#একজন_রুশা,চতুর্থ পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
ছোট্ট নৈঋত আর উত্তরা তাদের বাবা-মা’কে বাপি আর মামনি বলে ডাকতো। একদিন বাইরের খেলার মাঠ থেকে নৈঋত ছুটতে ছুটতে এলো।তার চোখমুখ লাল। উত্তরাকে বললো,” জানিস,এতোদিন আমরা কি লজ্জার কাজ করেছি? বাপি আর মামনি ডেকেছি। এসব ডাকে একদম ছোট বাবুরা। বড়রা ডাকে আব্বা আম্মা। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।”
আঁতকে উঠলো উত্তরা। কি লজ্জা! কি লজ্জা! তখন পর্যন্ত একটাও দুধ দাঁত না পড়া উত্তরা নিজেদের অজ্ঞানতা ও নির্বুদ্ধিতায় লজ্জায় নুয়ে পড়লো।
নৈঋত বললো,”এখন থেকে আব্বু আর আম্মা ডাকবি। মনে থাকবে?”
থাকবে না আবার? রুশা প্রাণপণে ছেলেমেয়েকে নিবৃত্ত করতে চাইলো। লাভ হলো না। বাচ্চা দু”জন আব্বু আর আম্মা ডাকা শুরু করলো। পরবর্তীতে তাদের দেখাদেখি ঈশানী।
সুখে-দুঃখে, আনন্দে -বেদনায় রুশার দিনগুলো কাটছিলো। রফিক সাহেবের বদলির চাকরি। রুশা সবসময় ছেলেমেয়েদের নিয়ে রফিক সাহেবের কর্মস্হলে থেকেছে। বদলির যা ঝক্কি। সব ঝক্কি বলতে গেলে রুশা একাই বহন করতো। শাশুড়ি প্রায় সময় তার কাছে থাকতেন। রুশার শাশুড়ি খারাপ নন মোটেই, কিন্তু ছোট বেলা থেকে দেখে আসা সংস্কার, প্রথার বাইরে যেতে পারেন নি । খুবই অল্প বয়সে বাপ মা হারিয়েছিলেন তিনি,খুবই অল্প বয়সে। মানুষ হন বড় ভাইয়ের কাছে। ভাই খুব ভালোবাসতেন ছোট বোনগুলোকে। খুব অল্প বয়সে রুশার শাশুড়ির বিয়ে হয়ে যায়। বড় ভাইয়ের ভালোবাসাময় কুটির থেকে শামসুন্নাহারকে ছিটকে পড়তে হলো মায়াহীন জগতে। স্বামী বড়ই কঠিন চরিত্রের, বিশেষত স্ত্রীর ক্ষেত্রে। বউকে লাঞ্ছনা, অপমান, অবহেলা করা ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। অল্পবয়সী শামসুন্নাহার দিনভর কাজ করতেন স্বামীর বাড়িতে , তিনি খেলেন কি খেলেন না, তাঁর শরীর ভালো না মন্দ,এটা কোনো বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না সংসারে। সন্তানদের মানুষ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। রফিক -শফিক দুই ভাইয়েরই স্বপ্ন ছিলো বড় কিছু হওয়ার, ওই অজপাড়াগাঁয়ে থেকেও। লেখাপড়ার জন্য ভীষণ কষ্ট করেছেন দুই ভাই, অন্যান্য ভাই বোনদের মধ্যে চেষ্টাটা ছিলো না। শামসুন্নাহার গোপনে ছাগল বেচে,মুরগী বেচে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ বহন করেছিলেন। রফিকের বাবার ইচ্ছা ছিলো, কলেজ পাশ করার পরে শফিক রফিক আর যেন পড়াশোনা না করে। বিয়ে শাদি করে সুখে ঘর সংসার করবে আর বাবার জমিজমা দেখাশোনা করবে। কিন্তু দুই ভাইয়ের অনেক দূর লেখাপড়া করার ইচ্ছা। কাজেই ভরসা ছিলো মা। মায়েরও বড় সাধ ছিলো, অনেক বড় হোক তাঁর সন্তানেরা।
