#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
১.
কড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা গত রাতে করে ফেলেছে। বাড়ি থেকে পালিয়েছিল সে। তাও গয়না সমেত। মাঝপথে রামিম তাকে ফিলিং স্টেশনে একা ফেলে গয়নাগাটি সব নিয়ে পগারপার। কড়ি তার ব্যাগটা রামিম এর হাতে দিয়ে টয়লেটে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখল রামিম নেই। নেই মানে কোথাও নেই। আকাশের ঐ বাঁকা চাঁদও যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। ওহ এই রামিম হলো তার প্রেমিক। একা স্টেশনে, রাতের অন্ধকারে, প্রতারিত কড়ি একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজের জন্য খুব সুন্দর একটা সান্ত্বনার বাণী খুঁজে ফেলল। গয়না গেলে গেছে, অসভ্যটা তাকে ত পায়নি। জীবনটা তার একটুর জন্য বেঁচে গেল। বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কড়ি সিএনজি ডাকল। সিএনজি ঠিক করে বাসায় ফিরে এসে দেখল বাড়ির কেউ এখনো ফিরেনি। তার পার্সটাও ঐ অসভ্য নিয়ে গেছে। সিএনজিওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে সে পাশের বাড়িতে গেল। গিয়ে বলল আসার সময় তার পার্স চুরি হয়ে গেছে। তারপর তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিএনজি চালককে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকল এবং টিএনটি থেকে বড় ভাইয়ের নাম্বারে কল করল। হতভম্ব গলায় বলল, “তোমরা কই? তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। বাসায় ত চুরি হয়েছে। গয়না, টাকা কিছু নেই।”
ভাইয়া বলল, “তুই বাড়িতে!”
“হ্যাঁ, তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম। এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজড।”
“বলিস কী! আচ্ছা আচ্ছা সাবধানে থাক আমরা আধ ঘণ্টার মাঝেই আসছি।”
তাঁরা আসতে আসতে কড়ি বাসার সব এলোমেলো করে দিলো। আলমারি খুলে রাখল। আলমারির চাবি ছুড়ে নীচে ফেলল। আলমারির অবশিষ্ট গয়না একটা ওড়নায় বেধে নিজের ঘরের বড় ফুলদানিটার মাঝে লুকিয়ে রাখল। তারপর ড্রয়িংরুমের সোফায় আসন গেঁড়ে বসে রিমোট হাতে টিভি অন করল। একটু পরই বাসার সবাই এসে পড়ল। কড়ির বাবা কাদের সাহেব গম্ভীরভাবে বাসায় ঢুকলেন। পেছন পেছন যথাক্রমে কড়ির বড় ভাই কাইয়ূম, মেজ ভাই কাদিন এবং ছোট ভাই কায়েস বাসায় ঢুকল। হতভম্ব চোখে তিন ভাই একেক ঘরে ছুটে গেল। গিয়ে দেখল সব এলোমেলো। তাদের আলমারিও খোলা। তবে আলমারির ভেতরটা আর দেখল না তারা। তাদের আলমারিতে কাপড় ছাড়া কিছুই থাকে না। বাবার ঘরে ছুটে গেল। কাদের সাহেব বিছানায় বসে দরদর করে ঘামছেন। কাইয়ূম পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, “তোর মায়ের সব গয়না নিয়ে গেছে। সব মানে সব। একটা কিছু নেই।”
কায়েস কোমরে হাত রেখে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, “কথা হলো চোর বাড়িতে ঢুকল কী করে!”
কাইয়ূম বলল, “বাবা, রিমাকে চলে আসতে বলব?”
