আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৮ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৮
#Esrat_Ety

নভেম্বর মাসের শুরু। এখনই বেশ শীত পরতে শুরু করেছে। উর্বীর সন্ধ্যে থেকে গা শিরশির করছে শীতে। গাঁয়ে একটা পাতলা চাদর জরিয়ে রেখেছে। হাতে তার একটা বই।
এই বইটা হাতে নিয়ে উর্বী দুদিন ধরে বসে থাকে,অথচ একটা পাতাও পড়া হয়ে ওঠে না।
কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থেকে উর্বী উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়।

আমিরুন ঘরে এসে উর্বীকে ডাকে,”ভাবি আপনেরে আম্মায় ডাকতাছে। বড় আপায় ভিডিও কল দিছে আপনের লগে কথা কইবো”
উর্বী বিছানা থেকে বইটা নিয়ে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখে আমিরুনের সাথে সেদিকে চলে যায়।

রওশান আরার মুখ হাসিহাসি। সে উর্বীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়েই বলে,”তোমার বড় ননদ,আর ননদাইও আছে কিন্তু। সালাম দিও।”

উর্বী সালাম দেয়। ওপাশ থেকে আজমেরীর স্বামী হাফিজুর রহমান সালামের উত্তর দেয়।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাবী ভালো আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন?
উর্বী বিব্রত হয় এতো বড় একজন লোকের মুখে ভাবি ডাক শুনে, সে বলে,”জী ভাইয়া।”

হাফিজুর রহমানের মুখ হাসি হাসি। সে বলে,”কি যে বলি ভাবি সরকারের চাকর আমি। করি সরকারি চাকুরী। ছুটিছাটা তো আর মন মর্জি মতো পাই না। বিয়েতে যেতে পারিনি। কদিন আগে সামিউলের এতো বড় একটা এ’ক্সি’ডেন্ট হলো তাতেও যেতে পারিনি। আপনার ননদ তো রে’গে আমার সাথে কথাই বলেনি তিন দিন।”

উর্বী তাকিয়ে আছে তার ননদের স্বামীর দিকে। সে কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। ওপাশ থেকে হাফিজুর রহমান বলে,”ভাবী কাজের কথায় আসি। সামনে একটা ছুটি পেতে যাচ্ছি। আমি ঠিক করেছি এবারের ছুটি আমি আমার গ্রামের বাড়িতে কাটাবো। রাওনাফ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আপনাদের সবাইকে এসে আমি নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে। সবাই মিলে আমরা আনন্দ করে ছুটি টা কাটাবো। আপনাকে বলে রাখলাম ভাবি।”

উর্বী জবাব না দিয়ে ম্লান হাসে। ওপাশে আজমেরী হাফিজুরের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে, “আমাকেও একটু কথা বলতে দাও তো।”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”উর্বী শোনো, ভাইয়াকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। জানোই তো তার কাছে তার হসপিটাল,ডাক্তারিই সব। আমি রুমাদেরও আসতে বলেছি। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হতে যাচ্ছে।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। আজমেরী আরো কথা বলতে থাকে।
বাইরে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বাজে। রাওনাফ এসেছে।

আজমেরী ফোন রেখে দেয়। উর্বী রওশান আরার কাছে বসে থাকে।মোহনাও সেখানে আছে। আমিরুনও রয়েছে। রাওনাফ দোতলায় উঠে রুমে না গিয়ে উঁচু গলায় আমিরুনকে ডাকে,”আমিরুন একটু কফি দিয়ে যা তো আমায়।”

রওশান আরা উর্বীকে বলে,”বৌমা যাও। এভাবে বসে আছো কেনো। স্বামী বাইরে থেকে ফিরলে তাকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়াটা স্ত্রীর কর্তব্য। আশা করি আমার বারবার তোমাকে বলে দিতে হবে না।”

উর্বী চলে যায়। মোহনা তার শাশুড়িকে বলে,”মা এভাবে কাজ হবে?”
রওশান আরা হাসে,বলে,”আমার শাশুড়ির কাছে একটা কথা শুনেছিলাম মেজো বৌমা,”দেখলে মায়া,না দেখলে ছায়া।”

মোহনা তার শাশুড়ির কথা বুঝতে পারছে না। তার শাশুড়ি কি করতে চাইছেন?

