কোথাও_কেউ_নেই ১৩.
হুমায়ুন আহমেদ
শওকত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।
আমার নাম ফজলু। ফজলুর রহমান।
আমি আপনাদের পাশেই থাকি। ঐ যে লাল দালানটা। লোহার গেট। গেটের পেছনে কামিনি ফুলের গাছ আছে। আমি আগেও কয়েকবার এসেছি আপনার বাসায়।
শওকত সাহেব খুব লজ্জা পেলেন। একই পাড়ায় পাশাপাশি থেকে চিনতে না পারাটা লজ্জার ব্যাপার। এক সময় সবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এখন একেবারেই নেই। অফিসে যান। অফিস থেকে ফিরে এসে বারান্দায় বসে থাকেন। এ রকম হয়ে যাচ্ছেন্ন কেন?
আমার স্ত্রীর সঙ্গে বকুলের খুব ভাব। ওরা প্রায়ই গল্পগুজব করে। আমার স্ত্রীর নাম হচ্ছে টিনা।
ও আচ্ছা। বসুন্ন ভাই বসুন। বয়স হয়ে গেছে কিছু মনে থাকে না।
আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। বকুল আমার স্ত্রীকে টিনা ভাবী ডাকে। আমি বলতে গেলে আপনার ছেলের মত। বকুলের সঙ্গে আমার ভাই সম্পর্ক।
তাই নাকি?
জি। কাজেই আপনিও যদি ভাই ডাকেন তাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে। সম্পর্কটা ঠিক থাকা দরকার।
ফজলু উঁচু গলায় হাসতে লাগল। শওকত সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। কি কথাবার্তা চালাবেন? কথা বলতে ইচ্ছাও হচ্ছে না। ক্লান্তি লাগছে। শরীর ভাল না, শুয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। তার আবার মনে হল বয়স হয়ে গেছে। তিনি দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন।
আপনি বসুন আমি বকুলকে ডেকে দিচ্ছি।
ওকে ডাকার দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। দরকারে এসেছি।
একটা দরকারি কথা বলব।
বলুন।
তার আগে এক কাপ চা খাব। বাসা থেকে চা না খেয়ে বেরিয়েছি। টিনা বলল, তুমি চাচার সঙ্গে কথাটা সেরে এসেই চা খাও। আমি ভাবলাম মন্দ কি!
শওকত সাহেব চিন্তিত মুখে চায়ের কথা বলে এলেন। তার সাথে এমন কি কথা থাকতে পারে? পাড়ার কোনো ব্যাপার কি? হতে পারে। মাঝে মাঝে হঠাৎ দু’একজন মানুষ এসে পাড়া দরদী হয়ে যায়। ক্লাবট্রিাব করে। একবার কি একটা পরিচ্ছন্ন কমিটি হল। তিনি হলেন সেই কমিটির মেম্বার। সপ্তাহখানিক এর-ওর বাড়িতে চা খাওয়া ছাড়া সেই কমিটি কিছু করেনি। একদিনের জন্যে একজন মেথর ভাড়া করে এনেছিল সে ঘণ্টা তিনেক কোদাল দিয়ে নর্দমা নাড়াচাড়া করে কুড়ি টাকা নিয়ে ভোগে গেল। পরিচ্ছন্ন কমিটিরও সমাপ্তি।
আমি বকুলের বিয়ের একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
শওকত সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। ইতস্তত করে বললেন, বকুলের বিয়ে? আমি তো ঠিক…
আগে সবটা শুনে নিন। তারপর আপনার যা বলার বলবেন। আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জনই বকুলকে খুব পছন্দ করি। আমি ওকে দেখি নিজের বোনের মত। ওর যাতে ভাল হয় তাই আমরা দেখব–এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
ফজলু থামল। কারণ রকুল চা নিয়ে ঢুকেছে। অবাক হয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। বকুলের চোখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।
বকুল, কেমন আছ?
