“একটি মৃত্যু এবং একটি বিয়ে”
৪
প্রমা আর হিমুর বিয়ের পাকা কথার জন্য আজ প্রমার বাবা-মা তাদের কিছু নিকটাত্মীয় আর মুরুব্বিদের দাওয়াত করেছিলেন। হিমুর খালা-খালু সহ ছেলেপক্ষের আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়স্বজনকেও আসতে বলা হয়েছে। তাদের ছোট ফ্ল্যাটে এতো মানুষ একসাথে আগে কখনও দাওয়াত দেয়া হয়নি।
প্রমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল ফখরুদ্দীন বাবুর্চির থেকে কেটারিং করাবেন। শত হলেও মেয়ের শশুরবাড়ি থেকে কুটুম আসছে প্রথমবারের মতো। ভালোমন্দ খাওয়ানোটা নিতান্তই দরকার।
কিন্তু প্রমার মায়ের মতে এখনই একসাথে এতোগুলো টাকা খরচ করা উচিত হবে না।সামনে বিয়ে আনুসাঙ্গিক আরও অনেক খরচ আছে।
মিসেস সায়রা বানু একজন বৈষয়িক মানুষ। গোনা টাকার
মধ্যবিত্ত সংসারে তাদের আলগা সাধ আহ্লাদের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
তাদের পাড়ার এক মহিলা ‘রেনু’স কিচেন’ নামে ঘরে বসে কেটারিংএর বিজনেস শুরু করেছেন কোভিড লকডাউনের সময়।
প্রথম প্রথম পাড়া প্রতিবেশিরাই ছিল তার প্রধান কাস্টোমার। এখন ফেসবুকে তার পেইজে প্রচুর অর্ডার আসে ঢাকার দূর দুরান্ত থেকে। তিনি রাতারাতি বেশ নাম করে ফেলেছেন, একেবারে জমজমাট অবস্থা। প্রমার মা প্রথম থেকেই মহিলার বিজনেসে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বলে আজ স্পেশাল ডিল পেয়েছেন প্রমার বিয়ের পাকা কথা উপলক্ষে।
মিসেস সায়রা বানুর অনুরোধে রেনু’স কিচেনের মিসেস রেনুকা রহমান
কাচ্চি বিরিয়ানি সহ শামি কাবাব, গরুর রেজালা, মুরগীর রোস্ট আর বোরহানি অর্ডার নিয়েছেন। আর বাড়িতেই সালাদ আর টমেটোর একটা টক বানিয়েছেন।
মোড়ের কাছের মিষ্টির দোকান থেকে দই, মিষ্টি নিয়ে আসা হয়েছে।
সন্ধ্যায় সবাই আসবে।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন হওয়াতে প্রমা ভেবেছিল একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। কিন্তু ঘরে মেহমান আসবে বলে তার মা সকাল থেকেই ঘরদোর সাফ করছেন, ইস্ত্রী করা বিছানার চাদর, বেডকাভার নামিয়েছেন অনেকদিন পর। বসার ঘরের সোফা কুশনের নতুন কাভার লাগানো হয়েছে। ড্রয়িং রুমের সোফাগুলো একদিকে সরিয়ে হাটাচলার জায়গা আরেকটু বড় করা হয়েছে।
পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি রিনা ভাবী, তার ছাদবাগান থেকে বেলী আর গন্ধরাজ ফুল পাঠিয়েছেন। বসার ঘরের ক্রিসটালের ফুলদানিটা প্রমার ছোট চাচা আয়ারল্যান্ড থেকে এনেছিল। সেখানে সদ্য ফোঁটা সুগন্ধি ফুল গুলো ভারি সুন্দর শোভা পাচ্ছে।
প্রমার একাধারে কেমন যেন নার্ভাস আবার প্রচন্ড আনন্দ লাগছে।
হিমুকে তার খুউব পছন্দ হয়েছে।
সে কখনও কল্পনাতেও ভাবে নি যে এ্যারেন্জ ম্যারেজের প্রপোজালে আসা ছেলের প্রেমে সে একবারে ‘ভরাডুবি টাইপ’ প্রেমে পড়ে যাবে!
হিমু অত্যন্ত চমৎকার করে কথা বলে, মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো।দেখতে মোটামুটি হলেও তার কথা বলার ভঙ্গি তার পারসোনালিটিকে অন্য লেভেলে নিয়ে যায়।
স্কুলের পর সেই একদিনেই একাকী সামনাসামনি দেখা হয়েছিল তাদের। গলির মোড়ে মোড়ে আজকাল কফিশপ থাকে। সেরকম একটা স্থানীয় কফিশপে বসেছিল তারা।
হিমুর খুব শখ ছিল প্রথম সাক্ষাতে প্রমাকে কোন ফ্যান্সি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে। ঢাকায় আজকাল এতো সুন্দর সুন্দর রেস্টুরেন্ট হয়েছে। অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ সেগুলোতে।
কিন্তু প্রমার হাতে সময় ছিল না। সে বারবার বলছিল যে সন্ধ্যা হওয়ার আগে তার বাড়ি ফিরতে হবে।
অগত্যা কি আর করা। কাছের কফিশপেই যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ঠান্ডা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেতে ঢুকে প্রমার একটু স্বস্তি লাগছিল। বাইরে এখনও প্রচন্ড গরম।
—প্রমা, কি খাবে কফি না কি কোল্ড ড্রিংকস?
