#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৭
অফিসে সাইন দিয়ে ফাইল বন্ধ করতে গিয়ে কাদিন থমকাল, তার মুখ কুঁচকে গেল। পিয়ন কাম দারোয়ানকে ডেকে বলল, “একটা ফ্লুইড কিনে নিয়ে আসুন৷”
পিয়ন ফ্লুইড কিনে আনতে গেলে কাদিন টেবিলের উপর থাকা ফাইলগুলোর দিকে তাকাল। কি করেছে সে! হাত দুটো একত্র করে টেবিলের উপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকাল। প্রতিটা ফাইলে নিজের নাম স্বাক্ষরের বদলে দীপা! দীপা! দীপা! শিট! এখানে দীপার কি আছে? সকালে আসার সময়ও তো দীপা তার সাথে কথা বলেনি। মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিল।
ফ্লুইড পেয়ে ব্লান্ডার করে দেয়া কাজ আবার ঠিক করতে বসল কাদিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীপার সহ্য ক্ষমতা ভালোই। গত রাতে এবং আজ সকালে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার মানে কাদিন সত্যিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। কিন্তু সে ঠিক ইচ্ছে করে এমনটা করে তাও নয়। সে সহজে কিছু ভুলতে পারে না। একবার তাকে কেউ অনুচিত কথা বললে সে রেশ তার মাঝে আজীবন থেকে যায়। সে অনুচিত কিছু করে না। তাই কেউ তার সাথে করলেন সেও মেনে নিতে পারে না। তার সঙ্গে দীপার সম্পর্ক আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতই। মাঝে মাঝে তারচেয়েও বেশি মধুর। কিন্তু যেই মুহূর্তে দীপা আবেগে টইটম্বুর, খুব রোমান্টিক মুডে থাকে তখন তার মনে একটা ঝামেলা বাঁধে। দীপার মুড নষ্ট করার ঝামেলা। দীপা কেন তাকে লুচ্চা বলবে? কেউ তাকে লুচ্চা বলবে এই দিনও তাকে দেখতে হলো! সেই কেউটা আবার অন্য কেউ নয়। বরং তার স্ত্রী! এমনও নয় যে সোহাগ করে বলেছে। এখন তাকে হাজারবার লুচ্চা বললেও সে ক্ষ্যাপত না। যখন ঝামেলা চলছিল তখন কেন বলল? সম্পর্কের গোড়ার দিকে এসব বলা! অবিশ্বাস্য!
.
মুবিন স্কুলে যাবার জন্য রিকশা ডাকতে গেটের সামনে দাঁড়াতেই ইমাদ বারান্দা থেকে তাকে ডাকল। উপর থেকে বলল, “কথা আছে। দুমিনিট।”
মুবিন ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল৷ বলল, “আচ্ছা।” ইমাদ হুড়মুড়িয়ে নীচে নামল, কিন্তু নীচে এসে দেখল মুবিন চলে গেছে। সে আবার মেসে ফিরে যেতেই মুবিন অন্য বিল্ডিংয়ের আড়াল থেকে দাঁত ক্যালিয়ে হাসতে হাসতে বেরুল। কিন্তু ইমাদও কম কিসে? সেও আবার মেস থেকে বের হয়ে মুবিনকে খপ করে ধরে ফেলল। সেও গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল। মুবিনকে সে খুব ভালো করে চেনে। মুবিন থতমত খেয়ে বলল, “কি?”
ইমাদ বলল, “আরে ভাই আসলেই বিপদে আছি আমি। আর তুমি মশকরা করো? কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ।”
মুবিন বলল, “কোথায় মশকরা করলাম? আপনার জন্য কি আমি খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন ঠিক করব? আপনি করেন নাকি?”
ইমাদ সেসবে কান না দিয়ে বলল, “কথা বলবে?”
মুবিন বলল, “আচ্ছা।”
“এটা কোন আচ্ছা? হ্যাঁ, আচ্ছা নাকি না আচ্ছা।”
“কি মনে হয়?”
ইমাদ খানিক ভেবে ইচ্ছে করে বলল, “নাসূচক আচ্ছা।”
এবং মুবিন প্রায় সাথে সাথেই শুধু ইমাদকে ভুল প্রমাণ করতে বলল, “কী অদ্ভুত! এটা হ্যাঁসূচক আচ্ছা।”
.
কাদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে শার্ট খুলতে খুলতে বলল, রাতে একটা দাওয়াত আছে।”
কাদিনের জন্য তিনদিন পর পর বালিশের কভার বদলাতে হয়। এমন না করলে নাকি চুলের ক্ষতি হয়। দীপা বালিশের কভার খুলে নতুন কভার লাগাচ্ছিল। সে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকল। কাদিন তাকিয়ে দেখল এখনও দীপা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর বাথরুম থেকে গলা উঁচিয়ে বলল, “টাওয়াল আনতে ভুলে গেছি।”
দীপা টাওয়াল নিয়ে বাথরুমের দরজায় নক করলে কাদিন দরজা খুলে টাওয়াল সহ দীপার হাত ধরে টেনে বলল, “এসো।”
দীপা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “না যাব না। সেদিন কেন ওমন করেছিলে তুমি? তোমার ইচ্ছাই শেষ কথা না।”
কাদিনও হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে।” সে টাওয়াল নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসে আলমারি খুলে দীপা কোন শাড়িটা পরবে, শাড়ির সাথে কি কি ম্যাচিং করে পরবে সব সময় নিয়ে স্যাট করে গেল দীপাকে ডাকতে। দীপা রিমার সাথে রিমার ঘরে বসে গল্প করছিল। কাদিন রিমার দরজায় নক করে বলল, “আপু আসব?”
