#ওগো_প্রণয়ের_নিমন্ত্রণ🌼
#লেখিকা:-Nowshin Nishi Chowdhury
#৬ষ্ঠ_পর্ব
পুব আকাশে রক্তিম সূর্যের আহবানে সকাল শুরু হলো মাইশার। নিজের এপার্টমেন্টের রেলিং বিহীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাক ডাকা ভোরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলো।
পরনে টি-শার্ট প্লাজো। কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে ওঠার কারণে চোখ মুখ এখনো ফোলা ফোলা ভাব ঘুমের রেশ কাটেনি।
ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস, মিষ্টি উত্তাপ এই দুইয়ের সংমিশ্রণে মাইশার হাতে থাকা মগে চিনি ছাড়া কফির তেতো ভাবটাও যেন মিষ্টতা ধারণ করেছে। চোখ বুজে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল সে। পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ অক্সিজেন।যেটা সারাদিন হাজার চাইলেও পাওয়া যায় না।
মগে থাকা শেষ কফি টুকু এক চুমুকে শেষ করে মগটা রান্না ঘরে গিয়ে ধুয়ে রেখে আসলো মাইশা। এরপর গোসল করতে ঢুকলো। নয়টার মধ্যে তাকে মেডিকেলে পৌঁছাতে হবে। মেডিকেলে যাওয়ার আগে সকালের নাস্তা এবং দুপুরের টিফিন তাকে নিজেই করে নিয়ে যেতে হবে। তাই সময় নষ্ট করলে চলবে না।
২০ মিনিটের একটা শাওয়ার নিয়ে মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে বেরিয়ে আসলো মাইশা। রাইস কুকারে নিজের জন্য ভাত চড়িয়ে দিয়ে রুমে ফেরত আসলো সে। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে মাথা থেকে তোয়ালে টা খুলে ফেললো মাইশা। কোমর সমান লম্বা চুল গুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়ল। চুলগুলো ভালো করে মুছে তোয়ালেটা বারান্দায় নেড়ে দিয়ে আসলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে ময়েশ্চারাইজার তুলে নিল। কিছুটা নিয়ে সারা মুখে মাখতে গিয়ে হঠাৎ তীক্ষ্ণ নাকের বাম পাশে পাতার উপর একটা ছোট কালো কুচকুচে তিল।
আয়নার দিকে তাকিয়ে মাইশা তার নাকের পাতার তিলটা ছুঁয়ে দেখলো। কানে বেশ পুরনো এক স্মৃতি কথা বেজে উঠল,
— তোমার প্রাকৃতিক নাকফুল কিন্তু আমার অনেক পছন্দের হে প্রিয়তমা। যাক আমার নাকফুলের খরচটা বেঁচে গেল। হাহাহা…
উক্ত লাইনগুলো ছ বছর আগের হলেও। প্রতিটা কথা অক্ষরে গেঁথে গেছে মাইশার মনে। চোখ বুজলে এখনো সে স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বাকি মশ্চারাইজারটুকু মেখে নিল সে।
§§§
পরনে বেবী পিঙ্ক রঙের থ্রি পিস, চুলগুলো পেছনে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকালো, এরপর সারা শরীরে ময়েশ্চারাইজার মেখে নিয়ে নিজের সাজগোজের ইতি টানলো মাইশা।
এরপর সে ছুটলো রান্নাঘরে।আগে থেকেই চিকেন ম্যারিনেশন করে রেখেছিল সে। সেটা এখন চুলার উপরে চড়িয়ে দিল। এরপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার কাছে মেঝেতে রাখা পেপারটা হাতে তুলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল সে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৭ঃ৩০ বাজে।
এরপর ডেইলি নিউজ এর প্রত্যেকটা পাতায় চোখ বুলাতে লাগলো সে। সকাল আটটা নাগাদ নিজের জন্য একটা ডিম পোচ করে নিয়ে এসে ডাইনিং এ বসলো মাইশা। পাউরুটিতে জ্যাম লাগিয়ে । তাতে একটু করে কামড় দিয়ে খেতে লাগলো এবং ফোনে তার আজকের সারাদিনের শিডিউল টা চেক করতে লাগলো।
নাস্তা শেষ করার কিছু মুহূর্তের পর তার বাসার কলিংবেলটা বেজে উঠলো। বেশ আশ্চর্য হলো মাইশা।এতো সকালবেলায় তার বাসায় তো কারো আসার কথা নয়।কে আসতে পারে? কথা ভেবে কপালে ভাজ পরলো মাইশার।
সে হাত ধুয়ে এসে লুকিং গ্লাস দিয়ে প্রথমে দেখল বাইরে কে আছে। কিন্তু সে একটা ফ্লাওয়ার বুকে দেখতে পাচ্ছে শুধু। পরে অনেক ভাবনা চিন্তা করে মাইশা দরজা খুলল। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে বেশ অবাক হলো সে,
— আবির তুমি!
