একটি মৃত্যু এবং একটি বিয়ে-৩

‘একটি মৃত্যু এবং একটি বিয়ে’

প্রমা ইমেইলটা পাঠিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। দেখা যাক মিস্টার হিমু কি সংগে সংগেই উত্তর দেয় কি না। কিন্তু তাকে হতাশ করে ইমেইলের বক্স শূন্য রয়ে গেল। প্রমা মন খারাপ করে খানিকটা অভিমান নিয়ে ঘুমোতে চলে এলো।

—আপুমনি, তুমি কি দুলাভাইকে টেক্সট করছিলে ?
প্রমার ছোট বোন তনিমা তাকে অবাক করিয়ে দিয়ে পাশ থেকে হঠাৎ বলে উঠলো।

—কি রে তনু, তুই এখনও ঘুমাস নাই ?

—বলো না আপুমনি! দুলাভাইএর সাথে টেক্সটে কি কথা হচ্ছিল ?

—পাকনামো করিস না তো। আমি আমার অফিসের কাজে ইমেইল করছিলাম। তাছাড়া মিস্টার হিমুর ফোন নম্বর আমার কাছে নাই। টেক্সট করবো কি করে ?
প্রমা যথেষ্ট গম্ভীর ভাব নিয়ে কথাগুলো বলার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো।
তার ছোটবোনটা বেশ ইঁচড়ে পাকা হয়েছে আজকাল। রাত জেগে মাঝে মাঝে সে মোবাইলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাকে যেন টেক্সট করে।
তার কি বিশেষ কেউ আছে?
এ বয়সে অবশ্য সেরকম বিশেষ কেউ থাকতেই পারে।
এতে অন্যায় কিছু নেই। প্রমা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
বড়োবোন সুলভ গাম্ভীর্যটা বজায় রাখার চেষ্টা করে।

—কি বললে? দুলাভাইএর ফোন নম্বর তোমার কাছে নেই? তার নম্বরটা তো বায়োডাটাতেই লেখা ছিল। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।

—না না। থাক লাগবে না। এতো রাতে কাউকে আমি টেক্সট করবো না। সেটা অভদ্র দেখাবে।

—লাগবে না মানে? একশ বার লাগবে। আর দুলাভাই কি অন্য
কেউ ? ওনার সাথে এতো ফরমালিটির কি আছে ?
সে কথা বলেই তনিমা এক লাফে উঠে মা-বাবার ঘর থেকে হিমুর বায়োডাটা নিয়ে এলো।

প্রমার মা আজ সকাল থেকে বহু আত্মীয়স্বজনসহ বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশি সবাইকে একে একে ফোন করে প্রমার এনগেজমেন্টের খবর জানিয়েছেন। হবু মেয়ে জামাইএর বায়োডাটা সামনেই রাখা ছিল।
সবাই কতরকম প্রশ্ন করেন। সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য মিসেস সায়রা বানু হিমুর বায়োডাটা হাতের কাছেই রেখেছিলেন।

—ভাবী, তা ছেলে কি করে? ডাক্তার ? কোন মেডিকেলে পড়েছে… সরকারি না কি প্রাইভেট ?

—ঢাকায় কি ছেলের পরিবারের নিজেদের বাড়ি আছে ?

—আহারে ছেলের মা নেই? তাহলে তার বাবা কি আবার বিয়ে করেছেন ?

—ছেলেরা কয় ভাই বোন ? ছেলে কত নম্বর ?

—ছেলের দেশের বাড়ি কোথায়?
ইত্যাদি ইত্যাদি …. মানুষের কৌতূহলের তো শেষ নাই!

