কাগজের তুমি আমি দ্বিতীয় অধ্যায়,৩য়_পর্ব,৪র্থ_পর্ব

কাগজের তুমি আমি দ্বিতীয় অধ্যায়,৩য়_পর্ব,৪র্থ_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩য়_পর্ব

সুভাসিনী বেগম এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। ধারার এমন আকুতি দেখে মনে মনে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন,
– সেলিম, ধারার বাচ্চাকে মেরে ফেলাটা কখনোই কোনো সমাধান নয়। এর চেয়ে বরং ধারার বিয়ের ব্যবস্থা করো। এই সপ্তাহে ধারার বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।

সুভাসিনী বেগমের এমন কথায় সেলিম সাহেব যেনো অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যান। তার বড় বোন হুট করেই একটা কথা বলে ফেললেন যা তার বুঝার বেশ বাহিরে। অবাক হয়ে সেলিম সাহেব বলেন,
– আপা, মাথা কি গেছে তোমার? কি বলতেছো? ধারার বিয়ের ব্যবস্থা মানে? এই অবস্থায় কে করবে ওকে বিয়ে? যে জানবে সেই তো কু কথা বলে মুখে থুথু ছিটিয়ে চলে যাবে। আর এমন ছেলে পাবো কই যে সব জেনেও ধারাকে আপন করে নিবে!
– এমন ছেলের সাথেই বিয়ে হবে যে সব কিছু জানবে। দেখো এখন একটা ভুল শুধরাতে যেয়ে আমরা তো নতুন করে ভুল করতে পারি না। আর বাচ্চাটাকে মারার আমরা কে?

সুভাসিনী বেগমের ঘোলাতে কথা সেলিম সাহেব সহ কারোর ই মাথায় ঢুকছে না। অনল তো অবাক নয়নে শুধু তার মাকে দেখে যাচ্ছে। ধারার প্রতি তার মায়ের একটু বেশি টান আছে তা অনলের বেশ ভালোকরেই জানা আছে। কিন্তু টানের কারণে যে পাগলের প্রলাপ দিবে এটা যেনো হজম হচ্ছে না। গলা খাকারি দিয়ে অনল বললো,
– মা, একটু খলসা করে বলবে কি বলতে চাও?

সুভাসিনী বেগম এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠান্ডা গলায় বললেন,
– আমি ধারা মায়ের বিয়ে আমার অনলের সাথে দিতে চাই। তাতে যদি তোমাদের কোনো আপত্তি থাকে তবে বলো?

সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার বক্তব্য সবার ঘাম ধরাতে যথেষ্ট। উনি যতটা স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে কথাটা বললেন, ততটাই তীব্রগতিতে ধারা এবং অনলের মাথায় বজ্রপাত ঘটলো। অনল এবার যেনো নিশ্চিত হয়ে গেলো তার মা ভাতিজীর শোকে পাগল হয়ে গেছে। নয়তো সব জানা সত্ত্বেও এতো বড় একটা কথা পারতে পারতো না। সেলিম সাহেব পুনরায় অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– আপা, তুমি ভেবে বলতেছো তো? অনলের সাথে বিয়ে এটা কিভাবে সম্ভব?
– আমি সব ভেবেই বলছি। আমি এবং অনল এই বাচ্চার ব্যাপারে সব জানি। আর আমার ছেলে, পাত্র হিসেবে তো খারাপ নয়। এখন তোমাদের আপত্তি থাকলে বলতে পারো
– কিন্তু আপা তুমি অনলের কথাটা একটু ভেবে দেখো। আমার মেয়ের জন্য সে তার জীবনটা কেনো নষ্ট করবে?
– সেটা আমি বুঝে নিবো, তোমরা বিয়ের ব্যাবস্থা করো।

সুভাসিনী বেগমের কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলো অনল। তার মার উপরে কখনোই কোনো কথা বলতে পারে নি সে। কিন্তু মার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা যে সুভাসিনী বেগম জানেন না তাও নয় তবুও, তবুও জিদে বসে আছেন। অনল কোনো কথা না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। ওখানে থেকে তার মাকে বুঝানো সম্ভব নয়। সেলিম সাহেবের কি এখন খুশি হওয়া উচিত নাকি চিন্তা করা উচিত বুঝে উঠতে পারছেন না। নিজের বোনের বাড়িতে মেয়েটা বউ হয়ে যাবে এটাতো বেশ আনন্দের সংবাদ। নিজের বোন সব জেনেও তার ছেলের বউ বানাচ্ছে ধারাকে এটা ভেবেই মনে একটা স্বস্তি আভাস হচ্ছে তার কিন্তু অনল সব কিছু জানার পর ও কি ধারাকে মেনে নিবে! সেলিম সাহেব বেশ ভালো করেই জানেন তার বোন একবার বলে ফেলেছেন যখন তখন এই বিয়ে হবেই তবুও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ধারা চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না, আজ যদি দিগন্ত তাকে সাপোর্ট করতো তাহলে হয়তো এই দিনটাই দেখতে হতো না। বারবার নিজের মনে একটা চিন্তাই ঘুরছে তার এবং তার বাচ্চার পরিণতিটা কি হবে_____

