গাঙচিল,পর্ব_১৭ (অন্তিম-১ম খন্ড)

গাঙচিল,পর্ব_১৭ (অন্তিম-১ম খন্ড)
লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)

ঘন্টাখানেক পর অহি গাল মুছে রুমে চলে আসলো।
বেশ স্বাভাবিক ভাবে ড্রয়িং রুমে গেল।বাবা-মা,শফিককে বিদায় দিয়ে শ্বাশুড়ি কে বিছানায় শুইয়ে সে নিজের রুমে আসলো।দরজা বন্ধ করতেই ভেতরের শূন্যতা টের পেল।মুহূর্তে ফ্লোরে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।

কিছুক্ষণ পর বিছানায় এলোমেলো ভাবে শুয়ে ফোনটা হাতে নিল অহি।এ কয়েকদিনে রোদ্দুর তাকে স্ক্রিণ টাচ ফোনের সবকিছুর মোটামুটি একটা ধারণা দিয়েছে।সে গ্যালারিতে ঢুকলো।

রোদ্দুরের ঘুমন্ত অবস্থার সাতচল্লিশটি ছবি উঠিয়েছে অহি।রোদ্দুরের অজান্তে।সেগুলো একটা একটা করে দেখতে লাগলো।তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে।যেই মানুষটা প্রতিটি সেকেন্ড তাকে মাতিয়ে রাখে,কয়েক সেকেন্ড পর পর অজান্তা অজান্তা করে কান ঝালাপালা করে,দু সেকেন্ডের জন্য চোখের উধাও হতে দেয় না,চোখের সামনে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে, সেই মানুষটার থেকে এক বছরের জন্য কিভাবে দূরে থাকবে?

ফোনের মেসেজ টিউন বাজতে অহি চোখ মুছলো।মেসেজটা অপেন করে চমকে গেল সে।রোদ্দুর মেসেজ পাঠিয়েছে।বাংলা অক্ষরে লিখেছে,

“অজান্তা,আমার গাঙচিল!কান্নাকাটি করবে না কিন্তু।আমার বুকের বাঁ পাশে ব্যথা হয়তো।বুঝো না কেন তুমি?এখন আলমারির কাছে যাও।আমার নীল রঙের শার্টের ভাঁজে একটা জিনিস লুকানো আছে।আজ থেকে একটা বছর আমার অবর্তমানে ওটা তোমাকে সঙ্গ দেবে।হুট করে আমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করলে বা মনে পড়লে যা তা লিখে রাখবে।এক বছর পর তোমার কাছে ফিরে ওটা ফেরত চাইবো কিন্তু!যত্নে রেখো।আর আমার অল্প প্রিয় শার্টটা অধিক প্রিয় মানুষটার জন্য রেখে এসেছি।যখনি মন চাইবে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ো।আমার স্পর্শ আছে ওতে।ও হ্যাঁ,তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে কিন্তু।ফ্লাইটে উঠে নেটওয়ার্ক পাব না।এয়ারপোর্টে পৌঁছে জানাব।আর… আর একটা কথা!ভালোবাসি!”

অহির চোখের সামনে রোদ্দুরের লজ্জা রাঙানো মুখটা ভেসে উঠলো।রোদ্দুর যতবার তাকে ভালোবাসি বলেছে ততবার মুখ,কান লালে লাল হয়ে গেছে। সে এক লাফে উঠে আলমারির কাছে গেল।কিছুক্ষণ খুঁজে নীল রঙের শার্টটা পেয়ে গেল।

ধূসর রঙের কাভারের চকচকে নতুন একটা ডায়েরি শার্টটা দিয়ে পেঁচানো।অহি ডায়েরিটা এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে শার্টটা নাকে চেপে ধরলো।তার ভেজা মুখের সর্বত্র প্রশান্তি ফুটে উঠলো।কাঁদতে কাঁদতে সে ডায়েরিটাতে হাত বুলাল।

রুম অন্ধকার করে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় অহি কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরিটা খুলল।প্রথম পেইজে কস্টেপ দিয়ে একটা টকটকে লাল গোলাপ লাগানো।গোলাপের পাপড়িগুলো মরা মরা।শুকিয়ে গেছে ডালা পালা।দেখে বোঝা যাচ্ছে চার-পাঁচ দিন আগের গোলাপ।অহি ডায়েরি উঁচু করে গোলাপে চুমু খেল।গোলাপের নিচে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, “ভালোবাসি গাঙচিল!”

