গাঙচিল,পর্ব_১৬

গাঙচিল,পর্ব_১৬
লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)

—“স্যার,আপনার বাবা দেখা করতে এসেছে।”

বিদ্যুতের উচ্ছ্বসিত কন্ঠে রোদ্দুরের শরীরে শীতল রক্ত বয়ে গেল।বাবা কেন অফিসে দেখা করতে এসেছে?রোদ্দুর কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে যেন।কি উত্তর দিবে?ভেতরে আসতে বলবে?

বিদ্যুৎ ফের বলল,

—“স্যার,আপনার বাবা বাইরে অপেক্ষা করছে।ভেতরে ডেকে দিই!”

রোদ্দুর শুকনো ঢোক গিলে মাথা নেড়ে হুঁ জানাল।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা ভেতরে ঢুকলো।বিনা বাক্য ব্যয়ে রোদ্দুরের অপজিটের চেয়ার টেনে বসে পড়লো।গায়ের অ্যাশ কালারের কোর্টটা খুলে টেবিলে রেখে বলল,

—“এক গ্লাস পানি দাও তো।প্রচুর গরম আজ!”

রোদ্দুর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।বাবা পানি খাওয়ার জন্য এত কষ্ট করে তার অফিস পর্যন্ত আসেনি সেটা সে বেশ বুঝতে পারছে।তবুও উঠে গিয়ে স্বচ্ছ গ্লাসে মিনারেল ওয়াটার ঢেলে বাবার সামনে ধরলো।

তার বাবা আজাদ রহমান হাসিমুখে গ্লাসটা হাতে নিলেন।এক চুমুক পানি পান করেই গ্লাসটা কাচের টেবিলে সাইড করে রাখলেন।স্বাভাবিক গলায় বললেন,

—“কেমন আছো রোদ্দুর?”

রোদ্দুর নিজের চেয়ারে বসে পড়লো।বাবার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে বার বার।তার বাবা ছোটবেলায় তাকে হিম বলে ডাকতো।তুই তুকারি করতো।প্রায়ই বাবা বলতো,’জানিস হিম!তোর নাম শুনলেই মনে হয় প্রখন রৌদ্রে এক পশলা বৃষ্টি নামছে যেন।রোদ্দুর হিম!নামটা আমি অনেক কায়দা করে রেখেছি বুঝেছিস!”

রোদ্দুর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

—“ভালো।হঠাৎ কি মনে করে?”

আজাদ রহমানের দৃষ্টি ক্রমেই তীক্ষ্ণ হয়ে যাচ্ছে।রোদ্দুরের দিকে চেয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলল,

—“তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো রোদ্দুর।নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছো।কয়েক মাস পরে তোমার বয়স আটাশে পড়বে।কেমন বিশ্বাস হতে চায় না।মনে হয় এইতো সেদিন অফিস যাওয়ার সময় গলা জড়িয়ে বললে,বাবা আমিও তোমার সাথে অফিস যাব।”

রোদ্দুরের বুকের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে।বাবা নামক মানুষটা যে তার বড্ড আপন ছিল।হয়তো এখনো আছে!হয়তো বা না!

আজাদ রহমান একটু থেমে বলল,

—“বিয়ে করেছো শুনলাম।তোমার মাও নাকি ও বস্তিতে রয়েছে।বাড়িতে আসছো না কেন?আজীবন ফ্ল্যাটে থাকবে?আচ্ছা যাও!সব মেনে নিলাম।এছাড়া তো আর উপায় দেখছি না।অবশ্য যেদিন আমার দ্বিতীয় বিবাহের কথা জেনে গেলে তোমরা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম হয়তো তোমাদের হারাতে বসেছি।আমার ধারণাটা সত্যি হয়েছে।তোমাকে কিছু কথা বলি রোদ্দুর।এই মুহূর্তে মনে করো আমি তোমার বাবা নই!তোমার বন্ধু তোমার সামনে বসে আছে।সে হিসেবে বললাম।ভালোবাসার মানুষ পরিবর্তনশীল।তোমার মাকে যখন ভালোবেসে ফেলি তখন মনে হতো এই মেয়েটাকে পাশে না পেলে আমার অন্ধকার কাটিয়ে সূর্য উঠবে না।তোমার দাদুর মত নিয়েই তাকে বিয়ে করি।বিয়ের বহু বছর পর বুঝতে পারলাম ভালোবাসা একজনের জন্য সীমাবদ্ধ নয়।ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার সৃষ্টি।আর ভালো লাগা মানুষের প্রতিনিয়ত চেঞ্জ হয়।আজ যে জিনিসটা তোমার পছন্দ হয়েছে কয়েক বছর পর নতুন কোনো জিনিস পছন্দ হয়ে গেল।তখন তুমি পুরনোটা রিপ্লেস করে নতুন জিনিস কিনবে।এটাই স্বাভাবিক।তবে এটা ভেবো না যে তোমার মায়ের প্রতি আমার ভালো লাগা নেই!আছে!তবে আগের তুলনায় কম।”