—আমি কফিই নিবো।
—আমিও কফি নিবো। আসলে দিনে ২-৩ বার ক্যাফেইন খাওয়া আমার অভ্যাস।
—তাই ? আপনার রাতে ঘুমোতে অসুবিধা হয় না ?
—নাহ্। নাইট ডিউটির জন্য যখন রাত জাগতে হতো তখন ক্যাফেইন মানে চা-কফি ছিল আমার একমাত্র ভরসা।
—ও আচ্ছা। আপনার আর এখন নাইট ডিউটি করতে হয় না ?
—নাহ। এখন আমার জুনিয়র ডাক্তাররা নাইট শিফ্ট করে।
আচ্ছা এবার তোমার কথা বলো এখন।আমার কাজের কথা বলতে ভালো লাগে না।
—আমার? ….আমার কি কথা ?
প্রমা অবাক হয়ে জিগেস করলো।
—মানে তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
—ভবিষ্যত পরিকল্পনা ? ….আমার আসলে তেমন কোন পরিকল্পনা নাই।
প্রমা একটি নিষ্প্রভ হয়ে বললো। সে মনে মনে ভাবলো, তাদের মতো পরিবারে জন্মালে কারোর তেমন কোন বড় উচ্চাশা থাকতে নেই।
—সত্যি? আমার তো তোমার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্য ধারণা।
— কি ধারণা ?
—আমার মনে হয় তুমি খুব দৃঢ় প্রত্যয়ী আর তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে তোমার কোন বাঁধা মানতে রাজি না।
—আপনার কি দেখে মনে হলো আমি এরকম?
—ঠিক জানি না। তবে আমার ইনটুইশন খুব ভালো। সারাদিন রোগীদের সাথে কথা বলতে বলতে মানুষ সম্পর্কে আমার একটা ভালো ধারণা হয়ে গেছে। মানুষ চিনতে সাধারণত আমার ভুল হয় না।
—ইন্টারেস্টিং!
—হুম। আচ্ছা, তুমি কি আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাও ?
—….জানি না।
প্রমা মনে হয় একটু লজ্জা পেলো। এরকম স্ট্রেড ফরোয়ার্ডভাবে তার সাথে কোন ছেলে আগে কথা বলে নি।
—তুমি বলেছিলে যে আমার মা সম্পর্কে তোমার কৌতূহল হয়েছে। আমার মায়ের নাম ছিল উপমা আখতার। তোমার নামের সাথে তার যেমন মিল তেমনি চেহারাতেও অনেক মিল।
—কি হয়েছিল ওনার? মানে কি করে মারা গেলেন তিনি?
—আমার জন্মের পর সে না কি অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পেতো। তারপর ধীরে ধীরে সে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। তারপর আমার যখন চার বছর বয়স তখন তিনি মারা যান।
—আহারে। আপনার কি মনে আছে আপনার মায়ের কথা ?
—এইতো আবছা আবছা কিছু বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো স্মৃতি মনের অন্ধকারে জেগে আছে। আমি আসলে আমার খালামনি আর নানির কাছে বড় হয়েছি।
—আপনার মা খুব লাকি। তিনি এতো আগে মারা যাওয়ার পরও আপনার হৃদয়ে সতত বিরাজমান।
—হুম। ‘মা’ বলে কথা তো।তাকে ভুলে কি করে বলো ?
আচ্ছা, অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি চলো।তোমার কি আমাকে পছন্দ হয়েছো না কি অসহ্য লাগছে ?
সে কথা শুনে প্রমা এবার হেসে ফেললো।
—সত্যি কথা নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলবো না।
—আমি এখনও আপনাকে চেনার চেষ্টা করছি।
—আই আন্ডারস্ট্যান্ড। প্লিজ টেইক এ্যাজ মাচ টাইম এ্যাজ ইউ নিড।
নো রাশ!
এমনি সময় প্রমার মোবাইলে তার মা কল করলো।
—মা তুই রওয়ানা হয়েছিস? আজ পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসিস, কেমন?
—কেন মা ? কোন স্পেশাল প্ল্যান আছে কি?