জি ভাল।
তোমার ভাবী জলপাইয়ের একটা আচার বানিয়েছে, একবার গিয়ে চোখে আসবে। নিজ দায়িত্বে রাখবে। হাহা হা।
বকুল হাসিতে যোগ দিল না। কাপ নামিয়ে চলে এল। তার বুক ঢ়িপঢ়িপ করছে। আজই কি সেই দিন? হয়ত বা। টিনা ভাবী বলেছিল। সে নিজেই আজকালের মধ্যে প্রস্তাব নিয়ে আসবে। তা না করে কী ফজলু ভাইকে পাঠিয়েছে? ফজলু ভাই কি গুছিয়ে কিছু বলতে পারবে? সে নিশ্চয়ই সব এলেবেলে করে দেবে। কি বলতে কী বলবে। তাছাড়া আগেই বাবার সঙ্গে কথা বলছে কেন? আগে মুনা আপার সঙ্গে কথা বলা দরকার–মুনা আপা যদি প্রথমেই বলে না। তাহলে তো এ নিয়ে আগানোই যাবে না। যদি কোন কারণে হ্যাঁ বলে ফেলে তবেই শুধু বাবার সঙ্গে কথা বলা উচিত। তার আগে নয়।
বকুল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কথাবার্তা তেমন কিছু শোনা যাচ্ছে না। ফজলু ভাইয়ের কথা দু’একটা শোনা গেলেও বাবার কথা কিছুই কানে যাচ্ছে না। বাবু তার ঘর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ছে। এমন চেঁচিয়ে পড়লে কিছু শোনা যায়? বকুলের ইচ্ছে করছে বাবুকে গিয়ে বলে–এত চেঁচিয়ে পড়ছিস কেন? মনে মনে পড়তে পাড়িস না। কিন্তু বাবুকে এসব কিছুই বলা যাবে না। সে একশটিা কথা বলবে, চেঁচিয়ে পড়লে কি হয়? তোমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। হয়ত একটা ঝগড়াই বাঁধিয়ে বসবে। বাবু এখন কথায় কথায় তার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাচ্ছে।
বকুল!
বকুল চমকে উঠল। মুনা আপা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী সর্বনাশ।
কি করছিস এখানে?
কিছু না আপা।
বকুল এগিয়ে এল ভয়ে ভয়ে। তার মুখ শুকিয়ে গেছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। মুনা। আপা নিৰ্যাৎ জেরা করতে শুরু করবে।
বসার ঘরে কে কথা বলছে?
ফজলু ভাই।
ফজলু ভাইটা কে?
টিনা ভাবীর হাসবেন্ড।
তুই কি আড়ি পেতে কথাবার্তা শুনবার চেষ্টা করছিলি?
না আপা।
না। আপা মানে? আমি তো বেশ খানিকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস। কি করছিলি?
চা দিতে গিয়েছিলাম আপা।
চোখ-মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? ব্যাপারটা কি?
কিছু না আপা।
তোর বিয়েটিয়ে নিয়ে কোনো কথা?
আমি জানি না।
বকুল এই শীতেও ঘামতে লাগল। বড় লজ্জার ব্যাপার হয়ে গেল। তার ইচ্ছে করছে মুনা আপার সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পা দু’টি হয়ে আছে পাথরের মত। বকুল খুব সহজ ভাবে হাসতে চেষ্টা করল পারল না। মুনা আপা এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার মুখ থমথম করছে। কেন যে দরজার পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিল।
ছেলে ডাক্তার। ছেলের বাবা নেত্রকোনা শহরের নামকরা উকিল ছিলেন–আবদুস সোবহান সাহেব। রাজাকাররা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মেরে ফেলেছে। নেত্রকোনা শহরে ওদের বিরাট বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে ছেলের মা এবং ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ থাকে না। ঢাকাতে মোহাম্মদপুরে ওদের একটা দোতলা বাড়ি আছে। তিন হাজার টাকা ভাড়া আসে বাড়ি থেকে।
ছেলে দেখতে কেমন?
আমার কাছে তো ভালই মনে হয়। আপনি নিজেও তো দেখেছেন। এই বাড়িতে তো সে আসে। মানে অসুখ-বিসুখ হলে তাকে আনা হয়। ডাক্তার জহির।
শওকত সাহেব অবাকই হলেন। ছেলেটিকে তার পছন্দ। ভদ্র ছেলে। বয়সও কমই মনে হয়। ফজলু হাসিমুখে বলল, ছেলে কেমন কি তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, আপনার মেয়ের ছেলেকে খুব পছন্দ।
কি বলছেন এসব?
ঠিকই বলছি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে বকুলের কথা হয়েছে। আপনি বকুলকে ডেকে জিজ্ঞেসও করতে পারেন।
আরে না। আমি এসব জিজ্ঞেস করব কেন?
জিজ্ঞেস করে নেয়াটা ভাল। তাছাড়া আজকালকার যুগে ছেলেমেয়ের নিজেদের পছন্দে বিয়ে হওয়াটাই ভাল। তাতে সমস্যা কমে যায়।
বকুল বাচ্চা মেয়ে সে আবার…।
বাচ্চা মেয়েদের তো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। পারে না?
শওকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আমি মুনার সঙ্গে আলাপ করে দেখি। মুনা রাজি হবে না।
দেখুন কথা বলে। আমার স্ত্রীও উনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমারও মনে হয় বিয়েটা বকুলের জন্য ভালই হবে। আমি উঠি এখন।
আরে না বসুন। আরেক কাপ চা খান। বকুল, বকুল।
ফজলু উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, এখন আর চা খাব না। বাসায় গিয়ে গোসল করব। আমি আবার অফিস থেকে ফিরেই গোসল করি। অনেক দিনের অভ্যাস।
দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফজলু আবার ফিরে এল।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ছেলের মা এখন ঢাকায় আছেন। কয়েক দিন ঢাকায় থাকবেন। সম্ভব হলে এর মধ্যে বকুলকে দেখিয়ে দিন।
শওকত সাহেব মুখ কালো করে বললেন, মুনা কিছুতেই রাজি হবে না। ওর ইচ্ছা বকুলের পড়াশোনা আগে শেষ হোক।
রাজি না হলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। দিনকাল খারাপ। মেয়ে বিয়ে দেয়া এখন মহাসমস্যা। ছেলে পাওয়া যায় না। বিয়ের যুগ্যি ছেলেদের কোন চাকরি-বাকরি নেই। বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তা ঠিক।
এই আমাকেই দেখুন না, সামান্য চাকরি তবু ডিসট্রিক্ট জজের মেয়ের প্রস্তাবও এসেছিল।
ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছেলেদের তো গায়েই হাত দেয়া যায় না। ঠিক বলছি না?
জি ঠিকই বলছেন।
মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিন।
দেখি মুনার সঙ্গে কথা বলে।
শওকত সাহেব রাত দশটার সময় মুনাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলতে লাগলেন। শীত খুব বেশি পড়েছে। তার অফিসের কে যেন বলছিল শ্ৰীমঙ্গলে বরফ পড়েছে। আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। এ রকম শীত কখনও পড়ত না। বুড়ো মরা শীত একেই বলে। ইত্যাদি।
মুনা বেশ খানিকক্ষণ মন দিয়ে মামার কথা শুনল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, এই ভদ্রলোক তোমাকে কি বললেন সেটা বল, শুনে চলে যাই। কেন শুধু শুধু দেরি করছ? শওকত সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।
উনি কি বকুলের বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন?
বুঝলি কি করে?
আন্দাজ করলাম। ডাক্তার ছেলে?
হুঁ।
তুমি কি বললে?
আমি না-ই করে দিয়েছি। বলেছি মেয়ের বয়স খুবই কম। পড়াশোনা করছে। এখন তুই ভেবে দেখ। তুই যা বলবি তাই। আসল গার্জেন হলি তুই।
মুনা হাই তুলে বলল, বিয়ে দিয়ে দাও।
শওকত সাহেব বুঝতে পারলেন না এটা কি সে ঠাট্টা করে বলছে না। সত্যি সত্যি বলছে। তিনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।
বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই ভাল।
কেন? ভাল কেন?
বকুল হচ্ছে বউ টাইপ মেয়ে। বিয়ের জন্যে মনে মনে সে তৈরি হয়েছে।
কি বলছিস তুই!
ঠিকই বলছি। ছেলেটাও ভাল। দেখি তো প্রায়ই।
তুই ভালমত চিন্তা করে তারপর বল। ফন্ট করে হ্যাঁ বলার দরকার কি? এমন কোন তাড়া তো নেই।
চিন্তা করেই বলছি। ওরা নিজেরা আগ্রহ করে আসছে সেটা দেখা দরকার। এ রকম আগ্রহ নিয়ে বকুলের জন্যে খুব বেশি ছেলে আসবে না।
আসবে না বেন? বকুল কী দেখতে খারাপ?
খারাপ হবে কেন? বকুলের মতো রূপসী মেয়ে কমই আছে। কিন্তু বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার শুধু মেয়েটাকে কেউ দেখে না। সব কিছু মিলিয়ে দেখে। বিয়ে কোন আলাপ হলেই সবাই জানাবে তুমি চুরির দায়ে এক সময় জেলে গিয়েছিলে। চোরের মেয়েদের ভাল বিয়ে হয় না।
শওকত সাহেব মুখ কালো করে ফেললেন। এ রকম কঠিন একটা কথা মুনা এমন স্বাভাবিক ভাবে বলল? মুখে এতটুকু আটকাল না।
বিয়ে দিয়ে দাও মামা; বকুলের ঐ ছেলেকে খুবই পছন্দ।
ওর পছন্দের কথাটা আসছে কেন?
আসবে না কেন? নিশ্চয়ই আসবে। বিয়েটা তো সেই করছে।
পছন্দ করবার জন্যে ছেলেকে সে পেল কোথায়?
পেয়েছে যে ভাবেই হোক। সেটা আমাদের দেখার ব্যাপার না। মামা, আমি উঠলাম।
বোস, আরেকটু বোস।
না মামা, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
বকুল আড়চোখে মুনার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন পৃথিবীর কোনো দিকে তার দৃষ্টি নেই। বাবু বসেছে তার উল্টো দিকে। সে পড়ছে চেঁচিয়ে। মুনা শুয়ে পড়ল। বাবু বলল, আপা আমরা বসার ঘরে গিয়ে পড়ব? বাতি নিভিয়ে দেব এ ঘরের?
