আলো-২৩,২৪
২৩
এখনো অন্ধকার কাটেনি। চারিদিক একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছে। অহনা উঠে পড়লো। রাতে ওর ভালো ঘুম হয়নি। শরীরটা বেশ ম্যাজ ম্যাজ করছে। ইচ্ছে করছে কড়া করে কফি খেতে।
কিন্তু একি রুমের মধ্যে রান্না করা হয়, এখন কফি বানাতে গেলেই আসিফের ঘুম ভেঙে যাবে। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ঘুমাক বেচারা।
ও ওয়াশ রুমে গিয়ে পোশাক পাল্টে দরোজা ভিজিয়ে রেখে নিচে নেমে আসলো। এলোমেলো হাঁটছে। ভোরের মিষ্টি মিষ্টি বাতাসে হাঁটতে বেশ লাগছে।
হাঁটতে হাঁটতে সে রমনার পার্কে চলে এসেছে। ও একটা বেঞ্চিতে বসে চারদিকের মানুষের কর্মকাণ্ড অবাক হয়ে দেখছে। কতো মানুষ!
কেউ হাঁটছে, কেউ দল বেঁধে ব্যায়াম করছে।
সাত সকালে ছোট ছোট বাচ্চারা চায়ের ফ্লাক্স হাতে ছোটাছুটি করছে।
অহনা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে, ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে কুকুর ছানা কোলে নিয়ে বসে আছে একি বেঞ্চের অপর মাথায়। কুকুর ছানাটা একটু পর পর কুই কুই করে ডাকছে।
মেয়েটা তখন ছানাটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে আর বলছে কি খিদা পায়ছে? তোর পেটে এত খিদা ক্যারে লাল্টু?
মেয়েটা আপন মনে কুকুর ছানার সাথে কথা বলছে আর অবাক চাহনি নিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে অহনার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে।
অহনা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো তোমার নাম কি খুকি?
মেয়েটি বললো, তোর নাম কি?
অহনা যারপর নেই অবাক হয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। কাল থেকে ওর মন বিষণ্ন হয়ে আছে। ও খুব চেষ্টা করেছে স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু পারেনি।
ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলো, আসিফের সাথে খুব ভালো ব্যাবহার করবে। কোন রকম রাগ, দুঃখ, মন খারাপ ভাব সে প্রকাশ করবে না।
কিন্তু পারেনি।
আসিফ কাল রাতে একটু বেশি ভালো ব্যাবহার করার চেষ্টা করছে। ওর প্রিয় গোলাপ ফুল নিয়ে এসেছে অফিস থেকে আসার পথে।
দুই টাকার হিসাব রাখা মিতব্যয়ী মানুষটা টাকা খরচ করে গোলাপ কিনছে, অহনা খুব অবাক হয়েছে।
সাথে ভালোও লেগেছে খুব।
কিন্তু সেই ভালো লাগাটাও ও প্রকাশ করতে পারেনি।
রাতে উল্টা দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থেকেছে।
আসিফ বার বার সরি বলেছে। অহনাকে টেনে ওর বুকের কাছে আনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অহনা শক্ত হয়ে থেকেছে।
সারারাত নিজের একটা হাতের ওপর মাথা রেখে চোখের পানি ফেলেছে।
আসিফ বালিশটা বার বার অহনার মাথার নিচে দেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হয়ে এক সময় নাক ডাকা শুরু করেছে।
অহনার খুব হিংসে হয়, মানুষটা শোয়া মাত্র নাক ডাকা শুরু করে। কতো সুখি হলে শোয়ার সাথে সাথে একটা মানুষ ঘুমাতে পারে!
অহনা বুঝতে পারে কাল ছুটির দিন। আজ আসিফ ওকে খুব আপন করে কাছে পেতে চেয়েছিলো।
কিন্তু ওর কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না।
অথচ এই মেয়ের একটা কথা শুনে অহনা হাসি থামাতে পারছে না। সে মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে। তার পুরো শরীর হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
চোখে পানি চলে এসেছে।
ও অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বললো, আমার নাম অহনা। এবার তোমার নাম বলো।
আমার নাম টুকু।
ওমা টুকু আবার কেমন নাম?