***
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় আরাম করে হেলান দিয়ে বসে পরে।

উর্বী কফি নিয়ে রুমে ঢোকে। রাওনাফের দিকে কফি এগিয়ে দিতে দিতে বলে,”আপনার কফি।”
রাওনাফ তার দিকে তাকায়। কফিটা নিতে নিতে বলে,”তুমি!!আমিরুন কোথায়।”

-মা তাকে একটু কাজে ডেকেছে।

এই বলে উর্বী ঘর থেকে বের হতে চায়। রাওনাফ ডাকে,”উর্বী।”

উর্বী ফিরে তাকায়। রাওনাফ বলে,”যেটা তোমার মন চাইবে না সেটা অন্য কেউ বললেও করার দরকার নেই, অন্তত এখানে, আমার বাড়িতে।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”আপনার এটা কেন মনে হয় সবাই শুধু আমাকে সবসময় জোর করে সবকিছু চাপিয়ে দেয়।”

রাওনাফ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,”এমনটা মিন করিনি।”

রাওনাফ তার ফোনের দিকে মনোযোগ দেয়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এইযে এই আ’ই’ডি টা তোমার? মৃদুলা উর্বী?”

উর্বী বলে,”হ্যা।”

-তোমার ভালো নাম মৃদুলা?

-হ্যা। কেন কবুল বলার সময় খেয়াল করেননি? কাজী বলেনি?
ঠান্ডা গলায় বলে উর্বী।

রাওনাফ থতমত খেয়ে যায়। তার ফোনটা পাশে রেখে বলে,”আজমেরীর স্বামী ফোন করেছিলো। তোমাকেও বোধ হয় বলেছে। নেক্সট উইক আমাদের সবাইকে নিতে আসবে। তোমার যদি ইচ্ছে না থাকে যাওয়ার আমায় খোলাখুলি বলতে পারো।”

-আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই আপনাকে কে বললো?

-না,হতে পারে না? ইচ্ছে নাই থাকতে পারে।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি যেতে চাই। আমার কোনো অসুবিধা নেই।”

***
শর্মী মনে মনে ভাবছে তার যদি বড় কোনো অসুখ হতো, তাহলে তো আর স্কুলে যাওয়া লাগবে না। আমিরুন এসে শর্মীর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
“আম্মু কিচ্চু খাইবা না? স্কুলের সময় হইয়া গেছে তো।”

-না খালামনি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

আমিরুন দাঁড়িয়ে থাকে। বলে,”টিফিন বক্সে ভইরা দিয়া দিমু?”

-হু দিতে পারো।

শর্মী তার ব্যাগ গোছাতে থাকে। শায়মী নাবিল স্কুলে গেছে। বাড়িতে আছে শুধু তার দাদু,উর্বী আর আমিরুন। অন্যরা সবাই বেরিয়েছে।

স্কুল ড্রেস গায়ে চাপিয়ে শর্মী তার পাপাকে ফোন করে।

-হ্যালো পাপা তুমি কখন আসবে?

-আমার তো আসতে বারোটা বেজে যাবে মামুনি। কেনো?

