একা_তারা_গুনতে_নেই — লামইয়া চৌধুরী। পর্বঃ ৪৩

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৩
দীপা ইমাদ আর নিলয় প্রথমে গেল লুতু ভূঁঞা জুয়েলার্সে। সেখানে গিয়ে দীপা অনেকগুলো দারুণ দারুণ পুরোনো গয়না বের করল। তারপর সেগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়ার অর্ডার দিয়ে তিনজনে গেল পাশের ডায়না হোটেলে। হালিম অর্ডার করে একটা টেবিলে বসল ওরা। নিলয় বলল, “বাপরে! কি ভারি ভারি গয়না!”
দীপা মন খারাপ করে বলল, “হ্যাঁরে সব আমার শাশুড়ির। এগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়তে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে।”
“তাহলে ভাঙছিস কেন? আমি তো ভাবলাম তোর নতুন ডিজাইন লাগবে।”
“তোর আমাকে এমন মনে হয়?”
নিলয় বলল, “কেঁদে ফেলছিস নাকি? মারে মা মাফ কর। তুই এমন না। তুই ঐ বংশের সবচেয়ে লক্ষী বউ।”
দীপা বেজায় মন খারাপ নিয়ে বলল, “কড়ির ভাগেরগুলো নিয়ে ঐ হারামি পালিয়ে যাওয়ার পর কড়ি নিরুপায় হয়ে ওর দুই ভাইয়ের ভাগেরগুলোও লুকিয়ে ফেলেছিল। রিমা ভাবিরগুলো উনার কাছেই ছিল। তাই সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাকিগুলো? চোর সব না নিয়ে শুধু ওরটা নিলে তো সমস্যা। ও ধরা পড়ে যেত না? তাই এখন আমাকে কাদিনের ভাগেরগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বলেছে যেন এগুলো ভেঙে নতুন গয়না গড়ে বলি আমার বাপের বাড়ির গয়না এসব। নাহয় সব ফাঁস হয়ে যাবে।”
ইমাদ টেবিলের উপর রাখা লবণদানিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওটার নকশা দেখছিল। নকশা দেখতে দেখতেই কারো দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “তার মানে তোর বরও জানে না এসব?”
“না। কড়ি ওয়াদা নিয়েছে। কাউকে কিছু বলা যাবে না।”
ইমাদ মনে মনে হাসল। ওহ এই তাহলে দীপাকে বিয়ে করিয়ে নেবার পেছনে কড়ির মূল উদ্দেশ্য! বিশ্বস্ত ভাবি হলেই শুধুমাত্র এই গয়নাগুলো এভাবে বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব। অন্যথায়….! কড়ি মেয়ে বটে একটা! এক পিস। ইমাদ মনে মনে তিনবার মারাহাবা বলল। মাশাআল্লাহ বলতেও ভুলল না।
.
মুবিন দু’তলার করিডোরে একা দাঁড়িয়ে চিঠিটা আবার পড়ল। পড়তে পড়তে মুচকি হাসল। একটা চড়ুই লাফিয়ে এলো। ওকে আর একা থাকতে দিলো না। চড়ুইটাকে সঙ্গে নিয়ে রেলিং এ সে হেলান দিলো। এরপর ডুবে গেল ভাবনায়। চারিদিকে ঘণ্টা বাজার ঢং ঢং শব্দ। ক্লাস শুরু হবার সংকেত। মুবিন রেলিং ছেড়ে ক্লাসে গেল। ইশারায় মিলাকে কাছে ডাকল। মিলা অবাক হয়ে উঠে এলো, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
মুবিন মিলার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “ক্লাসের সব ছেলেরা যে আমায় প্রচন্ড ভয় পায় তা কি তুই জানিস?”
“এটা কেমন প্রশ্ন?”
মুবিন এবার খেঁকিয়ে উঠল, “জানিস কিনা?”
মিলা মুবিনের চেহারা পড়বার চেষ্টা করল, ব্যর্থ হলো এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “হ্যাঁ জানি। সব ছেলেরা তোকে ভয় পায়।”
মুবিন আবারো বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল, “আর মেয়েরা?”
মিলা চমকে উঠে ভাইয়ের দিকে তাকাল, “মুবিন?”
“কি?”
“কার কথা বলছিস তুই? লুকাস না। কি শুরু হয়েছে সত্যি করে বল।”
মুবিন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল, মাথা দুলাল তারপর বলল, “বল না সবাই কি আমাকে ভয় পায়?”
মিলা ভ্রু কুঁচকে বলল, “বেশিরভাগ’ই। এ ক্লাসের কেন এই স্কুলের একটা মেয়েও তোর দ্বারা পটবে না। সবাই জানে তুই মারামারি করে বেড়াস। মেয়েরা ভালো ছেলে পছন্দ করে।”
মুবিন বলল, “ঘণ্টা! মেয়েরা ব্যাড বয়দের পছন্দ করে।”
“সব মেয়েরা না।”
“কোন মেয়েরা করে? যাঁরা বেশি সাহসী তাঁরা?”