—আপুমনি, এই নাও। দুলাভাইএর বায়োডাটা। ফোন নম্বর আর ইমেইল এড্রেস আছে এখানে লেখা।

—হুম।

—আচ্ছা আপুমনি, চলো এক কাজ করি। ফেসবুকে ওনার প্রোফাইল চেক করে দেখি।

—বাদ দে তো এসব। আমি ভীষণ টায়ার্ড, খুব ঘুম পাচ্ছে রে।

কথার মাঝেই তনিমা ম্যাজিকের মতো ফেসবুকে হেমায়েত হোসেন হিমুর ফেসবুক প্রোফাইল বের করে ফেললো।
হিমুর প্রোফাইলের ছবিটা প্রমা আড়চোখে দেখে নিলো।
ছবিটা মনে হয় পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি স্ক্যান করে দেয়া।
অত্যন্ত সাদামাটা হলেও ছবিটা দেখেই প্রমার বুকে কেমন যেন একরকম চিনচিন করে উঠলো। হঠাৎ এক শূন্যতা এসে গ্রাস করলো তাকে।
এরকম অদ্ভুত অনুভূতি তার আগে কখনও হয় নি।

এই সেই মিস্টার হিমু….যে কি না প্রচন্ড রকম সেকেলে। যিনি ফোন কিংবা টেক্সট না করে বয়স্ক মানুষদের মতো ইমেইল করেছেন তার হবু স্ত্রীকে !

—আপুমনি, দ্যাখো দুলাভাই কিন্তু ঠিকই ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস বদলে দিয়েছে গতকাল।
প্রমার বিশ্বাস হলো না বোনের কথা।সে ভালোমতো মোবাইলে চেক করে দেখলো, মিস্টার হিমু সত্যি সত্যি গতকাল রাতে তার ফেসবুক প্রোফাইল বদলে লিখেছে, ‘এনগেজড’ !

—আপু, তুমি তো পিছিয়ে আছো। এখনও ফেসবুকে স্ট্যাটাস চেন্জ করো নাই।

—ঠিক আছে আগামীকাল করবো। তাছাড়া সময়তো চলে যাচ্ছে না। বিয়ে মাত্র ঠিক হলো।

—তুমি নিশচয়ই খুব এক্সাইটেড বিয়ের ব্যাপারে আপু? তোমার আংটিটা এতো ভিনটেজ হয়েছে না ! খুবই অথেন্টিক।

—তুই এতো কথা জানিস কি করে তনু?

—আমি প্রচুর ফ্যাশন ম্যাগাজিন পড়ি, ফলো করি যে ! ইউ আর টকিং টু আ ফিউচার ফ্যাশন ডিজাইনার আপুমনি !