-কেনো মানে,তুমি ভুলে গিয়েছো আজ আমাদের স্কুলে প্যারেন্টস টিচার মিটিং।

-ওহহ হো মামুনি। আমি একেবারে ভুলে বসে আছি। সরি মামুনি।আচ্ছা মোহনা বাড়িতে নেই? ওকে নিয়ে যাও।

-বাড়িতে কেউ নেই পাপা সবাই বেরিয়েছে। সবার কাজ আছে।

-ঠিক আছে আমি তোমার ক্লাস টিচারের সাথে কথা বলছি। তুমি স্কুলে যাও মামুনি।

-লাগবে না, তুমি থাকো তোমার কাজ নিয়ে।

শর্মী রে’গে ফোনটা রেখে দেয়। আজ তাকে তার ক্লাস টিচার অনেক কথা শোনাবে। শর্মীর খুব কান্না পাচ্ছে। সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়। আমিরুন পেছন থেকে ডাকতে থাকে,”আম্মু টিফিন নিলা না যে। ও আম্মু দাড়াও।”

শর্মী দাঁড়ায় না। উর্বী আমিরুনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে আমিরুন আপা।”

-জানি না ভাবি। টিফিন না নিয়াই চইলা গেলো গটগট কইরা। রাইগা গেলো কেনো বুঝবার পারতাছি না। সব কয়টা পোলাপাইন ভাইজানের রা’গ পাইছে।

-তোমার ভাইজানের অনেক রা’গ? কই দেখে মনে হয় না তো।

-ভাইজান সব সময় রা’গ দেখায় না। যখন দেখায় তখন বুঝা যায়। তয় আমার ভাইজান সেরা ভাবি।

-হয়েছে আর ভাইজানের গুন গাইতে হবে না। টিফিন বক্স টা আমার হাতে দাও। আমি দিয়ে আসছি।

আমিরুন অবাক হয়ে বলে,”আপনি যাইবেন ভাবি?”

-হ্যা,আমার একটু কাজ আছে বাইরে। একটা চাকুরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে।

আমিরুন উর্বীর হাতে টিফিন বক্সটা দেয়। উর্বী বলে,”সিনথিয়া শর্মী তো ওর নাম? ক্লাস সেভেন, রোল ৩৭ তাই না?

-হ ভাবি।

উর্বী বেরিয়ে পরে। বাড়ির ড্রাইভার আব্দুল বলে,”কই যান ভাবি।ওঠেন গাড়িতে ওঠেন।”

উর্বী গাড়িতে উঠতে উঠতে বলে শর্মীদের স্কুলে চলুন।

***
ক্লাস টিচার ওয়াহিদুজ্জামান উর্বীকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ারে বসলেন। শর্মী দাঁড়িয়ে আছে। তার ভিষন রা’গ হচ্ছে। এই মহিলা এখানে কি করছে। কত্তো বড় সাহস!

ওয়াহিদুজ্জামান বলে,”আপনি শর্মীর কি হন?”

উর্বী খুব বিব্রত বোধ করতে থাকে। সে শুধু চেয়েছিলো শর্মীর হাতে টিফিন বক্স টা দিয়েই বেরিয়ে যাবে কিন্তু ওয়াহিদুজ্জামান তাকে দেখেই এগিয়ে আসে।
উর্বী আমতা আমতা করে বলে,”আমি শর্মীর বাড়ির লোক।”

-বাড়ির লোক বুঝলাম। কিন্তু আপনাকে কখনও দেখিনি। সম্পর্কে কি হন? কাজিন?

শর্মীর কান গরম হয়ে যায় লজ্জায়। তার পেছনে দাঁড়ানো তার বন্ধুরা উচ্চস্বরে হেসে ফেলে। ওয়াহিদুজ্জামান তাদের দিকে রা’গী চোখে তাকায়। তারা দমে যায়। শর্মীর ইচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে।

উর্বী ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ডক্টর রাওনাফ করিম খানের ওয়াইফ।”

ওয়াহিদুজ্জামান অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”ও আই সি। আমি এরকমটা শুনেছি। আপনি ডক্টর খানের ওয়াইফ! যাই হোক,বাড়ির লোকই তো। আপনাকেই বলি। শর্মীর প্রতি আপনাদের বাড়ি থেকে আরেকটু খেয়াল দিতে হবে। আমি মানছি ডক্টর খান বিজি মানুষ বাট…. শায়মী আর নাবিলকে নিয়ে আমার কখনো অভিযোগ করতে হয়নি কোনো ব্যাপারে। আপনি প্লিজ দেখবেন।”