এত সকাল সকাল শুয়ে পড়লে যে আপা?
এমনি, ভাল লাগছে না।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?
না লাগবে না।
বকুল এবং বাবু বাতি নিভিয়ে বসার ঘরে চলে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার এ ঘরে চলে এল। ঘর অন্ধকার। বারান্দা থেকে আলো এসে তেরছা ভাবে মুনার গায়ে পড়েছে। সেই আলোর জন্যেই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক মুনাকে খুব অসহায় লাগছে। বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, আপা ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
বসি একটু তোমার পাশে?
বোস।
বকুল মাথার কাছে বসল। বেশ কিছু সময় দুজনের কেউ কোনো সাড়াশব্দ করল না। এক সময় বাবু এসে উঁকি দিল।
আপা তোমরা এমন চুপচাপ বসে আছ কেন?
মুনা হালকা গলায় বলল, ইচ্ছে করলে তুইও এসে বোস। বাবু এল না। চলে গেল এবং আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান পড়তে লাগল। মুনা বলল–হঠাৎ এমন চেঁচিয়ে পড়া ধরেছে কেন বল তো? এ রকম মাইক লাগিয়ে কেউ পড়ে? বুকল হেসে ফেলল। মুনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ওদের কোন স্যার নাকি চেঁচিয়ে পড়তে বলেছেন। এতে নাকি পড়া তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়।
তোর পড়া কেমন হচ্ছে রে বকুল?
হচ্ছে।
ভালমত পড়। বিয়ে যদি হয় তারপরও পড়াশোনা চালিয়ে যাবি।
বিয়ের কথা উঠল। কেন?
ভাল করেই জানিস কেন উঠল। তুই তো আড়ি পেতে শুনছিলি।
বকুল চুপ করে গেল। মুনা হালকা গলায় বলল, অল্প বয়সে বিয়েটা খারাপ না। মন কোমল থাকে। সংসারের খারাপ দিকগুলি চোখে পড়ে না।
তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছ কেন আপা? আগে তো এ রকম বলতে না।
মানুষ তো সব সময় এক রকম থাকে না।
তুমি বদলে যাচ্ছ আপা।
হ্যাঁ বদলে যাচ্ছি। বয়স হচ্ছে। খুঁজে দেখলে দু’একটা পাকা চুলও বোধ হয় পাবি।
বকুল নিচু গলায় বলল, আপা তুমি কাঁদছ?
কি বলছিস পাগলের মত? কাঁদব কেন শুধু শুধু?
তোমার গলাটা অন্য রকম শুনাল।
অন্য রকম মানে?
কেমন যেন ভারী ভারী। কান্না চেপে রাখলে যেমন লাগে।
মনে হচ্ছে খুব কান্না বিশারদ হয়ে গেছিস।
মুনা নিচু গলায় হাসল। বকুলও হেসে ফেলল।
বকুল এক কাপ চা বানিয়ে আন তো। মাথা ধরেছে। আদা থাকলে আদা দিস। না থাকলে লিকার চা। আর দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যা। আলো চোখে লাগছে।
বকুল চা বানিয়ে ফিরে এসে, একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মুনা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কান্নার দমকে সে বারবার কেঁপে উঠছে। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে সে কান্না চেপে রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। বকুল হতভম্ব হয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়েই রইল। একবার শুধু বলল, চা এনেছি আপা। মুনা কিছুই বলল না। বকুল নিজেও তার চোখ মুছতে লাগল। কাউকে কাঁদতে দেখলেই তার কান্না পায়। সে ভাঙা গলায় ডাকল, আপা।
কি?
