এক_ফালি_রোদ ১৬তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
১৬তম_পর্ব

– হেড স্যার আপনাকে রুমে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন।

কথাটা শোনামাত্র প্রাপ্তির আত্না যেনো খাঁচা ছাড়া হয়ে গেলো। ছোট করে ‘”হুম” বলে পিয়নের পিছু পিছু হেড স্যারের রুমে গেলো সে। হেড স্যারের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে সেখানে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ শক্ত, চোখ স্থির। তার সামনে হেড স্যার চেয়ারে বসে রয়েছেন। লোকটার নাম মঈনুদ্দিন আজহারী। এই ডিপার্টমেন্টের সবথেকে কড়া স্যারদের মাঝে তিনি একজন। শিক্ষার্থীদের সুবিধা অসুবিধাতে তার কোনোই মাথা ব্যাথা নেই। সে শুধু নিজের এবং ডিপার্টমেন্টের রেপোটেশন কিভাবে রাখা যায় সেই কথাটা চিন্তা করে। প্রাপ্তি লোকটির দিকে তাকাতেই গলাটা শুকিয়ে আসলো তার। লোকটার চোয়াল শক্ত, চশমাটা নাকের ডগায় রেখে চশমার উপর থেকে অয়নের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। তার মুখের আকার ইঙিত দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি আদৌ রেগে আছেন কিনা! প্রাপ্তি ভয়ে ভয়ে রুমে প্রবেশ করে ধীর পায়ে অয়নের পাশে এসে দাঁড়ায়। নিচু কন্ঠে বলে,
– স্যার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
– প্রাপ্তি ইসলাম!
– জ্বী স্যার
– তোমার কি মনে হয়? আমি তোমাকে এখানে কেনো ডাকতে পারি?

হেড স্যার মঈনুদ্দিন সাহেবের এমন ধারা প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। বুকটা কাঁপছে, গলাটা আরোও বেশি শুকিয়ে আসলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার। মাথায় সব যেনো তালগোল পাকিয়ে গেছে। শব্দগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। গোঁছাতেও পারছে না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো প্রাপ্তি৷ তার পাজোড়া বরফশীতল হয়ে আসছে। কাঁপা স্বরে বললো,
– জানি না স্যার
– ওহ ভালো, মাঝে মাঝে অজ্ঞাত হয়ে থাকাটা সবচেয়ে ভালো। অজ্ঞাত মানুষের মাথায় চিন্তা থাকে না। সে জানে না তার সামনে কোন বিপদ তাকে গ্রাস করবার জন্য তেড়ে আসছে। ভালো। আমি তোমার গ্রেড দেখছিলাম। খুব ভালো গ্রেড রয়েছে তোমার। দেখলাম গত সেমিস্টারে তোমাকে ডিন এওয়ার্ডের জন্য ও নমিনেট করা হয়েছে। কিন্তু ভালো গ্রেড কি সত্যি ই ভালো?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মঈনুদ্দিন সাহেব। প্রাপ্তি তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে নিজের পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে। তার চোখের ভয়গুলো লোকটাকে দেখাতে চাচ্ছে না। আড়চোখে একবার অয়নকে দেখে নিলো সে। অয়নের মুখে চিন্তার রেশটুকু নেই। সে ভাবলেষীন ভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু বলতে যাবে তখন ই অয়ন বলে উঠলো,
– স্যার আপনার ইইন্টারোগেশনটা কি একটু ফাস্ট করা যায় না? আমার কাজ আছে
– দেখো অয়ন শুধু শুধু যে আমি তোমাকে ইনফ্যাক্ট তোমাদের এখানে ডাকি নি এটা তুমিও জানো। এই ভিডিও ক্লিপটা দেখো। আমাদের ডিপার্মেন্টের ফেসবুক গ্রুপে এ এই ভিডিওটা দেওয়া হয়েছে। শুধু আমাদের নয়, প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের গ্রুপেই দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি একটা ভাইরাল ভিডিও। চেক ইট।

