কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে #পর্ব_১৭,১৮

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১৭,১৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
১৭

রুদ্ধশ্বাস নিয়ে প্রতিটি সেকেন্ড অপেক্ষা করে আছে জুঁই । নাফিসের অপেক্ষায় নিজেকে আজ চাতক পাখি মনে হচ্ছে তার । নাফিসের ভালোবাসায় নিজেকে আজ রাঙিয়ে নিলে ক্ষতি কিসে । জীবন আরও একবার তাকে সুযোগ দিয়েছে । এই সুযোগ লুফে নিতে ক্ষতি কোথায় ?

সময় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু নাফিসের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না । আজ প্রায় দুই বছর পরে জুঁই সাদা শাড়ি ছেড়েছে । আজ নাফিসের পছন্দের সেই হলুদ রঙের শাড়িটা পরেছে জুঁই । সাদা শাড়িটা খুলে হলুদ শাড়িটা পরার সময় কেন যেন আপনা আপনি চোখ থেকে পানি ঝরে যায় জুঁইয়ের । হয়তো কিছু পুরনো স্মৃতি মনে গেছে । সাদা শাড়িতে অনেক বেদনার স্মৃতি লুকায়িত আবার হলুদ শাড়িতেও অনেক কষ্টের মুহুর্ত লুকায়িত । একদিকে নিজেকে যার কাছে সপে দেয়া হয়েছিল তার সারাজীবনের জন্যে চলে যাওয়াতে বুকে চাপা ব্যাথা । অন্যদিকে অতীতের ভালোবাসার মানুষটা সব ছেড়ে দিয়ে সেই ভালোবাসার অধিকার নিয়ে তাকে আপন করে নেয়ার সকল প্রচেষ্টার জন্য একটুকরো সুখের অনুভূতির প্রকাশ । সব মিলিয়ে জুঁই যেন দিশেহারা ।

শাড়ি পরে অনেক্ষণ অপেক্ষায় রত থাকা মন যেন আস্তে আস্তে বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে৷। প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেছে । রাত প্রায় ১১ টার উপর বেজে গেছে । অথচ নাফিস আসে নি । নাফিসের পথ পানে চেয়ে থেকে থেকে দুচোখ যেন প্রায় বুজেই আসে তার । এ অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকা ওই ফাঁকা রাস্তার পানে । এই তাকিয়ে থাকা যেন এক অন্যরকম ভালো লাগার স্পর্শ পেতে শিহরিত হয়ে থাকা ।

অপেক্ষার পালা বদলের সময় হয়ে গেছে । রাত প্রায় সাড়ে ১২ টা । প্রায় ৪ ঘন্টা হয়ে গেছে অথচ নাফিসের দেখা নাই । বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জুঁইয়ের চোখে যেন কুয়াশা ভর করে আছে । চোখের পানি গুলো আপন ইচ্ছায় ঝরে যাচ্ছে । মন থেকে শুধু কিছু কথা বেরিয়ে আসছে তার ।

– তাহলে কি নাফিস আবারও ঠকালো আমায় ? সেই আগের মত নাফিস আবারও আমায় কষ্ট দিলো । আমার ভালোবাসার কি তাহলে আরও একবার মিথ্যা প্রমাণিত হলো ?

এইসব ভেবে নিয়ে রুমে গিয়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখে জুঁই । চোখের পানি গুলো মুছে শাড়ির সেফটিপিনে হাত দেয় জুঁই । যার জন্যে এই শাড়ি সেই যখন আসে নি তাহলে আর এই শাড়ি কেন । শাড়ির সেফটিপিন খুলতে যাবে এমন সময় জুঁইয়ের মোবাইলে ম্যাসেজ আসে । চমকে গিয়ে মোবাইলের দিকে তাকায় জুঁই । নাফিসের নামটা দেখে চমকে গিয়ে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে যায় জুঁই । সেখানে লিখা আছে ,

– নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি , তুমি আস্তে করে বেরিয়ে আসো । ইফসিকে আন্টি দেখবে । অপেক্ষা করছি আমি ।