—হুম। ঠিক আছে আমার বিয়ের ফ্যাশন ডিজাইনার তুই হবি।
আমার আর চিন্তা নাই।

—আবার জিগস্….
তনিমা ঢং করে বললো।
সে কথা শুনে প্রমা না হেসে পারলো না।
কিছুক্ষণ পর দুই বোন মনে হাজারো স্বপ্নের বীজ বুনতে বুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
বড়ো বোন স্বপ্নে ভাবছে তার হবু বরের কথা আর ছোট বোন ভবিষ্যতে সুপার মডেলদের ফ্যাশন ডিজাইনার হবার স্বপ্নে ভেসে বেড়াতে লাগলো।

~~~##~~~

প্রমার রুমের সাথেই একটা লাগোয়া বারান্দা আছে। সেখানে কাপড় শুকানোর কাজ ছাড়া আর তেমন যাওয়া হয় না কারণ বারান্দাটা ভীষণ ছোট।
বারান্দার দরোজায় টুক টুক শব্দ হচ্ছে।
প্রমার ঘুম ভেঙে গেল।

সে পরিষ্কার শুনতে পারছে বারান্দায় একটু খসখস শব্দ। হঠাৎ করেই ভীষণ একটা ভয়ের অনুভূতি এসে তাকে গ্রাস করলো।

এ অসময়ে কে এলো তাদের বারান্দায়?
চোর না তো ?
না কি অন্য কেউ বা কিছু ?

ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।একটু পানি না খেলে মনে হয় জীবন চলে যাবে। প্রমা নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো। তারপর পা পা টিপে টিপে পড়ার টেবিলে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খাওয়ার পর একটু স্বস্তি পেলো।
খুলবে না খুলবে না করেও সে কি ভেবে বারান্দার দরোজা খুলে দিলো।
দরোজা খুলতেই সে যা দেখলো তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
একটা লোমশ কালো বিড়াল বারান্দার কোণায় ঘাপটি মেরে বসে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। অন্ধকারে বিড়ালের চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে জ্বলজ্বল করছে।

প্রমা বরাবরই জন্তু জানোয়ারের প্রতি অনেক মায়া। সেদিন রাস্তায় তাদের গেটের পাশে সে এই কালো বিড়ালটাকে দেখেছিল। তারপর এক বাটি দুধ নিয়ে রেখে এসেছিল সেখানে।
প্রমা বিড়ালের দেখে ভীষণ এবার হলেও ভয় পাই নি। সে কাছে গিয়ে বিড়ালটাকে কোলে নিতে চাইলে বিড়ালটা এক লাফে বারান্দায় গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

প্রমা বারানদায় দাঁড়িয়ে একটু বাইরে তাকালো। আজ রাতের আকাশটা একদম পরিষ্কার ফকফকে।অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে সেখানে। তাদের সাথে সাথে চাঁদটাও নরম আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
পরিবেশ দূষণের কারণে ঢাকার আকাশ সচরাচর এমন নির্মল দেখা যায় না।

গতকাল থেকে অনেকগুলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এগুলো কি সবই কাকতালীয় না কি এদের মাঝে কোন যোগসুত্র আছে ?

প্রথমত চাঁদনীরাতে গতকাল সামনের বাড়িতে কার ছায়া দেখেছিল সে?

তারপর কোন এক আগন্তুক এসে তার সিএনজির ভাড়া দিয়ে উধাও।

আবার আজ রাতে বারান্দায় কালো বিড়াল।

প্রমার জীবনে প্রথমবারের মতো ভালোবাসার চিঠি এলো।

প্রতিটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও কেন যেন মনে হচ্ছে এগুলো একে অপরের সাথে জড়িত।
প্রমা চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না।
আরও একটি ব্যস্ত দিনের পূর্বাভাস নিয়ে সে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।

~~~##~~~

সকাল থেকেই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে। কাজের মধ্য ফোন ধরার প্রশ্নই ওঠে না। তাই প্রমা মোবাইল মিউট করে রাখলো।
ক্লাস ফোরের বাচ্চা গুলো ভীষণ দুষ্টু টাইপের। দেখতে বড়োসড়ো হলেও এদের স্বভাব এখনও শিশুসুলভ।
এরা ক্লাসে অনর্গল কথা বলে। টিচারদের বিভিন্ন কসরত করতে হয় সবার এটেশন পাওয়ার জন্য।
পড়ানোর সময় অসংখ্য প্রশ্নবানে তারা প্রমাকে জর্জরিত করে।
আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চারা তো এমনিতেই অভিজাত পরিবারের, একটু বেশি স্মার্ট।

এ বছরের ক্লাসটা প্রমার বিশেষ প্রিয়। বাচ্চাগুলোও প্রমা মিস বলতে পাগল।

—প্রমা মিস, আজ গোলাপী শাড়িতে আপনাকে খুব প্রিটি লাগছে।
ক্লাসের ব্রেকে এসে তার এক ছাত্রী বললো।

—থ্যাংক ইউ সিমিন।

—মিস, ইউ নো পিংক ইজ মাই ফেভারিট কালার।

—হুম। লক্ষ্য করেছি। তোমার স্কুলের ব্যাগ থেকে শুরু করে পানির বোতল সবই তো পিংক।

—পিংক আমারও প্রিয় রং।
পাশ থেকে সানিয়া বলে উঠলো।

বাচ্চাদের সাথে কথা ফাঁকে প্রমা লক্ষ্য করলো তার ফোন ভাইব্রেট করছে। সে তাকিয়ে দেখলো ১০টা মিস কল একই নম্বর থেকে।
কে এতো বারবার ফোন করছে ?
সেল্স কল না তো আবার ?
না কি তার হবু খালা শাশুরি ? মা বলেছিলেন তিনি প্রমার নম্বর নিয়েছেন তার কাছ থেকে।মহিলা তো এমনিতেই একটু বেশি কথা বলেন। তার ফোন ধরা যাবে না এখন।
তাদের লাঞ্চব্রেক খুব অল্প সময়।