তোমার কি হয়েছে আমাকে বলবে? কিছুই হয়নি। তুই এ ঘর থেকে যা। চায়ের কাপ টেবিলের উপরে রেখে চলে যা।
বাকের একটা মোটর সাইকেল জোগাড় করেছে।
মটর সাইকেলটা মজিদের। তাকে বলেছে–দশ মিনিটের জন্যে দে তো গুলিস্তান যাব। আর আসব। মজিদ কিছুক্ষণ গাইগুই করলেও শেষটায় বিরসমুখে চাবি দিয়েছে। সেটা মঙ্গলবারের কথা। আজ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে মজিদ। দশবারের মত বাকেরের বাসায় এসেছে। নোট লিখে গেছে। জলিলের চায়ের দোকানে খবর দিয়েছে কোন লাভ হয়নি। বাকেরের কোন হদিস নেই।
মোটর সাইকেল জিনিসটা বাকেরের বেশ পছন্দ। কেনা সম্ভব নয়। এক সঙ্গে এতটা টাকা তার হাতে আসে না। ভাগ্যক্রমে মজিদেয় জিনিসটা যখন সঙ্গে আছে যত দূর সম্ভব ব্যবহার করা যাক। এর মধ্যে পেছনের একটা ল্যাম্প ভেঙে চুরমার। এটা ঠিক না করে মজিদের জিনিস তার কাছে ফেরত দেয়াও এক ঝামেলা। সে ল্যাম্প সারাতে দুশ টাকার মত লাগে। এও আরেক যন্ত্রণা। দুশ টাকা তার সাথে নেই। ইয়াদের কাছে চাওয়া যায়। কিন্তু ঐ শালা খচ্চরের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।
বাকের অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক করল। ইয়াদকে ধরতে হবে তার অফিসে। মিতিঝিল পাড়ায় অফিস। একবার এসেছিল, এখন কী খুঁজে বের করতে পারবে? জায়গা-টায়গা তার মনে থাকে না। দৈনিক বাংলার মোড়ে এসে সে একটা মজার দৃশ্য দেখল। হকার স্ট্যান্ডের সামনে মুনা দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে ম্যাগাজিন দেখছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টায় পুরুষেরা। একজন মেয়েও যেন এ রকম করতে পারে তা সে ভাবেনি। বাকের তার মািটর সাইকল রেখে এগিয়ে এল।
মুনা, কি করছ?
দেখতেই পারছেন কি করছি। পত্রিকা পড়ছি।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছি মানে?
বসে বসে পড়ার কোন উপায় নেই। চেয়ার-টেবিল দেয়নি দেখছেন না।
মুনার এই জিনিসটা বাকেরের ভাল লাগে। চটাচিটা জবাব দিবে। এক সেকেন্ডও ভাববে না। যেন জবাবটা তৈরিই ছিল! বাকের এ রকম গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না;
মুনা, একটু এদিকে আসি তো জরুরি কথা আছে।
মুনা এগিয়ে এল।
বলুন কি ব্যাপার?
আইসক্রিম খাবে?
আইসক্রিম খাব কেন শুধু শুধু।
না মানে কড়া রোদ তো।
কড়া রোদ উঠলেই লোকজন আইসক্রিম খায়?
বাকের কি বলবে ভেবে পেল না। মুনা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এটা কি আপনার জরুরি কথা?
না। ইয়ে শুনলাম। বকুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে — সত্যি নাকি?
হুঁ।
ডাক্তারের সাথে?
হ্যাঁ, ডাক্তারের সাথে। জহির উদ্দিন।
ভেরি গুড। ছোকরা খারাপ না ভালই। কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া নিয়েছ? না নিয়ে থাকলে নিও না। হাফ খরচে বাড়ির সামনে প্যান্ডেল খাটিয়ে ব্যবস্থা করে দেব। নো প্রবলেম।
মুনা হেসে ফেলল। বাকের অবাক হয়ে বলল, হাসছ কেন?
বেকার যুবকরা সামান্য একটা কাজ পেলে কেমন লাফিয়ে ওঠে তাই দেখে হাসছি।
বাকের মিইয়ে গেল। মুনা বলল, আইসক্রিম খাব না। তবে চা খেতে পারি। আশপাশে ভাল চায়ের দোকান আছে?
আশপাশে না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে মোটর সাইকেল আছে।
কি আছে?
মোটর সাইকেল। ভটভটি।
মোটর সাইকেলে আপনার পিছনে বসে চা খেতে যাব? পাগল হয়েছেন নাকি? আশপাশে কোথাও চায়ের স্টল থাকলে চলুন যাই।
তোমার অফিস নেই?
না ছুটি নিয়েছি।
কি জন্যে?
ঘুরে বেড়াবার জন্যে।
বাকের কিছুই বুঝতে পারল না। খুঁজে পেতে চায়ের স্টল একটা বের করল। মেয়েদের জেনা কেবিন আছে। মুনা ঠোট উল্টিয়ে বলল, কোন নরকে নিয়ে এসেছেন। আপনি?
কি করব, ভাল কিছু নেই এদিকে। উঠে পড়বে?
এসেছি। যখন চা খেয়েই যাই।
আমি একটা সিগারেট ধরালে তোমার অসুবিধা হবে মুনা?
না অসুবিধা হবে না।
বাকের খুব কায়দা করে সিগারেট ধরাল এবং এই সঙ্গে খুব সাবধানে মানিব্যাগটা ঠিক আছে কিনা দেখল। চা খাবার পর যদি দেখা যায় মানিব্যাগ আনা হয়নি। কিংবা পকেট মারা গেছে তাহলে সর্বনাশ। মেয়েমানুষের কাছে হাত পাততে হবে। বেইজ্জাতি ব্যাপার হবে।
চাটা ভালই বানিয়েছে কি বল মুনা?