এই তো এমনি নাম।
আমারে আমার বাবায় রাস্তায় ধারে টোকায় পাইছে।
তাই বাপে আদর কইরা টুকু ডাকে।
ঐ তুই চা খাবি?
অহনা আবারো ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, খাবো।
তোমার কাছে চা আছে?
আমার কাছে নাই। তয় আমাগো বস্তির রফিক্যার কাছে চা আর বিস্কুট আছে। তুই খাইতে চাইলে ডাইক্যা আনবো।
আচ্ছা ডাকো তোমার রফিককে।
কিন্তু টুকু বড়োদের এভাবে তুই বলে না।
তুমি নয়তো আপনি বলতে হয়।
টুকু মুখ বাঁকিয়ে বললো, আমি ডাকি।
তোরা বড়ো লোকরা খুব খারাপ। গরীবের কষ্ট বুঝিস না। আমাদের সাথে তুই ছাড়া কথা বলিস না। তুই তুইয়ে কাটাকাটি।
তাই আমি বড়ো লোকদের তুই বলি।
তুই বয়। আমি রফিক্যারে ডাইকা আনি। আবার চইলা যাস না যেন।
আমি যাবো না।
তুমি ডেকে আনো।
টুকু কুকুর ছানা নামিয়ে পা দিয়ে এক লাথি মেরে দৌড়ানো শুরু করলো। কুকুর ছানাটা লাথি খেয়েও টুকুর পেছন পেছন দৌড়ে গেল।
দুই মিনিটের মাথায় টুকু রফিককে সাথে করে নিয়ে ফিরে আসলো।
টুকু এবার আমার খুব কাছাকাছি বসলো।
কুকুর ছানা টাও লাফ দিয়ে টুকুর কোলে উঠে বসলো। তারপর খুব ভাব নিয়ে বললো, রফিক্যা চা যেন ভালো হয়। চা খারাপ হলে টাকা পাবি না।
অহনাকে গরম পানি দিয়ে কাপটা ধুয়ে খুব যত্ন করে এক কাপ চা দিলো রফিক।
অহনার চা টা খেতে বেশ ভালো লাগছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো তোমার নাম রফিক?
জে।
আজকে তুমি ও আমার সাথে চা খাবে রফিক।
আরো দুই কাপ চা বানাও।
টুকু কে এক কাপ দাও, তুমি এক কাপ নাও।
আজকে তোমরা দুজন আমার অতিথি।
আমার লাগবো না ম্যাডাম।
একদম কথা বলবে না। যা বলছি তাই করো।
টুকু তুমি চায়ের সাথে বিস্কিট খাবে?
হ খামু। আমার লাল্টু ও খাইবো।
অহনা আবারো হেসে দিয়ে বললো, লাল্টু কি তোমার কুকুর ছানার নাম?
হ।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল পার্কের বেঞ্চিতে বসে অহনা আর টুকু, ঘাসের ওপর বসে আছে রফিক।
তিনজনে খুব আরাম করে ফু দিয়ে দিয়ে গরম চা খাচ্ছে বিস্কিট ভিজিয়ে।
টুকু একটু পর পর বিস্কিট ভেঙে নিচে ফেলছে
আর লাল্টু কু কু শব্দ করে বিস্কিট খাচ্ছে।
আলোর ফোনটা বাজছে। ও গল্পের ভেতর এমন ভাবে ডুবে গেছে যে, ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল।
আলো আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো।
মুশফিকুর রহমান দু কাপ চা হাতে মেয়ের রুমের দরজার বাইরে থেকে সুপ্রভাত জানিয়ে অনুমতি চাইল, ভেতরে আসব মা?
আলো বইটা বিছানায় রেখে চোখ তুলে চেয়ে বললো, বাবা কি যে বলো না তুমি!
আমার রুমে আসত পারমিশন লাগবে কেন?
লাগবে মা।
যে কারো রুমে ঢোকার আগে অনুমতি নিয়ে ঢোকা এক ধরনের ভদ্রতা। তোর জন্য চা এনেছি। চা খাবি?
খাওয়া যায়। দাও।
আলো হাত বাড়িয়ে চা টা নিতে যেয়ে ফোনটা আবার বেজে উঠল। ও এবার ফোন হাতে নিয়ে দেখে ফুপির ফোন। রিসিভ করা মাত্র ফুপি কাঁদো কাঁদো কাঁদো সুরে বললো, আলো মা তুই ঘুম থেকে উঠছিস?