সে ছুঁয়ে দিল অক্ষর গুলো।এরপরের পেইজ উল্টাতে নীল কালিতে লেখা শব্দ গুলো ছন্দময়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

“অজান্তা!আমার এবং আমার অজান্তা।তোমাকে কতটা ভালোবাসি জানি না।শুধু জানি,পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী তোমাকে দেখতে চাই।পৃথিবীর সমস্ত শান্তি তোমাকে, শুধু তোমাকে দিতে চাই।পৃথিবীর সব ভালোবাসা তোমার আঁচল ভরে ঢেলে দিতে চাই।নিজেকে ভেঙে চূড়ে,টুকরো টুকরো করে, সম্পূর্ণ খন্ড বিখন্ড করে তোমাকে ভালোবাসতে চাই।তোমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলতে চাই।জানো অজান্তা। আমার ভীষণ ইচ্ছে হয় তোমাকে আমার বুক পকেটে পুড়ে সমস্ত পৃথিবী ঘুরে বেড়াব।তুমি পকেট থেকে মুখ বের করে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখবে।আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু তোমায় দেখবো।

যখন মন চাইবে,তোমায় নিয়ে গল্প গুজব করবো।যখন ছুঁয়ে দিতে মন চাইবে,চুপটি করে ছুঁয়ে দিবো।যখন বুক পাজরে আঁকড়ে ধরতে মন চাইবে,চুপটি করে পকেট থেকে বের করে তোমায় বুকে জড়িয়ে নিব।কত ভালো হতো তাই না?

অজান্তা,তুমি যখন লেখাগুলো পড়ছো তখন আমি তোমার থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবো।সত্যিই কি আমি দূরে?একদমই না!তোমার মনের কল্পনার শহরের সমস্ত দরজা খুলে দেখো,আমি তোমার বড্ড কাছে।তোমার গা ঘেঁষে বসে আছে রোদ্দুর হিম নামক পাগলাটে প্রেমিক।তোমার বদ্ধ উন্মাদ প্রেমিক।এইতো মাত্র তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল তোমার মাথায়।একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ছুঁয়ে দিল তোমার চুল।এইতো তোমার ক্ষ্যাপাটে প্রেমিক তার ভালোবাসাহীন শুষ্ক ঠোঁট জোড়া মিশিয়ে দিল তোমার স্নিগ্ধ ঠোঁট যুগলে!অজান্তা,রোদ্দুর হিম নামক তোমার ব্যক্তিগত পাগলটা তো সবসময় তোমার সাথেই আছে।তোমার খুব খুব কাছে!”

অহি বন্ধ চোখে ডায়েরির পেইজে মুখ রাখলো।তার মস্তিষ্কে রোদ্দুর হিম স্বগর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে।রোদ্দুরের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ভীষণ মনে পড়ছে।

কয়েকটা পেইজ পড়ে পরবর্তী পেইজ উল্টাতে অহির চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো।বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।কারণ তার চোখের সামনে একগুচ্ছ চুল।স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেটে ছোট ছোট ঘনকৃষ্ণ চুল।প্যাকেটের এক প্রান্ত কস্টেপ দিয়ে ডায়েরির সাথে আটকানো।খোলা প্রান্ত দিয়ে কিছু চুল হাতে নিয়ে অহি সন্দিহান চোখে পরখ করলো।হ্যাঁ,চুলই তো!সে দ্রুত নিচের লেখাগুলো পড়লো,

