#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫১
শিল্পীর দৃষ্টি অনুসরণ করে যাকারিয়া উচ্চতায় লম্বা, নাদুসনুদুস একদম কম বয়সী একটা ছেলেকে পাশের টেবিলে বসে থাকতে দেখল। ছেলেটা অনবরত পা নাচাচ্ছে। যাকারিয়া শিল্পীকে বলল, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?”
শিল্পী কিছু বলার আগেই মুবিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শিল্পীদের টেবিলের সামনে দাঁড়াল। যাকারিয়াকে বলল, “আমি দুটো বারবিকিউ স্যান্ডউইচ খেয়েছি। সাথে একটা মিল্ক শ্যাক। বিল পে করে দিন।”
যাকারিয়া হা হয়ে তাকিয়ে রইল, “আমি কেন তোমার বিল পে করব?”
মুবিন একগাল হেসে বলল, “মাগনা কেউ বাপ ডাকে না।”
শিল্পী ধমকে উঠে বলল, “বিহেভ ইউরসেল্ফ, মুবিন।”
মুবিন শিল্পীর দিকে তাকালোও না। সে যাকারিয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে শীতল হাসি বজায় রাখল। বলল, “কনগ্রাচুলেশন্স টু বোউথ অফ ইউ।”
মুবিন গটগট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। ডানে বায়ে তাকিয়ে কোন পথে যাবে ভাবল। একবার কি মিলার কাছে যাবে? মিলাকে বলবে মাও বাবার মতন? দুজনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। মাও তাদের কথা ভাবেননি? না, না মিলার কাছে যাওয়া যাবে না। মিলা তাকে বুঝে? মিলার কাছে সে মিলার সুখশান্তিতে ভাগ বসানো দৈত্য ছাড়া বেশি কিছু তো না। রাস্তায় মানুষের মাথা গুনতে বসলে তারা গুনবার দশা হয়। অথচ, দুটো কথা রাখা যায় এমন একটা মানুষের আকাল পড়েছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সুপারশপ চোখে পড়ল মুবিনের। কয়েক বছর আগেও কুমিল্লায় সুপারশপ ছিল বিরল। এখন অভাব নেই। সুপার শপটিতে প্রবেশ করবার আগে মানুষজন টোকেন নিয়ে শপিংব্যাগ গার্ডের কাছে রেখে যাচ্ছে। গার্ডটি নির্দিষ্ট টোকেনের মালামাল নির্দিষ্ট লকারেই রাখছেন৷ ক্রেতারা ফিরে এলে টোকেন দেখিয়ে নিজের জিনিসপাতি বুঝে ফেরত নিচ্ছেন। বিশ্বস্ত জায়গা। মুবিনের খুব ইচ্ছা গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কথা রাখেন? তাহলে একটা টোকেন দিন৷ আমার কিছু কথা আছে। আপনাকে বলি।”
.
ভোরে কাদিন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে৷ ভোরের বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী৷ দীপা উঠে দেরি করে। সকালের ঘুম তার খুব প্রিয়৷ শীতল বাতাস গায়ে মেখে কাদিন দালান ও বাড়ির গেইটের মাঝে থাকা ছোট পথটায় পকেটে হাত রেখে হাঁটছিল। কয়েকটা রঙ্গন গাছ পাশে দাঁড়িয়ে। নাম জানা কোনো পাখি চেনা ডাকে ডাকছে। পাশের বাড়িতে কোনো এক সুরেলা কণ্ঠী গানের রেওয়াজ ধরেছে। হারমোনিয়ামের সুরের সাথে কণ্ঠ দুলছে। গাইছে,
“আমার গানের মালা
আমি করবো কারে দান
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান ।”
কাদিনের ঠোঁটে ম্লান হাসি, মনে সূক্ষ অভিমান। তবুও গান শুনে নিজেকে ধরে রাখত পারল না সে। বাসায় গিয়ে দীপাকে ডেকে তুলল। দীপা ঘুমে ঢুলে ঢুলে বলল, “আমি ঘুমাব, আমি ঘুমাব।”
কাদিন বলল, “না, চলো বাইরে হাঁটি।”
“না।” দীপা আবার শুয়ে পড়ল। কাদিন আদুরে গলায় ডেকে বলল, “আরে চলো না৷ পাশের বাসার মেয়েটা গান গাইছে। দুজনে গান শুনব।”
পাশের বাসার মেয়ের কথা শুনে দীপা চোখ খুলল। উঠে বসে বলল, “চলো।”
ব্রাশ করে, চোখে মুখে পানি দিয়ে কাদিনের সাথে চলল সে। মেয়েটা অন্য আরেকটা গান ধরেছে,
“ছিল মন তোমারই প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম জনম গেল বিরহ শোকে
বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে”
কাদিন হাঁটতে হাঁটতে দীপার হাতটা ধরল, “কী সুন্দর গায় শুনলে?”
দীপা কাদিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রতিদিন গায়?”
“হ্যাঁ, প্রতিদিন।” কাদিন তাকিয়ে আছে ডালে ঝুলে থাকা একটা রূপসী লালচে পাতার দিকে। দীপা হঠাৎ কাদিনের হাত টেনে ধরল, “ঘরে চলুন।”
“মাত্রই তো এলাম।”
“চলুন।”
“আরে কি হলো?”