রোদ্দুর টেবিলের নিচে হাত মুঠ করে নিজেকে শান্ত করলো।কাঠ কাঠ গলায় বললো,

—“আপনার মতো পৃথিবীর সব পুরুষ না।তারা ভালোবাসাকে এভাবে সঙ্গায়িত করে না।চেয়ার, টেবিল, সোফা আমাদের ভালোবাসা নয়।এগুলো আমাদের ভালো লাগা।আর ভালো লাগা প্রতিনিয়ত চেন্জ হয় বলেই আমরা বছর না ঘুরতেই এই জিনিসগুলো পাল্টে ফেলি।কারণ ওগুলো জড়বস্তু। জড়বস্তুর মায়া নেই।এজন্য কাউকে মায়ায় আটকাতে পারে না।একটা মেয়ে কখনো চেয়ার,টেবিল, সোফা নয়।একটা মেয়ে কখনো জিনিস নয় যে তাকে রিপ্লেস করতে হবে।আপনি পৃথিবীর একজন ব্যর্থ পুরুষ।আপনি আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে মন থেকে ভালোবাসতে পারেননি।মেয়েদের মায়াবী রুপটা আজও আপনার অধরা।মন থেকে কাউকে ভালোবাসলে কখনো রিপ্লেসের চিন্তা করতেন না।

শুনুন!আমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসি,ও কখনো আমার কাছে পুরনো হবে না। এই এতগুলো মাস ধরে ওকে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখেও আমার মন ভরে না।প্রতিবার ওর দিকে নজর পড়লে মনে হয় এই প্রথম দেখছি।অবসরে ওকে নিয়ে চিন্তা করলে আমার মনের আয়নায় আবছা একটা খোলা চুলের রমণীর চেহারা ভেসে উঠে।সঙ্গে সঙ্গে আমি ফোন বের করে তার ছবি ঘন্টার পর ঘন্টা দেখি।সেই প্রথম চোখে চোখ রাখার মতো আজও তার চোখে চোখ রাখলে জ্বলে পুড়ে যাই।তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে,কবিতা লিখতে ভালো লাগে,পাগলামি করতে ভালো লাগে।প্রতিবার তার থেকে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই ফিরে আসি।মনে হয় এতক্ষণ কাছাকাছি ছিলাম তবুও তো তাকে ভালো করে দেখাই হয়নি।এটাকে ভালোবাসা বলে!এই অনুভূতির কখনো পরিবর্তন ঘটে না।আফসোস!আমার মা একজন ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছিল।”

রোদ্দুর থামলো।প্রয়োজনের বেশি বলে ফেলেছে।সামনের মানুষটাকে এসব বলার কোনো মানে নেই।কিছুক্ষণ নিরবতার পর আজাদ রহমান নিজে থেকে বলল,

—“অজান্তা অহি নামের যে মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করেছো সেটা আবেগপ্রবণ হয়ে করেছো রোদ্দুর।মেয়েটার দারিদ্র্যতা তোমার বিলাসবহুল মনে তীব্র দুঃখ সৃষ্টি করেছিল।মেয়েটার কষ্ট দেখে তুমি তার প্রতি দয়া করেছো।মেয়েটাও বিভিন্ন ভাবে তোমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করেছে।এর ফলে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছ।একটা সময় বুঝতে পারবে।”