-আচ্ছা।
উত্তর দেয় উর্বী।

-ডক্টর খানকে আমার সালাম দেবেন। সময় পেলে যাবো আপনাদের বাড়ি। চা খেতে।
হাসতে হাসতে বলে ওয়াহিদুজ্জামান।
উর্বী মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। দরজার কাছে শর্মী দাঁড়িয়ে। কটমট চোখে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে।

***
খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।

শায়মী,শর্মী চুপচাপ খাচ্ছে। রাওনাফ শুধু সালাদ খাচ্ছে। রওশান আরা উর্বীকে খেতে বসার জন্য জোরাজুরি করছেন।

উর্বী খাবার পরিবেশন করছিলো, নাবিলের প্লেটে মাংস তুলে দিতে যাবে অমনি নাবিল বলে,”আমি নিয়ে নিতে পারবো।”

উর্বী থেমে যায়।

-আপনাকে যেনো আমাদের তিন ভাইবোনের কোনো ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে ঢুকে পরতে না দেখি। শর্মীর স্কুলে যাওয়ার সাহস কিভাবে হয় আপনার। আপনি কি আমাদের মা হওয়ার ভান করছেন নাকি।দূরে থাকবেন আমাদের থেকে!

রাওনাফ মাথা তুলে নাবিলের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকায়। তারপর উর্বীর দিকে তাকায়।

উর্বী খুবই শান্ত ভাবে বলে,”আচ্ছা।”

রাওনাফ ছেলেকে কিছুই বলে না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তারপর মাথা ঘুরিয়ে রওশান আরার দিকে তাকায়। রওশান আরা খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে।

নাবিল কিচ্ছু বলে না আর। এমন ভাবে খেতে থাকে যেনো কিচ্ছু হয়নি। সে কিচ্ছু করেইনি।
উর্বী খাবার টেবিল ছেড়ে রুমে চলে যায়। রওশান আরা ডাকে, “ও বৌমা। না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো।”

উর্বী দাঁড়ায় না।

শর্মী আর শায়মী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ চুপচাপ উঠে পরে।

শর্মী তার দাদুকে বলে,”দাদু উনি কি খাবেন না?

-না বোধ হয়,তোমার ভাইয়া যা করেছে!
রওশান আরা আড়চোখে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল খেতে থাকে।
শর্মীর ভিষন খারাপ লাগছে। কেনো যে সে ভাইয়াকে বলতে গেলো স্কুলের কথা। তার জন্য একজন মানুষ না খেয়ে থাকবে !

ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাওনাফ হেঁটে ঘরের দিকে যায়। এই সবকিছু তারজন্য হচ্ছে। ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই সে চ’ম’কে ওঠে।

উর্বী মেঝেতে পরে আছে। রাওনাফ কয়েক মূহুর্ত থম মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে যায় সেদিকে। হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে ডাকতে থাকে,”উর্বী! উর্বী!”

উর্বী কোনো সাড়া দেয়না। রাওনাফ জড়তা নিয়ে উর্বীর মুখটা ঘুরিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো চ’ম’কে ওঠে, মুখ থেকে ফ্যা’না বের হয়েছে।

“ইয়া আল্লাহ! এসব কি! উর্বী! তুমি শুনতে পাচ্ছো! উর্বী!”

রাওনাফ উঁচু গলায় ডাকতে থাকে। উর্বী একই অবস্থায় পরে থাকে। রাওনাফ কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে উর্বীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়।
বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে বসে উর্বীর পালস চেক করে। চোখ দেখে। এবং ডাকতে থাকে,”উর্বী! উর্বী।”

উর্বীর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। রাওনাফ উঠে মোহনা আর আমিরুনকে ডাকতে থাকে।
মোহনা ছুটে আসে। উর্বীর এমন অবস্থা দেখে মোহনাও হতভম্ব হয়ে যায়।

মাথার কাছে বসে ডাকতে থাকে,”এই উর্বী!”

