একরত্তি_প্রেম #প্রথম_পর্ব

#একরত্তি_প্রেম
#প্রথম_পর্ব
#Alisha_Anjum

— চলে যাচ্ছিস?

দোলা ভীষণ ব্যস্ত। সেই সময় দীপের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর। দোলা ভাঁজ করা কাপড় ব্যাগে রেখে ফিরে চাইল দ্বীপের দিকে। দীপ মায়াময় দৃষ্টি মেলে রেখেছে। দোলা ব্যাস্ত ভঙ্গিতে একটু হাসলো। নিজের কাজে হাত লাগাতে লাগাতে বললো

— আধারের আজ সন্ধ্যায় ফ্লাইট। ও আসছে।

— ওহ।

দীপ একটা শব্দ ধ্বনিকরণ করেই চুপ রইল । বুকে এত জ্বালা করছে কেন? দোলার চলে যাওয়ায় তার মন ফুঁপিয়ে উঠছে। সেতো জানি দোলা চলে যাবে। এ অন্যের সম্পদ! তার অধিকার থেকেও নেই। তবুও এমন অস্থিরতা কেনো হানা দিচ্ছে? দীপ ভাবছে কোথায় কি কারণ। বুঝেও বুঝতে চাইছে না সে কারণ। খুঁজেও হারিয়ে ফেলেছে সে কারণ। একি হচ্ছে বারবার? মন খুজে নিয়ে আসছে ফাঁদ। প্রেমনামক বেড়াজাল। দীপ চমকে উঠলো। বুকের চারদিক ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে অশান্ত। সত্যিই কি তার সর্বনাশ হল? অবশেষে ভুল পথে পা বাড়িয়েঃদরিয়ায় ডুবলো সে? দীপ বুঝে উঠতে পারছে না সে কি করবে। এসর্বনাশের যে রাতও নেই দিনও নেই। কি হবে তার?


যাওয়ার সময় হয়ে গেল। দোলা ভীষণ বিরক্ত। দীপ যে কোথায় উধাও হয়ে গেল? সব সময় সে এমন করে। সঠিক সময়ের সাথে প্রয়োজনের সময়ের সাথে তার আড়ি। দোলার মনে পড়ে গেল ভার্সিটির কথা। তাদের বন্ধুমহলে দীপ আর দোলাই ছিল বড় উড়নচণ্ডী, পাজির পা ঝাড়া। অন্যদিকে তাদের পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে আঁধার ছিল বুদ্ধিদীপ্ত। সবদিক দিয়ে সে ছিলো দূরদর্শী। স্মৃতির পর পাতা উল্টাতে দোলার ভীষণ লজ্জা লাগছে। অনার্সে থাকাকালীন কোন এক বছরে হঠাৎ ঠাস করে মান ইজ্জত ভেঙ্গে যায় দোলার। ইংলিশে চূড়ান্ত মনের ফেল করে বসে সে। সেবার অবশ্য দীপ টেনেটুনে পাশ করে। তবে এ দীপের বিশ্বরেকর্ড সে কখনো ফেল করেনি আবার কখনো ভালো মানের নাম্বার পেয়েও পাস করেনি। তো যাই হোক দোলার ভীষণ হিংসা হল এ নিয়ে। মাঝে মাঝেই দীপ দোলার মান-ইজ্জতের ভাঙ্গা টুকরায় টোকা দিতে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতো। এদেখে দোলার ভেতর-বাহির দাউদাউ করে জ্বলে উঠত অদৃশ্য কারণে। যথারীতি সে এমন অবলা অত্যাচার মানতে না পেেরে নালিশ জানায় ন্যাকা ন্যাকা সুরে আধারের কাছে। ভালোবাসা মিশ্রিত ধমকাদমকিতে শাসন করে আধার দীপকে। অভিমান ভাঙ্গানোয় দোলার। অতঃপর বিবেচনায় আনা হয় দোলার লেখাপড়ার বিষয়বস্তু। সবশেষে সিদ্ধান্ত হয় দোলাকে আধার পড়াবে। যেহেতু সে একজন টপার স্টুডেন্ট এবং দোলার ফেল করা তার বন্ধু মহলের জন্য লজ্জাজনক। তাই আধার দোলার পাস করানোর দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়। এরপরই শুরু হলো সর্বনাশা পবন বওয়া। নীরবে একাকী কিছু সময় দোলা পড়তে বসে হুমরি খেয়ে পরতো আঁধারের ওপর। সে ভীষণ অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকত আঁধারের দিকে। মনে মনে একটা কথাই জপতো “হয় সর্বনাশ! এ যে সাম্রাজ্যের রাজা।” সে রাজা তাকে বেপরোয়া করে দেয়। তারপর দোলা আবেগে ভেসে গেল আধার কে নিয়ে। পড়ালেখা ঠাস করে ফেলে দেয়া হলো আঁধারের অজান্তে। কিসের লেখাপড়া! দোলার সামনে যখন আধার বসে থাকত সে শুধু আঁধারের দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকতো। আধারের লেকচার যেত তার মস্তিষ্কের ডান বাম ওপর নিচ দিয়ে ভেতর দিয়ে আর যায়নি। কিন্তু কথায় আছে না, চোরের দশ দিন গেরহস্তের এক দিন। আঁধারের চতুরতার কাছে হার মানতে হলো দোলার। কিন্তু দোলাকে চরম অবাক করে দিয়ে আধার প্রেম নিবেদন করে বাসে দোলাকে। দোলা সুযোগ পেয়ে মাথায় চড়ে বসলো আঁধারের। চুটিয়ে ভার্সিটির ক্যাম্পাস কাপিয়ে প্রেম করতে লাগল তারা। কিন্তু নিয়তি বেশিদিন টিকতে দিলোনা এপ্রেম। তাদের প্রেম ছাপাছাপি করে দিয়ে এক দুঃসংবাদ বয়ে এলো আঁধারের কাছে।