রোদ্দুর হাসলো।আচমকা হাসি থামিয়ে বলল,

—“অজান্তাকে বিয়ে করা এবং জীবন সঙ্গীনি হিসেবে পাওয়া আমার জীবনের সব ভালোর মধ্যে অন্যতম এবং অন্যতম।তাছাড়া আমি তো ওকে ওর কষ্ট দেখে বিয়ে করিনি।অজান্তাকে বিয়ে করেছি আমার নিজের জন্য।আমার নিজের ভালো থাকার জন্য।আমার নিজের সুখের জন্য।একটুখানি শান্তির জন্য।কারণ আমার প্রাণভোমড়া যে ওর মধ্যে।ওর জন্য যে আমার প্রাণ কাঁদে, মন কাঁদে।অস্থির হয়ে থাকি সবসময়।মনটা উথাল পাথাল করে,ব্যাকুল হয়ে থাকে ওর জন্য।ওকে ভালো না বেসে থাকতে পারিনি বলে ভালোবেসেছি।আর আজীবন বাসবো!”

আজাদ রহমান শুকনো কাশলেন।এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,

—” কয়েক সপ্তাহ পর তোমার সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট।এতবড় একটা সংবাদ জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?”

—“আমি জানতাম আর কেউ না জানলেও আপনি ঠিকই জেনে যাবেন।তার ফলাফল তো দেখতেই পাচ্ছি!”

আজাদ রহমান উঠে দাঁড়ালেন।দু পা এগিয়ে দরজার দিকে গিয়ে আবার ফিরে আসলেন।রোদ্দুরের দিকে ঝুঁকে তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

—“নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা ও দোয়া রইলো।হয়তো আমিই ভুল।কাউকে সত্যিকার ভাবে ভালোবাসতে পারিনি।তবে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার কোনো পরিবর্তন হয়নি।হবেও না।আমার দ্বিতীয় পক্ষেও কোনো সন্তান নেই!”

রোদ্দুরের একবারের জন্য মনে হলো বাবাকে জড়িয়ে ধরতে।পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল।আজাদ রহমান দ্রুত কেবিন থেকে বের হতেই রোদ্দুর সেদিকে স্নেহাশিস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

২৮.

ডিনার শেষে টেবিল গুছিয়ে অহি বিছানায় শুয়ে পড়লো।নতুন ফ্ল্যাটে এখনো কাজের লোক আনা হয়নি।তার শ্বাশুড়ি মা মাঝখানে কিছুদিন এখানে থেকে গেছে।সারাক্ষণ অহির সাথে সাথে থেকেছে।গল্প গুজব করেছে।কিছুদিন হলো আবার তিনি নাজমাকে নিয়ে কলতা বাজার তার বাপের বাড়ি গেছে।আজ অহি নিজে আনতে গিয়েছিল।তিনি আসেননি।বলেছে আর কিছুদিন পর আসবে।ও পরিবারকে আপন করে নিয়েছেন তিনি।

অবশেষে সুখ তরী তার ভেলা ভাসিয়েছে।অহি সুখী হয়েছে,তার জন্মদাত্রী মা স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকান এখন,ফুলের মতো নতুন মা পেয়েছে সাথে তুলনাহীন স্বামী!

রোদ্দুর ওয়াশরুমে।অহি বিছানায় শুয়ে সেদিকে চেয়ে রইলো।ঘুমানোর আগে রোদ্দুরের শাওয়ার করার অভ্যাস আছে।

আজ তাদের বিয়ের আঠারো দিন।এতগুলো দিন এতটা কাছাকাছি থাকার পরো রোদ্দুর তাকে যেন চোখে হারায়।প্রতিদিন অফিস যাওয়ার সময় সিঁড়ির কাছে গিয়ে ফের ফিরে আসে।তার দু কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে।তারপর চোখ বন্ধ করে দেখবে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে কি না।কোনো কোনোদিন ফুল গেটআপে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।অহি কারণ জিগ্যেস করতেই আচমকা ঠোঁটে চুুমু দিয়ে বের হয়ে যায়।

অফিস থেকে ফিরে তার আবার পাগলামি শুরু হয়।তাকে একটা কাজ করতে দিবে না।নিজেই ঘর ঝাড়ু দিয়ে চোখের পলকে মুছে ফেলবে।সারাক্ষণ অহিকে চোখের সামনে রাখবে।হুটহাট খপ করে হাত ধরবে!

