#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৫
কড়ির শেষ ঘোড়াটা ইমাদ তার নৌকা দিয়ে ঠেলে ফেলল।
মেহেদী পিনপতন নীরবতাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে সিটি বাজিয়ে উঠল। নিলয় গলার কাছে হাত রেখে জিহ্বা বের করে মরে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “হায়হায় ইস কামবাখাতনে বেয়াইন সাহেবাকো মারডালা।”
কড়ির রাজা ছাড়া আর কোনো গুটি অবশিষ্ট নেই। সে ইমাদের গুটিগুলো এক পলক দেখে নিলো। রাজা, রাণী আর নৌকো। চিন্তিত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে তার পরবর্তী চালটা চালল সে। ইমাদ তার রাণীকে কয়েক ঘর কোণাকুণি সরাল। কড়ির রাজাকে আবারো ইমাদের রাণী আর নৌকার আক্রমণ থেকে পালাতে হলো। রিমা টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাবার বোর্ডে ঝুঁকে দেখল পরের চালেই কড়ির চেকমেট হয়ে যাবে। ইমাদ খুব ধীরে সুস্থে তার রাণীর চাল চালল। কড়ির হাতে দুটো চাল আছে। কিন্তু দুটোর একটাও সে চালতে পারছে না। কারণ কড়ি যে দুইদিকে যেতে পারছে তার একদিকে ইমাদের নৌকা ঐ ঘরগুলো দখল করে আছে। আর অন্যদিকে চাল চাললে ইমাদের রাণীর চেকের কারণে সে সেই ঘরটিতেও যেতে পারছে না। এদিকে তার উপর এখন কোনো চেকও নেই। ব্যস হয়ে গেল স্টেলমেট। কড়ির ঠোঁট হেসে বলল, “ইট’স ড্র।”
ইমাদ হকচকিয়ে উঠল, “ড্র?”
নিলয় এবার দু’হাতে তালি বাজাতে বাজাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওয়েহোয়ে বেয়াইনসাহেবা হামকো মারডালা।”
কড়ি সবার সামনেই ইমাদকে হাসতে হাসতে চোখ মেরে বলল, “জি বেয়াই সাহেব ড্র হয়ে গেল। আপনি জিতে গিয়ে ইমপ্রেস করতে পারলেন না। আর না পারলেন বেয়াইনের কাছে হেরে গিয়ে তাকে ইমপ্রেস করতে।”
রিমা মজা করে বলল, “অনেক আগে আমাদের গ্রামে একবার উত্তরপাড়ায় দাবা খেলা নিয়ে ঝগড়া করে মাথা ফাঁটাফাঁটি পর্যন্ত হয়ে গেল। এখন আবার তোমরা শুরু করো না যেন। বিয়ে বাড়ি মনে রেখো, বাচ্চারা। পরে গ্রামবাসী বরপক্ষ আর কনেপক্ষের ঝগড়ার ঘটনা পুরো ইউনিয়নে ছড়িয়ে দিবে। হা হা হা। ”
ইমাদ কড়ির রাজা হাতের আঙুলে চেপে ধরে নিঃস্পৃহ গলায় বলল, “আমি তো আর আমার গুটির রাজা ছিলাম না। রাজা ছিলাম বেয়াইন সাহেবার সৈন্যদলের। বেয়াইন সাহেবার হয়েই খেলেছি। এই যে আমি।”
এরপর অন্যহাতে নিজের রাণী কড়ির রাজার পাশে ঠেলে দিয়ে আরো যোগ করল, “আর এইতো আমাদের বেয়াইন সাহেবা, আমার রাণী। আমরা একজন আরেকজনের বিপক্ষে না খেলে একে অপরের জন্য খেলেছি। আমাদের মধ্যে বড়ই মিল মহব্বত। মাথা ফাটাফাটির প্রশ্নই আসে না।”
সবাই ইমাদের রসিকতায় একসাথে হো হো করে হেসে উঠল।
কড়ি কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত ঘষে শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলল, “বেয়াই সাহেব দেখছি ফ্লার্টিং মাস্টার। গার্লফ্রেন্ড কয়টা আপনার?”