সেই কোন ভোর থেকে তোকে ফোন দিচ্ছি।
উঠেছি ফুপি।
সরি ফোন সাইলেন্ট করা ছিল। আলো অবলীলায় মিথ্যে বলতে পারে। আর এই মিথ্যা কথা বলার জন্য তার কোন রকম খারাপ লাগে না। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো কি হয়েছে ফুপি?
তোমার কন্ঠটা এমন শোনাচ্ছে কেন?
আলো তোর বাবা যদি ঘুম থেকে উঠে, তাহলে বাবাকে নিয়ে স্কয়ারে চলে আয়।
হাসপাতালে কেন ফুপি? রন্জু ভাইয়া ভালো আছে তো?
হুম এখন ভালো আছে।
মাঝ রাতে অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। তখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সারারাত আবোল তাবোল বকেছে।
আর বার বার অহনার নাম বলছিলো।
তুই একটু আয় তো মা। তোর কাছে শুনি কাল কি হয়েছিল।
ঠিক আছে ফুপি তুমি টেনশন নিও না। আমি বাবাকে নিয়ে আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি।
আসিফ ঘুমের মধ্যে বিছানা হাতাচ্ছে, উদ্দেশ্য অহনাকে কাছে টেনে নেওয়া। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পরও অহনা কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা এখন আসিফের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
সে তার প্রতিদিনের অভ্যাস মতো অহনাকে কাছে টানতে যেয়ে দেখে বিছানা খালি।
জানালা গলে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে তার পায়ের কাছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো ।
লাফ মেরে উঠে বসল। প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলো অহনা কোথায়?
ওয়াশ রুম ফাঁকা, দরোজা খোলা। ছাদেও কেউ নেই।
ওর বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো।
অহনা কি শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে চলে গেলো!
এতো তাড়াতাড়ি ওর ভালবাসা ফিকে হয়ে গেল!
এতো জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করে এক সপ্তাহের মাথায় তার সব আবেগ ফিকে হয়ে গেল!
তবে কেন তুমি আমার সাথে নিজেকে জড়ালে অহনা?
আলো-২৪
আসিফের বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো।
অহনা কি শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে চলে গেলো!
এতো তাড়াতাড়ি ওর ভালবাসা ফিকে হয়ে গেল!
এতো জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করে এক সপ্তাহের মাথায় তার সব আবেগ ফিকে হয়ে গেল!
তবে কেন তুমি আমার সাথে নিজেকে জড়ালে অহনা?
এক বুক অভিমান নিয়ে আসিফ ঘুরে দাঁড়িয়েছে রুমে ঢোকার জন্য, তখন পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অহনা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে।
অহনাকে দেখে আসিফের চোখ ভিজে উঠলো, ও অহনাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে দিয়ে কান্না করে দিলো।
কোথায় গিয়েছিলে আমাকে না বলে?
এভাবে কেউ ভয় পাইয়ে দেয়?
প্রচন্ড রকম ভালো লাগা এবং লজ্জায় এক হয়ে অহনা কুঁকড়ে যাচ্ছে। ও লজ্জায় বেগুনি হয়ে বললো, আহ্ কি করছো আসিফ! যে কেউ ছাদে চলে আসতে পারে।
ভেতরে চলো।
অহনা কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, আমার বিয়ে করা বউকে আমি যা ইচ্ছে তাই করবো।
কেউ দেখে ফেললে তাতে আমার কি?
তুমি আগে বলো এভাবে কোন কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলে?