রফিক সাহেব আর তাঁর ভাই মা’কে হতাশ করেন নি। দুজনেই সংগ্রাম করে পড়ালেখা করে সমাজের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। বাবা-মা তো বটেই, অন্যান্য ভাইবোনদের ব্যাপারেও কখনো কোনো অবহেলা করেন নি।
রুশাও স্বামীর এই গুণকে খুবই শ্রদ্ধা করে।
কিছু বিষয় খারাপ লাগতো বৈকি! রফিক সাহেব নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্য যথেষ্ট ব্যয় করতেন কিন্তু রুশার বাড়ির জন্য করতেন না। এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, “সরকারি চাকরি করি।যতো উঁচু পোস্ট হোক,কয় টাকা বেতন পাই? এ দিয়ে বাড়িভাড়া, বাচ্চাদের লেখাপড়া,সংসার খরচ, অল্প স্বল্প জমানো। সবার জন্যইতো করতে মন চায়,কিন্তু সাধ্য কই?” তাঁর কথা খুবই সত্য। কিন্তু প্রতি মাসে রুশাকে হাতখরচটা দেওয়া খুবই উচিৎ ছিলো। নিজের বাড়ির কর্মক্ষম মানুষগুলোকে সবসময় না দিয়ে মাঝেমধ্যে রুশার বাবার বাড়ির কাউকে দেওয়া যেতো। এটাইতো ব্যালান্স। শুধু রুশা বলে নয়, যে কোন গৃহিণীর কাজ কারোর চেয়ে এতোটুকু কম নয়। রুশার বিষয়ে কেউ বলতে পারবে না, সময় মতো নাস্তা টেবিলে হাজির হয় নি। সকালের নাশতা,দুপুরের খাবার,বিকালের নাস্তা,রাতের খাবার, সবকিছু সময় মতো উপস্থিত। গৃহ সহকারী কখনো থাকতো,কখনো থাকতো না, ছুটা খালা দিয়ে কাজ চালানো হতো অনেক সময়। তিন বাচ্চার দেখাশোনা। বাড়িতে মেহমান প্রায় সবসময় থাকতেন। তাঁদের যত্ন। ঘর দুয়ার টিপটপ রাখা। এগুলোর কোনো মূল্য নেই? সব শ্রমেরই তো মূল্য আছে,এই শ্রমের মূল্য কই? অথচ এটাইতো কঠিন শ্রম, একঘেঁয়ে শ্রম। এই শ্রমের এতোটুকু মূল্যায়ন কেন করা হয় না? কেন সুগৃহিনীর বেতন নেই? অনেকে বলবে,এ কেমন কথা?নিজের সংসারের কাজে আবার বেতনের কথা আসে কেন? বেতনের কথা আসে এইজন্য যে প্রতিটা মানুষের আর্থিক স্বাধীনতার দরকার আছে। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা নিঃসন্দেহে এক নয়। আমি ঘরের সব কাজ সামাল দিবো, সপ্তাহে একটা দিনও আমি ছুটি পাবো না,অফিসে একজন যা করে ঘরে আমি তেমনই পরিশ্রম করবো, কিন্তু আমার নিজের কোনো অর্থ থাকবে না? আমাকে স্বামীর কাছে চেয়ে চেয়ে নিতে হবে? রফিক সাহেব অবশ্য বছরে একবার শ্বশুর শাশুড়িকে জামা কাপড় দিতেন। রুশার ভাই-বোন, অন্যান্য স্বজন এলে খুবই আদর যত্ন করতেন।
রুশা খুব মেধাবী। কিশোরী বেলায় তার অনেক স্বপ্ন ছিলো। কখনো পাইলট হওয়ার চিন্তা, কখনো ডাক্তার। কিন্তু অতো অল্প বয়সে তার মতের তোয়াক্কা না করে অতি অনাড়ম্বর ভাবে বিয়ে হওয়া, সংসারের চক্করে পড়া, বিয়ের কাঁটায় কাঁটায় এক বছরের মাথায় নৈঋতের জন্ম, সংসারের কাজ বা নৈঋতের দেখাশোনায় বাবা-মা,শ্বশুর -শাশুড়ির তিলমাত্র সাহায্য না পাওয়া, নৈঋতের অসুখ, সেটার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে উত্তরার আগমন, রফিক সাহেবের এখানে বদলি সেখানে বদলি, অতিথি সেবা,ঈশানীর জন্ম _ সব মিলে রুশার নিজেকে নিয়ে আর কোনো রঙিন স্বপ্ন অবশিষ্ট ছিলো না। তখন ছেলেমেয়ে তিনটাই ছিল তার স্বপ্ন,তার আনন্দ।