ম্যাসেজটা দেখে দৌড়ে বারান্দায় যায় জুঁই ।
দেখে নিচে নাফিস বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । শালটা শাড়ির উপরে দিয়ে আস্তে করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় জুঁই । বাসায় তখন ইফসি আর তার মা ঘুমাচ্ছিলো । দরজায় তালা দিয়ে
জুঁই নিচে নেমে আসে । কেচি-গেইটের তালা খুলে বেরিয়ে নাফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জুঁই । আর এদিকে জুঁইকে দেখে নাফিস অবাকই হয় নি ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । চিরচেনা সেই হলুদ শাড়িটা যা আজ জুঁই তার অঙ্গে জড়িয়েছে । জুঁইকে দেখে চোখের পানি গুলো চিক চিক করছিল নাফিসের । অসাধারণ বললেও কম হয়ে যাবে আজ । মুখে যেন দুজনেই কুলুপ এঁটে দিয়েছে । কোন কথা নেই কারো মুখে । অজান্তেই জুঁইয়ের হাতটায় স্পর্শ করে নাফিস । নাফিসের স্পর্শে ধ্যান ভেঙে যায় জুঁইয়ের ।

– এত দেরি কেন করলে নাফিস ?
– কিছু কাজ ছিল ।
– আমি ভেবেছিলাম,,,,,,,,
– ভেবেছিলে নাফিস বুঝি আবারও তোমায় ঠকালো ?

নাফিসের এমন কথায় একদম চুপ হয়ে যায় । মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নাফিসের সামনে । জুঁইয়ের নিচু মাথা দেখে জুঁইয়ের থুতনিতে হাত দিয়ে তার মাথাটা উঁচু করে দেয় নাফিস । তারপর হাল্কা হেসে বলে ওঠে ,

– এই নাফিস আর বদলাবে না কাদম্বরী । এই নাফিস তার কাদম্বরীকে আর ঠকাবে না । এখন চলো ,
– কোথায় ?
– যাবো এক জায়গায় ।
– কোথায় নিয়ে যাবে আমায় ?
– যেথায় বিরাজ করবে শুধু নিস্তব্ধতা
যেথায় আমার মনে রাজ করবে তোমার
ভালোবাসা !!

নাফিস কথা বলার সাথে সাথে জুঁইয়ের হাত ধরে তাকে বাইকে উঠিয়ে দেয় । আর তারপর বাইক স্টার্ট দিয়ে দেয় ।

গভীর রাতে প্রকৃতিও চুপ হয়ে আছে । একা রোডে নাফিসের বাইক ছুটে চলছে এক অজানা গন্তব্যে । জুঁই বার বার চাইছে নাফিসের কাঁধে হাত রাখতে । কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা কাজ করছে তার মাঝে । নিজেকে এখনও লজ্জায় ঢেকে রেখেছে সে । অন্যদিকে নাফিস চাইছে জুঁই তার কাঁধে হাত রাখুক । একটু ভরসা করুক যদিও সে জুঁইয়ের ভরসা একবার ভেঙে দিয়েছিল অনায়াসে ।

– জুঁই,,,,,,,,?
– হু ,
– ভরসা করেই দেখো না ?
– মানে ?
– তোমার মন বলছে আমার কাঁধে হাত রাখতে , কিন্তু তোমার বিবেক বলছে কার কাঁধে হাত রাখবি , যে তোকে ছেড়ে চলে গেছে তার কাছেই ভরসা খুঁজছিস ?

নাফিসের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায় জুঁই । ওর মনের কথা নাফিসের মুখে শুনে সে আসলেই অবাক হয়ে গেছে । নাফিস কি তাহলে আসলেই বদলে গেছে ।

– নাহ মানে আসলে,,,?
– একটা বার হাত রেখে দেখো , যদি ভরসা খুঁজে না পাও তাহলে হাতটা সরিয়ে নিও , আমি কিছুই মনে করবো না ।

নাফিসের কথার পেচে পড়ে গিয়ে নাফিসের কাঁধে হাত রাখতে বাধ্য হয় জুঁই । নিজের কাঁধে কাদম্বরীর হাত পড়ায় আনন্দের অনুভূতি গুলো নাফিসের হৃদয়কে হাল্কা শিহরিত করে দিয়ে যায় ।

প্রায় অনেক্ষন পর একটা নদীর পাড়ে এসে নাফিসের বাইক থামে । বাইক থামিয়ে জুঁইয়ের হাত ধরে জুঁইকে নদীর পাড়ে নিয়ে দাঁড় করায় নাফিস । এত রাতে এখানে নদীর পাড়ে এসে অবাক হয়ে যায় জুঁই । আরেকটু অবাক হয় ঘাটে একটা নৌকা দেখে ।

– নাফিস , এত রাতে এখানে নিয়ে এলে যে ?