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটা চশমার আড়ালে থাকা চোখ জোড়ায় হাসলো। ঠোট্টা সামান্য প্রসারিত করে বলল,
— কেমন লাগলো সারপ্রাইজ ম্যাডাম?
মাইশা কিঞ্চিত হেসে বলল,
— জঘন্য। এত সকালে এভাবে ভয় দেখানোর কোন মানে আছে। আমিতো দরজায় খুলতাম না আর একটু হলে।
— দরজা আপনাকে খুলতে হতো ম্যাডাম।এই নিন এটা আপনার জন্য। আর
আমাকে কি এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কথা বলবেন ভেতরে আসার অনুমতি দিবেন না।
মাইশা দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই আবির ভিতরে গিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলো। মাইশা দরজার আটকে রান্নাঘরে গিয়ে চুলা অফ করে রেখে এসে আবিরের সামনের শোফায় বসলো। পুরো ড্রয়িং রুম ভালো করে দেখে আবির মাইশার দিকে তাকাল।
—বাহ বেশ সুন্দর সাজিয়েছে তো টুনির সংসার।
আবিরের কথার পিঠে মাইশা কিঞ্চিত হাসলো।
মাইশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
— তুমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছো মাইশা। আগের মাইশা আর
মাইশা আবিরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
— এখনকার মাইশার মধ্যে অনেক তফাৎ তা আমি জানি। সময় তো আর থেমে নেই। আর সময়ের সাথে সাথে মানুষ পরিবর্তন হয়ে যায় এটাই চিরন্তন সত্য ।
আবির মাথা নাড়িয়ে বলল,
— হুম। তা ঠিক। কিন্তু তুমি যেন একটু বেশি পরিবর্তন হয়ে গেছো। তা মা-বাবাকে ছেড়ে এত দূরে এসে থাকছো কেন?
মাইশা আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুমি কি এটা শোনার জন্য এখানে এসেছ?
— না আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি ফেরত আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই জানতে পারি তুমি বাংলাদেশে চলে এসেছ। কিন্তু ব্যবসায়িক কাজের চাপে চট্টগ্রাম থেকে আসতে পারেনি। কালকে ফেরত এসে তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম আগে। আঙ্কেল বলল তুমি নাকি অ্যাপার্টমেন্টে থাকছো।
মাইসা নির্বিকার উত্তর দিল,
— হসপিটাল এর কাছাকাছি হওয়ায় সেজন্য এই অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি।
— খুব কাছাকাছি কিন্তু নয় হসপিটাল থেকে তোমার এপার্টমেন্ট । এখান থেকেও তোমাকে প্রায় 15-20 মিনিট জার্নি করে হসপিটালে যেতে হয়।
মাইশা বেশ বিরক্ত বোধ করল। তারপরও সৌজন্যবোধ ধরে রেখে বলল,
— সকালে নাস্তা করেছো আবির ?না হলে বসো আমি তোমার নাস্তার ব্যবস্থা করছি।
তাড়াহুড়ো করে বলল,
— এই না না আমি সকালে নাস্তা করেই এসেছি। আমি শুধু এসেছি একটা অনুরোধ নিয়ে।
— অনুরোধ!
— হ্যাঁ অনুরোধ। আগামীকাল তোমার জন্মদিন। আঙ্কেল আন্টি এত বছর অপেক্ষা করেছেন এই দিনটার জন্য যে তুমি তোমার জন্মদিনে বাংলাদেশে থাকবে। আঙ্কেল আন্টি কাল অপেক্ষা করে থাকবেন তোমার জন্য ।
— বাবা তো আসেনি আমাকে নিতে।
— তুমি যখন ওই বাড়ি থেকে এপার্টমেন্টে আসছিল আঙ্কেল আন্টি কিন্তু তোমাকে অনেকবার আটকানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তুমি শোনোনি জেদ করে চলে এসেছ।
মাইশা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে আছে দেখে আবির আবার বলল,
— বাইরের একটা ছেলের জন্য মা বাবার সাথে মান অভিমান করে বসে আছো কেন তুমি? সে অন্যায় করেছে তার শাস্তি তুমি আঙ্কেল আন্টিকে দিতে পারো না। তাহলে কালকে যাবে তো তুমি?
মাইশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
— হুম যাবো।
_________
আবির বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। তারপরপরেই মাইশা হাতে এপ্রোন ও স্টেথোস্কোপ নিয়ে ঘাড়ে ক্যারি ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসলো।
মেইন ডোর লক করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গেলে পেছন থেকে বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার ডেকে উঠলো।সে মনে হয় ছাদে গিয়েছিল। ছাদের সিঁড়ি থেকে নেমে আসলো এসে মাইশাকে সালাম দিয়ে বলল,
— আপনার এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ম্যাডাম?
মাইশা মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,
— আরে না না ভাই। এখানে আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আর কোন কিছুর দরকার হলে আমি আপনাকে জানাবো।
ভাই ডাকায় কেয়ারটেকার খুব খুশি হল। সে ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
— অবশ্যই আপা। আপনার যে কোন দরকারে আমাকে বলবেন আমি আমার যথাসম্ভব সাহায্য করবো আপনাকে।
মাইশা সম্মতি জানিয়ে বলল,
— আর কিছু বলবেন।
কেয়ারটেকার হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
— ওহ আপা যেটা বলার জন্য আপনাকে থামতে বললাম। আসলে আপনার পাশের ফ্ল্যাটটা বুকিং হয়ে গেছে। আজ সম্ভবত ফ্ল্যাটের মালিকের আসার কথা আছে।
মাইশা তাড়াহুড়ো করে বলল,
— উনারা আসলে পরে ওনাদের সাথে কথা বলবো। এখন আসি ভাইয়া । আমার হসপিটালে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
🤎🖤🤎
আলমারির উপর থেকে লাগেজ নামিয়ে আনলো ফালাক। লাগেজ বিছানার উপরে রেখে আলমারি থেকে একে একে জামাকাপড় গুলো এনে লাগেজে ভরতে শুরু করল।একে একে প্রয়োজনীর সবকিছু ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেল ফালাক।
শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো বিছানার উপরে তার মা বসে আছে সামনের সেন্টার টেবিলের উপর খাবার রাখা। মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে টাওয়ালটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সামনে বসে বলল,
— মুছে দেও।
ছেলের আদুরে আবদার শুনে ছেলের গাল টেনে দিয়ে মাথা মুছতে শুরু করলেন। মাথা মুছে দিতে দিতে বললেন,
— কোথাও কী যাবি বাবু?
ফালাক কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে বলল,
— হুম।
— কোথায়?
— খুব দরকারী একটা কাজে। এই কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তোমার ছেলের জন্য। জাস্ট একবার হয়ে গেলে..
— কী !
ফালাক মাথা থেকে তোয়ালাটা সরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
— এখন বলবো না। সারপ্রাইজ! তুমি আমার চুল আচড়ে দাও তো। ঠিক সেই ছোটবেলার মতো।
মিসেস রাফিয়া জামান ছেলের কথায় হেসে উঠলেন। হাত বাড়ির ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে ছেলেকে চুল আচড়ে দিতে লাগলেন। আর চোখ বুজে মায়ের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর বলল,
— আমার ফিরতে কিন্তু বেশ কয়েকদিন সময় লাগবে।
— কতদিন?
— এখনই বলতে পারছি না। কাজের উপর ডিপেন্ড করছে।যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো আমি। কিন্তু আমি তোমাকে জানাবো। সবকিছু জানাবো।
মায়ের হাত থেকে খেয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করে বিকেল নাগাদ সবকিছু গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো ফালাক। ঘুম থেকে বেরোনোর আগে পুরো রুমটা আরেকবার দেখে নিয়ে বলল,
— ভাগ্য ভালো থাকলে, এখন একা বের হচ্ছি ঠিকই আর জোড়ায় ফিরব এখানে।
ভাবনাচিন্তা শেষে ফালাক নিচে নেমে আসলো। সবার সাথে কথা বলে দাদীর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
— আসছি কুটনি বুড়ি। আমার ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ভালো থেকো।
মিসেস রাফিয়া জামান বেশ চমকালেন। ছেলের মধ্যে বেশ পরিবর্তন খুঁজে পেলেন। ছেলেকে খুব হাসি খুশি লাগছে। আচ্ছা সারপ্রাইজটা কি হতে পারে!
ফালাক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মাঝ রাস্তায় তার ফোনটা বেজে উঠলো। গাড়িটা রোডসাইড পার্ক করে রেখে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল।
— হুম বেরিয়ে পরেছি। পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না এই ৪৫ মিনিটের মতো।
— *******
অপর পাশে বলা ব্যক্তির কথা শুনে ফালাক ঠোঁট প্রসারিত করে চমৎকার হেসে বলল,
— আপনার অবদান কিভাবে ভুলতে পারি মিসেস মীরা হাসান..!
#চলবে🤎