একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৫৪

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৪
সুহাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ইমাদ সাইকেলটা একটা সাইড করে রাখল। কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে রইল। কত বয়স হবে মুবিনের? এক ক্লাসে দুইবার পড়লেও ষোলো সতেরোর বেশি বয়স হবে না। মিলা অবহেলিত-উপেক্ষিত ছিল বলে তার দুঃখ হতো। অথচ, মুবিনকে ঘুণপোকারা খেয়ে ফেলছে। মিলাকে নিয়ে চিন্তা নেই। মিলা খুব ভালো করবে, একদিন ভালো থাকবেই। কিন্তু তছনছ হয়েছে মুবিন। মুবিনকে সে বুঝেনি, কেউ বুঝেও না। ইমাদ অনেক চিন্তা করল। যদি কিছু একটা করতে পারত ওর জন্য! সেখানে দাঁড়িয়েই সে একটা মেসেজ লিখল। মেসেজে লেখা “এইবার সত্যিই খুব জরুরি কথা।” প্রাপক কড়ি।

সুহা জানালা দিয়ে দেখল ইমাদ স্যার এখনও তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। এখনও যাননি৷ বাসায় এনে এক কাপ চা খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। কতবার বলল সে, ইমাদ স্যার এলেন না। সুহাও কম না। চট করে চা বানাতে চলে গেল সে। রান্নাঘরে গিয়ে চা করল। চায়ের কাপ হাতে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল ইমাদ স্যার নেই। বিড়বিড় করল, “হুম অদৃশ্যমানব!”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাসায় ফিরে গেল। ধরে নিলো, সে চা পান করা যে কথা, ইমাদ স্যার পান করাও একই কথা। সে কি আলাদা নাকি! মন থেকে সে এখন ইমাদ স্যারের সাথে মিলেমিশে একাকার। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসতে হাসতে বাসার সিঁড়িতে গরম চা ফেলল। তারপর সে চায়ে পিছলে পড়ে আবার ব্যথা পেল। কাপ ভাঙল, মা উপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল। তবুও সে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। আজ খুশি খুশি দিন। ইমাদ স্যার তাকে নিয়ে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ কিনেছে। তারপর নিজ হাতে সেঁটে দিতে দিতে তার দিকে তাকিয়েছে। সেও ইমাদ স্যারের দিকেই তাকিয়েছিল। তিনি তাকাতেই অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলেছিল। তিনি শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “বাসা কোথায়?”
উত্তর দেবার বাহানায় সে সুযোগ পেয়ে গেল। সুযোগ হাতছাড়া না করে কিশোরীর চঞ্চল চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে ঠিকানা বলল। তিনি হঠাৎ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা একটি পাউরুটির প্যাকেট আর কলা তুলে সুহার হাতে দিলো। সুহা বলল, “না, না লাগবে না।”
তিনি শুধু তাকালেন, কিছু বললেন না। সেও বুঝল তিনি তাহলে সত্যি সত্যি কথা কম বলেন৷ আরো জানতে চায় সে। আরো, আরো এবং আরো৷
পরে তিনি আরো বললেন, “তোমার সাথে আসছি।” তিনি রিকশাও ডাকলেন। সুহা আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল। কী হচ্ছিল তার সাথে? ইমাদ স্যার পথ চলতে সঙ্গী হবেন? একটা ঘোরের মাঝে সে রিকশায় উঠল, কিন্তু হায় ইমাদ স্যার ভেতর থেকে সাইকেল নিয়ে এলেন! সে ফুঁস হয়ে গেল। এক রিকশায় এলে কি এমন হতো? সে নাহয় একটু শান্তি পেত, আরেকটু অস্থির হতো।
.
অফিসের কাজ করতে করতে কাদিনের মাথাটা ধরে গিয়েছিল। তাই ডেস্কের চেয়ারটা টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। দীপা ঘরে বসে তার নিজের পড়া পড়ছিল। সে বই বন্ধ করে এসে বারান্দায় উঁকি দিয়ে বলল, “কি হয়েছে?”
কাদিন কপালে হাত রেখে বলল, “মাথা ব্যথা।”
দীপা ঘাড় দুলিয়ে বলল, “ম্যাসাজ করে দিব?”