কতো ঝড় ঝাপটা জীবনে এসেছে। সবকিছু ধৈর্য্য ধরে সামলেছে রুশা। পক্ষীমাতার মতো আগলে রেখেছে স্বামী ও সন্তানদের। রুশার সাহস,ধৈর্য্য ও মনোবল আসলেই অতুলনীয়।
শাশুড়ি একসময় স্ট্রোক করলেন। শরীরের একপাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। রুশা রান্না করতো,সংসার সামলাতো,অসুস্থ শাশুড়িকে দেখতে আসা মেহমানদের সামলাতো,ছোট্ট ঈশানীকে স্কুলে আনা নেওয়া করতো আর করতো নিষ্ঠার সাথে শাশুড়ির দেখাশোনা। প্রতিদিন বেলা সাড়ে বারোটায় নিজের হাতে শাশুড়িকে কুসুম গরম পানিতে সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো, পরিস্কার ধোয়া শাড়ি পরিয়ে দেয়া, বড় কাঁসার থালায় ভাত নিয়ে রান্না করা সব ক’টা পদ দিয়ে নিজের হাতে দুইবেলা খাওয়ানো, অনেক আন্তরিকতা ও নৈপুণ্যের সাথে করতো রুশা।
একে একে চলে গেলেন শাশুড়ি, মা,বাবা। শ্বশুর তো অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন।
ছেলেমেয়েরাও দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলো।
নৈঋত ও শ্রাবণী পরস্পরকে পছন্দ করে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করলো। রফিক -রুশা তিন ছেলেমেয়েকে ই
এই স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন, খুব অসামঞ্জস্য পূর্ণ না হলে তোমরা তোমাদের ইচ্ছা মতো জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে পারো। জামাইদের শাশুড়ি সাধারণত ভালো হয়,জামাইদের ভালো খাওয়ায়-দাওয়ায়,যত্ন-আত্তি করে, কিন্তু বৌদের শাশুড়িরা যে এতো ভালো হয়, তা উত্তরা আগে দেখেনি। শ্রাবণী চাকুরীজীবী, তার শিক্ষা জীবন-কর্মজীবন-পারিবারিক জীবন কোন কিছুতেই কোন বাধা সৃষ্টি করেন নি রুশা। করবেন ই বা কেন? তিনি শিক্ষিতমনা। কারো ব্যক্তি জীবন বা পারিবারিক জীবনে নাক গলানো তাঁর রুচিতে বাধে। সবাই অ্যাডাল্ট। সবাই লেখাপড়া জানা।তাছাড়া নিজের সন্তানদের তিনি ভালো-মন্দের বিষয়টা শিখিয়েছেন সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে। এখন যে যার সংসার নিজস্ব বিবেক দিয়ে সামলাক।
তিন ভাইবোনের মধ্যে উত্তরার বিয়ে হয়েছে সবার আগে।স্বামী বা শ্বশুর বাড়িতে উত্তরা কোন কষ্ট পেলে মাঝে মাঝে বাবা-মা’কে বলতো। রফিক -রুশা সবসময় মেয়েকে বলতেন,”তুমি জানো,কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। আমরা কেউ শতভাগ ভালো না। ভুল ত্রুটি মানুষ মাত্র করে। কাজেই সবকিছু সিরিয়াসলি নিওনা। তাতে তোমারই কষ্ট। কিছু ভুল আছে, বুঝিয়ে বললে বা সামনাসামনি ঝগড়া না করে আলোচনা করলে সমাধান হয়ে যায়। যারা ইচ্ছা করে বারবার দোষ করে, এড়িয়ে চলো তাদের। মনে কোরো,তাদের শিক্ষা দীক্ষা -মানসিকতার লেভেল তোমার ধারের কাছেও না। কাজেই তোমার চোখে যা মন্দ, তাদের চোখে তা মন্দ না,এই যেমন হুটহাট মিথ্যা বলা, এর কথা ওকে লাগানো, বানিয়ে কথা বলা,অকারণে ঠেস দিয়ে কথা বলা।