জুঁইয়ের শান্ত গলার মিষ্টি প্রশ্নে অভিভূত হয়ে নাফিস জুঁইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । তারপর সে তার হাতখানা দিয়ে তার কাদম্বরীর হাতে স্পর্শ করে অত্যন্ত শান্ত গলায় আস্তে করে মিষ্টি ভাবে বলে ওঠে ,

নিশিরাতে কবো কথা
তোমারও সনে
প্রিয়া মোর শুনো তবে
আমি আছি তোমারও মনে

নাফিসের বলা কবিতায় আজ যেন আগের মত হাসি ফুটে উঠে জুঁইয়ের ঠোঁটে । আজ যেন প্রাণ খুলে হাসতে মন চাইছে তার । নাফিস তখন জুঁইয়ের হাতে নিজের হাত জোড়া একটু চেপে ধরে বলে ,

– হাসো কাদম্বরী , আজ হাসো । আজ আমি দেখি আবার আমার সেই কাদম্বরীর মিষ্টি হাসিখানা ।
– হাসতে বড্ড বেশি মন চাইছে আমার ।
– হ্যাঁ , আজ থেকে তুমি হাসবে । আর কখনো ওই চোখে পানি আসতে দিবো না তোমার ।
– আমায় একটু জড়িয়ে নিবে তোমার বই বুকে ?

জুঁইয়ের এমন আবদারে নাফিস যেন হাজারো সুখ তার হাতের মুঠোয় পেয়ে যায় । দিক বিক না ভেবে নিজের কাছে টেনে নেয় নাফিস জুঁইকে । তারপর কোলে তুলে নেয় তার কাদম্বরীকে । এগিয়ে যায় নৌকার দিকে ।

– নাফিস ,
– হু ,
– রাতের বেলায় নদীতে নিয়ে এলে কেন আমায় ?
– আজ রাতে তোমার সাথে জোছনা বিলাস করবো ওই নৌকার মধ্যে নদীর মাঝখানে ।
– আমার যে ভয় হয় নাফিস ?
– আমি তো আছি , আরেকটু ভরসা করো আমায় ।
– লোকে যদি জানে কি হবে ?
– সাহস করো নারী , একবার সাহস করো
ভালোবাসায় আপন করে আদর সোহাগে
ভরিয়ে দিবো ।

জুঁই তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি । কোলে চড়ে থাকা অবস্থাতেই নাফিসকে জড়িয়ে ধরে সে । নিজের কোলে রেখে জুঁইকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে নৌকায় উঠে নাফিস ।

নদীর শান্ত ডেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে নৌকা বয়ে যাচ্ছে তার আপন গতিতে । গভীর রাতে নিস্তব্ধ নদীতে শুধুই পানির শব্দ । ঢেউগুলো একে অপরের সাথে খেলে যাচ্ছে । মাঝি বৈঠা বাইছে । আর নাফিস আর জুঁইকে পরখ করছে । অন্যদিকে নাফিস যেন তার পলক ফেলছে না । এক দৃষ্টিতে তার কাদম্বরীকে দেখে যাচ্ছে সে । নাফিসের এইভাবে তাকিয়ে থাকা জুঁইকে যেন ডুবিয়ে দিচ্ছে । থাকতে না পেরে নিজের হাত দিয়েই নাফিসের চোখ বন্ধ করে দেয় জুঁই ।

– এভাবে তাকিও না , আমি মরে যাবো ।
– মরতে দিবো না তোমায় । আমার হৃদয় মাঝে বন্দী করে রাখবো ।
– পাগল করো না আমায় ।
– উহু আমি যে তোমাতে পাগল প্রায় ।
– দেখো , ঢেউ গুলো শব্দ করছে ।
– তোমার কথার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ।