টিচারস কমন রুমে সবাই যেন একসাথে কথা বলছে। তাদের সবার মধ্যে বেশ মিলমিশ। রুবা আপা আজ তার নিজ হাতে বানানো চালতার আঁচার নিয়ে এসেছেন। ইউ টিউব দেখে আজকাল তিনি রান্নায় বেশ পটু হয়ে গেছেন। তার সব রান্না আইটেমের গিনিপিগ হলো তার কলিগরা।

—চালতার আঁচারটা কিন্তু দারুণ হয়েছে রুবা আপা।

—হুম। সেই ছোটবেলার ফ্লেভার আনার চেষ্টা করেছি। দেখো না, লাল-কমলা ফুড কালারও মিশিয়ে দিয়েছি।

সবাই খুব ব্যস্ত আঁচার টেস্টিংএ। প্রমার এর মাঝে তার ইমেইল চেক করে দেখলো।
নাহ্ ! যে কাঙ্খিত ইমেইলের আশায় সে বারবার ইমেইল চেক করেছে, সেখান থেকে কোন ইমেইল আসে নি।

কি আশ্চর্য ! মিস্টার হিমু তাহলে কেন লিখেছিল,
“আমি অপেক্ষায় থাকবো”?

প্রমার মনে অভিমানের ধূসর মেঘ জমতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
সে ঠিক করেছে হিমু আবারো ইমেইল করলে সে আর উত্তর দেবে না।

লাঞ্চব্রেকের পর খানিকটা মন খারাপ নিয়েই সে বাকি ক্লাসগুলো নিলো।সকালের ফুরফুরা মুডটাও এখন কেমন চুপসে গেছে।

স্কুলের কাজ শেষ করে সে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়লো।গতকালের মতো বাস মিস করতে চায় না সে।
স্কুলের গেইটের বাইরে এসে সে বিরাট এক ধাক্কা খেলো।

হিমু দাঁড়িয়ে সেখানে। তার হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা।

—কেমন আছে প্রমা ?
শুদ্ধ উচ্চারণে কি গভীর কণ্ঠস্বর!

—আমি ভালো আছি।
প্রমার ভ্রম এখনও পুরোপুরি কাটে নি।

—আমি তোমাকে সকাল থেকে কমপক্ষে ২০ বার ফোন করেছি। জানি তুমি স্কুলের কাজে ব্যস্ত। তাই সোজা চলে এলাম।

—ও আপনিই ফোন করছিলেন? সরি, নম্বরটা চেনা ছিল না বলে ধরি নি।

—ইটস পারফেক্টলি ফাইন।
আচ্ছা, তোমার কি একটু সময় হবে আজ ? চলো কোথাও কফি খেতে যাই ?

প্রমা মোবাইল ঘড়িতে দেখলো বিকেল পাঁচটা বাজে।
সে কি করবে বুঝতে পারছে না।
মন চাইছে হিমুর সাথে কফিতে যেতে। বেশি দেরি করে বাড়ি ফিরলে আবার অন্ধকার হয়ে যাবে।

—আমি বেশিক্ষণ বসতে পারবো না।

—কোন অসুবিধা নাই।চলো কাছের একটা কফিশপেই যাই তাহলে।

—আচ্ছা।

এই প্রথম পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। হয়তো বাকিজীবনটাও এমনি করেই হাঁটা হবে একে অপরের সাথে।

(চলবে)

–বিপাশা বাশার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here