#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২১
মুরাদের মায়ের দেয়া নাশতা খেয়ে তুলিকে নিয়ে চিন্তিত মনে বেরিয়ে পড়ে নাঈম। সারারাস্তা ভাবতে থাকে কি থেকে কি হয়ে গেল? সে কিভাবে পারল ইতির গায়ে হাত তুলতে? বাসায় ফিরেই ইতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বোনসহ বাসায় ঢুকে দেখে ইতি নাই। শুধু তাই না ঘরে ইতির ব্যবহৃত একটা সুতা পর্যন্ত নাই। হঠাৎ পাগল পাগল লাগে নাঈমের। এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
নাজমা বেগম ছেলের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখে সে মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। ভয় পেয়ে যান উনি – যদি ছেলে মারা যায়।
দৌড়ে ছেলের চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেন। হঠাৎ নিজেকে দিশেহারা লাগে নাজমা বেগমের। ছেলে উনার জান, ছেলের কিছু হয়ে গেলে কেমনে বাঁচবেন উনি? ছেলের মাথা নেড়ে দিয়ে বাবা বাবা বলে ডাকতে থাকেন। তুলিকে বলেন ওর বাবাকে ডাকতে। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে তুলিও হতভম্ব হয়ে যায়।
মায়ের অনেক প্রচেষ্টার ফলে নাঈমের জ্ঞান ফিরে আসতেই সে ইতির নাম ধরে কাঁদতে কাঁদতে আবারও জ্ঞান হারায়। এবার ভয় পেয়ে যান নাজমা বেগম। নাঈমের বাবা সব দেখে এম্বুলেন্সে কল দেন। এম্বুল্যান্স এলে তাড়াতাড়ি করে নাঈমকে পার্শ্ববর্তী একটা ক্লিনিকে ভর্তি করায়, সেখানে ডাক্তার প্রথমেই লক্ষন দেখে স্ট্রোক আশংকা করেন।
এদিকে তুলি ভাইয়ের অবস্থা দেখে রাগ ভুলে ইতিকে ফোন দেয়। কিন্তু বুঝতে পারে ওর নম্বর ব্লক। ওর মা, বাবা এমনকি নাঈমের নম্বর থেকেও কল দিয়ে দেখে সবার নম্বর ইতি ব্লক করে রাখছে।
নাঈমের জ্ঞান ফিরলেই ইতিকে ডাকা দেখে ডাক্তার জানতে চান কে সে? তাকে এই সময় সামনে রাখলে ভালো নাঈমের জন্য। তখন তুলি জানায় ইতি সবাইকে ব্লক করে রাখছে। নাঈমের বাবা বুঝতে পারেন ইতির অভিমান। উনি নিজেই যান ইতিকে আনতে।
ইতি দরজা খুলে শ্বশুরকে দেখে সালাম দিয়ে ঘরে এনে বসতে বলে কিন্তু উনি না বসে ইতির হাত জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠেন। ইতি হতবাক হয়ে যায় শ্বশুরের আচরণে। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে উনি আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরে বলেন “আমার ছেলেটাকে তুমি বাঁচাও মা।”
ইতি অবাক হয়ে যায় শ্বশুরের এই কথা শুনে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করবে তার আগেই উনি বলেন -“নাঈম ক্লিনিকে ভর্তি। বারবার শুধু তোমাকেই ডাকতেছে। ডাক্তার যতদ্রুত সম্ভব তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
ইতির মনে হয় এটা ওদের আরেকটা নাটক। কারণ ওর সামনে দিয়ে যখন নাঈম আর তুলি বের হয়ে যায় তখন নাঈম সম্পুর্ণ সুস্থ। তাহলে এই অল্প সময়ের মধ্যে কি ঘটল যার জন্য তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করাতে হল? মনে মনে একটু কষ্ট পেল ওর সহজ সরল শ্বশুরটাকেও ওরা নাটকে শামিল করেছে ভেবে। শান্ত কন্ঠে বলে -“বাবা, আপনিও শেষ পর্যন্ত তুলিদের মা মেয়ের নাটকে শামিল হলেন? আপনার ছেলে তো ওদের কথায় আমার গায়ে হাত তুলে ওদের খুশিই করল, এখন আপনিও? খুব কষ্ট পেলাম বাবা।”
-“মা, ইতি, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা তোমার? তুমি আমার ছেলেকে ওর মা বোনের তৈরি নরকে একা ছেড়ে এসেছো গো মা। আমার ছেলে স্ট্রোক করেছে। যতটুকু জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে শুধু তোমাকেই খুঁজছে, তোমাকেই ডাকছে। ডাক্তার তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। এই বুড়ো ছেলে তোমাকে হাত জোড় করে অনুরোধ করছি মা তুমি আমার ছেলেকে বাঁচাও। আমার সাথে চল।” কেঁদে কেঁদে বলেন নাঈমের বাবা।
সেই সময় ইতির বাবা ড্রইংরুমে এসে বলেন -“ইতি শিজ্ঞিরি চল মা, ইমন ফোন করেছিল, ওকে মুরাদ কল দিয়ে বলেছে নাঈম ক্লিনিকে ভর্তি, স্ট্রোক করেছে।”
বাবার মুখে এই কথা শুনে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না ইতি। শ্বশুরের সাথে বের হয়ে যায় ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখে নাঈম ক্লিনিকের বেডে শোয়া, নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো, হাতে ক্যানোলা। দেখেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে ইতির। দৌড়ে গিয়ে নাঈমের হাত ধরে বসে বুকে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছু পরে নাঈম চোখ আধখোলা করে আস্তে আস্তে ইতি বলে ডাকতে থাকে। ইতি যখন বলে এইতো আমি আছি তখন নাঈম কেঁদে উঠে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে -“আমাকে ক্ষমা করে দাও ইতি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি আর বাঁচবোনা, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
নাঈমের এই কথায় ডুকরে কেঁদে উঠে ইতি। নাঈমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে -“আমি আছি, আমি তোমার কাছেই আছি। কোথাও যাবোনা তোমাকে ছেড়ে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠ প্লিজ।”
সেইসময় নার্স এসে জানায় এমআরআই করতে যেতে হবে। স্ট্রেচারে করে নিয়ে যায় ইতি। নাঈম সেইযে ইতির হাত ধরেছে শক্ত করে আর ছাড়ছে না। অনেক কষ্টে এমআরআই শেষে নাঈমকে ফিরিয়ে আনা হয় কেবিনে। রাউন্ডের ডাক্তার এসে ভীড় কমাতে বলে। কিন্তু কে বাইরে যাবে? সবাই তো নাঈমের আপন। মা, বাবা, বোন, স্ত্রী। শেষে নাঈমকে ভালো করে দেখে ডাক্তার ইতি বাদে সবাইকে কেবিনের বাইরে যেতে বলে। নাজমা বেগম বাইরে বের হয়েই চিৎকার শুরু করে দেন -“আমি নাঈমের মা আর আমাকেই কি না বাইরে বের করে দেয় ডাই/নিটাকে রেখে। ডাক্তারকে ঘুষ দিছে এই ডাই/নি। নইলে মা কে কেন বের করে দিবে?”