“কি?খুব চমকে গেছো না?ডায়েরিতে চুল এলো কোথা থেকে ভাবছো তো?এগুলো আমার চুল অজান্তা!ইয়ে মানে, অজান্তা!তুমি তো আমার চুল ভীষণ পছন্দ করো।সেজন্য কিছুদিন আগের কাটা চুলগুলো প্যাকেট করে তোমার জন্য রেখে এসেছি।জানো,সেলুনের নাপিত ব্যাটা কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল।যখন আমি সমস্ত চুলগুলো নিয়ে আসছিলাম!তার শকুনের মতো দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমার মাথার চুল আমি নিয়ে এসেছি।ভালো করেছি না?অবশ্যই ভালো করেছি।আলবাত ভালো করেছি।তুমি অনেক খুশি হয়েছো অজান্তা।তাই না?আমি জানতাম তুমি খুশি হবে।

ইয়ে মানে, অজান্তা।আমি কিন্তু তোমার বেশকিছু জিনিস নিয়ে এসেছে।হারিয়ে গেছে ভেবে খোঁজাখুঁজি কোরো না।বেশিকিছু আনতে পারিনি ওয়েটের জন্য।শুধু তোমার ব্যবহৃত ব্রাশ,ওড়না,কিছু চুড়ি,মাথার চুল আর কয়েকটা জিনিস যেগুলোর নাম আমি লিখতে পারবো না।সবকিছু তোমার আড়ালে প্যাকেট করে রেখেছিলাম।ভার্চুয়ালের ছবি আর বাস্তবে ছুঁয়ে দেখার মধ্যে অনেক তফাত।সেজন্য যা মন চেয়েছে এনেছি।শুধু তুমি ছাড়া!আর হ্যাঁ!গত পরশুদিন ভোরে যে কালো রঙের ব্লাউজ টা খুঁজলে ওটা আর খুঁজো না।আমি নিয়ে এসেছি।ভয় পেয়ো না,আমি এখানে ব্লাউজ পড়ে ঘুরবো না।শুধু মন চেয়েছে,তাই নিয়ে এসেছি।ইচ্ছে তো করছিল আস্তো তোমাকে লাগেজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে আসি।

বউ!এই যে রোদ্দুর হিমের বউ!পিচ্চি গাঙচিল হয়ে যাও না!চড়ুই পাখির মতো ছোট্ট গাঙচিল হয়ে আমার বুকের খাঁচায় ঢুকে থাকো না!যাতে পৃথিবীর কেউ তোমার খোঁজ না পায়।বউ,বউ আমার!”

অহির লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে রোদ্দুর তার মুখের দুই ইঞ্চি সামনে বসে,চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলছে।ইশ!কি লজ্জা!সে লজ্জা মিশ্রিত মুখে পরের পেইজ উল্টাল।

৩০.

প্রেগনেন্সি কীটটা বেসিনের উপর রেখে শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়াল অহি।ঠান্ডা পানির স্পর্শে শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল।চোখের পাতায় পানি গড়িয়ে পড়তে চোখ বন্ধ করে ফেলল।সঙ্গে সঙ্গে তার গা গুলিয়ে উঠলো।পেটে হাত চেপে এক লাফে বেসিনে মুখ দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল।মুহূর্তে হড়হড় করে বমি করলো।

কিছুক্ষণ হাঁফাতে হাঁফাতে স্থির হয়ে গেল।ট্যাপ ছেড়ে কুলি করলো।ভেজা চোখে মুখে আবার বার কয়েক পানির ঝাপটা দিল।হাত পা সহ সমস্ত শরীর কাঁপছে।তবুও জোর করে দাঁড়িয়ে রইলো।ভেজা পাপড়ি মেলে বেসিনের আয়নায় ভেসে উঠা নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালো।

চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার।মুখটা রক্তহীন পান্ডুর মতো।শরীর শুকিয়ে গেছে।হাড়গোড় সব গোণা যাচ্ছে যেন।অত্যধিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।সর্বোপরি তার প্রেগসেন্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।