বলেই ফোনটা এগিয়ে দিলেন মঈনুদ্দিন সাহেব। অয়ন ফোনটা হাতে নিয়ে ভিডিওটা অন করতেই তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো। ভিডিওটা এমন এঙ্গেল থেকে করা হয়েছে যে কেউ দেখলে মনে করবে অয়ন এবং প্রাপ্তি অসৌজন্যমূলক কাজে লিপ্ত৷ ভিডিও টা সেই সন্ধ্যার যেই সন্ধ্যায় সে তার আর্ট রুমে একা বসে ছিলো। অয়ন যখন তাকে জোর করে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো তখন এই ভিডিও টা করা। ভিডিওটার লেন্থ মাত্র এক মিনিট ছাব্বিশ সেকেন্ডের। অয়ন ভিডিওটা শেষ হবার পর ফোনটা টেবিলে রাখে। ভাবলেশহীন ভাবে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে,
– এই ভিডিওতে কি প্রমাণ হয় স্যার?
– মানে? কি বলতে চাচ্ছো?
– স্যার ভিডিও টা মিথ্যে সেটা বলবো না, তবে ভিডিওটা যা দেখাচ্ছে সেটা মিথ্যে। এখানে এডিট করা হয়েছে। আমাদের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যেটায় আমরা এমন কোনো কাজ করবো। স্যার আমি যেতে চাচ্ছি। আপনি এই ভিডিও এর কারণে আমাকে ডাকবেন জানলে আমি আসতাম ও না। আমার কথা কখনো বদলাবে না। আর আপনারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিবেন আশা করি।
– তোমার চাকরিটা কিন্তু আমি যখন তখন কেড়ে নিতে পারি অয়ন।
– তাতে আমার কিছুই যায় আসে না স্যার। আমি এমনেও কয়েকদিনের মাঝে রেজিগনেশন লেটারটা জমা দিয়ে দিতাম, আসছি স্যার। তবে প্লিজ যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিবেন।

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অয়ন। মঈনুদ্দিন সাহেবের উত্তরের অপেক্ষা করলো না অয়ন। অয়নের যাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মঈনুদ্দিন সাহেব। তার কপালের শিরাটা দপদপ করছে। প্রাপ্তি সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। মঈনুদ্দিন সাহেব নিচু গলায় প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বললো,
– তোমার বক্তব্য ও কি এক?
– জ্বী স্যার, এই ভিডিও এর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের মাঝে সেকরম কোনো সম্পর্ক নেই।
– তাহলে সন্ধ্যার সময় তোমরা আর্ট রুমে কি করছিলে?

মঈনুদ্দিন সাহেবের প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রাপ্তি। বুকে এক পাহাড় সমান সাহস নিয়ে ধীরে ধীরে সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলতে থাকে সে। তার দৃষ্টি মঈনুদ্দিন সাহেবের মুখের দিকে। তিনি তার কথা কতটুকু বিশ্বাস করছে বুঝতে পারছে না প্রাপ্তি। তবুও সে বলেই যাচ্ছে, কারণ এটাই সত্যি।