রাত ১১টা,
নিজের রুমের সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে অনলের। সব ভেঙ্গে ফেললে হয়তো শান্তি হতো তার। মায়ের উপর মারাত্নক রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। অনলের বাবা রাজ্জাক সাহেবের সাথে সুভাসিনী বেগমের ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকে অনলের সব কিছুই তার মা ছিলো। তার কাছে মা সবচেয়ে উপরে। আজ পর্যন্ত মা যা বলে এসেছে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে। কিন্তু ধারাকে বিয়ে করার কথাটা যেনো মানতেই পারছে না। তার অগোছালো জীবনে কাউকে আনার কথা ভাবতেই পারে না অনল। রাগের বশে ধাপ করে টেবিলের উপর একটা কিল দিয়ে বসলো সে।
– আমার রাগ নির্জীবের উপর ঝেড়ে কি আদৌ শান্তি পাবে?

সুভাসিনী বেগমের ঠান্ডা গলার কথাটা শুনে চমকে উঠে অনল। পেছনে ফিরে দেখে সুভাসিনী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে মাত্রাতিরিক্ত স্বাভাবিক লাগছে। নিজেকে শান্ত করে অনল জিজ্ঞেস করে,
– তুমি ঘুমাও নি?
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো
– আমি বিয়ে করতে পারবো না মা
– কেনো?
সুভাসিনী বেগমের নির্বিকার ভঙ্গিমাতে প্রশ্ন করা দেখে অনল আরো অবাক হয়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করে বলে,
– তোমার তো অজানা নয় মা, তুমি ধারার জীবন সাজানোর নামে আরো এলোমেলো করে দিচ্ছো। আমি অকে কেনো কাউকেই নিজের জীবনে আসার অনুমতি দিবো না। একজন মৃত মানুষ কখনোই কারোর নবজীবনদাতা হতে পারে না মা। তোমার তো অজানা নয় একথা। আমি তো অনেক আগেই মরে গেছি। এখন আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়
– নবজীবন নাই দিতে পারলো কিন্তু খড়কুটোর মতো বাঁচাতে তো সাহায্য করতে পারে।

অনল অবাক চোখে তাকাতেই তিনি আবার বলেন,
– ধারার এখন অবস্থাটা তোমার অজানা নয়। সে যাকে বিশ্বাস করেছে সে তাকে ঠকিয়েছে। ওই ছেলেটা হয়তো এই বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। নয়তো ধারা একবার হলেও জোর গলায় বলতো আমার বাচ্চার বাবা বেঁচে আছে, তোমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছো কেনো? আমি ধারাকে তোমার সাথে বিয়ে দিচ্ছে একটা কারণে যাতে মেয়েটা সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে। তুমি তাকে ভালোবাসবে না, স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না কিন্তু একটা পরিচয় তো দিতেই পারো। তার বাচ্চাটাকে নিজের নাম তো দিতেই পারো। সেটাতেও কি বাঁধা আছে?
– কিন্তু মা?
– এমন ও তো হতে পারে, যে আসছে সে তোমাকে বাঁচতে শিখাবে। নতুন করে উজ্জীবিত হতে উদ্দীপ্ত করবে। হতে পারে না? তোমার আত্নাটা মরে গেছে অনল। কিন্তু সেটা বাঁচবে না এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। একটা মানুষ কিন্তু আবার প্রেমে পড়তে পারে, ভালোবাসতে পারে, বাঁচতে পারে। আর এটা আমার শেষ ইচ্ছে বলেও মেনে নিতে পারো। বয়স তো কম হলো না, একটা পুত্রবধু, নাতী পেলে কি খুব খারাপ হবে? আমি জানি, আমাকে তোমার খুব স্বার্থপর মনে হতে পারে। আমি সত্যি ই স্বার্থপর, এক ঢিলে তিন পাখি মারার চেষ্টায় আছি। কি করবো বলো, আমি ও তো মা। ধারার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পেয়েছিলাম। মেয়েটা তার বাচ্চাকে বাঁচাতে চায়। তার জন্য লড়াই করতে চায়। এটা কি খুব অন্যায় দাবি? হ্যা সে ভুল করেছে। হয়তো তার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই ভুলটা করতো না কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করাটা হয়তো এতো বড় ভুল ও নয়। সেই মানুষটা তার হাত ছেড়ে দিয়েছে। এটার শাস্তি এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে না নিশ্চয়ই। তাই না? তুমি ভেবে দেখো এক সপ্তাহ তো আছে। তোমার আপত্তি থাকলে আমি অন্য ব্যাবস্থা নিবো।