কাদের সাহেব মেঝের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে বললেন, “না, থাক ওর ভাইয়ের বিয়ে। ও থাকুক সেখানে।”
কাদিন বলল, “বড় কোনো অ্যামাউন্টের টাকা পয়সা বাড়িতে থাকে না বলে বড় বাঁচা বাঁচলাম।”
কাইয়ূম সাহেব আফসোস করে বললেন, “টাকা গেলে যেত! তোর মায়ের গয়নাগুলো যদি বেঁচে যেত! ওগুলো তো তার শেষ স্মৃতি। ভাগ্যিস রিমার গয়নাগুলো রিমা পরে গিয়েছিল। নাহয় সেগুলোও যেত।”
কড়ি ট্রেতে করে বাবা আর ভাইদের জন্য লেবুর শরবত নিয়ে ঘরে ঢুকল। মনে মনে বলল, “রিমা আপুর গয়নাগুলো থাকলেও আমি নিতাম না, বাবা। মায়ের বলেই নিয়েছিলাম।”
তারপর বাবা আর ভাইদের হাতে গ্লাস তুলে দিতে দিতে বলল, “আফসোস খুব খারাপ জিনিস। মানুষের অর্ধেক জীবন চলে যায় চলে যাওয়া মানুষ কিংবা জিনিস নিয়ে আফসোস করতে করতে। আফসোস করতে নেই। গেলে গেছে। যা….”
কড়িকে বাকিটা বলতে না দিয়ে তার তিন ভাই একসাথে সুর তুলে টেনে টেনে বলল, “যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”
কড়ি ঘাড় নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ তাই। ধরো আমি যদি আরেকটু আগে এসে পড়তাম আর চোররা বাসায় থেকে যেত তবে আমার যেকোনো ধরনের ক্ষতিই তারা করতে পারত। তোমাদের উচিত টাকা, গয়নার জন্য আহাজারি বাদ দিয়ে আমার সুস্থতা নিয়ে ছোটখাটো একটা পার্টি করে ফেলা।”
কাইয়ূম বোনের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ঠিক বলেছিস। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া।”
কড়ি এমনি। কড়ির জীবনে ব্যথা আছে কিন্তু দুঃখ নেই। কারণ সে রক্তাক্ত ঘটনাগুলোকেও রঙধনুর সাত রঙের এক রঙ লাল দেখতে পায়। যেমন তার মায়ের মৃত্যুর সময় সে কলেজ পড়ুয়া। বড় ভাই কাইয়ূম মা ঘেঁষা ছেলে। মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছিল। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিনের পর দিন পাথর হয়ে ঘরে বসে থাকতো। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেন একটা ননির্বাক পুতুল। সেবার আর মাস্টার্স পরীক্ষা দিবেনা বলেও ঘোষণা দিলো। বড় ভাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কড়ি একদিন বলেছিল, “মা থাকলে রিমা আপুর সাথে তোমার সম্পর্কটা কখনোই মেনে নিতেন না। সব ব্যাথাই অন্য কোনো ব্যাথার ঔষধ। কিংবা সব ঔষধই নতুন কোনো জ্বালাপোড়ার কারণ। যা হয় ভালোর জন্য হয়।”
এ কথায় বড় ভাই পরীক্ষা দিলো। পরীক্ষা শেষে ভালো চাকুরী পেল, রিমাকে বিয়ে করল।
যাইহোক, কড়ি সবকিছুরই একটা ভালো দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এবারেও তাই করল। রাতে নিজ হাতে রান্না করে বাবা- ভাইদের নিয়ে এক টেবিলে বসে খেলো। রিমার সাথেও ফোন করে কথা বলল। আশ্বস্ত করল রিমাকে। রিমা বলল, “কড়ি, তুই না বললি তোর পরীক্ষা? এই জন্য ভাইয়ার বিয়েতেও আসবি না বললি।”
“এমনি বলেছিলাম। তোমাদের সারপ্রাইজ দিব বলে আগে বলিনি। ভেবেছিলাম হলুদের রাতে এসে আচমকা হাজির হয়ে তোমাদের চমকে দেব।”
“তাহলে তুই সরাসরি আমাদের বাসায় এলি না কেন?”
“বাসায় আমার সবচেয়ে পছন্দের ড্রেসটা রাখা। তাই আগে তোমাদের বাসায় না গিয়ে বাসায় এসে ঐটা পরে তারপর হলুদে যেতে চেয়েছিলাম।” কড়ি কী সুন্দর করে যে বলল!
