কোথাও যেতে পারবোনা।
মেরাজ কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বললো,আপনি ভেবে বলছেন তো মিস চাঁহাত?
:এতো ভাবাভাবির কি আছে।আমার বাসায় নিশ্চয়ই বাঘ ভাল্লুক নেই।নাকি আপনার হিরো গরীবের ঘরে আসতে পারবেনা?
:ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন।স্যার তো চেয়েছিলেনই, আপনাদের সুবিধার্থে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন।
:ঠিক আছে চলে আসুন।
চাঁহাতের কথার ভঙ্গি দেখে দিলারা মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে বসে পড়লো।এই মেয়ে কিভাবে পারলো এতো বড় হিরোর এসিসটেন্ট এর সাথে এমন ডোন্ট কেয়ার মুডে কথা বলতে!
দিলারা তাঁদের কাজের মেয়ে রিপা কে ডেকে বেশ কিছু আইটেম তৈরি করতে বললো।এতো বড় হিরো তাঁর বাসায় আসবে তাঁকে তো না খাইয়ে রাখতে পারেনা।
চাঁহাত একবার ভাবলো নুশুকে খবর দিয়ে আনবে।।পরক্ষণে মনে হলো না এটা করাটা ঠিক হবেনা।নুশুর ভরসা নেই গায়ে পড়ে টরে আবার কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ফেলতে পারে।
সচরাচর যে গাড়িটা আয়াজ ব্যবহার করে সেটা বদলে অন্য গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে।কালো গ্লাসের গাড়িটায় বাইরে থেকে তাঁকে দেখা যাবেনা।চাঁহাতদের বাড়ির সামনে বিশাল বাগান।সেই বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে বাড়ির দরজায় গাড়ি থামলো।তিনতলা বাড়িটা অসম্ভব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে।আয়াজকে রিসিভ করতে দিলারা আর ওমর ফারুক ছুটে এলেন দরজায়।
আয়াজ দুজনকেই সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
:আপনাদের এভাবে বিরক্ত করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
দিলারাঃ আরে কি যে বলছেন।এটা আমাদের সৌভাগ্য এতো নামী হিরো আমাদের বাসায়!
:আন্টি আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।
দিলারা আয়াজের ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেল।তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে অপরিচিত কেউ।বরং মনে হচ্ছে সে তাঁদের আত্মীয় যে প্রায়ই বেড়াতে আসে!
আয়াজ কিছুটা অবাক হয়ে গেল চাঁহাতকে না দেখতে পেয়ে।কিন্তু কেমন এক লজ্জায় সরাসরি বলতেও পারছেনা।চাঁহাতের বাসার সবাই আছে অথচ চাঁহাত নেই।
হঠাৎ দেখলো চাঁহাত চোখ কচলাতে কচলাতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছে।আয়াজের পৃথিবীটাই যেন থমকে গেল,চোখ আটকে গেল অজানা মুগ্ধতায়।হার্ট বিট বেড়ে এতো সাউন্ড করছে পাশের সবাই শুনে ফেলছে কিনা কে জানে!
এলোমেলো চুলে উঁচু করে বান করা একটি বাচ্চা মেয়ে!যাঁর হয়তো খারাপ স্বপ্ন দেখে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে ।ব্ল্যাক টিশার্টের সাথে টাউজার পড়া মেয়েটাই তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া সিনড্রেলা।যাঁকে এতোদিন খুঁজেছে,কেবল ফোনের স্ক্রিনেই দেখেছে।
চাঁহাত আড়মোড়া ভেঙে বললো, হ্যালো মিস্টার হিরো।কেমন আছেন?
আয়াজ খানিকটা চমকে উঠলো;দ্রুত নিজেকে সামলে বললো,হেই মিস চাঁহাত! আমি ভালো আছি আপনি ভালো আছেন?আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম না তো?
: না না ডিস্টার্ব কেন হবে।
দিলারা চাঁহাতকে দেখে রাগে কিড়মিড় করতে লাগলো মেয়েটা এ কি বেশে এসেছে!আজকে অন্তত একটু ভালো কিছু পড়তো উফ!
চাঁহাত সেটা দেখেও না দেখার মতো করে বললো,
আপনি আমার সঙ্গে আসুন,এখানে আমার পরিবার আপনাকে শান্তিতে কথা বলতে দেবেনা।বলি তোমরা সবাই এমন মৌমাছির মতো উনাকে ঘিরে রেখেছ কেন?