জুঁই নাফিসের কথার সাথে পেড়ে উঠতে পারছে না । নাফিস যেন সব কথা সাজিয়ে রেখে দিয়েছে । তাই জুঁই চুপ করে যায় । কিছুক্ষণ পর নাফিস একটা ফানুশে আগুন ধরায় । ফানুশ দেখে জুঁই যেন দিশেহারা হয়ে যায় । কারণ ফানুশ যে তার খুব প্রিয় । আর এর সাথে সাথে ওদের দুজনের প্রথম দেখার কথাটা মনে পড়ে যায় জুঁইয়ের । প্রথম দেখায় নাফিস এইভাবেই ও-কে সাথে নিয়ে ফানুশ উড়িয়েছিল ।

নাফিস তখন জুঁইকে কাছে টেনে নিয়ে দুজন মিলে ফানুশটা উড়িয়ে দেয় । তারপর জুঁইয়ের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দেয় । এইসবই জানো জুঁইয়ের কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে । নিজেকে নাফিসের সাথে জড়িয়ে রেখে পরম শান্তিতে চোখ বুজে জুঁই । আর নাফিস তার কাদম্বরীকে জড়িয়ে রেখেই বলে ওঠে ,

ভালোবাসি মোর প্রিয়া তোকে
অনেক ভালোবাসি
এই ভালোবাসার জন্যে আমি
দিব হাজার নদী পাড়ি

ওগো মোর কাদম্বরী
আমি তোকেই ভালোবাসি
আমার ভালোবাসার মাঝে যে তোর
আছে বশত বাড়ি

মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরিয়ে
চোখটা তুই বুজ
আমার বক্ষের মাঝে যেন
পাস অনেক সুখ

নাফিসের কথার পর পরই জুঁই নাফিসের শার্টটা আরও শক্ত করে ধরে নাফিসের বুকে নিজেকে আরও লেপ্টে নিয়ে যায় । এ যেন সুখের ভেলায় চড়ে এক জোড়া পাখির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলার শান্তিময় মুহুর্ত ।।

.
.

চলবে………..

#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

দুই পরিবারের সম্মতিতে নাফিসের মায়ের একান্ত আপত্তিতে নাফিস আর জুঁইয়ের আজ বিয়ে । খুবই সাধারণ ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে । জুঁইয়ের ইচ্ছাকেই সম্মান জানিয়েছে নাফিস আর তার পরিবার । নাফিস নিজেও চায় নি বিয়েটা ধুমধাম করে হোক । তাই অফিসের কিছু কলিগ আর দুই পরিবারের মানুষ মিলেই ছোট করে বিয়ের আয়োজন করেছে জুঁইয়ের মায়ের বাসায় । বিয়েতে মাহবুব সাহেব এবং তার স্ত্রীও উপস্থিত হয়েছেন । ইফসির মুখে আজ হাসি । সে তার মাকে আজ বধূ বেশে দেখতে পাচ্ছে । যদিও তেমন সাজে নি জুঁই । নাফিসের দেয়া লাল বেনারসি আর সাথে একদম সিম্পল সাজ । আর নাফিসের একান্ত ব্যাক্তিগত অনুরোধে খোঁপায় বেলীফুলের মালা পরেছে । আর ইফসি বার বার জুঁইয়ের খোঁপার ফুল গুলো ধরছে । তবে নষ্ট করছে না ।

জুমার নামাজের পর নাফিস তার বাবা দুই বোন আর বোনের জামাই সাথে আরও দুজন মুরুব্বি নিয়ে জুঁইদের বাসায় আসেন । মাশা-আল্লাহ আজ নাফিসকে রাজপুত্রের মত লাগছিল । একটা পাঞ্জাবি আর চুড়িদার পরেছে সে আজ । ড্রইং রুমটা বেশ ভালো বড় সড় । সেখানেই ওনাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে । আর ভেতরে মহিলারা আছেন । নিজের জায়গায় একদম কমফোর্টেবল ভাবে বসে আছে নাফিস । মনে হচ্ছে কিছুই হয় নি । আজ যে তার বিয়ে সেটাও তার জন্য একদম সিম্পল ব্যাপার । কারণ এই তিনটা বছরে নিজের বুকের ব্যাথা নিজের কর্তব্য গুলো পালন করতে করতে এখন সব কিছুই তার কাছে নরমাল মনে হয় ।