আচ্ছা বলছি।
খুব ক্ষুধা লাগছে। বাসার সামনে গরম গরম পরোটা ভাজা দেখে কিনে আনলাম। রাতে তোমার গরুর মাংস ভূনা ভালো করে খেতে পারিনি। এখন পরোটা দিয়ে খাবো। খেতে খেতে বলছি। চলো ভেতরে চলো।
ঠিক আছে তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো।
আমি মাংস গরম করি।
আসিফ কাল রাতে অহনাকে খুশি করার জন্য ওর ভাইয়ের আনা গরুর মাংস কাটা মশলা দিয়ে রান্না করেছিলো।
কিন্তু অহনা রাতে কিছুই খেতে পারেনি। গলা দিয়ে কোন খাবার নামছিল না। ভাত নাড়াচাড়া করে পানি ঢেলে উঠে গেছে।
এখন ও খুব মজা করে খাচ্ছে। খেতে খেতে বললো,
আসিফ মাংস রান্না তো অসাধারণ হয়েছে।
আমাকে একটু শিখিয়ে দিও তো কিভাবে রান্না করছো।
আরে তেমন কোন কঠিন কিছু নয়।
আমাদের যেহেতু মশলা গুঁড়া করার কিছু নেই, তাই আদা, রসুন, পেয়াজ, শুকনো মরিচ সব কিছু কেটে টুকরো টুকরো করে নিয়ে রান্না করছি।
তেলে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, গোটা জিরা, শুকনো মরিচ, গরম মশলা সব দিয়ে মাংস কষিয়ে কষিয়ে রান্না করলেই কাটা মাংস ভূনা হয়ে যায়।
আচ্ছা ঠিক আছে শিখে রাখলাম। আমি একদিন তোমাকে রান্না করে খাওয়াবো।
সে না হয় করো, আজকে ছুটির দিনে তুমি রান্না করবে। আমি আজ তোমার সহকারী হবো।
অহনা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, ধুর আমি কি রাঁধতে জানি নাকি!
জানতে হবে না।
আমি ডিরেকশন দিব। তুমি রান্না করবে।
আজকে তুমি কাতল মাছ রান্না করবে।
নাস্তা খেয়ে আমি বাজার থেকে মাছটা কাটায় আনবো।
তুমি রাঁধবে। এতো বড়ো মাছ ঘরে কাটলে নষ্ট হবে। বাজারে নিয়ে যাই, কি বলো?
অহনার খাওয়া শেষ। প্লেট গোছাতে গোছাতে বললো, তুমি যেটা ভালো মনে করো।
অহনা নিজের আর আসিফের প্লেট নিয়ে উঠতে যাওয়ার সময় আসিফ বাম হাত দিয়ে অহনার হাতটা ধরে বসিয়ে দিয়ে বললো, কোথায় গিয়েছিলে বললে না তো?
অহনা মিষ্টি করে হেসে বললো, আর বলো না।
হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কে চলে গিয়েছিলাম। খুব ভালো লাগলো জানো।
আমরা এখন থেকে ছুটির দিনে ভোরে পার্কে হাঁটতে যাবো ঠিক আছে?
আসিফ গাল ফুলিয়ে বললো, তুমি চাইলে আজকে ও যেতে পারতাম।
অহনা ফিক করে হেসে দিলো।
আমি তো নিজেই জানিনা পার্কে যাবো। বললাম না, হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি।
অহনা আবারো প্লেট নিয়ে উঠতে গেলেই, আসিফ বাঁধা দিয়ে অহনার হাত থেকে প্লেট গুলো নিয়ে নিলো।
আমি ধুয়ে আনছি। তুমি কফি বানাও।
তোমার বানানো কফি অসাধারণ হয়।
অহনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
ওর কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে মুখ ধোয়ার বেসিনে প্লেট বাটি ধুতে। কিন্তু কিছুই করার নেই। রান্নার সব কাজ ঐ বেসিনেই করতে হয়।
আসিফ কফি খেয়ে বাজারে চলে গেল, ফ্রিজ থেকে মাছটা বের করে নিয়ে।
অহনা দেখলো মাছটা সত্যি অনেক বড়। ব্যাগ থেকে অনেক খানি লেজ বের হয়ে আছে।
আসিফ চলে যাওয়ার পর ও দরোজা ধরে বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল। আসিফের বাচ্চাদের মত আচরণের রেশটা যেন রয়েই গেছে। ঘাড়ের মধ্যে এখনো সুর সুর করছে।
এর মধ্যে বাড়িয়ালি খালাম্মা ছাদে কাপড় শুকাতে এসেছে। উনি কাপড় নেড়ে দিয়ে অহনার কাছে আসলো।
কি করো বৌমা?
তোমাদের টুনা টুনির সংসার কেমন চলছে?
