#একরত্তি_প্রেম,শেষ_পর্ব
#Alisha_Anjum
দূর দূর সুদূর হতে হাওয়ারা আন্দোলন করতে করতে আসছে। চোখেমুখে জাপ্টে পড়ছে দোলার। এমন প্রশান্তির পবনেও তার মন অস্থির অশান্ত। রিকশায় বসে আছে দোলা। যত পথ অতিক্রম হচ্ছে ততই যেন মন খারাপের অসুখ তীব্র হচ্ছে। স্বশরীরে বসে আছে ঠিকই কিন্তু মনটা হাহাকার করছে। শূন্য শূন্য অনুভব অনুভূতিতে। দোলা সামনে তাকালো। রিকশা থেকে হয়তো আর পাঁচ মিনিট পর নেমে যেতে হবে। আঁধারের কাছে চিরতরে চলে যেতে হবে। চাইলেও এ পথে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে পারবেনা দোলা। থাকতেই ডলার বুক ধক করে উঠলো। ক্রমে ক্রমে যেন উঠে পড়ল মনে কালবৈশাখী ঝড়। এমন কেন হচ্ছে? দোলার ভীষণ অস্থির লাগছে, ছটফট লাগছে। এরইমধ্যে বিবেকের অবিশ্যম্ভাবী আক্রমণ। এক অখন্ডনীয় যুক্তিতে পেচিয়ে ধরল দোলাকে। বিবেক কড়া গলায় প্রশ্ন করে উঠলো, সে কি সত্যিই আঁধারের কাছে চলে যাবে? আঁধারের কাছে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? প্রেম মানুষের জীবনে আসেই। কিন্তু সবার জীবনে প্রেমিক-স্বামী হয়ে আসে না। অনেক মেয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে সংসার করে। স্বামীকে উপেক্ষা করা বাঙালি নারীর পক্ষে অসম্ভবপ্রায়। স্বামীকে রেখে যারা প্রাক্তনের কাছে চলে যায় তাদেরকে সমাজে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখা হয়। দুলাক্স এই ঘৃণ্য দলের নারীদের সামঞ্জস্যতা পেতে চায়? মোটেই না। দোলা ভাবনাতে বিবেকের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিল।
ভিতর থেকে উঠে আসা কথাগুলো কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়। উফ! দোলার হাঁসফাঁস লাগছে। কি করবে সে? দোলার ভাবনার মাঝে হঠাৎ রিক্সাওয়ালা চেঁচিয়ে উঠলো। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দোলা চমকে উঠলো। তার শাড়ির আচল রিক্সার চাকায় আবদ্ধ। রিকশাওয়ালা দোলাকে বকছে! আরেকটু হলেই তার অবস্থা অবর্ণনীয় হত। দোলা আঁতকে উঠলো। ঠিক তখনই তার মনে পড়ে গেল দীপের কথা। এমন অসাবধানী দোলাকে কত-শতবার যে দীপ সামলে রেখেছে তার হিসেব নেই। এখানে ওখানে যেখানে সেখানে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে অত্যন্ত পারদর্শী দোলা। আর ভাবনা নয়, একটুও ভাবনা নয়। দোলার কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। তল্পিতল্পা নিয়ে সে রিকশা থেকে নেমে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সে রওনা হল নিরুদ্দেশ ভাবে। তার কি করা উচিত, না উচিত সে জানেনা। শুধু জানে সে তার প্রাক্তন এর কাছে যাবে না। তার বাবার বাড়ির ইজ্জত, শ্বশুরবাড়ির ইজ্জত সে ধুলোয় মিশে পারবেনা। এই মন কেমন আর পিছুটান, দ্বিধা নিয়ে আঁধারের কাছে যেতে সাঁই মিলছে না। আর দীপের প্রসঙ্গ তুললে দোলার মধ্য হতে কি জবাব আসে?
দোলা জানেনা সে ভালোবাসে কিনা দীপকে। কিন্তু তাকে ছেড়ে আসার সময় বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে। দোলা জানেনা তার এমন হয়েছে কিনা। একরত্তি প্রেম জন্মেছে কিনা দীপের জন্য। সৃষ্টিকর্তা তাকে তিন কবুলের দৃঢ় বন্ধনে বাঁধলো কিনা। তবে যাই হোক না কেন, দোলা আজ আপন মনের বাইরে কিছু করবে না।
.