“আপনি আর এখানে হাঁটবেন না। হাঁটতে হলে বাইরে যাবেন।”
কাদিন তাকিয়ে দেখল দীপার ভ্রু কুঁচকে আছে। প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে তোমার?”
দীপা ঝাড়ি মেরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “কি হবে আমার?”
কাদিন বলল, “আমি মেয়েটাকে চিনিও না।”
দীপা বলল, “চেনার বোধহয় শখ আছে! প্রতিদিন গান শুনতে চলে আসে! রুনা লায়লার প্রতিবেশী উনি।”
কাদিন দীপার নাক টেনে বলল, “কি কিউট তুমি!”
দীপা রেগেমেগে চলে এল। কাদিন পেছনে পেছনে এসে বলল, “আচ্ছা যাও আর এখানে হাঁটব না। পার্ক থেকে ঘুরে আসব।”
দীপা সিঁড়িতেই ঘুরে কাদিনের গলা জড়িয়ে ধরল, “আর এই মেয়ের গান শুনবেন না।”
কাদিন বলল, “শুনব না।”
দীপা গলা ছেড়ে কাদিনের বাহু ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, “আপনি অনেক ভালো।”
কাদিন হাসল, কিছু বলল না। দীপা বলল, “কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যান।”
কাদিন এখনও চুপ।
.
শার্ট থেকে সসের দাগ ইমাদ তুলতে পেরেছে। আধভেজা ইমাদ সাদা ফকফকা ভেজা শার্টটা বারান্দায় ঝুলিয়ে এসে ঘরে বসল। তারপর প্রায় সাথে সাথে আবার উঠে বারান্দায় গেল। বারান্দায় শুকোতে দেরি হবে এবং মুবিন সুযোগে কিছু করবে ভয়ে দড়ি থেকে শার্টটা নামিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেল সে। চুলার উপর ঝুলে থাকা রসিতে কাপড় শুকাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ না শার্টটা শুকাল সে এক পাও নড়ল না৷ বাড়িয়ে দেয়া আগুনের আঁচে শার্ট শুকাতে বেশিক্ষণ লাগল না। শার্ট শুকিয়ে যেতেই ঘরে এনে ইস্ত্রি করল। তারপর ভাঁজ করে তুলে রাখল। এই শার্ট আর কোনোদিন পরবে না সে। যদি নষ্ট হয়ে যায়! মনে মনে সে মরেই যাবে!
শার্ট ভাঁজ করে রেখে কড়িকে একটা কল করল। ধরলে বোনাস না ধরলেও ক্ষতি নেই। কড়ির ঠান্ডা লেগেছে। গলা বসে গেছে। ধরা গলায় সে মোবাইল কানে চেপে ধরে বলল, “জরুরি কিছু হলে বলুন।”
“আচ্ছা।” ইমাদ কল কেটে দিলো। জরুরি কিছু তো নয়। কি কথা বলবে সে?
তবে কড়ি কলব্যাক করল, “ঠিক আছে। প্রথম ও শেষবারের মতন অজরুরী কথা বলে ফেলুন।”
ইমাদ নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, “আপনার কণ্ঠ শোনার তেষ্টা পেয়েছিল।”
কড়ি কলের ওপাশে নখ খুটতে খুটতে বলল, “আপনি এর আগে কখনো প্রেম করেছেন?”
ইমাদ বলল, “জেনে কি করবেন?”
“ঠিক আছে বলতে হবে না। আপনার কি মন খারাপ?”
ইমাদ বলল, “আপনার মন খারাপ।”
কড়ি হেসে বলল, “আমি যদি আপনাকে এখন আমার মন খারাপের কারণটা বলি আপনি কি ভেবে নিবেন আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?”
“জি ভাবব।”
কড়ি নিঃশব্দে হাসল, “মন খারাপে কারণ শুনবেন না?”
“শুনব।”
“কিন্তু আমি তো এখন আর বলব না।”
“আচ্ছা।”
“আপনি খুবই সৎ।”
“আচ্ছা।”
“আমার মন খারাপের কারণ শুনতে আপনি মিথ্যের আশ্রয় নেননি। আপনি একজন সৎ মানুষ৷ আপনার সঙ্গে আমার আগে দেখা হলে আমি সম্ভবত আপনার প্রেমেই পড়তাম।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “রাখি?”
“আচ্ছা।”
“এই আচ্ছার অর্থ কি রাখুন নাকি ইচ্ছে হয় না?”
ইমাদ উত্তর দিলো, “রাখতে ইচ্ছে হয় না।”
“আমার ইচ্ছে আমায় ঠকিয়েছে। তাই ইচ্ছেরা এখন মূল্যহীন।” কড়ি কল কেটে দিলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
বি.দ্রঃ আমার আম্মুর ডিফিউজ প্যারেনকাইমাল লাং ডিজিজ। আসন্ন বইমেলার পাণ্ডুলিপি, নিজের পরীক্ষা, টার্ম পেপার এবং আম্মুর অসুস্থতায় হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে একটি অক্ষরও লেখার সময় কিংবা মানসিকতা দুটোর একটাও হয়নি। আবার শুরু করলাম৷ আল্লাহ চাহে তো ভালোভাবেই শেষ করব। আমি তাড়াহুড়ো করে উপন্যাসের বারোটা বাজাতে চাইনি৷ আপনাদের ভালো এবং প্রিয় কিছু উপহার দিতেই সময় নিলাম। আমার আম্মুর জন্য প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ সবাই দোয়া করবেন। ভালোবাসা। 💙