এ কথায় একেকজন হাসতে হাসতে একে অপরের উপর গড়াগড়ি পর্যন্ত খেল। ইমাদ কিছু বলল না। কড়ির চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল। কড়িও সোজা ইমাদের চোখের দিকেই তাকিয়ে রইল। দুজনের কেউ’ই চোখ সরাচ্ছিল না। দীপা এসে তাদের চোখাচোখিতে বাগড়া দিলো, “এখানে এত হাসাহাসি কেন? আমাকে ত সবাই ভুলেই গেছে।” দীপা এমন একটা ভাণ করল যেন ওর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ইমাদ কড়ি থেকে চোখ সরিয়ে দীপার দিকে তাকাল। নিলয় দীপাকে ক্ষ্যাপিয়ে বলল, “তুই এখানে কি করিস? নতুন বউদের হাসাহাসি মানা। নতুন বউ হয়েছিস, মুখে আঁচল চেপে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদ। লজ্জাশরম কিছুই নেই মেয়েটার।”
দীপা রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠল। ইমাদ বলল, “আমি একটু ঘুরে আসি।”
দীপা বলল, “হ্যাঁ, আমি এসেছি না, এখন ত তোকে যেতেই হবে।”
ইমাদকে দেখে মনে হলো সে দীপার কথা শুনতেই পায়নি। একা ঘুরতে চলে গেল সে। মন খারাপ করে দীপা বলল, “ধুর আমার আসাই ঠিক হয়নি।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কায়েস পিছুডেকে বলল, “মেজো ভাবি, যাচ্ছ কোথায়? জানালা নেই বলে বসবে না, নাকি? এখন উঠোনে আমি তোমার জন্য জানালা কি করে ব্যবস্থা করি বলো তো।”
দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে লাজুক গলায় বলল, “যাহ দুষ্টু।”
কায়েস বুকের বা’পাশে দু’হাত চেপে বলল, “ইশ্ কি মিষ্টি!”
এই গ্রামের বাজারে ক’টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে কে জানে! ইমাদ দ্রুত পা বাড়াল। নাহ্ শেষ পর্যন্ত বাজারে দু একটা দোকান খোলা ছিল। ইমাদ একটা আইস ললি কিনল। আইস ললি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দীপার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল।
দীপা বলল, “কে?”
ইমাদ প্রশ্নের উত্তরে গম্ভীর গলায় ডাকল, “দীপু?”
দীপা একা একা মুখ ভেঙাল। তারপর বলল, “দরজা খোলাই আছে। ভেতরে আয়।”
ইমাদ দরজা ঠেলে ভেতরে এসে আইস ললির প্যাকেটটা দীপার কপালে চেপে ধরল। দীপার চোখ ভিজে উঠল। সে যখন একটু আগে বাইরে গিয়েছিল তখন সবাই’ই তো ছিল। সে যে ব্যাথা পেয়েছে কেউ’ই খেয়াল করেনি। এই একটুখানি ফুলেছে, চোখে পড়ার মত তো নয়। ইমি এত ভালো কেন! ঐ যে কি একটা গান আছে না? “তুমি মায়ের মতই ভালো!” ইমি ঠিক তেমন। ইমিকে একদিন বলতে হবে, “তুই মায়ের মতই ভালো, তুই বাবার মতই ভালো, তুই ভাইয়ের চেয়েও ভালো।”
ইমাদকে দূর থেকে দীপার ঘরে ঢুকতে দেখে নিলয় দৌড়ে চলে এল, “এই আমাকে ছাড়া এখানে কিসের ফুসুর – ফাসুর হচ্ছে?”
বলতে বলতে থেমে গেল সে। দীপু বিছানার এক কোণে বসে আছে। ইমাদ খাটের পাশে দীপুর কপালে ঠাণ্ডা বোতল চেপে ধরে দাঁড়ানো। নিলয় আঁৎকে উঠে ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে দীপুর?”
দীপা বলল, ” অন্ধকার ঘরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি খাটের স্ট্যান্ডে আমার মাথা ঠুকে গেল।”
নিলয় অবাক হয়ে চোখ বড় করে বলল, “খাটের স্ট্যান্ডে লেগে এই অবস্থা! আর তুই কি বাচ্চা নাকি?”
দীপা ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল, “তা আমি বড়ই’বা ছিলাম কবে?”