বলেই সুভাসিনী বেগম নিজের রুমে জন্য পা বাড়ালেন। তার প্রতিটি কথা অনলের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আসলেই কি আবার বাঁচাটা সম্ভব? আবার ভালোবাসাটা সম্ভব?

সকাল ৯টা,
সারারাত নির্ঘুম কেটেছে ধারার। চোখ মুখ ফুলে আছে। চোখগুলো অবিরাম ধারা বর্ষনে ক্লান্ত। শরীরটাও ভালো নেই। এতো চাপ এই সময়ে নেওয়াটা বাচ্চার জন্য ভালো নয়, কিন্তু এমন একটা ভাগ্য যে এতো সুন্দর সময়টা তার গলার কাটা হয়ে গেছে। একটা নারীকে মাতৃত্ব পরিপূর্ণ করে কিন্তু তার দূর্ভাগ্য এতোটাই যে এই মাতৃত্ব তাকে সমাজের কলঙ্কিনীর পরিচয় দিচ্ছে। সুরাইয়া বেগম একবারো তার সাথে কথা বলছেন না। আর সেলিম সাহেব নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। সব দেখছে আর প্রতিক্ষনে হাজারো বার মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করছে ধারা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হিসাব মিলাতে যখন ব্যস্ত ধারা তখন……………

চলবে

কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
৪র্থ_পর্ব

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের হিসাব মিলাতে যখন ব্যস্ত ধারা তখন পাশ থেকে শুনতে পায়,
– সেদিনও বলেছিলাম যা কুকাম করার তাতো করেই ফেলেছিস। এখন কেঁদে ভাসালেও কিছুই হবে না। তবুও তুই সেই ফ্যাছফ্যাছানি কান্না লাগিয়েই রেখেছিস। সারাটাজীবন আমার এখন তোর এই মরা কান্নাই দেখতে হবে।

অনলের কথা কানে আসতেই পেছন ফিরে তাকায় ধারা। একটা সাদা শার্ট এবং কালো জিন্স পড়ে বেশ আল্লু আর্জুনের মতো পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনল। অনল দেখতে অনেকটাই সাউথের হিরোদের মতো, ছয় ফুট লম্বা, সুঠাম দেহী, শ্যাম বর্ণের একটি ছেলে। যেকোনো মেয়ে দেখলে ক্রাস খেয়ে যেতে পারে। চুলগুলো চোখের উপরে এতো সুন্দর ভাবে পড়ে থাকে যা তাকে আরো হ্যান্ডসাম এর কোটায় ফেলে। এতো সুন্দর মুখে সবচেয়ে মাতাল করা হলো তার উদাসীন চোখ জোড়া। সেখানে কাউকে হারিয়ে ফেলার বেদনা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মুখ খুললেই যে কারোর ইম্প্রেশন খারাপ হয়ে যাবে। ধারার তো মনে হয় তার ফুপি অনলকে কোনোদিন মধুই ছোয়ায় নি। করলার মতো কড়া আর তেতো বুলি শুনতে পাওয়া যায়। মুখটা ঘুরিয়ে দৃষ্টি বাহিরে দিয়ে উদাস কন্ঠে ধারা বলে,
– মজা নিতে এসেছো?
– জীবনটা আমাকে একটা মজা বানিয়ে রেখে দিয়েছে, আমি কার মজা নিবো বল?

অনলের কথাটা খুব যে বোধগম্য হলো তা নয়, কিন্তু উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না ধারার। তার জীবনটাও একটা “জোক অফ দ্যা ইয়ার” হয়ে বসে আছে। সে অন্যের জীবন নিয়ে কি আর চিন্তা করবে আর কি টিপ্পনী দিবে! ধারার উদাসীনতা দেখে অনল আবারও বললো,
– তোর নাগরকে জানিয়েছিস?
– এবোর্শন করাতে বলেছিলো, আমি রাজী হই নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা হলেই ভালো হতো
– করাতে হবে না, ওকে ফোন দিয়ে বলে দিস সামনের সপ্তাহে তোর বিয়ে। বিয়েটা খেয়ে যেতে
– মানে?