জি ভালো খালাম্মা। চা বানাই? বসেন।
উনি বসতে বসতে বললেন, না বৌমা চা খেয়েই আসলাম। তাছাড়া পান মুখে দেওয়ার পর আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না।
অহনা হালকা করে হেসে ফ্রিজ থেকে ফল, আর দধি বের করে খেতে দিলো।
আপনি খান খালাম্মা। বাসায় গিয়ে না হয় আবার পান খাবেন।
তুমি যখন এতো করে বলছো, খাবো।
কিন্তু বাসায় নিয়ে তোমার খালুর সাথে খাবো।
তোমার খালু দধি খুব পছন্দ করে।
আপনি খান খালাম্মা, খালুজানের জন্য দিয়ে দিব।
আপনি যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন।
অহনা বাড়ি আলির সাথে হাসি মুখে কথা বললেও ওর মাথায় শুধু মাছ রান্না ঘুরছে। ও আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে বসলো, আচ্ছা খালাম্মা কাতল মাছ কিভাবে রান্না করে?
মুখ ভর্তি দধি নিয়ে উনি বললেন, ওমা এইটা কোন কথা হলো! তুমি কাতল মাছ রান্না জানো না?
অহনা মুখ টিপে হেসে বললো, কাতল মাছ কেন, আমি কোন রান্নাই জানি না খালাম্মা। শুধু মাত্র চা, কফি বানাতে পারি।
পারো না শিখবা। সমস্যা নেই। যখন যা লাগে আমার কাছে চলে আসবা। আমি শিখায় দিব। না পারা দোষের কিছু নয়। শেখার আগ্রহ থাকাটাই বড় কথা।
শোন বৌমা, একটা কথা মনে রাখবা। বড়ো মাছ রান্না করতে গেলে মাংসের সব মশলা লাগে।
মাছের গায়ে আঁশটে গন্ধ থাকে। লেবু আর লবণ দিয়ে মাখিয়ে রাখবা কিছু সময়ের জন্য। তারপর হালকা কুসুম গরম পানিতে ভালো করে ধুয়ে হলুদ, মরিচ আর লবণ দিয়ে মাখিয়ে দশ মিনিট ঢেকে রাখবা।
তারপর মাছটা তেলে ভেজে, অন্য একটা হাঁড়িতে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে লাল লাল হয়ে আসলে, আদা, রসুন, জিরা, হলুদ মরিচ গুঁড়া পানি দিয়ে মশলাটা ভালো কষাবে।
মশলা থেকে তেল ওপরে উঠে আসবে যখন পরিমাণ মতো পানি দিয়ে পানটা ফুটে উঠলেই মাছ দিয়ে দিবা।
ঝোল মাখা মাখা হলে নামিয়ে ফেলবা।
বুঝছো?
যদি জিরা ফাঁকি থাকে, নামানোর আগে ছিটায় দিবা ওপর দিয়ে।
না বুঝলে বলো। আবার শিখায় দিব।
না খালাম্মা আমি বুঝতে পারছি। আর শেখাতে হবে না।
এর মধ্যে আসিফ চলে আসছে।
আসিফকে দেখে উনি মাথায় কাপড় তুলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আসি বৌমা। দরকার পড়লে ডেকো।
আসিফ বাজার নামিয়ে, মাছ গুলো হাল্কা ধুয়ে সুন্দর করে চার পিচ চার পিচ করে ভাগ করে ফেললো।
আজকে রান্নার জন্য ও চার পিস নিলো।
অহনা আরো চার পিস মাছ এই মাছ গুলোর সাথে রেখে বাকি গুলো ফ্রিজে রাখতে রাখতে বললো, ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
বাড়ি আলার বাসায় তরকারি দিব।
তাই বেশি মাছ নিলাম। তাছাড়া একটু থাকলে কাল গরম করে আমার দুপুরের খাওয়া হয়ে যাবে।
ও আচ্ছা। আমি ভাবলাম এতো বড়ো বড়ো পিস, চার পিস খেতেই তো কষ্ট হবে, আট পিস কেন?