রিমার অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কড়ি সোজাসুজিভাবে কিছু করে অভ্যস্ত নয়। সবকিছু অন্যরকম, আলদারকম করতে ভালোবাসে সে। পাগলাটে সব কাজই কড়ি দারুণ মন দিয়ে করে। রিমা বলল, “কাল তো বিয়ে। আসবি না?”
“আসব ত। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, আপু।”
“আচ্ছা।”
রিমার সাথে কথা শেষ করে কড়ি ডায়েরী নিয়ে বসল। লেখার জন্য না, ছেঁড়ার জন্য। আগুন জ্বালিয়ে পোড়াবে বলে রামিমকে নিয়ে লেখা পাতাগুলো ছিঁড়ে রাখল। সাথে কানে বাজবে পছন্দের গান। ফুলতোলা লাল ব্লাউজের সাথে সাদা শাড়ি পড়ল। সাথে গলায় গোলাকৃতির কাঠের গয়না। গয়নায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন”
কুঁচি ঠিক করতে করতে আয়নায় লেখাটার দিকে চোখ পড়তেই সে নিজের খোঁপা খুলে দিলো। চুলগুলো স্বাধীন হয়ে তার অঙ্গে ঝরল। মানাচ্ছে বেশ! ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক দিয়ে ছাদের দিকে রওনা হলো সে।
সুনসান পূর্ণিমা রাত। চারিদিকে জোছনার ঢেউ। কড়ি ছাদের আনাচেকানাচে পড়ে থাকা পাতা জড়ো করে দেশলাই দিয়ে আগুন জ্বালল। গান বাজছে, “যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে, কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে….”
সাবধানে আগুনের পাশে বসতে বসতে কানে ইয়ার ফোন গুঁজল। একটা একটা করে ডায়েরীর পাতাগুলো আগুনে ফেলল। কী শান্তি! কী শান্তি! বুক শীতল করা প্রশান্তি।
সবকিছু নান্দনিকভাবে করবার একটা আনন্দ আছে। কড়ি সে আনন্দটুকু পেতে পছন্দ করে। এমন করেই আগুনের পাশে বসে তার বিভৎস এই রাতটি নান্দনিক এক রজনী হয়ে উঠল।
কড়ি ছাদ থেকে নামল ফজরের আজানের সময়। কাঁদেনি সে। সে কাঁদবে আয়োজন করে। যেদিন বৃষ্টি আসবে সেদিন। কান্নাটা তোলা রইল। আজ রইস ভাইয়ের বিয়ে।
.
ইমাদ কাল রাত থেকেই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে। এক চুলও নড়েনি সে। যে করে হোক মেয়েটার সাথে তাকে দেখা করতেই হবে। খুব দরকার তার, খুব। সে ভালো করে বাড়িটার দিকে তাকাল। বাড়ির নাম “কড়ির কুটির”। আচ্ছা মেয়েটির নাম কী কড়ি হতে পারে? হতেই পারে। বাড়ির নামগুলো সাধারণত দুই প্রকার হয়। এক প্রকার হলো, শান্তি নিকেতন, ক্ষণিকালয়, মা ইত্যাদি। অন্যদিকে, বিভিন্ন ভিলা, কুটির, কটেজ, প্যালেস। আর এগুলোর আগে বাড়ির মালিকের নাম কিংবা, বাড়ির মালিকের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির নাম জুড়ে দেওয়া হয়। মেয়েটির নাম কী তবে কড়ি?