নাফিসের কথায় শান্তা ভেতরে গিয়ে ইফসিকে নিয়ে আসে । এনে নাফিসের কোলে তুলে দেয় । আর নাফিসও তাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে রাখে । অন্যদিকে ইফসিকে এক নজরে দেখে যাচ্ছে আনিস বেপারি মানে নাফিসের বাবা । এখন থেকে নাতনি হিসেবে এই বাচ্চাটাকে নিজের সব ভালোবাসা বিলাবেন তিনি । এদিকে নাফিস ইফসির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ।

– এইযে বুড়ি ,,,,,?
-………..
– এত সাজুগুজু করছেন কেন আপনি ?
-………..
– পাপা কথা বলি তো মা , কথা বলো পাপার সাথে ।
-………..
– ওইযে দেখো দাদান আসছে , তাকাও ওইদিকে মা । তাকাও তো

নাফিসের হাতের ইশারায় ইফসি নাফিসের বাবার দিকে তাকায় । নাফিস বার বার দাদান দাদান করছিল । প্রায় ৫ মিনিট পর ইফসি মিষ্টি হাসি দিয়ে দাদান বলে ওঠে । আর সেখানে উপস্থিত সবাই হেসে ।

কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেব এসে যান । বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে গেছে । হুজুর বিসিমল্লাহ বলে বিয়ে পড়তে শুরু করেছেন । কিন্তু এখানে নাফিস বাঁধা দিয়ে দেয় । এই রুম আর ওই রুম , অল্প ফারাক । তাই এই রুমের সব কথা জুঁই ভেতর থেকেই শুনে নেয় ।

নাফিস তখন বলছিল ,

– হুজুর একটু অপেক্ষা করুন ।
– জ্বি বলুন ,
– এখানে আরও কিছু থাকবে ।
– যেমন ,
– এখানে শুধু নাদিরা ইয়াসমিন মানে জুঁইয়ের নাম নেয়া হচ্ছে কিন্তু সে তো একা নয় । তার সাথে আরও একটা প্রাণ জড়িত ।
– একটু পরিষ্কার করে বুঝালে ভালো হতো ।
– এখানে উল্লেখ করুন , যে নাদিরা ইয়াসমিন জুঁইকে স্ত্রীর সম্মান দেয়ার সাথে সাথে তার মেয়ে ইফসির সমস্ত দায়িত্ব আমার । এখন থেকে ইফসির বড় হওয়া এবং তার বিয়ে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত তার সমস্ত দায়িত্ব আমার । ওর সমস্ত সার্টিফিকেট এবং ওর সমস্ত উপস্থিতিতে আমি নাফিস আহমেদ ওর বাবা । এক কথায় আজ থেকে ইফসি শুধু নাদিরা ইয়াসমিন জুঁইয়ের মেয়ে না ইফসি আমাদের মেয়ে হিসেবেই পরিচিতি পাবে ।

নাফিসের বলা কথা গুলো সেখানে উপস্থিত সবাই এতক্ষন মনোযোগ সহকারে শুনেছেন । নাফিস তখন হুজুরকে আবার বললেন ।

– হুজুর বিয়ের দেনমোহর ৫ লক্ষ টাকা করুন যার মধ্যে পুরো ৫ লক্ষ টাকাই নগদ যাবে ইফসির একাউন্টে ।

এ কথা ভেতরে জুঁই আরও অবাক হয়ে যায় । সেখানে উপস্থিত সবার মাঝে কেউ কেউ অবাহ হয় এটা ভেবে যে এই পুরুষ কি করে এত অনায়াসে আরেকজনের সন্তানকে এতটা আপন করে নিতে পারে । আর কেউ কেউ আনন্দ হয় তার এত উদারতা দেখে । আর ভেতরে থাকা নব বধূর সাজে বসে থাকা জুঁইয়ের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে যায় এটা ভেবে যে তার মেয়ের ভবিষ্যত এখন থেকে সুরক্ষিত ।

