#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৭
খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনার মাঝে ইমাদরা ঠিক করেছিল বাগেরহাটের মংলা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকবে। সে অনুযায়ী মংলা থেকে ২ রাত ৩দিনের শিপ বুকিং করা। যখন ওরা মংলা পৌঁছুলো তখন ভোর। মংলা বাসস্টপের কাছেই ফেরিঘাট। ফেরিঘাট থেকে ট্রলারে করে খানিক দূরে নোঙর করা শিপে পৌঁছে যে যার রুম বুঝে নিলো। রানা ট্যুর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছে। সে নিলয় আর ইমাদকে ডাবলবেড উইদ বাঙ্কার এ্যাকোমোডেশনের একটা রুম দিয়ে বলল, “তোমরা হলে পার্ফেক্ট ফ্যামিলি৷ মাম্মি, ড্যাডি আর খোকা। তাই তোমাদের বাঙ্কার সহ ঘরটা দিলাম।”
নিলয় পুরো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, “কি বললেন রানা ভাই? বাসে আমাদের কি কথা হয়েছিল? ওই বিচ্ছুর সাথে রুম শেয়ার যেন করতে না হয় সেজন্যই তো আমি সিটটা ছাড়লাম।”
“উপায় নেই৷ হুট করে এক্সট্রা কেবিন বুক করা যায় না। সব ফুল। আমরা কেবল আমাদের সংখ্যা গুনে ডাবল বেড এর কয়েকটা কেবিন নিয়েছিলাম। তাও ভাগ্য ভালো এই একটা কেবিনে বাঙ্কার পেয়েছি। তোমরা বেড এ থাকবে, বিচ্ছুটাকে বাঙ্কারে উঠিয়ে দিবে।” রানা বুঝালো।
নিলয় হাত নেড়ে বলল, “এতকিছু বুঝি না ভাই। আমাকে আর ইমাদকে অন্য কেবিন দিন। আপনার রুমমেট। আপনি থাকুন।”
মুবিন কাছেই দাঁড়িয়েছিল। রানা এবং নিলয়ের মধ্যকার এই সূক্ষ ঝামেলায় সে ভয়াবহ খুশি। দুজনেই ওর বর্তমান শত্রু। শত্রুরা নিজেরা নিজেরা কুরুযুদ্ধে নামলে তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ। মুবিন পরিস্থিতির খুব মজা নিয়ে বলল, “চাবি দিন। আমি আমার বাঙ্কারে যাই। আপনারা বসে জুয়া খেলুন। যে হারবে চলে আসুন।”
মুবিন ঠোঁট উল্টে হাসছিল হালকা। নিলয় বলল, “ইমাদ তোর খোকাকে সামলা।”
মুবিন চটে গেল, “না সামলালে কি করবেন?”
নিলয় দিলো ধমক, “এখানেই ফেলে যাব।”
মুবিন লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল,
“আপনি কি জানেন? আপনাকে তুলে শিপ থেকে ফেলে দিতে পারি?”
নিলয় মুবিনের দিকে তাকাল। ইয়া লম্বা, তাগড়া, স্বাস্থ্যবান মুবিনকে দেখে নিলয়ের মনে হলো তার সামনে বাদামী টিশার্ট, সাদা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা মনুষ্যরূপী একটা ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে। সে একবার মিজের দিকেও তাকাল। মা ঠিক বলে, আসলেই ওর আরো খাওয়া দাওয়া করা দরকার৷ কত শুকিয়ে গেছে! এই ষাঁড়টা যদি সত্যি তাকে তুলে ফেলে দেয়? এজন্যই মায়ের কথা কানে তুলতে হয়।
সাঁতার সে জানে, শিপও এখনও ছাড়েনি, পানিও এখানে অতটা গভীরে নয়। কিন্তু, সে না ডুবলেও, পুচকে একটা ছেলে তাকে কোলে তুলে নদীতে ফেললে মান সম্মান তো ডুববেই। নিলয়কে ফ্রিজ হয়ে যেতে দেখে, মুবিনের গরম রক্ত ঠান্ডা হলো৷ সে শিষ বাজাতে বাজাতে রানার হাত থেকে খাবলা দিয়ে চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। দুতলার রুম। জানালা দিয়ে বাইরের নদী আর জঙ্গল দেখা যাবে। বাহ্ দারুণ তো। খানিক বাদে ইমাদ, নিমরাজি রানাকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকল। নিলয় শেষ পর্যন্ত এই কেবিনে থাকতে রাজি হয়নি। রানাকে অগত্যা বাধ্য হয়ে আসতেই হলো। মুবিন বাঙ্কারে পা ঝুলিয়ে বাবলগাম চিবুচ্ছিল। রানাকে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে টিটকারি মারল, “হ্যালো, মাম্মি। ওয়েলকাম টু আওয়ার হ্যাপি ফ্যামিলি।”
রানা টগবগ করে উঠল, “চুপ করো তো, মুবিন৷ বাজে কথা বলবে না।”
“আপনিই তো বাইরে এটাকে আমার ফ্যামিলি কেবিন বলেছিলেন। এখন আমি আপনার খোকা।”
রানা ফুঁসতে ফুঁসতে ইমাদের দিকে তাকাল, “ইমাদ, এসব বলতে তুই ওকে না করবি কিনা বলতো আমাকে?”