রিমা ঠাট্টা করে বলল, “বউকে নিতে এলি? যা ভাই নিয়ে যা তোর বউ।”
কাদিন বলল, “একটা ডিল সাকসেসফুল হওয়ায় বস সব এমপ্লয়িদের ট্রিট দিচ্ছেন। বউসহ দাওয়াত।”
“অবিবাহিতদের কি হবে?”
“প্রেমিকাসহ যেতে চাইলে যাবে।”
“আর প্রেমিকা না থাকলে একা যাবে?”
“সেরকমই। দীপা, তৈরী হও। দেরি হচ্ছে আমাদের।”
দীপা বলল, “আমার তৈরী হতে দশ মিনিট। আমি তৈরী হয়ে বসে থাকত পারব না।”
কাদিন মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এই মেয়ে কি একবার তার দিকে তাকাবেও না? কত সুন্দর কেতাদুরস্ত হয়ে সে তৈরী হয়ে এসেছে! বউই যদি না তাকায় কি লাভ এই টিপটপ থাকার? রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে একশোটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মত গুছানো ছেলে পুরো কুমিল্লা শহরে আর একটা থাকলে সে তার নাম বদলে ফেলবে। আর এই অন্ধ মেয়ে তাকে বলে তৈরী হতে! আর কি তৈরী হবে সে? এতক্ষণ কি তাহলে সে নেচেছে? কাদিন বিরক্তিতে কাঁদা হয়ে বলল, “আমি রেডি।”
দীপা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খুব দ্রুত শাড়ি পরে সেজেগুজে সে বের হয়ে এল। অন্যদিন এসে কাদিনকে জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিকঠাক? তুমি তো এসব ভালো বুঝো। দেখো তো ভালো করে।”
কাদিনও নিখুঁতভাবে তার ফিডব্যাক জানায়। আজ এসবের কিছুই বলল না দীপা। তাই কাদিনই বলল, “এত বড় হ্যান্ডব্যাগ! তুমি ছোটখাটো, পাতলা মানুষ৷ ছোট কোনো হ্যান্ডবাগ নিলে ভালো হয়।”
দীপা ঘরে ফিরে গেল। কাদিনও পিছু পিছু গিয়ে দেখলো দীপা হ্যান্ডব্যাগ উল্টে ব্যাগের সব জিনিসপত্র ড্রেসিংটেবিলে ফেলল। তারপর জরুরি যা কিছু তা ছোট হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে নিলো। ঠোঁটে হাসির ছিঁটা পর্যন্ত নেই। গাল দুটো থমথম করছে। দাওয়াতে গিয়েও এই অবস্থা বহাল রইল। অন্যদিন কাদিন দীপার অনর্থক বেশি কথা বলা, এবং হাসাহাসি করা নিয়ে আতঙ্কিত থাকে। বারবার ইশারায় এটাওটা বুঝিয়ে বলে। আজ যে কথাটুকু না বললেই নয় দীপা ওটুকুও বলতে চাইল না। এমন দীপাকে কাদিন চেনেই না!
.
কড়ি কাপে চা ঢালতে ঢালতে গুনগুন করল, “এখন তো সময় চা খাওয়ার,
চা আর কড়ির কাছে আসার।
চা যে একা, আমিও যে একা
লাগে যে ভালো,
ও চা… ও চা….
মহানন্দে সে কাপ নিয়ে আয়েশ করে বসল। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। সবটা মন দিয়ে সে চায়ে চুমুক দিলো। এই সময়ের নাম চায়ের সময়। চা পান করার সময়টা সে যতটা পারে দীর্ঘ করে। তবে আজ খুব দ্রুত ইতি টানতে হলো। কারণ ইমাদের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে, “মুবিন কথা বলবে। ওর নাম্বার ০১*********। কাইন্ডলি কল হিম।”
কড়ি দেরি করল না। চা বাদ রেখে সে সাথে সাথে মুবিনকে কল করল। দেরি করা ঠিক হবে না। ছেলেটা মত পাল্টে ফেলার আগেই তার সাথে খাতির জমাতে হবে।
মুবিন আইপ্যাডটা স্তূপীকৃত তার নামকাওয়াস্তে টেবিলে সাজিয়ে রাখা গাইড বইগুলোর উপর হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে হাতে বার্গার নিয়ে বসল। বার্গারে মস্ত বড় বড় কামড় বসিয়ে সে অ্যানিমেটেড ইংরেজী সিনেমা দেখছে। এরমাঝে মোবাইল বেজে উঠায় সে মোবাইল বন্ধ করে ছুড়ে ফেলে আইপ্যাডে ফিরে এল। পুরো সিনেমা দেখা শেষ করে সে আবার পেস্ট্রি খেল। তারপর যখন তার মন চাইল তখন মোবাইল খুলে সেই নাম্বারটায় কল করে বড়দের মত বলল, “কাকে চান?”
কড়িও বলল, “আমি মুবিন সাহেবকে চাইছি।”
মুবিনের বড় হতে ইচ্ছে করে। অনেক বড়। কড়ি তাকে ত্রিশ সেকেন্ডে ছোট্ট মুবিন থেকে মুবিন সাহেব করে দিলো। মুবিনের মনে হলো ইমাদ স্যারের গার্লফ্রেন্ডকে কিছু সময় দেয়াই যায়।
চলবে…
বি.দ্র. আমার পাঠকদের বহুল প্রতীক্ষিত উপন্যাস “একটুখানি” বইটির প্রি-অর্ডার চলছে। প্রি-অর্ডার সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জানতে নীচের লিঙ্কে ঘুরে আসুন।💘
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1127224604700136&id=100022378217757