মাঝরাতে তাকে বিশেষ নামে ডাকবে।প্রায়ই গভীর রাতে সে তাকে গাঙচিল বলে ডাকে।কখনো বা মাঝরাতে ডেকে তুলে গান শোনাবে!কখনো রাতের বেলা চুপচাপ এক কাপ চা হাতে ডেকে তুলবে। পাশে নিয়ে বেলকনিতে বসে তারা দেখবে।মাঝরাতে ঝুম বৃষ্টি নামলে বেলকনিতে সাথে নিয়ে ভিজবে।এ কয়েকদিনে এমন হাজারো পাগলামিতে অহি অভ্যস্ত হয়ে গেছে।মানুষটা তাকে নিয়ে এত্তো পাগলামি করে!এত কেন ভালোবাসে মানুষটা?

রোদ্দুর শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে।অহি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেদিকে চেয়ে আছে।তার ঠোঁটে হাসি।রোদ্দুরের মাথার চুল মোছার কায়দাটা তার ভীষণ ভালো লাগে।রোদ্দুরের পরণে এখন ফিনফিনে কাপড়ের কালো ফতুয়া আর সাদা ট্রাউজার।সাদা, কালোর কম্বিনেশনে কি দূর্দান্ত লাগছে মানুষটাকে।এত সুদর্শন একটা ছেলে তার মতো এমন চেহারার একটা মেয়েকে এতটা গোপন করে ভালোবাসে,এতটা আদর করে ভাবতেই অহি লজ্জায় মিশে গেল।সে পাশের বালিশটা মুখের উপর দিয়ে লজ্জা মিশ্রিত মুখ আড়াল করলো।

রোদ্দুর বেলনিতে টাওয়াল শুকাতে দিয়ে এসে অহির দিকে তাকালো।বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে অহির মুখের উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,

—“অজান্তা,কি হয়েছে তোমার?মুখে বালিশ চেপে রেখেছ কেন?”

অহি লজ্জিত চোখে মুখে বলল,

—“আপনি এত সুদর্শন কেন?কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর নাক,কি সুন্দর কপাল,কি সুন্দর ভ্রু, কি সুন্দর ঠোঁট!আপনার সবকিছু এত সুন্দর কেন?”

রোদ্দুর বড় বড় চোখে অহির দিকে তাকালো।শীতল হাতটা অহির কপালে রাখতেই অহি কেঁপে উঠলো। রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে ঢোক গিলে বলল,

—“অজান্তা,জ্বর তো আসেনি।শরীরের তাপমাত্রা নরমাল।তাহলে উল্টো পাল্টা কথা বলছো কেন?”

অহি যেন নিজের হুশে ফিরলো।এক লাফে বিছানায় উঠে বসলো।নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,

—“ক-কই?কি বলেছি?কিছু বলিনি তো!”

সে একটানে বালিশের নিচ থেকে থ্রি পিসের ওড়নাটা ভালো মতো গায়ে জড়ালো।রোদ্দুর সরে গিয়ে আলমারির কাছে দাঁড়াল।একটুপর নতুন একটা প্যাকেট অহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—“শাড়ি পড়তে যা যা লাগে সব পড়ে আসো।শুধু শাড়ি ছাড়া।”

—“অ্যা?”

রোদ্দুর নিজের বাক্য সঠিক করে বলল,

—“না মানে শাড়িটা আমি পড়িয়ে দিবো।ওয়াশরুমে গিয়ে তুমি সাথের জিনিসগুলো পড়ে আসো না!”