রাওনাফ উর্বীর লক্ষণ দেখে একবার চিন্তা করলো হস’পিটালাইজড করার। পরক্ষনেই উর্বীর ভাই রেজাউলকে ফোন দেয় সে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে রেজাউল সালামের উত্তর দেয়। রাওনাফ একটু তাড়াহুড়া করে বলে ওঠে,”প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। একটা কথা জানার ছিলো। উর্বী কি হি’স্টিরিয়ার রোগী? মানে আগে কখনও লক্ষন দেখেছেন কোনো?”

রেজাউল কবির উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”না! এমন কিছু নেই। কেনো? কি হয়েছে!”
চেঁচিয়ে ওঠে রেজাউল।

রাওনাফ বলে,”উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছি। একটু সেন্স’লেস হয়ে গিয়েছে। নাথিং সিরিয়াস। আপনাকে ফোন দিয়েছি কথাটা জানতে। আমার ধরন বোঝা দরকার। চিকিৎসা দিতে হবে। টেনশনের কিছু নেই। ভালোমন্দ জানাবো আপনাদের।”

রাওনাফ ফোন কেটে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে উর্বীর চোখে মুখে পানি ছেটাতে থাকে। মোহনা বলে ওঠে,”ভাইয়া হাতের তালু ঘামছে খুব!”

রাওনাফ কিছু একটা চিন্তা করে বলে,”তুমি ওর শরীর থেকে কাপড় কিছুটা আলগা করে দাও। তারপর ম্যাসাজ দাও। জানো তো কিভাবে দেয়?”

মোহনা মাথা নাড়ায়। রাওনাফ এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”দিতে থাকো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

ফোন হাতে নিয়ে রেজাউল তহুরার দিকে তাকায়। তহুরা এগিয়ে এসে বলে,”কি হয়েছে! কি হয়েছে ওর!”

_সেন্স’লেস হয়ে গিয়েছে হঠাৎ!

_আবার! আবার শুরু হয়েছে সেসব!
তহুরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।

রেজাউল কবির স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে উদাসী গলায় বলে,”শান্তি পাবে না কখনো!”

***
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রাওনাফ। কিছুক্ষণ পরে বাইরে থেকে মোহনাকে বলে ওঠে,”ইজ এভরিথিং ওকে মোহনা!”

_ভাইয়া,জ্ঞান ফিরছে।

_ঠিকাছে। তোমাকে যা বলেছি তাই করো। ওর পোশাক পালটে দিও পারলে।

_দিয়েছি ভাইয়া।

রাওনাফ মাথা নিচু করে তার টি-শার্টের দিকে তাকায়। উর্বীর মুখ থেকে নিঃসৃত ফ্যা’না কিছুটা তার গায়ে লেগে গিয়েছিল যখন উর্বীকে কোলে তুলেছিল। নিজেকে দেখে রাওনাফ ম্লান হাসে।

শর্মী এসে তার পাপার সামনে দাঁড়ায়। রাওনাফের ঘরের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলে ওঠে,”ওনার জ্ঞান ফেরেনি পাপা?”

_ফিরছে মামুনি।

শর্মী চুপ হয়ে যায়, তারপর আবার বলে ওঠে,”তখন ভাইয়া ওনার সাথে বাজে ব্যাবহার করেছে সেজন্য এমন হয়েছে পাপা?”

রাওনাফ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”না। এটা এক ধরনের অ’সুস্থতা মামুনি।”

শর্মী তবুও চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ নিজের সরল মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ্য করে। তারপর বলে,”তোমার কি ওনার জন্য খারাপ লাগছে?”