অহনার সাথে কথা বলতে বলতে আসিফের ফোনটা বেজে উঠলো। আসিফ তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে চেয়ারম্যান ম্যামের ফোন।
ফোন রিসিভ করে সালাম দেওয়া মাত্র ওপাশ থেকে বললো, সরি আসিফ সাহেব ছুটির দিনে ফোন করে বিরক্ত করলাম।
না না ম্যাম ঠিক আছে। আপনি বলুন কি করতে হবে।
আসলে কাল আমাদের একটা জরুরী মিটিং আছে।
কিছু কাজ গোছানো বাকি ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমি একাই পারবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনার একটু সাহায্য দরকার।
আপনি কি দশ মিনিটের জন্য অফিসে আসতে পারবেন?
অবশ্যই পারবো ম্যাম। আমি এখনি আসছি।
আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনি চলে আসুন।
গাড়ির দরকার ছিল না ম্যাম। আমি রিকশা নিয়ে চলে আসতাম।
আসিফ অফিসে গিয়ে কাজের চাপে আটকে গেছে।
অহনাকে যাওয়ার সময় বলছে, যাবো আর আসবো। তুমি টেনশন নিও না। আমি এসে রান্না বসাব।
আসিফ কাজ করছে আর বার বার ঘড়ি দেখছে।
ঠিক সাড়ে বারোটায় কাজ শেষ করে বড়ো করে হাফ ছাড়লো।
কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে যাওয়ার সময় রুবাইদা অফার করে বসলো, চলুন আসিফ সাহেব এক সাথে লাঞ্চ করি আজ।
সরি ম্যাম। আজ পারবো না। আরেকদিন হবে।
আমার জন্য অহনা অপেক্ষা করছে। আমাকে এখন বাসায় যেতেই হবে।
বাহ্ খুব ভালো। বউকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
হ্যা, না মানে সারা সপ্তাহ তো একসাথে দুপুরের খাবার খাওয়া হয় না। একটা মাত্র ছুটির দিন।
আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন আপনাকে নামিয়ে দেই।
না না ঠিক আছে। আমি চলে যেতে পারবো।
আমি জানি আপনি যেতে পারবেন। আমি যেহেতু যাচ্ছি, আর একি পথ। লিফট দিলাম না হয়।
অহনা রান্না শেষ করে গোসল করে আসিফের জন্য অপেক্ষা করছিলো। ছাদে দাঁড়ালে নিচের সব কিছু দেখা যায়। ও ছাদের একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আসিফের অপেক্ষায়।
ও দেখলো, বাসার সামনে একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির দুপাশের দরোজা খুলে এক পাশে আসিফ অপর পাশে একজন সুন্দরী মহিলা বের হয়ে আসলো।
ও বুঝতে পারল এটাই সম্ভবত আসিফের চেয়ারম্যান ম্যাম।
আসিফ খুব হেসে হেসে কি যেন বলছে। খুব সম্ভবত ওপরে আসার অফার করেছে হয়তো। উনি রাজি হননি।
এতো ওপর থেকে কথা শোনা না গেলেও ভাব দেখে তাই মনে হচ্ছে অহনার।
তারপর বিদায় নিয়ে ওপরে চলে আসলো আসিফ।
অহনার মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে কেমন যেন একটা কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়ে আসিফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।
সরি সরি।
হঠাৎ করে একটা কাজে আটকে গেলাম।
তুমি চিন্তা করো না অহনা। আমি ঝটপট রান্না করে ফেলবো। আজ না হয় তুমি পাশে থেকে দেখো।
রান্না শেষ আসিফ।
তুমি গোসল করে নামাজ পড়তে যাও।
তারপর একসাথে খাবো।
আসিফ খুব অবাক হলেও, কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গোসল করে নামাজে চলে গেল। করণ নামাজের সময় হয়ে গেছে।
আসিফ যাওয়ার পর অহনা একটা বাটিতে দুই পিস মাছ, আর দধি নিয়ে বাড়ি আলার বাসায় দিয়ে আসলো।
তখন তাড়াহুড়ো করে খালাম্মা চলে গেল, দধি দিতে মনে নেই ওর।
ওরা দুজন খেতে বসেছে। আসিফ খাবার মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
অহনা খাবারে হাত দিয়ে আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
ওর খুব ভয় করছে, আসিফ খেতে পারবে তো?
মনে মনে খুব আফসোস হচ্ছে,
ইস পন্ডিতি করে মাছ গুলো নষ্ট না করলেও পারতাম।