ভাল কি দেখলেন এর মধ্যে আপনি? বমি আসছে।
কফি খাবে? কফি পাওয়া যায়। এক্সপ্রেসো কফি।
না। যথেষ্ট হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি শেষ করুন।
বাকের কোনো রকম তাড়া দেখাল না। তার ইচ্ছা করছে অনন্তকাল এই ঘুপসি ঘরটাতে বসে থাকতে।
মুনা।
বলুন।
মামুন সাহেবের সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে নাকি?
ঝগড়া হবে কেন?
এমনি জিজ্ঞেস করছি। আগে তো প্রায়ই আসতেন তোমাদের বাসায় এখন আসতে দেখি না।
আপনি কী দিনরাত মানুষের বাসার দিকেই তাকিয়ে থাকেন? কে আসছে কে যাচ্ছে তাই দেখেন?
না তা না। তোমাদের বিয়ে কবে?
হবে শিগগিরই। হলে খবর পাবেন। সস্তায় কোথায় ডেকোরেটর পাওয়া যায়। এইসব খোঁজ তো আপনাকেই করতে হবে।
মুনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বাকের বলল, এখন কি বাসায় যাবে?
হুঁ।
চল একটা রিকশা করে দি।
রিকশা আমি নিজে নিয়ে নেব। আপনার যেখানে যাবার যান;
আমার তেমন কোন কাজ নেই। একটা অবশ্যি আছে সেখানে পরে গেলেও কোন ক্ষতি হ না। বকুলের বিয়ের তারিখ হয়েছে নাকি?
মোটামুটি ভাবে হয়েছে, তেসরা জ্বিলকদ।
জিলকদটা আবার কি?
আরবি মাসের নাম। মোহররমের আগের মাস হচ্ছে জিলকদ। বিয়েশাদিতে আরবি মাস ব্যবহার করা হয় জানেন না?
না জানি না তো।
রিকশায় উঠে মুনার বিরক্তির সীমা রইল না। বাকের মোটর সাইকেলে করে তার পেছনে আছে। ভাবটা এর রকম যেন পাহারা দিতে দিতে যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা হল কড়া করে ধমক দেয়। কিন্তু ধমক দিতে মায়া লাগছে। চোখে চশমা পরে কেমন মহাকাপ্তান ভঙ্গি নিয়ে এসেছে চেহারায়। ঠোঁটে আবাবু একটা সিগারেট কামড়ে ধরা আছে। রিকশাওয়ালা একবার একটু বেশি স্পিড দিয়ে ফেলায় সে বাঘের মতো গর্জন করে উঠেছে–থাবরা দিয়ে মুখ ভোতা করে দেব। একসিডেন্ট করে প্যাসেনজার মারতে চাস নাকি? অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থা। মাঝে মাঝে আবার দু’হাত ছেড়ে মোটর সাইকেল চালাবার চেষ্টা করছে। এটা বোধ হয় নতুন কোন কায়দা। মুনা ভেবে পেল না। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কী করে মাঝে মাঝে এমন বির্বোধের মতো আচরণ করে? নাকি সে ঠিক বুদ্ধিমান নয়? বুদ্ধিমান মানুষ স্বার্থপর হয়। এটাই নিয়ম। টিকে থাকবার জন্যেই তাকে স্বার্থপর হতে হয়। বাকেরকে কী স্বার্থপর বলা যাবে? না বোধ হয়।
বকুলকে আজ তার শাশুড়ি দেখতে আসবেন।
এর মানে কি বোঝা যাচ্ছে না। জহিরের আত্মীয়-স্বজন এর আগে কয়েক দফায় তাকে দেখে গেছে। আংটি পরিয়ে দিয়েছে। বিয়ের তারিখ ঠিক করেছে। এরপর আবার মা আসছেন কেন? টিনা এসে বকুলকে খানিকটা ভয়ও পাইয়ে দিয়েছে। গম্ভীর হয়ে বলেছে, খুব ক্যাটক্যাটে মহিলা। স্কুল মাস্টারি করেছে। কিছুদিন তাই মেজাজ। এ রকম হয়েছে। কথাবার্তা সাবধানে বলবি। বেশি। কথা বলার দরকার নেই।
বকুল বলল, উনি কী বিয়েটা পছন্দ করছেন না?
না।
বুঝলে কি করে, তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে?
না, জহির আমাকে কথায় কথায় বলল; তোর একটা ছবি দিয়েছিল। ভদ্রমহিলা ছবির দিকে না তাকিয়েই বললেন, মেয়ের নাক মোটা।
আমার নাক কি মোটা?