ইমাদ মাথার হ্যাডস্কার্ফটা খুলে নতুন করে খুব সুন্দর করে মাথায় বাঁধতে বাঁধতে একবার ভাবলো বাড়ির ভেতরে যাবে। পরক্ষণেই মত পাল্টাল। না ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না। মেয়েটা বিপদে পড়ে যাবে। তারচেয়ে বরং অপেক্ষা করাই ভালো। সে বাড়ির সামনে থেকে নড়ল না। বরং, উল্টোদিকের রাস্তাটায় পায়চারি করতে লাগল।
কাল রাত থেকে কিছু খাওয়াও হয়নি। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। বাড়ির সামনে কোনো দোকানপাটও নেই। আসার সময় দেখেছিল গলির মুখে একটা দোকান আছে। সেখান থেকে কিছু কিনে খাওয়া যেতে পারে।
ইমাদ খানিক সামনে এগিয়ে দোকান থেকে পাউরুটির প্যাকেট আর দুটো কলা কিনলো। প্যাকেট ছিঁড়ে দাঁড়িয়েই খেতে শুরু করে দিলো। তখনি কড়ি বাড়ি থেকে বেরুলো। তবে একা নয়। সাথে বাবা আর ভাইদের সহ। রিকশা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। রিকশার উপর নজর পড়তেই ইমাদ দোকানদারকে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলল, “তাদের বাড়িতে গতকাল কী কোনো অঘটন ঘটেছিল?”
“হ্যাঁ, চুরি হয়েছিল।” দোকানদার ব্যথিত।
“কেউ ছিল না বাসায়?”
“না। বিয়েতে গিয়েছিল। আর মেয়েটা ঢাকা থেকে বিয়েতে এসেছিল। এসে দেখে বাসায় চুরি হলো!”
“আচ্ছা।”
দোকানদার একটু কেমন করে তাকালেন। একটা মানুষ শুনল চুরি হয়েছে অথচ, কী চুরি হয়েছে, কেমন করে হয়েছে কিছুই জানতে চাইল না। এমনকি আহারে, ইশশিরে, বলেন কী জাতীয় কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাল না। বড়ই নির্বিকার এই লোক! দোকানদার ইমাদের এই নিঃস্পৃহতায় বড্ড বিরক্ত হলেন। এই ধরনের মানুষগুলো হয় ভয়ানক এবং নিষ্ঠুর। মানুষ খুন করতেও তারা দ্বিধা করে না। তাদের গ্রামে ছিলেন কালা ব্যাপারী। কালা ব্যাপারী এমন নির্বিকার গোত্রের মানুষ ছিলেন। এখন তিন তিনটা খুনের দায়ে হাজতে। তাই তিনি খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, “আপনাকে ত এর আগে এলাকায় দেখিনি কখনো?”
ইমাদ বিচলিত হলো না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি এই পাড়ায় নতুন টিউশনী নিয়েছি।”
“ওহ তাই বলুন। তবে আপনি কীভাবে অঘটনের কথা জানলেন?”
“আমার ছাত্রর মুখ থেকে শুনেছি।”
তবুও দোকানদারের সন্দেহ দূর হলো না। ইমাদ আর কথা বাড়াল না। বাড়িটি মেয়েটির বাড়ি। যত যাই হোক দিনশেষে মেয়েটিকে এখানেই ফিরতে হবে। এইটুকু নিশ্চিত হয়ে ইমাদ রিকশা ডাকল। রিকশায় বসতেই নিলয়ের ফোনটা এল। ইমাদ রিসিভ করতেই নিলয় ভীত কণ্ঠে বলল, “দিপু মরে যাচ্ছে, দোস্ত দিপু মরে যাচ্ছে।”
ইমাদের কোনো হেলদোল নেই। সে শুধু বলল, “ওহ আচ্ছা।”
“তুই কী শুনতে পাচ্ছিস আমি কী বলছি? তুই শুনতে পাচ্ছিস?” নিলয় রাগে চিৎকার করে উঠল।
ইমাদ স্থির, শান্ত গলায় পাউরুটি খেতে খেতে বলল, “হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।”
নিলয় এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তুই এমন কেন, ইমাদ? তুই এমন কেন?”
“কেমন?”
“তুই একটা পাথর।”
“হ্যাঁ, পাথর ভালো জিনিস। পাথর আরাধ্যের।”
নিলয় অসহ্য হয়ে মোবাইলটা হাসপাতালের করিডোরে ছুঁড়ে ফেলল। ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল মোবাইল।
চলবে…