ওমর ফারুক হেসে বললো,কিছু মনে করো না আমার মেয়েটা একটু অন্য রকম।তুমি বরং দোতলার গেস্টরুমে গিয়ে বসো।
চাঁহাত উঠে যেতেই আয়াজ মুচকি হাসি দিয়ে তাঁর পেছন পেছন গেল।
চাঁহাত ভেসিনে গিয়ে মুখে পানি ঝাপটে মুখ মুছতে মুছতে বললো,স্যরি মিঃ হিরো।পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।হঠাৎ মনে পড়লো আপনি আসার কথা তাই উঠে এসেছি।আমার ফ্যামিলি তো আপনাকে নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমকে ডাকার কথা ভুলেই গেছে।কিছু মনে করবেন না।আসলে আপনাকে সরাসরি দেখে সবাই ভড়কে গেছে।
:আপনি ভড়কে যাননি?
চাঁহাত মিষ্টি করে হাসি দিলো।যাঁর অর্থ সবাই যেটাতে চমকায় সে সেটাতে চমকায় না।
আয়াজ বললো,আপনাকে আমি যেমনটা ভেবেছিলাম আপনি ঠিক তেমনই।আমি জানতাম আমি আসলেও আপনি স্বাভাবিক থাকবেন।
:তাই নাকি! আমার সম্পর্কে ভালোই খোঁজ খবর নিয়ে এসেছেন দেখছি?
আয়াজ মাথা চুলকালো।তারপর লাজুক হাসি দিয়ে বললো,আপনি জানতে চান না আমি কেন আপনার সঙ্গে মিট করতে এসেছি?
: অবশ্যই জানতে চাই।তবে অপেক্ষা করছিলাম আপনি নিজ থেকে বলার।
:আমাকে একটু দেখুন তো ভালো করে?
আয়াজ দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখালো।চাঁহাত আয়াজের কাজে কিছুটা অবাক হলো।চোখ গোলগোল করে বললো,আপনি আমাকে দেখাচ্ছেন কেন?আপনাকে তো সবাইই দেখে।আপনার আগাগোড়া দেখে দেখে কতো মেয়ে যে রোজ ক্র্যাশ খাচ্ছে সেই খবর আছে?
“আপনি তো দেখছেন না মিস চাঁহাত!আমার দিকে একবারো তো মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি দিলেন না।এই প্রথম আমি চাইছি এই চোখজোড়া আমাকে মন দিয়ে দেখুক।” মনে মনে বললো আয়াজ।
:না সেটা না আসলে।
:তারপর বলুন?
:আসলে হয়েছে কি …. (আয়াজের কেমন জানি নার্ভাস লাগছে।কথা সব গলায় আটকে আসছে।সে তো কতো ইন্টারভিউ-প্রেস কনফারেন্স এটেন্ড করে।ঝটাং ঝটাং করে সাংবাদিকদের রিপ্লাই করে।কই তখন তো এতো নার্ভাস লাগেনা।আজ কেন সে ঠিকঠাক কথা বলতে পারছেনা।চাঁহাতকে দেখার পর থেকেই কেমন কেমন লাগছে।এই অনুভূতি টা কি ভাষায় বলতে পারবেনা।)
চাঁহাত এসির পাওয়ার দুই সেন্টিগ্রেড কমিয়ে দিলো।আয়াজ এসির নিচে বসেও এমন তরতরিয়ে ঘামছে কেন?
:আপনি ঠিক আছেন মিঃ হিরো?
:মিস চাঁহাত আমি এখন যাই।আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।
বলেই হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল আয়াজ।চাঁহাত বোকা বনে গেল।ঘটনার আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না।
আয়াজকে চলে যেতে দেখে দিলারা দৌড়ে চাঁহাতের কাছে এলো,কিরে ছেলেটা এরকম চলে গেল কেন?কি বলেছিস তুই?
চাঁহাত হাই তুলতে তুলতে বললো, আমি কিছুই বলিনি মা।তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল এসেছে এখন ইচ্ছে হয়েছে চলে গেছে।
দিলারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।কি বলবে বুঝতে পারলোনা।

আয়াজ গাড়িতে বসে এক নিঃশ্বাসে হাফ লিটার পানি শেষ করে ফেললো।তাঁর মনে হচ্ছে হার্ট টা এখুনি লাফিয়ে বের হয়ে আসবে।তারপর বিড়বিড় করে বললো,ইউ আর সো ডেঞ্জারাস মিস চাঁহাত!!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here