সে মা হতে চলেছে।তার ভেতরে রোদ্দুরের ভালোবাসার অম্লান সাক্ষী হিসেবে ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে মাস চারেক হলো।অথচ সে খবরটা কাউকে জানায়নি।সে বাদে কেউ জানে না।কিন্তু এভাবে কতদিন?সবাইতো জেনে যাবে।এমনিতে তার শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে সবাই প্রশ্ন করছে।সে সুন্দর মতো এড়িয়ে গেছে।কিন্তু আজ হোক,কাল হোক সবাই জেনে যাবে।তার চেয়ে আজ সন্ধ্যায় সে সবাইকে বলবে।শুধু একজন মানুষ ছাড়া।হ্যাঁ,রোদ্দুর হিম।রোদ্দুরকে ছাড়া বাকি সবাইকে জানাবে এবং শপথ করাবে কেউ যেন রোদ্দুরকে না জানায়।

অহি ভালো করে জানে,রোদ্দুর খবরটা পেলে এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে পালিয়ে হলেও সিঙ্গাপুর থেকে চলে আসবে।সে খেতে পারছে না,হাতে পায়ে ঘা দেখা দিচ্ছে ,প্রচন্ড দূর্বল হয়ে গেছে।এসব রোদ্দুর সইতে পারবে না।ছুটে চলে আসবে।তার চেয়ে আর কয়েকটা মাস সে শুধু অডিও কলে কথা বলবে,মাঝে মধ্যে শুধু মুখ দেখাবে এবং খুব সাবধানে বিষয়টা গোপন করে যাবে।তারপর ছয় মাস পর রোদ্দুর যখন মিশন থেকে ফিরবে তাকে সারপ্রাইজ দিবে।বিশাল বড় সারাপ্রাইজ!

পেটে হাত রেখে নতুন প্রাণকে স্বাগতম জানাল অহি।প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ।তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।ইশ!রোদ্দুর প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতিটা কিভাবে প্রকাশ করবে?হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকবে?অহি কল্পনা মিশিয়ে ভাবতে লাগলো।

খুব তাড়াতাড়ি গোসল করে সে বের হলো।এখন থেকে আরো সাবধানে থাকবে হবে।বাচ্চার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।মাথার চুল মুছে সে ড্রয়িং রুমে আসলো।

এক সপ্তাহ হলো বাপের বাড়ি থেকে সে ফ্ল্যাটে ফিরেছে।ও বাড়িতে বেশি থাকা হয় না।রোদ্দুরের রুমটাতে যে হাজারো স্মৃতি জমে আছে।এই স্মৃতিগুলোই তো তার সম্বল।

রোনজিদা সোফায় বসে আছে।তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ।অহি গিয়ে তার পাশে বসে নারকেল তেলের মুখ খুললো।হাতের তালিতে তেল ঢেলে বলল,

—“মা,সোজা হয়ে বসো তো।তেল দিয়ে দিই।”

রোনজিদা মুখ ঘুরিয়ে বলল,

—“তুই আবার এই গরমের মধ্যে তেল দিয়ে দিবি কেন রে অহি?”

—“মা,তোমার গোসল করতে হবে তো।নাও সোজা হও তো।”

অহি জোর করে রোনজিদাকে সোজা করে বসিয়ে দিল।মাথায় তেল দিতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

৩১.

অহি শুয়ে শুয়ে রোদ্দুরের পাঠানো ভয়েস এসএমএস শুনছে।সে এখন বিছানা থেকে নড়তে পারে না প্রায়।পেট ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেছে।নয় মাস আরো বেশ কিছু দিন চলছে তার পেটের বাচ্চার বয়স।ডাক্তারের ডেট আর ছয়দিন পর!

বিগত মাসগুলোতে অহি রোদ্দুরের বড্ড অভাববোধ করেছে।বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে সে আরো ভেঙে পড়েছিল।হুট করে মুড সুইং আর অসুস্থতা যেন ঘিরে রেখেছিল।প্রায় মাঝরাতে কান্না করতো।এসময় টাতে তার মা এবং শ্বাশুড়ি মা দুজনে সবসময় চোখে চোখে রাখছে।বাচ্চা ধারণের এত কষ্টের মধ্যেও রোদ্দুরের পাগলামি গুলো তাকে সব ভুলিয়ে রেখেছে।দিনশেষে তান মুখে হাসি ফুটাতে ভোলে না রোদ্দুর!