[ বিঃদ্রঃ এই অংশটুকু নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া । আমাদের জীবন কখনো কখনো গল্পের মত হয়ে যায় আর আমরা অনেকেই এমন কিছু গল্পের চরিত্র হয়ে যাই অথবা । আমাদের মত চরিত্র আর আমাদের জীবন থেকেই তৈরি হয়ে যায় এক একটা গল্প কিংবা উপন্যাস । যা লিখতে বসলে পাতা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু উপন্যাসের সমাপ্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না । #কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে উপন্যাসটি তেমন একটি বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস যেখানে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তুলে ধরা হচ্ছে । কখনো প্রেমে ঠকে যাওয়া , কখনো শ্বশুরবাড়ি স্বামী দিতে অসুখী হওয়া নতুবা আবারও বিচ্ছেদ অথবা পুরনো ভুল বুঝে ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেয়া । এই উপন্যাসটিকে সেই সব চিরাচরিতয়তার মাঝে প্রতিকূলতার মুখোমুখি করে ফুটিয়ে তোলার আমার এক ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র ]

অবশেষে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেছে । সবার মুখেই আলহামদুলিল্লাহ । যেন এক ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আজ জোড়া লাগলো । যেন কিছু ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আবারও ভীত খুঁজে পেলো । ভালোবাসার সম্মান আর ভালোবাসার মানুষটার সম্মান বাঁচাতে তার অসহায়ত্বের শেকড়কে নিজের শেকড়ে পরিণত করে তার পাশে থাকাটা সবাই হয়তো পারে না । যা হয়তো নাফিস পেরেছে ।

সব অনুষ্ঠান শেষে জুঁই আর ইফসিকে নিয়ে বাসায় পা রাখে নাফিস । এমন ঘরে এসে পা রেখেছে জুঁই যেখানে নতুন সংকার উৎপন্ন ।
রেহানা পারভিন ছেলের বউ দেখে খুশি হওয়ার বদলে দুঃখী বেশি হয়েছে । তার চিন্তা পাড়া প্রতিবেশীরা এসে যখন দেখবে ছেলের বউয়ের আগের ঘরের বাচ্চা আছে তখন তার মুখ থাকবে কোথায় ?

জুঁই এসে সালাম দেয়ার পরেও তিনি তেমন একটা গুরুত্ব দেয় নি । জুঁই বেশ বুঝে গেছে তার নতুন শ্বাশুড়ির মনে কি চলছে এই মুহুর্তে । অন্যদিকে ছোট্ট ইফসিটাকে দেখেও না দেখার ভান করে আছেন তিনি । সবার মাঝে থেকে কাজ তো করে যাচ্ছেন সাথে বিষ হজম করছেন ।

শান্তা আর শাম্মি দুজন মিলে নাফিসের ঘরে জুঁইকে রেখে আসে । মায়ের কাছে থাকবে বলে ইফসিকেও জুঁইয়ের সাথে নাফিসের ঘরে রাখা হয় । রুমে ঢুকে অনেকটা অবাক জুঁই । পুরো রুমটাই শূন্য । এখানে যে বাসর হবে দেখে বোঝা যাচ্ছে না । সব সময়ের মত রুম যেমন থাকে তেমনি রাখা হয়েছে । ফুল তো দূরে থাক ফুলের ফ টাও খুঁজে পাবে না কেউ এই রুমে । ইফসি তখন গুটি গুটি পায়ে দৌড়ে নাফিসের বিছানায় উঠে বসে যায় । হাতে ইশারা করে মাকে দেখায় তার পাশে বসতে ।

প্রায় এক ঘন্টা পর জুঁইয়ের সাথে খেলতে খেলতে ইফসি ঘুমিয়ে যায় । ইফসি ঘুমানোর পরেই নাফিস দরজা ঠেলে রুমের মধ্যে আসে । নাফিসকে দেখে হাল্কা স্মিত হাসি দেয় জুঁই । হাসির উত্তর হাসি দিয়েই দেয় নাফিস । খাটের দিকে নজর করে দেখে ইফসি খাটের মাঝ বরাবর শুয়ে আছে । ইফসির এপাশে বসে জুঁইকে উদ্দেশ্য করে নাফিস বলে ,

– রাগ করো নি তো ?
– কেন ?
– এইযে ফুল বিহীন ফাঁকা বাসর উপহার দিলাম তোমায় ।
– হয়তো এটাতেই শান্তি ।
– ইফসির কথা ভেবেই আনি নি । আর হ্যাঁ আমি তো স্ট্রেট ফরওয়ার্ড মানুষ তুমি তো জানো । বিয়েটা আমার ইচ্ছায় করেছি । মা একটু ঝামেলা করবে জানতাম তাই ফুলের ব্যবস্থা করি নি ।
– সমস্যা নেই ।
– ক্লান্ত লাগছে কি ?
– উহু ,
– ইফসি খেয়েছে ?
– শান্তা খাইয়ে দিয়েছে , তুমি কোথায় ছিলে ?
– ছাদে ঘিয়েছিলাম , মাহবুব ভাইয়া আরও কয়েকজন বন্ধুরা ছিল ।
– ওহ ,
– সবাই শিখিয়ে দিল ।
– কি ?
– বললো আমাকে নাকি প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হবে ।

