ইতির_সংসার পর্ব ২০

0
444

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২০

নাঈমের কথা ও ওর মায়ের আচরণে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে ইতি। ওর স্কুল খোলার আরো দুদিন বাকি, তাই ভাবে মায়ের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। নাঈম অফিসে যাওয়ার সময় কথা টা পারে ইতি। এ সময় নাজমা বেগম বলে উঠেন -“আমার মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি থেকে আসছে, তাকে দুইটা ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াবা কি বাপের বাড়ি পালাতে চাইছ?”

ইতি বলে -“আপনার মেয়ে তার বাপের বাড়ি আসছে, আমি আমার বাপের বাড়ি যেতে চাই কি সমস্যা বলুন?”

-“সমস্যা থাক আর না থাক তুমি যেতে পারবানা।” গর্জে উঠেন নাজমা বেগম।

-“আপনার মেয়ে বাপের বাড়ি আসলে দোষ নাই আর আমি যেতে চাইলেই…… ” কথা শেষ করতে পারেনা ইতি আচমকা এক চড় এসে ওর গালে পড়ায়। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে দেখে চড়টা এসেছে তারই প্রাণপ্রিয় স্বামী, যার সাথে সে আগের দিনই হানিমুন ট্রিপ থেকে ফিরেছে সেই নাঈমের হাত থেকে। চিৎকার করে উঠে ইতি -“কাজটা ভালো করলেনা। পস্তাতে হবে তোমাকে।”

নাজমা বেগম বলেন -“কি করবা? জেলে দিবা? দাও, জেল মানুষের জন্যই তৈরি হইছে।” একটা কথাও আর বলেনা ইতি, বলার রুচি হয়না। চড়ের ধাক্কায় আগেই মাটিতে পড়ে গেছিল, সেভাবেই পড়ে থেকে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত হয়ে মাটিতেই ঘুমিয়ে যায় ও। কেউ আসেনা ওকে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে। একসময় ঘুম ভেঙে দেখে দুপুর হয়ে গেছে। নাঈম ওকে চড় মেরেই অফিসে চলে গেছে। আস্তে আস্তে উঠে রুমে যায় ইতি। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। খাটে শুয়ে ভাবতে থাকে ওর পরবর্তী করণীয় কি?

একবার ভাবে আর নাঈমের সাথে সংসার করবেনা, একবার যখন হাত উঠে গেছে এরপর বারবার হাত উঠবে। আরেকবার ভাবে হঠাৎ করে কি হল যে নাঈম কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পালটে গেল। আবার ভাবে এতো সহজে ওদের জিততে দেয়া যাবে না। ওরা মা মেয়ে তো চায়ই ইতি চলে যাক নাঈমের জীবন থেকে যাতে ওরা আবারও ওকে চুষে খেতে পারে।

শেষে ঠান্ডা মাথায় ভেবে ঠিক করে সবাইকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। এতো সহজে ছেড়ে দিলে হবে না। প্রথমেই যদি ছাড় পেয়ে যায় তাহলে অভ্যাস হয়ে যাবে। চড়ের ধাক্কায় ঠোঁটের একপাশে কেটে ফুলে গেছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। এই অবস্থায় এলোমেলো চুলে এই চেহারার একটা সেল্ফি তুলে নেয়। তারপর পোস্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ফিমেল গ্রুপে। জানতে চায় “শাশুড়ী ও ননদের উস্কানিতে হাসবেন্ড এভাবে আঘাত করছে। মামলা করা ছাড়া কিভাবে তাদের শায়েস্তা করা যায়?”

সেল্ফিটা পাঠায় মুরাদের ইনবক্সে। বলে -“আপনার স্ত্রী আর শাশুড়ির উস্কানিতে আপনার বন্ধু আমার এই হাল করছে। আমি আর ওর সাথে সংসার করব না।”

ওর পোস্টে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কমেন্ট করতে থাকে। সব দেখে কিন্তু রেসপন্স করেনা। এরমধ্যেই মুরাদ ম্যাসেজ দেখে সাথে সাথে কল দেয় ইতিকে -“ভাবি, কি বলেন নাঈম এই কাজ করছে আপনার সাথে? ওর কিভাবে সাহস হয় আপনার গায়ে হাত তুলার।?”

ইতি ওদের ট্রিপ থেকে শুরু করে সব জানায়। তুলির হুমকির কথাও জানায়। এটাও বলে যে সে আশংকা করতেছে খুব সম্ভব নাঈমকে কুফুরি কালাম করা হয়েছে নইলে শরবত ও পায়েস খাওয়ার পরে আচমকা আচরণ পালটে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার না। সব শুনে মুরাদও চিন্তিত হয়ে যায়।

মুরাদ ওর মাকে কল দিয়ে সব জানায়। এটাও জিজ্ঞেস করে এই কুফুরি কালামের প্রভাব কাটাতে কি করা যাবে? খাদিজা বেগম বলেন উনাদের এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেব আল্লাহর কালাম পড়ে একটা পানিপড়া দেন যেটাতে এইসব নেগেটিভ ভাইব কেটে যায়। উনি সেটা নাঈমকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলেন। আর মুরাদকে বলেন তুলি ও নাঈমের সাথে কথা বলতে।