হ্যাঁ গাধী দীপা এটা অবশ্য ঠিক বলেছে। দীপা যে কোন কালেই বড় ছিল না তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই।
নিলয় গুরুজনদের মত ভাব নিয়ে বলল “দীপু, তোর এখন বিয়ে হয়েছে। তোকে হরলিক্স খেয়ে এখন তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে।”
নিলয়ের কথার ভাবে ইমাদও একটু না হেসে পারল না।
এদিকে কাদিন তখন বরফকুচি নিয়ে আসতেই তিন বন্ধুর হাসাহাসির শব্দ শুনল। ওর মেজাজটা চটে গেলে আরও। তাকে লুচ্চা বলে এখন বন্ধুদের সাথে হাসা হচ্ছে! সে গিয়েছিল দীপার জন্য বরফকুচি জোগাড় করতে। বাড়িতে থাকা হয়না বলে ফ্রিজ নেই। পাশের বাড়ির হাশেম চাচাদের ফ্রিজ থেকে বরফকুচি আনতে গিয়ে সেখানেও পেল না। আরো কয়েকঘর খুঁজে তারপর আনতে আনতে দেরি হয়ে গেল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করল না আর। বরফকুচি নিয়ে সোজা সে উল্টোপথে হাঁটা ধরল। আসলে দীপা গাধী নয়, সে নিজে গাধা। শুধু গাধাই না, উচ্চমানের মস্তবড় গাধা। গাধা না হলে কেউ দীপার মত মেয়েকে বিয়ে করে না।
.
পুরোনো টিয়া রঙের পাঁচ তলা বাড়ি। একেকটা সিঁড়ি ইয়া চওড়া আর উঁচু। উঠতে নামতে দম বেড়িয়ে আসে সবার।
মুবিন আর মিলা একসাথে এখানে চারতলায় ব্যাচে পড়ে। পাঁচতলায় ছাদ। সামনের অর্ধেক বেঞ্চ মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। আর শেষের বাকি বেঞ্চগুলো ছেলেদের। যারা তাড়াতাড়ি আসে তারা সেগুলো দখল করতে পারে। তারপর বাকি ছেলেমেয়েরা টুল নিয়ে বসে পড়ে। এত বেশি ভিড় এখানে! ঘরটার একটাই দরজা এবং সেটি পেছনের দিকে হওয়ায় ছুটির সময় আগে পেছনে বসা ছেলেরা বের হয়। এরপর সামনে বসা মেয়েরা। আর প্রবেশ করার সময় মেয়েরা আগে আগে প্রবেশ করে। ছেলেরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। মিলার অবশ্য কখনোই মেয়েদের সাথে মেয়েদের বেঞ্চগুলোতে বসার সৌভাগ্য হয়না। মুবিনের ঢিলেমির কারণে প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়। তখন বেঞ্চে বসার জায়গাটুকু সে আর পায়না। ছেলেদের পাশাপাশি টুল নিয়ে বসে ক্লাস করতে হয়। আজ মুবিন আসেনি বলে মিলা তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছে। অনেক বুঝিয়েছিল মিলা, কিন্তু মুবিন মায়ের উপর জেদ দেখিয়ে আসলই না। মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আগের ব্যাচের এখনও ছুটি হয়নি। সে একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে। তাই পাঁচতলার চিলেকোঠার পাশে সিঁড়িতে বসে রইল। আচমকা সিঁড়িতে দপদপানির আওয়াজ হলো। মিলা গলা উঁচিয়ে তাকাতেই দেখল একটা ছেলে লাফিয়ে লাফিয়ে ইয়া বড় বড় দুই তিনটে সিঁড়ি একসাথে টপকে উপরে উঠে আসছে। ছেলেটাকে সে চিনতে পারল। ছেলেটার নাম অভ্র। এই ছেলেটা গত বৃহস্পতিবার ক্লাসের বাইরে রাখা মিলার জুতা জোড়ার উপর জুতা পায়ে দাঁড়িয়েছিল। কি আশ্চর্য! ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়াবে না? কারো জুতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা এ কেমন অভদ্রতা! তাও আবার জুতা পায়ে! মিলা চোখমুখ কুঁচকে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, “সরো।”
অভ্র প্রথমে বুঝতেই পারেনি, কোথায় সরবে সে? কেন সরবে? মিলা ফের বলল, “আমার জুতা।”
অভ্র তখন গিয়ে বুঝল। নীচে তাকিয়ে বিব্রত হয়ে গেল। দ্রুত সরে দাঁড়াতেই মিলা বিরক্ত ভঙ্গিতে জুতা পায়ে দিলো। ওর জুতাগুলোর অবস্থা ময়লায়, ধূলোয় এমন হয়েছিল যে পায়েই দেয়া যাচ্ছিল না।
চলবে…