এদের এড়িয়ে চলো।সবসময় নিজে ন্যায় পথে থেকে মাথা উঁচু করে চলো, তাহলে এরা তোমাকে ঘাঁটানোর সাহস পাবেনা। আর যদি বড় কোন অন্যায় হয়, সেখানে যদি আশফাকের হাত থাকে বা জামাই সব জেনেও কোন ব্যবস্থা না নেয়,সোজা চলে এসো। এই বাড়ি তোমারও।আর আমরাও তখন প্রয়োজনীয় স্টেপ নিবো।”
পুত্রবধূ শ্রাবণী কে রফিক-রুশা কন্যাজ্ঞান করেছেন। একমাত্র পুত্র বধূ। তাঁদের নৈঋতের বৌ। শ্রাবণী উচ্চশিক্ষিত,এই পরিবারের সাথে মানানসই। যদি মানানসই নাও হতো,তবু সে শ্বশুর -শাশুড়ির আদরের বৌমা হতো,ননদদের ভালোবাসার ভাবী। কারণ শ্বশুরকুলের কাছে তার প্রথম পরিচয়,সে একজন মানুষ। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ পরিচয়,সে নৈঋতের বৌ। তার অন্য পরিচয় এই পরিচয়ের তুলনায় গৌণ। নৈঋতের বৌ সবার নয়নমনি হবে এটাই স্বাভাবিক।
রুশা যখন যা কিনে, দুই কন্যা ও এক পুত্রবধূর জন্য একই রকম কিনে। শুধু রংটা আালাদা। সবার আগে রুশা পুত্রবধূর সামনেই সব উপহার রাখে। সে আগে পছন্দ করবে,তারপরে মেয়েরা। তা সে শাড়ি হোক,সালোয়ার কামিজ, টুকটাক সাজগোজের জিনিস। শ্রাবণীও সহজে নিজের জন্য আগে নেয় না। ননদরা পছন্দ করুক। রফিক সাহেব
দুই কন্যা এবং ছেলে বৌএর জন্য সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ রাখেন তাদের জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী কিংবা ঈদের জন্য। খাবার,আদর-যত্ন,সম্মান,উপহার কোন কিছুতেই রফিক-রুশা সামান্যতম বিভেদ করেন না পুত্রবধূ ও কন্যাদের মাঝে। কেন বিভেদ করবেন? এই অন্যায় প্রথাকেতো সারাজীবন তাঁরা ঘৃণা করে এসেছেন। উত্তরা-ঈশানী ভাবীকে বোন মনে করে।
ছেলে মেয়েরা সাত সকালে যার যার কর্মস্হলে চলে গেলে চার নাতি নিয়ে রুশার ভয়াবহ ব্যস্ততা। ঈশানী তখনও বিয়ে করেনি। নৈঋত -শ্রাবণী -ঈশানী অফিসে বের হয়ে যেতো।উত্তরা দুই ছেলে আর তাদের দেখাশোনার জন্য একজন মেয়েকে বাপ- মায়ের হাওলায় দিয়ে দৌড়াতো হাসপাতালে। চার বয়সী চার নাতি। নৈঋত আর উত্তরার ছেলেরা। নাতিদের দেখার জন্য দু’জন মেয়ে। বাড়ির কাজকর্মের জন্য একজন বয়স্ক মহিলা। চার ভয়ংকর নাতি আর তিন মুখরা,ঝগড়া প্রিয়, ফাঁকিবাজ গৃহকর্মীদের নিয়ে
রুশার মাথা খারাপ হয়ে যেতো। চাকুরি হতে রিটায়ার্ড রফিক সাহেব প্রাণপণে খবরের কাগজের আড়ালে থাকতেন যেন এই মহা তান্ডব তাঁকে দেখতে বা শুনতে না হয়। তবে নাতিদের স্কুলে আনা-নেওয়া এবং ঐ সময়ে তাদের পাহাড় সমান আবদার তিনি খুবই আনন্দময় হৃদয়ে পূরণ করতেন। নাতিদের খাওয়ানো, গোসল করানো, গল্প বলা, জিদ সামলানো সব রুশা করতো।