বিদেশে অবস্থানরত আঁধারের বাবা পরলোক গমন করেছেন। মধুর স্বল্প দিনের প্রেম ফেলে আঁধারকে দৌড়াতে হলো বিদেশে। মা মারা গেছেন একদম ছোট বয়সে। বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকভরা মায়া দেখিয়েছেন কিন্তু মোটেও প্রিয়তমা ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধার কথা মাথাতেই আনেননি। এদিকে আধার দুদিন হল দেশ ছাড়তে না ছাড়তেই দোলার রক্ষনশীল পরিবার উঠে পড়ে লাগলো বিয়ের জন্য। এই ছিল তাদের জন্য একমাত্র সুযোগ মেয়েকে প্রেমপথ থেকে টেনে আনার। তোড়জোড় বেঁধে গেল পাত্র খোঁজার। শত চেষ্টা করেও দোলা থামাতে পারলো না পরিবারের কাজের গতি। বিয়ে ঠিক হল দ্বীপের চাচাতো ভাইয়ের সাথে। দোলা তখন দিশেহারা ছন্নছাড়া। সে ভীষণ আহত হয়ে শুধু ঘরের মধ্যে বন্দি পাখির মতো ছটফট করছিল। এর মধ্যে শুধু একবার ফোনে কথা হয়েছিল আঁধারের সাথে। আঁধারকে সবকিছু কোনরকম ভাবে জানাতে পারে দোলা। তারপরই দোলার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আটকা পরে তার রক্ষণশীল বাবার হাতে। যে বাবার ধারণা সেইম এজের প্রেম টেকে না। যারাই প্রেম করে ঘর বাঁধে তাদের সংসারে ঝামেলা লেগেই থাকে। হয়তো মেয়েটা বিষপান করে নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে অসহ্য জীবন থেকে চিরতরে মুক্তি নিতে চায়। যেমনটা করেছিল দোলার ফুফু। সেই একই পথে তো আর কোনো বাবা মেয়েকে গমন করতে দিতে চাইবে না!