খাদিজা বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন আছর নামাজের সময় প্রায় হয়ে গেছে। উনি এক বোতল পানি নিয়ে মসজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখেন ইমাম সাহেব আসছেন। কাছাকাছি এলে সালাম দিয়ে কথা বলতে চান। নাম গোপন রেখে সব বিস্তারিত জানালে ইমাম সাহেব দুয়া কালাম পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে দেন। আর বলেন -“আম্মাজি আমার যা সাধ্য আল্লাহর নাম নিয়ে আমি করলাম। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”

নাঈমকে ফোন করে ডেকে নেন খাদিজা বেগম। সাথে তুলিকেও নিতে বলেন। ওরা এলে তুলিকে ভিতরে ওর রুমে পাঠিয়ে দিয়ে নাঈমের সাথে কথা বলতে শুরু করেন। এটা সেটা দিয়ে শুরু করে আসল কথায় আসেন, কেন ইতির গায়ে হাত তুলেছে জানতে চান। নাঈম প্রথমে নিজেদের ব্যাপার বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তুলি কাঁদতে কাঁদতে সামনে এলে অবাক হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?

তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলে -“মুরাদ আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে।”

-“কেন?” জানতে চান খাদিজা বেগম।

-“ভাবিকে ভাইয়া চড় মেরেছে সকালে, সেজন্য।”

-“দেখ তুলি, তোমার হাসবেন্ড তোমাকে কি বলেছে তাতে আমার কিছু বলা মানায়না। মুরাদ যেহেতু চলে যেতে বলেছে সেহেতু তুমি সবকিছু গুছিয়ে নাও। তোমার ভাই এখানেই আছে, ওর সাথে চলে যাও।”

-“আন্টি, মুরাদ অন্যায় কথা বলেছে, আমি এখনও ছেলের পক্ষ নিবেন?” বিস্মিত নাঈম জানতে চায়।

-“কেন নেবনা বাবা বল? তুমি যেমন তোমার মায়ের ছেলে তেমনি মুরাদও আমার ছেলে। অন্যায় করলেও ছেলের পক্ষ নিতে হয় এটা তোমার মায়ের থেকেই শিখেছি বাবা।”

-“আন্টি, মা আবার কখন আমার পক্ষ নিল?”

-“তুমি যখন তোমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুললা তখনই তোমার মায়ের উচিৎ ছিল তোমাকেও একটা দেয়া। কিন্তু তা না করে উনি তোমাকে সাপোর্ট করেছেন। তাহলে আমি আমার ছেলেকে সাপোর্ট করলে দোষ কি বল?” খাদিজা বেগম ধীর স্থির ভাবে কথাটা বলেন।

কিছুক্ষণ পরে উঠে গিয়ে নিজে নাস্তা নিয়ে আসেন নাঈমের জন্য। সাথে পানি পড়াও। ততক্ষণে তুলি কাঁদতে কাঁদতে ওর দুইটা ট্রলি ব্যাগ আর একটা বড় লাগেজ ঠেলে ড্রইংরুমে চলে আসে। খাদিজা বেগম নাঈমকে তাড়া দেন নাস্তা করে নেয়ার জন্য। নাঈম সামান্য কিছু মুখে দিয়ে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খাদিজা বেগমকে আবারও অনুরোধ করে -“আন্টি আমি নাহয় একটা ভুল করেই ফেলেছি সেই ভুলের শাস্তি আমার বোনটাকে দিবেন?”

খাদিজা বেগম কোন উত্তর দেন না। নাঈম আস্তে করে বোনের হাত ধরে বের হয়ে আসে। বাসায় ফিরে দেখে ইতি তখনও ঘরে দরজা বন্ধ করে আছে। ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে যাবে এমন সময় মুরাদের ফোন আসে নাঈমের কাছে। নাঈম ফোন রিসিভ করে ড্রইংরুমে চলে যায়। মুরাদ ওকে ক্লিয়ার করে বলে -“দেখ নাঈম, আমি তোকে আগেই বলছি তুলি যেমন তোর বোন ঠিক তেমনই আমি ইতি ভাবিকে আমার বোন মানি। আমি তোর বোনকে মাথায় তুলে রেখেছি আর তুই আমার বোনের গায়ে হাত তুলেছিস। এতো সাহস তোর হয় কি করে? ইতি ভাবি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর তোর সাথে সংসার করবেনা। আমি তুলিকে বিয়ে করেছি তোদের বিবাহিত জীবনে যাতে ইতির বিয়ের খরচের চাপ নামক কোন অশান্তি সৃষ্টি না হয়। তোদের সেই সংসারটাই যদি না থাকে তাহলে তুলির সাথে আমার বিবাহিত জীবন কন্টিনিউ করার কোন অর্থ আমি পাচ্ছিনা। খুব দ্রুতই তোর বোনকে আমি ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

মুরাদের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় নাঈম। -“কি বলছিস দোস্ত? আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে তার মানে কি? আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছিনা তুই কি বলছিস?”

-“হ্যাঁ আমি সেটাই বলছি যেটা ইতি ভাবি জানিয়েছেন। আমিও সম্মত হয়েছি উনার কথায়। তুই কথা ভালো মতো করে না শুনে ফট করে বউয়ের গায়ে হাত তুলবি আর তোর বউ চুপচাপ সহ্য করবে? আমি তুলিকে মারলে তুই সহ্য করতি? উত্তর জানতে চাই তোর।” মুরাদ বলে।

কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না নাঈম। সত্যিই তো কি করত সে?
চলবে….

©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here