রুশার একান্ত চাওয়া ছিলো,তার দুই কন্যাসহ সব মেয়েরা এগিয়ে যাক। তার কর্মজীবী পুত্রবধূকেও সে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেয়। কিন্তু রুশা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো বড় মেয়ে উত্তরার বেলায়।
উত্তরা হাসপাতাল ছুটি হওয়া মাত্র বাসায় রওনা হতো।তার মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খেতো, কি কষ্টটাই না বাবা-মায়ের হচ্ছে
নাতি-সংসার নিয়ে। এখন তাঁদের বিশ্রামের সময়। তাদের উচিত বাপ-মায়ের বিশ্রাম -বিনোদনের ব্যবস্থা করা।তা না, এখনো তাঁদের সংসারের জোয়াল টেনে বেড়াতে হচ্ছে। কেউ কেউ বলতেন,”এই নাতি-নাতনি পালতেই তো সুখ।”
উত্তরা মনে মনে বলতো,”তুমি একটু সুখ করো, আমি দেখি। নাতি-নাতনীদের গাল টিপে আদর করা এক জিনিস, আর সম্পূর্ণ পরিচর্যা করা আরেক জিনিস। ”
হাসপাতাল ছুটি হওয়ার পরে এক মিনিটও উত্তরা বাইরে থাকতো না।গল্প না,আড্ডা না, বন্ধুদের আবদারে বাইরে খাওয়া না,বেড়াতে যাওয়া না, কোন মিটিং -সেমিনার অ্যাটেন্ড করা না, লাইব্রেরি না,সবচেয়ে বড় কথা, চেম্বার করা না। মায়ের বাসায় পৌঁছে সে আগে ভাত খেতো,তারপরে আবার দুই শিশুপুত্র ও বালিকা গৃহকর্মী নিয়ে বাসায় রওনা হতো। এফসিপিএস ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি সে মোটামুটি নিয়ে ফেলেছিল।
পরীক্ষার আগ দিয়ে উত্তরা হঠাৎ বেশি অসুস্থ হওয়া শুরু করলো। আশফাক বরাবর কঠিন পরিশ্রমী ও ক্যারিয়ারিস্ট। বিয়ের পর হতে বৌকে সে সময় দিতে পারেনি নিজের ক্যারিয়ার গড়তে এবং ক্যারিয়ার গড়ার পরে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে যেয়ে। তার একই কথা,”যা করছি তোমার জন্যইতো করছি। এই বাড়ি,গাড়ি সব তোমার। তোমার স্বামীর যে নাম-প্রতিষ্ঠা, তোমার স্বামীর প্রতি রোগীদের যে ভালোবাসা,আস্হা, সবতো তোমার জন্য ই। ” অফিসের চাপ সামলে,দুই ছোট্ট বাচ্চাকে সামলে,তাদের লেখাপড়া করিয়ে, বরাবরের অসুস্থ শরীর নিয়ে উত্তরা এতোদূর পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু এখন যেন আর সে পারছে না। শরীর অতি খারাপ হয়ে যাওয়ায় মনের সাথে তীব্র যুদ্ধ করে উত্তরা চাকরি ছেড়ে দিলো। হায় রে উত্তরা! যে ভাবতো, মরার দিন পর্যন্ত সে চিকিৎসা করে যাবে। রুশা -রফিক খুব কষ্ট পেলো মেয়ের এহেন সিদ্ধান্তে। উত্তরা চাকরি ছেড়ে দিলো! উত্তরা এফসিপিএস ফাইনাল দিলো না! আরেকটু কষ্ট , আরেকটু পরিশ্রম সে করতে পারলো না! রুশার মেয়ে হয়ে মনে সে আরও জোর, জেদ আনতে পারলো না!
কিন্তু উত্তরার শারীরিক অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটলো,তখন রুশার মাথা থেকে এসব চিন্তা কর্পূরের মতো উবে গেলো। মেয়ের বেঁচে থাকাটাই এখন স্রষ্টার কাছে তার একান্ত চাওয়া। বরং এখন তার ভাবনা উল্টো হয়ে গেছে। এতো শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা নিয়ে উত্তরা এতোদূর এলো কি করে?
চলবে।