দিন ঘনিয়ে এল। সময় শেষ হয়ে গেল। গায়ে হলুদও পার করল দোলা। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা চেপে, কান্না আটকে। নির্লজ্জের মত হাউমাউ করে কেঁদে বাবার কাছে মিনতি করেছিল আঁধারকে। কিন্তু এতোটুকু আশার আলো ফোঁটেনি। অবশেষে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় দোলার। তার আগে সে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল দীপকে। দীপের মাধ্যমে সে বরের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু ওই যে, দীপের একটাই চিরাচরিত স্বভাব। সঠিক সময়ে তার উধাও হওয়া আবশ্যক। দোলা অবশেষে হার মানলো। সবকিছু ভোলার চেষ্টা করল। ছেড়ে দিল সব ভাগ্যের ওপর। ঠিক তখনই এক ঝটকা, ম্যাজিক। হাসি-আনন্দের আর আশার একটা আলো। চারদিকে ছড়িয়ে গেল বর নিখোঁজ। পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। দোলার কানে সংবাদটা আসতেই সে খুশীতে মা চাচিদের সামনে শব্দ করে হেসে উঠল। সে সময় দেখা গেল দীপ এদিকেই আসছে। দোলা উল্লাসে দ্বীপের কাছে চলে যায়। তার প্রাণ যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল। দীপের মুখেও জয় জয় হাসি লেগে আছে। দোলা কাছে আসতেই দীপ ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো

— দোতলা রে, তোর জন্য অনেক কষ্ট করেছি। আমি কিন্তু বউ নিয়ে বছর বছর হানিমুনে যাওয়ার সময় আমার বাচ্চাকাচ্চা গুলো তোর কাছে রেখে যাবো। দেখে রাখবি।

দ্বীপের কথায় দোলা চোখ পাকিয়ে চাইল। এই ছেলে আস্ত একটা খাটাস। এমন পরিস্থিতিতেও মুখে কেমন কথা লেগে আছে! ভানা যায়! দীপ দোলার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ঠোঁলট উল্টিয়ে ফেলল। বলল

— এমন করে আছিস কেন? কষ্ট করে চাচাতো ভাইকে পামটাম দিয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসলাম। শুধুমাত্র তোর জন্য। আর তুই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমার বাচ্চাগুলো একটু দেখবি না? অকৃতজ্ঞ মহিলা।

দোলা না চাইতেও হেসে উঠল। বিয়ে বাড়ি লোকজনের অভাব নেই এইভাবে বধু সেজে বন্ধুর সাথে হাসি তামাশা করা মোটেই মানায় না। দুষ্টামি মনে চেপে দমে গেল দোলা। শুধু কৃতজ্ঞতার চাহনি মেলে সে দ্বীপকে কম্পিত কন্ঠে ধন্যবাদ জানালো। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যেখানে আঁধারও কিছু করতে পারেনি, দোলাও না। সেখানে দীপ অনেক বড় কিছু করেছে। কিন্তু নিয়তির খেলা এখানেই সমাপ্ত হয়নি। দোলা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো। মনে করতে চায় না সেই কাহিনী। বিবেক উল্টো পথ ধরে। স্বামীর উপর দায়িত্ববোধ আসে। দোলা কল্পনা থেকে বেরিয়ে এলো। স্মৃতিচারণ করতে করতে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। দীপটা যে কোথায় গেল? দুোলা পার্স থেকে ফোন বের করল। একটা ফোন দিয়ে দেখা যাক। দোলার ভাবনার মাঝে চেঁচিয়ে উঠলো ফোন। আঁধার ফোন করেছে।

— হ্যালো আঁধার।

— হ্যাঁ, তুমি কোথায়?

— আমিতো শ্বশুরবাড়ি।

ফোনের ওপাশে আধার ধমকে উঠল হাসলাম

– – তুমি এখনও ওখানে কি করো? একটু পর আমার ফ্লাইট তুমি সিলেট থেকে ঢাকায় কখন আসবে? আমায় রিসিভ করবে কে? আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো।

কথাগুলো বলেই ফোন কাটলো আধার। দোলা দোটানায় পড়ে গেল। দীপের সাথে সে দেখা না করে যায় কিভাবে?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here