—না…..কোন প্ল্যান না। এমনি বললাম। তোর বিয়ে হয়ে যাবে কিছুদিন পর। তারপর তো পরের বাড়ি চলেই যাবি। তোকে আর কাছে থেকে আদর করার সুযোগ কি আর আসবে?
—মা, কি যে বলো না! আমি আসছি একটু পরেই। তুমি চিন্তা করো না।
প্রমা এবারও তার মায়ের কাছে হিমুর সাথে দেখা হওয়ার কথাটা এড়িয়ে গেল।
মা-কে আগ বাড়িয়ে বেশি কথা বলতে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে!
হবু বরের সাথে কফি খাওয়াটা তো কোন অপরাধ নয়। তারপরও মনের ভেতর কেমন একটা জড়তা কাজ করে।
তাদের পরিবারের সবাই একটু বেশিরকম কনজারভেটিভ।
রবিন মামা আর মামী প্রমার সাথে হিমুর এভাবে দেখা করাটা হয়তো এপ্রুভ করতেন না।
আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো তাদের দুজনার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তারা দুজন একজন আরেকজনের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল যেন বহু পুরাতন চেনা।
এরপর থেকে মোবাইলে কথা আর টেক্সট চলছে।
তারা দুজনই যার যার প্রফেশনে অত্যন্ত ব্যস্ত। তারপরও সময় করে হিমু প্রমার সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছে।
—আগামীকাল আপনাদের বাড়ি থেকে মুরব্বির আসছেন বিয়ের পাকা কথা বলার জন্য।
—আমি জানি।
—ওহ।
—তুমি যদি চাও তবে আমিও আসতে পারি।
হিমু মুচকি হেসে বললো।
—আপনি… আপনি কেন আসবেন? মানে আপনাকে কি আপনার খালামনি আনতে রাজি হবেন ?
—কেন হবে না? বিয়েটা তো আমারই হচ্ছে, তাই না?
—হুম।
—তুমি তো বললে না….. আসবো ?
—আচ্ছা আসেন।
—দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল !
প্লিজ পারলে একটা সবুজ রঙের শাড়ি পরো। সবুজ রঙটা আমার খুবই প্রিয়।
—আচ্ছা দেখি আছে কি না।
—ক্যান্ট ওয়েইট টু সি ইউ এগেইন মাই ব্রাইড টু বি !
প্রমা ব্লাশ করতে করতে কিছু বলতে পারলো না।
~~~~##~~~~
প্রমা আর হিমুর বিয়ের তারিখ পাকা হয়ে গেল আগামী মাসের ১৭ তারিখে। হিমু একটা হাল্কা নীল রঙের শার্ট আর থাকি রঙের প্যান্ট পরে এসেছে আজ। তাকে বেশ দেখাচ্ছে।
প্রমা হিমুর কথা মতো তার মায়ের একটা গাঢ় সবুজ রঙের জামদানি শাড়ি পরেছে।
মুরুব্বিরা যখন গল্পে ব্যস্ত তখন হিমু প্রমাকে সংগোপনে টেক্সট পাঠালো।
—প্রমা, আজ তো তোমাকে স্বর্গের অপসরী লাগছে।তোমারে কিডনাপ করে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
প্রমা মুচকি হেসে লিখলো,
—Patience Is a Virtue!
—আমি খালামনিকে বলি কাজী ডেকে আজই নিকাহ্ করে ফেলুক।
—-কি বলেন? আর মাত্র এক মাস!
—এই এক মাস মানে আমার কাছে একশ বছর !
—দুলাভাই কাকে টেক্সট করছেন ?
হঠাৎ করে তনিমা এসে হিমুকে জিগেস করলো।
—কাজে, খুব ইম্পরটেন্ট টেক্সট।
—কাজের বস কি সবুজ রঙের জামদানি পরনে?
বলেই তনিমা হেসে চলে গেল।
হিমু একটু লজ্জা পেলো। সে তার মোবাইল ফোন পকেটে রেখে চুপচাপ গুরুজনদের কথায় ধ্যান দেয়ার বৃথা চেষ্টা চালালো। তার মন পড়ে আছে সবুজ রঙের জামদানি পরনে রূপসী মেয়েটির প্রতি।
হিমু তার খালাসহ অন্যান্য মেহমানরা একে একে চলে গেল।
রাতের বেলা প্রমা শুয়ে শুয়ে হিমুর কথা ভাবছে আর মুহূর্তে মুহূর্তে শিহরিত হচ্ছে!
আনন্দঘন আবেশের পাশাপাশি কোথাও কিসের যেন একটা খটকা তার মনের ভেতর গেঁথে আছে।
সব কিছু এতো সুন্দর নির্ঝঞ্ঝাটভাবে একদম তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু শেষমেশ সত্যি সত্যি কি তাদেক বিয়েটা হবে ?
(চলবে)
–বিপাশা বাশার