নাক ঠিকই আছে। বুদ্ধি মোটা।
বকুলের মন খারাপ হয়ে গেল। তার বুদ্ধি কম এটা সে নিজেও জানে। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা পাটিগণিত ভাল জানে। সে একেবারেই জানে না। মেট্রিকে সে যদি ফেল করে পাটিগণিতের জন্যেই করবে।
ভদ্রমহিলার সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। তিনি বিকেলে একা একা চলে এলেন। চল্লিশ-পয়তাল্লিাশ বছর বয়সী একজন মহিলা। লম্বা, ফর্সা, রোগা মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল। পান খাবাব। কারণে ঠোট টকটকে লাল। সাদা সিন্ধের শাড়ি পরেছেন। শাড়ির ওপর নীলের ওপর সাদা কাজ করা একটা চাদর। তাকে দেখে মনেই হয় না তার এত বড় একটা ছেলে আছে। তিনি রিকশা থেকে নেমেই বললেন, খুব ফার্স ফর্সা শুনেছি, তুমি কিন্তু মা একটু কালো।
মুনা হেসে ফেলল।
আপনি ভুল মেয়েকে দেখেছেন। ফার্স মেয়ে ঘরে আছে। আমার নাম মুনা। আমি বকুলের মামাতো বোন।
ভদ্রমহিলা মোটেই অপ্রস্তুত হলেন না। আরো শক্ত করে মুনার হাত চেপে ধরলেন। মুনার মনে হল ইনি ইচ্ছে করেই ভুলটা করছেন। তিনি ভালই জানেন এই মেয়ে তার ছেলের পছন্দের মেয়ে নয়। ছবি দেখেছেন অন্যদের কাছে শুনেছেন।
মুন্না, তোমার নাম?
জি।
তোমার কথা আমি জহিরের কাছে শুনেছি।
কি শুনেছেন?
তুমি নাকি খুব শক্ত মেয়ে।
আপনার কাছে কি সে রকম মনে হচ্ছে? я
হ্যাঁ হচ্ছে। আমি নিজেও বেশ শক্ত মেয়ে। জহিরের চার বছর বয়সে তার বাবা মারা গেলেন। তারপর আমিই এদের এত দূর টেনে তুললাম। শক্ত মেয়ে না হলে কি এটা সম্ভব তুমিই বল।
বকুলকে দেখে তিনি তেমন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। গল্প করতে লাগলেন শওকত সাহেবের সঙ্গে। ঘর-বাড়ির গল্প, জমিজমার গল্প। পঞ্চাশ বিঘা জমি আছে তার। জমির বিলিব্যবস্থা নিয়ে যে সব সমস্যা হচ্ছে তার গল্প। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি ঘর দেখলেন।
কে কোথায় ঘুমায় আগ্রহ করে জানতে চাইলেন। শওকত সাহেবের স্ত্রীর বাধানো ছবি দেখে বললেন, বেয়ান সাহেব তো খুব সুন্দর ছিলেন। ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর মতো হয়নি।
মুনা এক ফাঁকে বলল, বকুলকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
তিনি শীতল গলায় বললেন, আমার পছন্দ-অপছন্দের তো কোনো ব্যাপার না। জহির পছন্দ করেছে, বিয়ে হচ্ছে ওর পছন্দে।
তার মানে আপনার পছন্দ হয়নি?
না মা হয়নি। আমার দরকার ছিল তোমার মত একটা মেয়ে। শক্ত, তেজী। বকুল সে রকম না। কোনো একটা ঝামেলা হলেই এ মেয়ে ভেঙে পড়বে। আমার সংসার হচ্ছে মা ঝামেলার সংসার।
কিসের এত ঝামেলা আপনার?
আছে অনেক। বলব সবই।
বকুলের ভদ্রমহিলাকে ভাল লাগছে না। ইনি এত কথা বলছেন কেন? একজন বয়স্ক মানুষ বয়স্ক মানুষের মত থাকবেন। হড়বড় করে এত কথা বলবেন কেন? তাছাড়া উনার জমিজমার সমস্যা। সে সব পৃথিবী সুদ্ধ মানুষকে জানানোর দরকার কী? বকুল রান্নাঘরে চলে এল। মুনা খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছে। সবই বাইরের খাবার। ঘরের বলতে পায়েস। সেটা এত মিষ্টি হয়েছে যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না।
আপা!
বল।
ভদ্রমহিলাকে তোমার কেমন লাগছে?
ভালই।
এত সাজগোজ করেছেন কেন বল তো?
সাজগোজ কোথায় দেখলি?