ইমাদ কিছু বলার আগেই মুবিন ঝম্প মেরে বাঙ্কার থেকে শীপের ফ্লোরে নামল, “মাম্মি, প্লিজ ড্যাডির সাথে ঝগড়া করো না। আমরা সুন্দর একটা ট্যুরে এসেছি। ড্যাডির কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে ড্যাডিকে জ্বালাবে না।”
রানা বাকহারা! রাগে ওর কান দিয়ে ধোয়া বেরুচ্ছে। ইমাদ নির্বিকার। সে ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে কেবিনের ভেতর থাকা অ্যাটাচ্ড বাথে ঢুকল ফ্রেশ হতে। আর মুবিন আপাতত সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার৷
.
“এক কাপ চা পাওয়া যাবে?” কাদিন বলল মিষ্টি গলায়।
দীপা তাকাল ভ্রু কুঁচকে, হাতের বইটা বন্ধ করে, “তুমি এখনও এখানে কি করছ? সকাল হয়েছে বাসায় যাও। কাল রাতে এসেছ। আমি না করা সত্ত্বেও শাশুড়ি তার কলিজার টুকরা জামাতাকে রেখে দিয়েছেন। চা খেতে মন চাইলে শাশুড়িকে বলবে। নতুবা, নিজে করে খাবে। এই বাসায় আমি রান্না করি না। তোমার শাশুড়িরও বয়স হয়েছে বলে এখন রান্নাঘরে যান না। প্রেশার বেড়ে যায়৷ বুয়া যা রাঁধে তাই খাওয়া হয়। তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমাকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াব তাহলে তোমার ধারণা ভুল। এই বাসায় বাঁচতে হলে তোমাকে বেয়ার গ্রিলস হতে হবে। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড।”
কাদিন বিপদে পড়ে বিড়বিড় করল, “ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড ওম্যান।”
দীপা খেকিয়ে উঠল, “কি বললে তুমি? কি বললে?”
কাদিন বলল, “কিছু না। তেমন কিছু না।”
“না, কিছু একটা তো বলেছ। আমি শুনেছি।”
“কবুল বলেছি, কবুল। আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
“আমার চোখের সামনে থেকে যাও।”
কাদিন সকালের নাস্তা না করেই অফিসে গেল। কপালে জুটল না সমান্য চাও। রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতেও পারেনি। চোখে রাজ্যের ঘুম, পেটে ক্ষুধা আর স্মৃতিতে বিভৎস গতরাতে দীপার নৃশংসতা মনে করে অফিসের এক্সিকিউটিভ চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলো। ঠিকই বলে সবাই, নারী নিষ্ঠুর, নির্মম, নির্দয়। বিশেষ করে দীপার মত সহজ, সরল কোমলমতী নারীরা। গতরাতে দীপা অমন একটা কাজ করতে পারল! সত্যিই দীপা করল! কীভাবে করল? এত বড় শাস্তি তার! সে ফিরে গিয়ে বলেছিল, “তুমি এখান থেকে না গেলে, আমিও যাচ্ছি না।”
দীপা জবাবে বলল, “ভেবে বলছ?”
“আমি এক কথার মানুষ।”
“আমি যদি সারাজীবন এখানে থাকি তুমিও থাকবে?”
“তুমি সারাজীবন এখানে থাকবে না।”
“থাকব।”
“পারবে না।”
“পারব।”
“তোমার মন পুড়বে, তুমিও গলবে।”
“কক্ষনো না।”
“কেন?”
“কারণ তুমি এমন কাউকে ডিজার্ভ করো যে তোমার মতই ম্যাচিউর, পার্ফেক্ট, অ্যাস্থেটিক।”
“আর তুমি কেমন মানুষ ডিজার্ভ করো?”
দীপা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমি এমন একজনকে ডিজার্ভ করি যে আমাকে আমার মতন করে মেনে নিবে। আমাকে বদলাতে চাইবে না। প্রেশারাইজ করবে না। নিঃশ্বাস নিতে দিবে। যার কাছে আমার দমবন্ধ লাগবে না।”
“তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বদলাতে চেয়ে যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে মাফ করে দাও।”
“তুমি তোমার স্ট্যান্ডার্ডের জন্য আমাকে বদলাতে চেয়েছ। আমার ভালোর জন্য নয়।”
“মেনে নিলাম।”
“তোমার মানা না মানা দিয়ে কিছু যায় আসে না।”
“কিসে যায় আসে বলো। সেটাই করব।”
“তুমি চলে যাও।”
“ঘুমাব দীপা। দু চোখ ভেঙে আসছে।” কাদিন ক্লান্ত।
দীপা বিতর্কে উপসংহার ছাড়া ইতি টানল। বিছানার সামনে থেকে সরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। জনমানবশূন্য সুনসান রাস্তা। কাকপক্ষীও নেই, খালি দাঁড়িয়ে আছে হলুদ আলো মাথা নিয়ে ল্যাম্পপোস্ট৷ কাদিনও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “একটা বিছানার চাদর দিবে?”
“বিছানায় চাদর দেয়াই আছে।”
“এটা তুলব।”
“এটা তোলা হবে না। থাকতে হলে এভাবেই থাকো।”
কাদিন শুলো ঠিকই কিন্তু সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। বিছানায় নতুন, ফ্রেশ চাদর না বিছিয়ে নতুন কোথাও গিয়ে সে ঘুমোতে পারে না। দীপা জানে৷ তবু করল এমন? সারারাত ছটফট করে সকালে উঠে নাশতাও করতে পারল না। কাদিন বাইরের কিংবা অন্যকারোর রান্না খেতে পারে না। দীপা জানে। তবু অভুক্ত রাখল! আহ্ নিষ্ঠুর প্রিয়া।
চলবে…