অহি বুঝতে পারলো।গম্ভীর ভাবে বলল,

—“বুঝতে পেরেছি।তাহলে আপনি আমায় কোলে করে নিয়ে ওয়াশরুমে রেখে আসুন।না হয় ঘুরে দাঁড়ান।এখানেই চেঞ্জ করি।”

—“একদম না!এখানে নয়।”

এক নিঃশ্বাসে শেষ করে রোদ্দুর অহিকে কোলে তুলে নিল।এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিল বাইরে থেকে।

অহি মুচকি হাসলো।

কিছুক্ষণ পর ব্লাউজ, পেটিকোট পড়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে সে বের হলো।রোদ্দুর অন্য দিকে তাকিয়ে তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসতে বলল।অহি না বসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো।রোদ্দুর এগিয়ে এলো কালো পাড়ের মেরুন রঙের জর্জেট শাড়ি নিয়ে।একদম নতুন শাড়ি।এটার কথা অহি নিজে জানে না।সে সম্পূর্ণ শাড়ি ছাড়িয়ে কিছুটা অংশ অহির কোমড়ে পেঁচাতে অহি চমকে বলল,

—“আপনার হাতে কি ওগুলো?গ্লাভস পড়েছেন কেন?”

রোদ্দুর নিজের হাতের দিকে এক পলক তাকাল।তার হাতে কনুই পর্যন্ত মোটা কালো রঙের গ্লাভস।সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

—“ইয়ে মানে অজান্তা,গ্লাভস পড়েছি।যাতে তোমার শরীরে স্পর্শ না লাগে।”

অহি চরম অবাক হয়ে বলল,

—“এমন ভাব ধরছেন যেন আপনি সাধু সন্ত মানুষ।আজ পর্যন্ত আমাকে ছুঁয়েই দেখেননি।সব জায়গাতেই তো স্পর্শ করা শেষ।কামড়ে টামড়ে ত………”

রোদ্দুর ঝট করে এক হাতে অহির মুখ চেপে ধরলো।অনুনয়ের স্বরে বলল,

—“কি বলছো অজান্তা?মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?আমি তো মনোযোগ দিয়ে শাড়িটা পরাতে চাচ্ছি।তোমার স্পর্শ পেলে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটবে।সেজন্য গ্লাভস পড়েছি।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো তো।”

অহি হাসবে না কাঁদবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে।শেষমেশ সে মাথা নিচু করে হেসে ফেলল।এই মানুষটা এমন কেন?

অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে রোদ্দুর হাতে কুঁচি করছে।তার সমস্ত ধ্যান,জ্ঞান যেন শাড়ি পড়ানোতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এই মুহূর্তে।অহি মুখ টিপে হাসছে আর এই পাগলা মানুষটাকে দেখে যাচ্ছে।

রোদ্দুর কুঁচি গুঁজে দিয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিল।অহির মাথার চুল গুলো ব্রাশ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো অপলক।তারপর তার হাত টেনে বেলকনিতে ফ্লোরে বসে পড়লো।

আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোর আলো নিভে গেছে।অন্ধকার বেলকনিতে দুজন পাশাপাশি বসে আছে।রোদ্দুর একটানে নিজের গ্লাভস গুলো খুলে বলল,

—“অজান্তা,শাড়ি পড়ানো কেমন হয়েছে?”

—“ভীষণ ভালো।একদম পার্ফেক্ট।এরপর থেকে রোজ একবার হলেও আমায় শাড়ি পড়িয়ে দিবেন।”

রোদ্দুর এক মুহূর্ত দেরি না করে অহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।অহির বাম হাতটা বুকে চেপে চোখ বন্ধ করলো।

অহি মুচকি হেসে রোদ্দুরের মাথার চুলে হাত রাখলো।চুলগুলো হালকা টেনে টেনে হাত বুলাল।রোদ্দুর কিছুক্ষণ উসখুস করে, নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে বলে ফেলল,

—“অজান্তা,পরশুদিন রাত বারোটায় আমার সিঙ্গাপুর ফ্লাইট।দুই সপ্তাহ ধরে তোমাকে বলার চেষ্টা করছি।কিন্তু পারছি না।প্রতিবার বলতে নিতে তোমার হাসিখুশি মুখ দেখে আর বলতে পারি না।এক বছর অনেক বেশি সময় অজান্তা?”