মিলা বিরক্ত হয়ে বলল, “ধ্যাত! তোর সাথে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট! আমি কি এসবে পিএইচডি করে রেখেছি নাকি? স্যার আসছেন আমি যাই।”
মিলা গিয়ে নিজের বেঞ্চে বসল। মুবিন মুখের পুরোনো চুইংগামটা জানালা দিয়ে থু করে ফেলল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মিলার পেছনে বসা সুহার দিকে তাকাল। সুহা মিলার অগোচরে লুকিয়ে লুকিয়ে মিলার সাদা ওড়নায় কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে আর মিটিমিটি হাসছে। মুবিনে ওদিকে তাকিয়ে হাসল।
ছুটির পর মিলা কখনো দাঁড়ায় না। খুব দ্রুত বাসায় চলে যায়। তাই মুবিন ছুটি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ছুটির পর সুহা স্কুলের মাঠে তার অন্য বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। মুবিন এসে ওদের পাশে দাঁড়াতেই সব ক’টা মেয়ে ভড়কে গেল। এই ছেলেটা ছেলেদের সাথে মারামারি করে, স্যার ম্যাডামদের সাথে বেয়াদবি করে। সবসময়! তবে যা কখনো করে না তা হলো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা। এমনকি নিজের বোন মিলার সাথেও স্কুলের সময়ে কখনো তাকে বেশি একটা কথা বলতে দেখা যায়নি। তবুও সব মেয়েরা ওকে মোটামুটি ভয় পায়। মুবিন বলল, “হ্যালো, সুহা।”
বাকি মেয়েরা এতক্ষণে হালকা হলেও স্বাভাবিক হলো। মুবিন মিলার ভাই তাই সুহার সাথে কথা থাকতেই পারে।
সুহা বলল, “কি দরকার?”
মুবিন খসখসে গলায় বলল, “আমি জানতাম না আমাদের প্র্যাক্টিকেল খাতা সাইন করবার ডেইট আগামী সপ্তাহে। আমি হৃদয়ের প্র্যাক্টিকেল খাতাটা করে দিতে চাই।”
সুহা মেজাজ দেখিয়ে বলল, “হ্যাঁ, তোমার উচিতও।”
“কিন্তু কীভাবে করব?”
সুহা ধমকাল, “কীভাবে করবে মানে? হাত দিয়ে করবে।”
অন্য মেয়েরা সবাই থ বনে গেল। সুহা এগুলো কি করছে? এই ভয়ঙ্কর ছেলেটার সাথে এভাবে কথা বলছে! শাসিয়ে, শাসিয়ে!
মুবিন আমতা আমতা করে বলল, “আমি ত নিজেরটাও করিনি। আমারটা মিলা করে দেয়। আমার কাছে পুরোনো কোনো প্র্যাক্টিকেল খাতাও নেই। না আছে প্র্যাক্টিকেল বই। আমার কোনো বন্ধুও নেই যার কাছ থেকে এসব চেয়ে নিব।”
“মিলারটা দেখে করে দাও।
মুবিন শ্লেষাত্মক গলায় বলল, “ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখো আমাকে ওর খাতাটা দিবে কিনা। আমার গল্পের বইগুলো চুরি করে নিয়ে তোমাকে ঠিকই দিতে পারে। কিন্তু ওর বই, প্র্যাক্টিকেল খাতা এসব আমাকে ছুঁতেও দেয় না। তুমি তো জানোই। তোমাকে দেয় নাকি?”
সুহা বলল, “না, তা দেয় না। বইখাতা ওর বয়ফ্রেন্ড। এসব নিয়ে ও যথেষ্ট পজেসিভ।”
মুবিন বলল, “আমি এখন কি করব? আচ্ছা এক কাজ করা যায় দোকান থেকে করিয়ে আনি।”
সুহা বলল, “খবরদার! নিজে করবে। টাকার গরম দেখিয়ে প্রায়শ্চিত্ত হয় না।”
মুবিন কাঁধ নাচিয়ে বলল, “আর কি করব আমি?”
সুহা বলল, “আমি কি করব সেটা বলো।”
“তোমার তো অনেক বন্ধুবান্ধব কারো কাছ থেকে নিয়ে দাও।” সুহা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “আমার খাতাগুলো দিচ্ছি। ওগুলো দেখে করো।”
মুবিন বলল, “না তোমার খাতা নেব না।”
সুহা অবাক হলো, “কেন?”
“আমার ইচ্ছা। অন্য কারোটা কালেক্ট করে দাও।”
সুহা এবারে নরম হলো। বলল, “কেন নেবে না? নাও। রাগ করেছ নাকি? আমি তো তোমাকে প্রথমে অনেক অনেক ভালো চিঠি লিখেছি। বুঝিয়ে চিঠি লিখেছি। তুমিই তো ওসব পাত্তা দাওনি। তাই অবশেষে রেগেমেগে একটা চিঠি লিখলাম। দেখলে তো? এখন ঠিকই শুনলে। সোজা আঙুলে ঘি কখনোই উঠে না।”
মুবিন কর্কশভাবে প্রশ্ন করল, “কখন?”
“তোমার গল্পের বইগুলো পড়ে ফেরত দেবার সময় প্রতিটার মাঝে একটা করে চিঠি দিয়েছি। তুমি কি একটাও দেখোনি?”
“ওহ। না দেখিনি।”
“তাই বলো। আচ্ছা শুনো প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো আমি কালকে স্কুলে আসার সময় নিয়ে আসব।”
“ঠিক আছে।” মুবিন হনহন করে হেঁটে চলে গেল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here