সেই মুহুর্তে ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে সোজা নাজমা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন -“কেন এই তরতাজা ছেলেটা বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি। এভাবে যদি চিৎকার করতে থাকেন তাহলে ক্লিনিকের বাইরে গিয়ে করুন। আর নইলে আপনার ছেলেকে নিয়ে যান। আমার এই ক্লিনিকে শুধুমাত্র ভদ্র পরিবার থেকে মানুষ আসে।”
এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলে নার্স এসে নাজমা বেগমকে সরিয়ে নিয়ে যান। নাঈমের বাবা এই প্রথম শক্ত হয়ে স্ত্রীকে বলেন -“নাঈম সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তোমার আসার দরকার নাই। আমি আছি, ইতি আছে, নাঈমের সেবার কমতি হবে না। নাঈমকে বাসায় ফিরিয়ে নেয়ার পরে আর কি কি উপায়ে ওদের জ্বালাবা সেসব ঠিক কর মা বেটি বসে।”
দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বাড়ি ফিরে যান নাজমা বেগম আর তুলি। খবর পেয়ে ততক্ষণে খাদিজা বেগম চলে আসেন, আসার পথে ইতির মা-বাবাকে তুলে আনেন। উনি এসে কেবিনের বাইরে থেকে প্রথমে চিকিৎসার বর্তমান খোঁজ খবর নেন, তারপর ইতির ক্লিনিকে থাকাকালীন যা যা লাগতে পারে সবকিছুর ব্যবস্থা করেন। কতদিন ক্লিনিকে থাকতে হবে তা জানা যাবে পরদিন এমআরআই রিপোর্ট পেলে। যেহেতু কেবিনে ভীড় করা ডাক্তারের মানা তাই উনারা কেবিনের বাইরেই অপেক্ষা করেন।
ডাক্তার নাঈমের প্রেসার বেশি দেখে ঘুমানোর জন্য ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন কিন্তু নাঈম টানা ঘুমাতে পারছেনা। কিছুক্ষণ পরপরই চমকে চমকে উঠে ইতিকে খুঁজে আর মুখে বিড়বিড় করে বলে -“ইতি আমাকে ছেড়ে যেওনা। ইতি আমাকে ক্ষমা করে দাও।” ইতি তাই সারাক্ষণ ওর হাত ধরে বসে আছে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে যাতে সে স্পর্শে বুঝতে পারে ইতি আছে।
এদিকে ইতির ভাই ইমন ইউকে থেকে ফোন করে জানায় যে ডাক্তার নাঈমকে দেখছেন উনি ইমনের স্ত্রী মিলির বাবার বন্ধু। মিলির বাবা কথা বলেছেন উনার সাথে। উনি কথা দিয়েছেন উনার সর্বোচ্চ ডেডিকেশন দিয়ে উনি নাঈমকে দেখবেন। ইমনের কথা শুনে ইতি অনেকটা শান্ত হয়।
রাতে নয়টার দিকে নাজমা বেগম এসে উপস্থিত, রাতে থাকার উদ্দেশ্যে। হাজার হোক মা তো। একমাত্র ছেলেকে এভাবে ক্লিনিকে রেখে কোন মায়েরই বা মন মানে? বাসায় ফিরে আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছে ছেলের জীবন ভিক্ষা চেয়ে। এটাও নিয়ত করেছে ছেলে এই যাত্রা সুস্থ হয়ে উঠুক, আর কখনো ইতির সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না।
রাত এগারোটায় ডাক্তার আসেন আরেকবার রাউন্ড দিতে। রাউন্ড শেষে উনি নাঈমের ব্যাপারে কথা বলার জন্য ইতিকে সাথে নিয়ে যান উনার চেম্বারে। পিছনে পড়ে থাকে ৭ জোড়া উৎসুক দৃষ্টি। সবাই জানতে চায় নাঈমের ব্যাপারে।
চেম্বারে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করেন ডাক্তার……..
চলবে
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