নাফিসের কথায় একটু জোরেই হেসে দেয়
জুঁই । তারপর বলে ,

– তুমি কি বললে ?
– আমি বললাম আমি তো আগেই বিড়ালের কাছে নিজেকে সারেন্ডার করে দিয়েছি ।
– হা হা ,
– হাসলে অনেক ভালো লাগে তোমাকে ।

নাফিসের কথায় হাসি থামিয়ে দেয় জুঁই । নাফিস আবারও বলে ওঠে ,

– এক কাজ করো , শুয়ে যাও ।
– ঘুমিয়ে যাবে ?
– তুমি ঘুমাও , সারাদিনের ধকলে শরীর ক্লান্ত তোমার ।
– আমি ভালো আছি ।
– হ্যাঁ , ঘুমিয়ে যাও ।
– নাফিস ,,,,,,,,?
– হ্যাঁ,
– আমায় দেখে কামনা জাগছে না মনে ?
– তুমি তো আমার কামনার খোড়াক নও কাদম্বরী । তুমি আমার চোখের খোড়াক , আমার মনের খোড়াক । এর বেশি আর হয়তো কিছু বলা লাগবে না তোমায় । আমি আসবো তোমার কাছে এটা ঠিক তবে অসময়ে নয় । সময় অনুযায়ী । যেখানে কামনার চাইতে ভালোবাসার স্থান বেশি থাকবে । কামনা তো শরীরের চাহিদা মেটাবে কিন্তু ভালোবাসা শরীর মন আবেগ সব কিছুর চাহিদা মেটাবে । ঘুমিয়ে যাও , কেমন ?

কথা গুলো বলে নাফিস শুয়ে যায় । নিজ সন্তানের মত ইফসিকে বুকের সাথে মিশিয়ে ঘুমিয়ে যায় নাফিস । ইফসির এপাশে শুয়ে এক ধ্যানে নাফিসকে দেখছে জুঁই । নাফিসটা বরাবরই এরকম । শরীরের চাইতে মনের দিকে টান বেশি তার । হয়তো পরিস্থিতির চাপে পড়ে মনকে শক্ত করে ফেলেছিল এই মানুষটা । হঠাৎ করেই ফারুকের কথা মনে পড়ে যায় জুঁইয়ের । বিয়ের প্রথম রাতেই রুমে ঢুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল , ” তুমি শারীরিক ভাবে সুস্থ তো ” স্বায় পেয়ে বাঘের মত নিজের পুরুষত্ব ফলিয়েছিল সেই পুরুষটা । প্রচন্ড যন্ত্রণায় কেঁদে দেয়া জুঁইয়ের ব্যাথাটা সেরাতে খেয়াল করেনি সেই পুরুষটা । সেদিনও তার বাসর ছিল আর আজও তার বাসর । শুধু তফাৎ সময় আর মানুষের । সেদিনের পুরুষটি তাকে চেয়েছিল শরীরের খোড়াক হিসেবে আর এই পুরুষটি তাকে চাইছে মনের খোড়াক হিসেবে । দুনিয়ার অদ্ভুত সব নিয়ম । কখনো দুঃখ তো কখনো সুখ ।

এইসব ভেবে ভেবে চোখে তার অঝোর শ্রাবণ । নাফিসকে দেখছে আর কাঁদছে সে । এ কান্না হয়তো সুখের কান্না । এ কান্না হয়তো পরিপূর্ণতার কান্না । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজে নিজে ভাবছে আর মনে মনে বলছে ,

এই পুরুষকে কোথায় রাখবো আমি
যে আমার মনের মাঝেই রাজ করে যাচ্ছে
এই পুরুষকে কোথায় রাখবো আমি
যে কিনা আমাকে রেখেছে তার হৃদয়ের গভীরে

.
.

চলবে……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here