ধারার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে সে জানে না এই বিয়ের ব্যাপারে। অনল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহিরে শুন্য দৃষ্টি দিয়ে বলে,
– অনেক ভেবেছি, চিরকুমার থাকাটা আমার দ্বারা আর হবে না বুঝলি? এবার সংসারটা করতেই হবে। বাহিরের কোনো পিস ঘাড়ে তুলার থেকে তোকে বিয়ে করাটা সোজা। সাথে ফ্রি বাচ্চা ও আছে। স্কিমটা খারাপ না। আমি ও বিয়ে নামক ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবো তুইও এই সমাজের চোখে সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবি। একটা বিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে দিবে।

অনলের কথাশুনে ধারার নিঃশ্বাস আটকে রাখার জোগাড়। উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে লাগে,
– তুমি ভেবে বলছো তো? তুমি অন্য কারোর পাপের ফসল কেনো নিজের ঘাড়ে বয়ে বেড়াবে? এখন হয়তো তুমি ভাবছো এটা ঝামেলা থেকে তোমাকে মুক্তি দিবে কিন্তু ইন দ্যা এন্ড যখন মানুষ তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দিবে এটা তোমার বাচ্চা না, আমি একটা নষ্ট মেয়ে পারবে, পারবে মেনে নিতে? এতো সোজা না অনল ভাই, এতো সোজা না
– আচ্ছা একটা কথা বল তো, মানুষ কি আমাকে দুইবেলা খাওয়াবে? নাকি তারা আমাকে চ্যালচালায়ে বেহেশতে নিয়ে যাবে? শোন এসব মানুষের কথায় আমার কোনো কালে কিচ্ছু যায় আসে নি, আসবে ও না। আমার মাকে যখন বাবা ডিভোর্স দিয়ে অন্য কারো কাছে চলে গেছিলেন আমাকে মানুষ দেখে নি। আমি যখন ড্রাগের অভারডোজ করে আই.সি.উ তে ছিলাম তখন মানুষ আমাকে বাঁচায় নি। সুতরাং এই ঢং এর আলাপ আমাকে দিস না।

ধারার বুঝতে বাকি রইলো না এ মানুষকে বুঝানো তার কম্য নয়। সে যা ভালো বুঝবে তাই করে এসেছে এবং তাই করবে। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো ধারার। ক্লান্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি আমাকে বিয়েটা কেনো করতে চাচ্ছো এখনো সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। আমার মতো কলঙ্কিনীকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা অন্ধকারে ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমার ভাগ্যে যা আছে আমি সেটা মাথা পেতে নিয়েছি। প্লিজ আমাকে দয়া করে নিজের জীবনে অভিশাপ ডেকে আনবে না অনল ভাই!
– তুই তো বেশ বড় হয়ে গেছিস ধারা! অবশ্য যে কান্ড ঘটিয়েছিস তাতে এই ব্যাপারটা প্রমাণিত। তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না। তোর সাথে বিয়ে নামক বস্তুটা আমার কাছে কেবল কাগজের একটা সই আর তিন অক্ষরের একটা শব্দ মাত্র। আমার কাছে এই জিনিসের কোনোই মূল্য নেই। থাকবেও না। তোর কাছে এই বিয়েটা যেমন সকল ঝঞ্জাট থেকে পরিত্রাণের উপায়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। নিছক মায়ের ইচ্ছেটুকু পূরণ করা মাত্র। মা যা বলে সর্বদা মেনে এসেছি, এখনো মানবো। তাই এই বিয়েটাও করবো। কিন্তু চিন্তা করিস না আমার মতো অগোছালো লোকের কাছে এটা একটা কাগজের লিখিত ঠুনকো সম্পর্ক মাত্র। বিয়ের পর আমি কেবল তোর কাগজের স্বামী আর তুই আমার কাগজের স্ত্রী। আমি তোর জীবনে কখনোই হস্তক্ষেপ করবো না তদ্রুপ তুই ও আমার জীবনে কখনোই হস্তক্ষেপ করবি না। আমাদের সম্পর্কটা কেবল এবং কেবল কাগজের। আমরা কাগজের তুমি আমি হয়েই থাকবো।