করিডোরে এসে একটা সিগারেট মুখে দিলো অয়ন। লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুণটা জ্বালালো সে। সিগারেট জ্বলছে, একের এক সুখটান দিয়ে যাচ্ছে অয়ন। তার কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট। দৃষ্টি বাহিরের দিকে। মাথার শিরাটা দপদপ করছে। রাগে গা রি রি করছে। চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। এতোক্ষণ হেড স্যারের সামনে খুব কষ্টে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করেছে সে। তার এবং প্রাপ্তির রেপোটেশন পুরোই নষ্ট করার জন্য কেউ এমন একটা কাজ করেছে। কিন্তু কথা হলো মানুষটা কে? কে এভাবে একটা মেয়ের রেপোটেশন নষ্ট করতে চায়? কথাটা চিন্তা করতেই প্রাপ্তির মুখটা চোখের সামনে ভাসতে লাগলো অয়নের। না জানি মেয়েটার কি অবস্থা হচ্ছে স্যারের ওখানে। মঈনুদ্দিন নামক ব্যাক্তিটির উপর ভরসা নেই অয়নের। নিজের ডিপার্টমেন্টের রেপোটেশনের জন্য সে প্রাপ্তিকে রাস্টিকেটও করতে পারেন। আবার গার্ডিয়ান ও কল করতে পারেন। অয়নের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ক্লাসে যাবার সময় হয়ে এসেছে, হাতের পঞ্চম সিগারেটটা নিভিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা দিলো সে। প্রাপ্তি নামক মেয়েটিকে মাথা থেকে বের করার চেষ্টা করছে কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটা হচ্ছে না। এখন ক্লাস নিলে যদি এই চিন্তাটা দমে যায়। তার সত্যি কিছু যায় আসার কথা নয়, প্রাপ্তির সাথে তার পরিচয় এক মাস ও হয় নি। কিন্তু তার যায় আসছে, কারণ অজ্ঞাত। কারণটা জানাটা দরকার, নয়তো ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাবে সে। হয়তো তার সূচনাও হয়ে গিয়েছে______________

অয়নদের রুমের ড্রয়িং রুমে বসে রয়েছেন ইসমাইল সাহেব এবং নাসিমা বেগম। তাদের মুখে কোনো কথা নেই। তাদের ঠিক সামনে বসে রয়েছেন নাসির সাহেব এবং শেফালী বেগম। তাদের মুখের রঙ পালটে গিয়েছে। কপালে চিন্তার ভাজ। সব কিছু জানার পর তাদের কথাবলার মুখ অবধি নেই। রাইসা একটা কোনায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না অয়ন এমন একটি কাজ করবে, তাও প্রাপ্তির সাথে। এখন প্রাপ্তির মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করলেও মন টা বসে যাচ্ছে রাইসার। না জানি তার বাবা তাকে কি কি কথা শুনিয়েছে। ইসমাইল সাহেব এবং প্রাপ্তির সম্পর্কটা ভালো নয় তার খুব ভালো করেই জানা আছে রাইসার। হঠাৎ ইসমাইল সাহেব বলে উঠলেন,
– আমাদের মেয়ের তো বাহিরে বের হবার জোগাড় নেই। মানুষ যেভাবে তার দিকে আঙ্গুল উঠাচ্ছে। আত্নহত্যা ব্যাতীত আর কোনো উপায় থাকবে না। আপনারাই ঠিক করুন কি করবেন? কলেজ থেকেও ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে। এর পরে এমন আচারণ করলে তো ওকে হয়তো বের ই করে দিবে। ওর রেজাল্ট ভালো বলে তারা এবার ছেড়ে দিয়েছেন। দেখুন আপনাদের তো মেয়ে নয়, আপনারা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু মেয়েটা তো আমাদের। এই পাঁচদিন বাসা থেকে ওকে বের করছি না। তালি কিন্তু এক হাতে বাজে না নাসির ভাই। এবার আপনারা ঠিক করুন কি করবেন?

ইসমাইল সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। তিনি প্রাপ্তির একটা কথা বিশ্বাস করতে চান নি। যেদিন মঈনুদ্দিন সাহেব তাকে কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছেন সেদিন থেকেই তিনি প্রাপ্তিকে বাড়িতে আটকে রেখেছেন। তার কথা এবারে যেভাবে হোক এই মেয়েকে সে ঘাড় থেকে নামাবেন ই। সেটা সেভাবেই হোক না কেনো? ইসমাইল সাহেবের প্রশ্নটা শুনে কি উত্তর দিবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ভিডিওটা দেখে তার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। এমন অশালীন আচারণ তার ছেলে কিভাবে করতে পারে! কিছু বলতে যাবেন তার আগেই………..

চলবে

[ সরি গল্পটা সঠিক টাইমে দিতে পারি নি। আজ ডাবল পর্ব দেওয়া হবে না। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here