প্রিয় আঁধার,
তোমায় কিভাবে বলবো আমি জানিনা। তুমি জানো আমি সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু লিখতে পারিনা। সহজ ভাষায়, সহজ কথায় আমি লিখছি। তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি আমার স্বামী হীনা অন্য কাউকে গ্রহণ করতে পারবোনা। আমি আমার স্বামীর কাছে থাকতে চাই। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়ে তার সাথে সংসার করতে চাই। আমি তাকে ভালবাসতে চাই, তার সাথে ঘর বাঁধতে চাই। তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও।
একটা মুদির দোকান থেকে কাগজ কলম সংগ্রহ করে দোলা তড়িঘড়ি করে চিঠিটা লিখে ফেলল। এখনই সে ডাকে পাঠিয়ে দেবে চিঠিটা। দোলা ছুটলো পোস্ট অফিসের পানে।
.
গ্রীষ্মের গুমোট গরমে তাপে তাপে প্রকৃতি উত্তপ্ত। দোলা ঘেমে নেয়ে একাকার। সে এক হাতে ব্যাগ ঠেলছে অন্য হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম নির্যাস করছে। কিন্তু তাতে তার মনের আঙিনায় বিরক্তির এতোটুকু জায়গাও নেই। সে হাহাকার হয়ে ছুটছে সম্মুখের দিকে। ভাবতেও ভারী অদ্ভুত লাগে! স্বামী! সে মনকাড়া সম্রাট। এই ব্যাক্তিটার প্রতি কিভাবে এত টান সৃষ্টিকর্তা তৈরি করে দেয়? দোলা ভীষণ অবাক হল। এক সময় তার মনে হতো আঁধারকে ছাড়া সে অস্তিত্বহীন। কিন্তু আজ সেই আঁধারেরই চার বছরের ভালোবাসা ফেলে সে স্বামীর দিকে ছুটে চলেছে। দোলা মনে ভাবনা নিয়ে দ্রুত পথে চলছিল। হঠাৎ যে থেমে যায়। ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে। হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আসতে লাগল দোলার। সামনের দৃশ্যে সে স্তব্ধ। দীপ ছুটে আসছে। ঠোঁটে তার লেগে আছি বিশ্বজয়ের হাসি। ঠিক এমনভাবে যেন হাসতে হাসতে পেছন থেকে ধেয়ে আসছে একটা ট্রাক। ট্রাকটা যেন দীপকেই লক্ষ্য করে আসছে। দোলার ভয় হচ্ছে ভীষণ। সে আতঙ্কে আত্মহারা। কি হবে এখন? দোলা হাতে থাকা ব্যাগটা ফেলে দীপ বলে একটা চিৎকার করে দৌড়াতে লাগলো। ততক্ষণে ট্রাক দীপের খুবই কাছাকাছি। দোলার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। আশঙ্কায় কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে, অস্থির লাগছে। দোলা থেমে গেল, আপনা আপনি চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল। সামনের দৃশ্য তার মস্তিষ্কে ধারণ করা বড় কষ্টকর। গাড়ির গতিরোধ হওয়ার বিকট একটা আওয়াজ হলো। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল কোন একজনের নির্মম আর্তনাদ। মূহুর্তেই যেন আকাশ বাতাস সবকিছুই স্তব্ধ হয়ে গেল। পথের যাবতীয় কাজকর্ম যেন থমকে গেল। দোলা দুইহাতে মুখ ঢেকে আছে। কোনমতেই তার সাহস হচ্ছে না চোখ খোলার। শুধু কান্না পাচ্ছে, শুধুই কান্না পাচ্ছে তার। বুক ভেঙ্গে কুলহারা দুখীনির মত কান্না এসে জমেছে চোখে। সে ধীরগতিতে দুই হাত নামিয়ে ফেলল। রাঙ্গা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। পথের ধারে জমেছে মানুষ। আবৃত করে আছে কারো আহত দেহকে। দোলার সাহস হচ্ছে