অনলের ঠান্ডা গলার কথাটা শুনে ধারা আর কথা বাড়ায় না। একটা প্রশান্তি মনে জাগে, সে অন্তত সমাজের হাহাকার থেকে মুক্তি পাবে, তার সন্তানটি বেঁচে থাকবে। অনলের মতো একটা বটবৃক্ষের ছায়া পাবে, তার দূর্ভাগ্যের জীবনে এটা জ্যাকপটের ন্যায়। কিন্তু একটা কাগজের সম্পর্ক টেনে নেওয়াটা সহজ হবে! চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আরো কি কি দেখা বাকি কে জানে_____

সকাল ১১টা,
ক্যাম্পাসে বাইক পার্ক করে সারাকে খুজতে লাগলো দিগন্ত। আজ দুদিন ধারা তার ফোন রিসিভ করছে না। ব্যাপারটা খুব ভাবাচ্ছে তাকে। যদি ইমোশোনাল হয়ে কোন একটা স্টেপ নিয়ে নেয়, তখন কি করে দিগন্ত। সারা ধারার খুব ভালো বান্ধবী সে ধারা বিষয়ে সব তথ্য রাখে। সারাকে খুজে পেলেই ধারার নিউজ পাবে দিগন্ত। একটা জিনিস মোটেই মাথায় ঢুকছে না তার, একটা বাচ্চাই তো। এতো ইমোশোনাল হওয়ার কি আছে? একবার তার চাকরি হয়ে গেলে, ক্যারিয়ার গড়ে গেলে ধারাকে বিয়ে করে নিবে সে। তখন সারাটা জীবন পরে আছে তাদের। এখন এই খাল কেটে কুমির আনার কোনো মানেই নেই। আর এই বয়সে এই ভুল গুলো হওয়াটা খুব ন্যাচারাল। তাও তো রিলেশনের আড়াই বছর বাদে ধারা তাকে ছুতে দেওয়ার পারমিশোন দিয়েছে, কই তার বন্ধুদের বেলায় তো এমন হয় নি। আসলে এসব ব্যাকডেটেড মেয়ের সাথে প্রেম করলে এমন ই হয়। এখন বাচ্চা রাখার জন্য কান্নাকাটি বাধিয়েছে। দিগন্তের মাথা ফেটে যাচ্ছে, কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সত্যি বলতে সে বেশ ঘাবড়ে গেছে। সে ধারাকে ভালোবাসে, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছে এখন তার নেই। কেবল মাত্র ২৬ বছর তার। এখন কোথায় মজা করার সময়, ইঞ্জয় করার সময়। এখন বিয়ে করা মানেই একটা বোঝা কাধে নেওয়া। ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে সারাকে দেখেই ছুটে যায় দিগন্ত তার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে তাকে বলে,
– সারা, তোমাকেই খুজছিলাম
– কেনো গো দিগন্ত ভাই?
– আচ্ছা ধারা কি কলেজে আসছে না? ওকে আমি দুদিন ধরে খুজে পাচ্ছি না
– ও এই সপ্তাহে কলেজে আসবে না, সামনের সপ্তাহে আসে কি সেটাও বলতে পারছি না
– কেনো বলোতো?
– ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে, এই শুক্রবার ওর বিয়ে

সারার নির্বিকার ভাবে বলা কথাগুলো দিগন্তের কানে যেতেই মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায় তার। বিয়ে মানে টা কি? আর ধারা বিয়ে করছে এটা তাকে জানানোটা প্রয়োজন মনে করলো না ধারা। আর এখন ধারার যে অবস্থায় আছে তাতে তাকে কেউ বিয়ে করতে চাওয়ার ই কথা না। এটার একটাই মানে হয় ধারা নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলেছে, এখন নিশ্চয়ই কোনো বড়লোক পটিয়ে তার সাথে বিয়ে করে সুখে সংসার করার কথা চিন্তা করছে। রাগে গা রি রি করছে দিগন্তের। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে সে। এই মূহুর্তে আর দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাচ্ছে না তার। তড়িৎ গতিতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

বিকেল ৫টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা, আগামী পরশু তার এবং অনলের হলুদ। দিগন্তের সাথে একটাবার কথাও হয় নি সেদিনের পর থেকে। শেষবারের জন্য একটাবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জানাতে ইচ্ছে করছে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে ধারা। কথাটা ভাবতেই ফোনটা হাতে নিলো ধারা। এতোদিন ফোন অফ করে রেখেছিলো ধারা। ফোনটা অন করতে না করতেই মোবাইল স্ক্রিনে দিগন্তের নামটি ভেসে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here