কাদিন বলল, “না।”
“চলে যাবে।”
“এসব অভ্যাস হয়ে যায়।”
“তাহলে একটা আদা দিই। চিবিয়ো। সাথে সাথে মাথা ব্যথা চলে যাবে।”
কাদিন নাকে হাত চেপে ধরে বলল, “অসম্ভব, আমি এখনি গন্ধ পাচ্ছি।”
দীপা শশব্যস্ত হয়ে বলল, “তাহলে লবঙ্গ একটা তাওয়ায় গরম করে এনে দিই। রুমালে রেখে ঘ্রাণ নিবে।”
“লাগবে না। তুমি বসো।”
দীপা ঠাট্টা করে বলল, “ভয় পেও না আমার রুমাল দিব না, বাবু।”
কাদিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আগে কায়েস বিরক্ত করত এখন তুমিও।”
দীপা কাদিনের মুখটা ধরে বলল, “তোমাকে নিয়ে কোথায় যাই বলো। চা- কফিও তো খাও না। সবকিছুতে তোমার অভ্যাস হয়ে যাবে এই এক ভয়।”
কাদিন দীপার হাত সরিয়ে বলল, “গুনী স্বামী পেয়েছ। কদর করো। গিয়ে নিজের বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করো। বরের জন্য চা- নাশতা বানাতে বানাতে দিন ফুরোয় ওদের।”
দীপাও ক্যাটক্যাট করে বলল, “আর আমার দিন ফুরোয় তোমার ঘর পরিষ্কার করতে করতে।”
কাদিন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, “কথা বলে বলে আরো মাথা ব্যথা করে ফেলছ।”
দীপা কোমরে হাত রেখে বলল, “যত দোষ দীপা ঘোষ।”
কাদিন চুপ হয়ে গেল। দীপা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে অন্তত পানি খাও। পানি খেলেও মাথা ব্যথা কমে।”
কাদিন বলল, “তুমি চুপ করে বসলেই আমার মাথা ব্যথা কমবে৷ চুপ করো।”
দীপা থমথম করে উঠল। বারান্দায় নীরবতার হৈ হৈ। আর একটাও কথা না বলে সে ঘরে চলে যাচ্ছিল। কাদিন চোখ বন্ধ করে আছে। তার চোখে পড়বে না বলে দীপা কিছুটা গিয়ে থেমে দাঁড়াল। ফ্লোরের সাথে পা ঘঁষে ঘঁষে শব্দ তুলে যেতে যেতে কাদিনকে চোখ খুলবার কারণ তৈরী করে দিলো। পায়ের শব্দে কাদিন বুঝল দীপা চলে যাচ্ছে। চোখ খুলে বলল, “চলে যাচ্ছ যে?”
দীপা খুবই বিরক্ত হয়েছে ভান করে বলল, “আহা তোমার জন্য আমি একটু পড়াশুনাও করতে পারব না নাকি?”
“চুপ করতে বললাম সেটা শুনলে, রাগ করলে। অথচ, চুপ করে যে আমার পাশে একটু বসতে বললাম সেটা কানে গেল না, ভালো লাগল না।” কাদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
দীপা হেসে ফেলল। বলল, “তাহলে ঠিক আছে।”
“চেয়ার নিয়ে এসো যাও।”
“চেয়ার লাগবে কেন?” বলতে বলতে দীপা কাদিনের গলা জড়িয়ে ধরে তার কোলে বসে পড়ল৷ কাদিন দীপাকে ধরতে গিয়েও ধরল না। হাত গুটিয়ে নিয়ে আচমকা রেগে গেল, “বললাম মাথা ব্যথা।” দীপাকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো। দীপার খুব গায়ে লাগল, “কাদিন, তোমার সমস্যা কি?”
“কয়বার বলব মাথা ব্যথা?”
শক্ত গলায় কথা বলা দীপার দ্বারা হয় না। তার কণ্ঠ ভিজে এল। কষ্ট পেয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে তোমার সমস্যা কি সেটা বলো।”
“তোমাকে বললাম চুপ করো।”
“তুমি খুবই ডমিনেটিং কাদিন৷ সবসময় তোমার কথামত কেন চলতে হবে?” দীপার কণ্ঠ নড়বড়ে।
“ঠিক আছে। কিছু বলব না।”
“তোমার যখন ইচ্ছে কাছে আসবে। অথচ, আমি এলে তুমি আমাকে এভাবে অপমানিত করো। সবসময়।”
কাদিন কিছু বলবার প্রয়োজন মনে করল না। তাই দীপাও বলল, “আমি আর থাকব না।”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here