রোদ্দুরের চুলে বিলি কেটে দেয়া হাতটা থেমে গেছে অনেক আগেই।অহির হৃদয়ের পাড় ভেঙে যেন নতুন পাড় গড়ছে।একটা বছর?তিনশত পয়ষট্টি দিন!এত কষ্ট কেন হচ্ছে?কেন ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে?কিন্তু তাকে তো শক্ত হতে হবে।তা না হলে এই পাগলটাকে সামলাবে কে!সে ভেঙে পড়লে তো মানুষটা নিজেই উথাল পাথাল হয়ে যাবে।মিশনটা ক্যান্সেল করে দিবে।

দাঁতে দাঁত চেপে অশ্রুগ্রন্থি থেকে বের হওয়া পানিটুকু চোখ বেয়ে গালে গড়িয়ে পরতে দিল না অহি।রোদ্দুর ততক্ষণে তার কোল থেকে উঠে পড়েছে।তার গালে হাত রেখে অনবরত বলে যাচ্ছে,

—“অজান্তা,প্লিজ মন খারাপ করবে না।দেখো!আমার দিকে তাকাও।আমি প্রতিটা সেকেন্ড তোমার সাথে কথা বলবো।তোমার একদম একা লাগবে না।তোমার সব খোঁজ খবর রাখবো।ভিডিও কলে সবসময় কথা হবে,দুজন দুজনকে দেখতে পারবো অজান্তা।”

অহি কিছু বলল না।তার চোখের কিনারা বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে রোদ্দুরের হাত ভিজে গেল।রোদ্দুর তাকে একটানে বুকে চেপে বলল,

—“তুমি না চাইলে আমি কোথাও যাব না অজান্তা।প্লিজ কান্নাকাটি করবে না।খবরদার!চোখের পানি ফেলবে না।”

অহি রোদ্দুরকে দু হাতে আকড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ক্ষণে ক্ষণে তার শরীর কাঁপছে।রোদ্দুর আরো শক্ত করে অহিকে বুকের মাঝে আকড়ে ধরলো।

২৯.

অহি উদাস হয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।তার বিষণ্ণ দৃষ্টি দুটো সামনের অন্ধকার দেখতে ব্যস্ত।একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে।এখন চারিদিকে অন্ধকার তার আধিপত্য বিস্তার শুরু করে দিয়েছে।তার দৃষ্টি ছাপিয়ে একটা ছোট্ট পাখি নজরে এলো।

রাস্তার পাশের মাঝারি সাইজের নিম গাছটার ডালে নিঃসঙ্গ হয়ে বসে আছে পাখিটা।সেও কি পাখিটার মতো একা হতে চলেছে?নিজের অজান্তে তার গাল ভিজে উঠলো।

—“অজান্তা!”

পিছন থেকে রোদ্দুরের কন্ঠ কানে যেতে অহি সাবধানে চোখের জল মুছে ফেলল।তার চোখের জল দেখলে রোদ্দুর পাগল হয়ে যাবে।নিজের ভেতরকে লুকিয়ে অহি হাসিমুখে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুরের আজ রাত বারোটায় ফ্লাইট।বাইরে বিদ্যুৎ সহ সবাই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।লাগেজ উঠানো শেষ।এখন রোদ্দুর রওনা দিবে শাহজালাল বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।

রোদ্দুরের মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে।শুকনো মুখে জোরপূর্বক মলিন হাসি।রোদ্দুরের পরণে আকাশি রঙের শার্ট।গলায় কালো টাই।ইন করা শার্টের সাথে কালো স্যুট, কালো প্যান্ট, কালো জুতো।কি সুন্দর লাগছে মানুষটাকে।

অহি এগিয়ে গিয়ে রোদ্দুরের চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।স্যুট ঝেড়ে বলল,

—“আপনি এত বেশি সুন্দর কেন?আমার হিংসে হয় তো!”

অহিকে এতটা স্বাভাবিক দেখে রোদ্দুরের ভেতরে চিন্তার ঝড় বয়ে গেল।ভেতরে কোথাও কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে যেন।অহি নিজের অনুভূতি গুলো ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে না।ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরে।যেটা রোদ্দুরকে আরো চিন্তিত করে তুলছে।সে অহির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

—“আমি তো তুমিই অজান্তা!আমার এই আমিটা তো শুধু তোমার এবং তোমার।এই আমিটা তো তুমি নিজে।নিজেকে কি কেউ হিংসে করে বুঝি?”