রোদ্দুর প্রতিদিন গাদা গাদা ভয়েস মেসেজ পাঠাবে,যেখানে যাবে সবকিছুর ভিডিও করে পাঠাবে,সময় পেলেই হুট করে সেল্ফি তুলে পাঠাবে,রাতভর গান শোনাবে,কতদিন যে অহি তার গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।এই বেসুরো কন্ঠে উল্টো পাল্টা লাইনের গান রোদ্দুর শুধু তাকে নিয়ে গায় এবং তাকে শোনায়!

অহির প্রেগনেন্সির বিষয় টা রোদ্দুর আজও জানে না।অনেক ধকল গেছে তার উপর দিয়ে এটা গোপন রাখতে।আর মাস দুয়েক বা তার থেকে বেশি কিছুদিন।তারপরেই তো মানুষটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপহার পাবে।পৃথিবীর বেস্ট সারপ্রাইজ।

হাসিমুখে হাতের ফোনটার দিকে তাকালো অহি।রাত দশটা বাজে প্রায়।কিছুক্ষণ ফোন ঘেঁটে সে রোদ্দুরের পুরনো একটা ছবি বের করলো।যেটাতে রোদ্দুর তার কোলে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।

ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অহির সমস্ত মুখ মন্ডল ব্যথায় নীল হয়ে গেল।পেটের বাচ্চা টা লাথি দিতে শুরু করেছে।ফোনটা হাত থেকে খসে পড়লো তার।পেটে হাত চেপে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো।সমস্ত শরীর কাঁপছে।হাড়গোড় সব মুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে যেন।পেটের নাড়ি সব ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন।দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ সহ্য করলো।চোখের কোণ বেয়ে বন্যার ধারা।শেষ মেষ না পেরে হাঁসফাঁস করতে করতে চিৎকার করে বলল,

—“মা,আমি মরে যাচ্ছি!আমাকে হাসপাতালে নাও।ব্যথায় মরে গেলাম!”

৩২.

ট্রানজিট এরিয়া থেকে কাগজের মতো ধবধবে শুভ্র রঙের একটা ছেলে বেরিয়ে আসছে।বাম হাতে টেনে নিয়ে আসছে বিশালাকার ট্রলি।পরণে কালো কুচকুচে শার্ট!ডেনিম প্যান্ট,কালো জুতো!অ্যাশ কালারের স্যুটটা হাতের কবজিতে গোটানো।ব্রান্ডেড ঘড়ির কাচে সূর্যের আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।সামনের দুটো বাটন খোলা।সেই খোলা অংশ দিয়ে হাঁটার তালে তালে একটা শুভ্র লকেট নড়াচড়া করছে।হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসতে আসতে ছেলেটি চোখের সানগ্লাস খুলে ফেলল।ডান হাত নাড়িয়ে এগিয়ে এসে সেই বহু পুরনো মাতাল করা হাসিটা ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে বলল,

—“বিদ্যুৎ, শফিক কেমন আছো তোমরা?”

দুজনের মুখ কিছুটা থমথমে।শফিক জোরপূর্বক হেসে বলল,

—“ভালো, রোদ্দুর ভাইয়া।”

বিদ্যুৎ স্যালুট করে রোদ্দুরের হাতের ট্রলিটা নিজের হাতে নিল।তারপর বিদ্যুৎ আর শফিকের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলো রোদ্দুর।আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিজের প্রাণভোমড়াকে খুঁজলো।অহিকে না দেখে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো সে।মাও আসেনি!বুকের ভেতর অভিমান এসে জড়ো হলো তার।প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে সে গাড়িতে উঠলো।বিদ্যুৎ গাড়ি ছাড়তে শফিক রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুরের মন খারাপ ভাব দেখে সাবধানে বলল,

—“রোদ্দুর ভাইয়া,দুটো খবর আছে আপনার জন্য।এটা ভালো, আরেকটা খারাপ।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here