না ভিড় ঠেলে ভিতরে যাওয়ার। তার দীপ কোথায়? বুকের কোণে একটু আশা। মন বলে তার সৃষ্টিকর্তা তার সাথে এমন করতেই পারেনা। এই এক চিলতে আশা নিয়ে দোলা এদিক-ওদিক দীপের সন্ধান করতে লাগলো। দোলার আশা-নিরাশায় পরিণত হলো না। দেখা গেল ভিড়ের এক কোন থেকে বেরিয়ে আসছে অক্ষত দীপ। দোলা খুশিতে আত্মহারা হলো। চোখ ভরা জল নিয়ে গালভরা হেসে দিল। হাজার শুকরিয়া। তার দীপ অক্ষত আছে। দোলা ছুট লাগালো দীপের দিকে। দুজনে কাছাকাছি দাড়িয়ে । মাঝখানে এক হাত জায়গা অবশিষ্ট। দোলা চোখ ভরে দীপকে দেখেছে।
— গাধা, ভালোভাবে রাস্তা পার হতে পারিস না? কানা রাস্তা দেখে পার হবি। আমি তো প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
দোলাকে দেখে দীপের আবেগ ভাগ চাপা পড়লো। দুষ্টুমি তার মনে কড়া নেরেছে।
— তুই এখানে কি করিস? তোর প্রেমিক তোকে নেয়নি?
দীপের কথায় দোলা থমকে গেল। মুখে গাম্ভীর্য এসে ভিড় জমাল। চোখ মুছে স্বভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো
— আমি তো ডান্স করতে আসছি এখানে। কিন্তু তুই এখানে কি করিস?
দোলার কথায় দীপ হাসল। মুখে কেমনতর এক ভাব আসলো। চোখে ফুটে উঠল অনুরাগ। মায়াবী কন্ঠে বলে উঠলো
— বউকে নিয়ে যেতে এসেছি।
দীপের কথা শুনে দোলার চোখ সজল হয়ে উঠলো। ভীষণ আশ্চর্য হল সে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ক্ষণিক পর হঠাৎ এসে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো দীপের পিঠে। মুখে শুরু হল রেকর্ড ভাঙ্গা গালিগালাজ।
— কুত্তা, হারামি, ভীতু বউ পালতে জানিস না তুই। আমি যদি এখন চলে যেতাম তাহলে কি হতো? ভালোবাসার কথা বলতে কী মুখ ক্ষয়ে যায়? ইচ্ছে করছে তোর চুল কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেই।
দোলার গালিতে দীপ হেসে কুটি কুটি। সে হাত বাড়িয়ে দোলাকে কাছে নিল। চোখে মুখে তার আবেগ খেলা করছে। ভীষণ মায়াময় কন্ঠে সে বলে উঠলো।
— একরত্তি প্রেম চাই, একমুঠো আবেগ চাই একটুখানি ভালবাসতে তো তোর কষ্ট নাই।বাসবি আমায় একটু ভালো?
দোলার চোখ ছল ছল করে উঠলো। দীপ কে ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ালো সে? দীপ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দোলার দিকে। দোলার পানিপূর্ণ আঁখি মায়ার ঝলকানি দেয়। দোলা দুই হাটু গেড়ে বসে পড়েছে মাটিতে। দুই হাতের ওপর আঁচল বিছানো। দোলার ছল ছল নয়ে,, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ হতে ধ্বনিত হলো
— আমায় নিয়ে একটা সুখের ঘর বাঁধবি?
আগলে রাখবি আজীবন তোর করে।
এইযে আঁচল রেখেছি বিছিয়ে।
একরত্তি প্রেম চাই তোর থেকে।
দোলার চাওয়া দেখে দীপের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আনন্দে, উচ্ছাসে, উত্তেজনায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। ভালোবাসা সত্যিই সুন্দর। এর সংস্পর্শে আসলে সব কিছুকে তুচ্ছ মনে হয়। দীপ দোলাকে নিয়ে এক রত্তি প্রেমের একটা সংসার গড়বে। দুজনের একরত্তি প্রেম নিয়ে এক জীবন পার করে দেবে।
সমাপ্ত