অহি ম্লান হাসলো।কিছু বলল না।ড্রয়িং রুম থেকে রোদ্দুরকে ক্রমাগত ডাকছে।দেরি হয়ে যাচ্ছে।অহিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রোদ্দুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।অহির নিচু করে রাখা থুতনি ধরে উঁচু করে নিরবে বলল,

—“অজান্তা,আর কিছু বলবে না?”

অহি মাথা নেড়ে না জানাল।রোদ্দুরের দিকে তাকালো না।তার চোখে চোখ রাখার সাহস নেই।সে তার ছলছল দৃষ্টি রোদ্দুরকে দেখতে দিবে না।রোদ্দুর নিরবে অহির কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতে অহি চোখ বন্ধ করলো।রোদ্দুর রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

—“আমি আসছি অজান্তা।মাকে সামলে রেখো।”

এক ছুটে বেরিয়ে পড়তে নিতে অহি হাত টেনে ধরলো।রোদ্দুর ঘুরে দাঁড়াতে অহি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো।রোদ্দুর বেলকনির কাচে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অহিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।ব্যস্ত হয়ে বলল,

—“অজান্তা,তুমি কান্না করলে কিন্তু আমি সত্যি যাব না।কান্না থামাও!”

অহি আরো জোরে কান্না শুরু করলো।কয়েক মিনিট চেষ্টা করেও সে অহির কান্না থামাতে পারলো না।অহির প্রতি ফোঁটা চোখের জলে রোদ্দুরের ভেতর ভস্ম হয়ে যাচ্ছে।সে হঠাৎ একটানে গলার টাই খুলে দৃঢ় ভাবে বলল,

—“অজান্তা,আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।যাই হয়ে যাক না কেন,আমি সিঙ্গাপুর যাব না।”

রোদ্দুরের দৃঢ় কন্ঠে অহি নিজের মাঝে ফেরে যেন।রোদ্দুরের বুক থেকে মাথা তুলে ভেজা চোখে তার মুখপানে তাকায়।রোদ্দুরের চোখে মুখে স্পষ্ট দৃঢ়তা বোধ ফুটে উঠেছে।যেন সত্যি যাবে না।অহি চিন্তিত হয়ে চোখের জল মুছে ফেলল।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

—“যাবেন না মানে?”

—“যাব না মানে যাব না।আমি কোথাও যাব না।এই খানেই থাকবো।বাংলাদেশেই থাকবো।”

অহি এবার কাঠিন্য ঢেলে বলল,

—“একদম পাগলামি করবেন না এসআই।আপনি যাবেন।আমি অপেক্ষা করবো।দূরত্বে ভালোবাসা সুমিষ্ট হয়।প্রগাঢ়তা বাড়ে।গভীরতা বাড়ে।এটা হয়তো আমাদের ভালোবাসার পরীক্ষা।”

অহি টাইটা হাতে নিয়ে সুন্দর করে রোদ্দুরের কলার উঁচু করে বেঁধে দিল।রোদ্দুর অসহায় মুখে বলল,

—“অজান্তা,আমার গাঙচিল ভালো থাকবে তো?”

অহি রোদ্দুরের বুকে, সারা মুখে হাত বুলিয়ে বলল,

—“থাকবে।আর শুনুন।এই যে,এই মানুষটাকে আপনার কাছে আমানত রাখলাম।এক বছরের জন্য নিজেকে গচ্ছিত রাখলাম আপনার কাছে।খবরদার!অন্য কোনো মেয়ের ছিঁটেফোঁটা স্পর্শ যেন তার শরীরে না লাগে।আমি কিন্তু সব বুঝে যাব।সাবধান! ”

অহির কথায় রোদ্দুর ফিক করে হেসে ফেলল।বিদ্যুৎ তের গলা কানে আসছে।রোদ্দুর গম্ভীর হয়ে অহির মুখ পানে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।আচমকা অহির সারা মুখে ভেজা চুমুতে ভরিয়ে দিল।এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে দৌঁড়ে বের হয়ে গেল।

নিচ থেকে গাড়ি ছাড়ার শব্দ কানে আসতে অহির পা ভেঙে এলো।হাঁটু মুড়ে সে ফ্লোরে বসে চোখের জল বিসর্জন দিল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here