আমার ভাল লাগছে না আপা। তার এই সমস্যা সেই সমস্যা। এ সব শুনতে কি কারো ভাল লাগে।
যা চা দিয়ে আয়।
আমি পারব না।
বাজে কথা বলবি না। নে ট্ৰে’টা ধর।
বকুল ট্রে নিয়ে মুখ কালো করে বের হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবু এসে বলল, আপা, মামুন ভাই এসেছে। বসার ঘরে বসেছে। মুনা সহজ স্বরে বলল, গিয়ে বল ঘরে অনেক মেহমান অন্যদিন যেন আসে।
বাবু নিচু স্বরে বলল, এটা আমি বলতে পারব না আপা। বলতে হলে তুমি বলবে।
মামুন জড়সড় হয়ে বসে ছিল। তার হাতে এক হাঁড়ি দৈ। আসার পথে কি মনে করে সে এক হাঁড়ি দৈ কিনে ফেলেছে। এর জন্যে নিজেই সে খানিকটা বিব্রত বোধ করছে। মিষ্টি, দৈ এসব কিনে কারো বাড়ি যাওয়াটাই অস্বস্তিকর। নিজেকে কেমন জামাই জামাই মনে হয়। মুনা এসে ঢুকল। মামুন হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা ঠিক ফুটিল না। কোথায় যেন আটকে গেল।
তোমাদের বাড়িতে কি হচ্ছে? কেউ এসেছে নাকি?
ই। বকুলের বিয়ে হচ্ছে। ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে।
বকুলের বিয়ে হচ্ছে নাকি?
হুঁ।
এত তাড়াতাড়ি যে?
ডাল ছেলে পাওয়া গেছে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এটা খারাপ না। একদিক দিয়ে ভালোই। আমি তাহলে বরং অন্যদিন আসি। কথা ছিল তোমার সঙ্গে।
কথা থাকলে এখনি বল। আবার আসার দরকার কি?
আর আসার দরকার নেই, কি বল তুমি?
একবার তো বলেছি তোমাকে।
শোন মুনা, ঠাণ্ডা মাথায় একটা কথা শোন। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বল।
আমি যা বলছি ঠাণ্ডা মাথায় বলছি।
আচ্ছা ঠিক আছে, একটা কথা রাখ, তুমি বরং আরো মাসখানেক নিজের মতো থাক। মাসখানেক আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।
ভাল।
গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। মাসখানেক ওখানে থাকব। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
মুনা চুপ করে রইল। মামুন সিগারেট ধরাল একটা। নিচু গলায় বলল, বাসা যেটা নিয়েছিলাম সেটা থাকবে। ভাড়া দিয়ে যাব। তোমার রাগ ভাঙলে বিয়ে করে ঐ বাড়িতে গিয়ে উঠব। উঠি এখন?
এসেছ। যখন বসি। চা খেয়ে যাও।
আচ্ছা খেয়েই যাই। তোমাদের জন্যে দৈ এনেছিলাম। দৈটা নাও।
মুনা দৈ হাতে রান্নাঘরে চলে গেল। বাবুকে দিয়ে চা এবং পায়েস পাঠিয়ে দিল। মামুন চা খেয়ে বেশ খানেক সময় একা একা বসে রইল। একসময় বাবু ঢুকল। মামুন নড়েচড়ে বসল।
বাবু কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমার যে মাথাব্যথা হত। সেটা সেরে গেছে, না এখনো মাঝে মাঝে হয়?
হয় মাঝে মাঝে।
তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস সেভেন।
বাহ ভাল তো। সাঁতার জানো তুমি?
না।
আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিরাট পুকুর আছে। নিয়ে যাব তোমাকে। সাঁতার শিখিয়ে দেব, দুদিনে শিখিয়ে দেব।
বাবু কিছু বলল না। বকুলের শ্বশুর বাড়ির আরো কিছু লোকজন এল এ সময়। সবই মেয়ে মানুষ। এরা সরাসরি ভেতরে চলে গেলেন। বাবুও উঠে ভেতরে চলে গেল। মামুন থাকল। আরো খানিকক্ষণ। একটা টিকটিকি উঁকি দিচ্ছে।-কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখছে। বিশাল তার সাইজ। সম্ভবত এটা তক্ষক।
বিদেয় নেবার আগে মুনাকে বলে যাওয়া দরকার কিন্তু মুনা আসছে না। হয়ত আর আসবে না। মেহমানদের নিয়ে ব্যস্ত। মামুনের মনে হল মুনার রাগ কিছুটা কমেছে। আজকের ব্যবহার তো খুব সহজ ও স্বাভাবিক। নিজ থেকেই চা খেয়ে যেতে বলল। রাগ কমে যাবে। নিশ্চয়ই কমবে। এক মাস দীর্ঘ সময়। আদর্শন কোন না কোন ভাবে মন দ্রবীভূত করায় একটা ভূমিকা নেবে।
মামুন বসেই রইল। কাউকে না বলে চলে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। টিকটিকিটা এখনো তাকে দেখছে।
চলবে..