শর্মী পাপার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তার খারাপ লাগছে।

***
উচ্ছাস বসে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে সি’গারেট। বুঝতে পারছে না কলটা রিসিভ করবে কি না। তার মা ফোন করছে। গত দুইদিনে বেশ কয়েকবার তার মা ফোন দিয়েছিলো। সে রিসিভ করেনি। সে জানে তার সাথে কথা বলার জন্য তার মাকে অনেক কথা শুনতে হবে।
উচ্ছাস অ্যাশট্রে তে অর্ধেক খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে তার মা শেফালির কন্ঠ ভেসে আসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ,”বাবা। বাবারে! তুই আমার ফোন ধরিস না কেনো বাবা। তোর মাকে এইভাবে কষ্ট দিবি বাবা।?”

-ফোন দিচ্ছো কেনো। সজীব বলে নি আমি ভালো আছি। এই বয়সে তা’লাক খাওয়ার শখ হয়েছে?
ক’ড়া কন্ঠে বলে উচ্ছাস। শেফালি জবাব দেয়,”দিক তালাক,এই লোকের সাথে আমি থাকতে চাই না। আমার কলিজার টুকরাকে আমি দেখতে পারি না এই লোকের জন্য। ও বাবা! আমি তোকে একটু দেখতে চাই। তুই একটু………”

শেফালি কথা শেষ করতে পারে না। তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় শাখাওয়াত চৌধুরি।
সে উচ্ছাসকে বলে,”আমার জীবনে প্রথম ভুল হচ্ছে তোমার মতো একটা কু’লা’ঙ্গার কে জন্ম দেওয়া আর দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে সেদিন তোমায় গু’লি না করা।”
উচ্ছাস কোনো কথা বলে না। শাখাওয়াত বলে,”তোমার মায়ের জন্য চিন্তা করতে হবে না। তাকে আমি তা’লাক দেবো না। আমি এতো বোকা না যে ইলে’কশ’নের আগে এইরকম বোকামি করবো।”

উচ্ছাস চুপ করেই থাকে। শাখাওয়াত বলতে থাকে,”আর একটা কথা মাথায় রাখবে। উর্বী মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সেটা নিশ্চই জেনে গিয়েছো। আমি যদি শুনি তুমি ওর ব্যাপারে আর নাক গলিয়েছো তাহলে ভালো হবে না। তোমার জন্য যদি আমার পলি’টিক্যা’ল লাইফে আর কোনো প্রভাব পরে তবে আমি তোমায় ছা’ড়বো না।”
শাখাওয়াত ফোনটা নিজের স্ত্রীর হাতে দিয়ে চলে যায়। শেফালী ফোন কানে ধরে ফোপাতে থাকে, উচ্ছাস বলে ওঠে,”তোমার স্বামীর কথামতো চলো মা। হুটহাট ফোন দিও না।”
কথাটা বলে উচ্ছাস ফোনটা রেখে দেয়। তারপর ঠোট বাকা করে হাসে। তার দৃষ্টি ফোনের স্ক্রি’নে উর্বীর ছবিতে নিবদ্ধ। উর্বী বই হাতে নিয়ে দাড়িয়ে হাসছে। আকাশী রঙের সালোয়ার কামিজ পরনে তার।এই ছবিটা উচ্ছাস তুলে দিয়েছিলো।

***
ঘরের দরজা বন্ধ করে রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে বিছানায় উর্বীকে একপলক দেখে। জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু খুবই অসুস্থ শরীরটা।

আলমারি থেকে একটা টিশার্ট বের করে রাওনাফ ওয়াশ রুমে ঢুকে টি-শার্ট টা পালটে নেয়। তারপর এসে বিছানার কাছে দাড়ায়।

ঘড়িতে সময় রাত দেড়টা। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রাওনাফ উর্বীকে ভালো করে লক্ষ্য করে। একে শুধু শুধু রো’গা মনে হয় না, এই মেয়েটা নিশ্চিত কোনো ভয়াবহ শারীরিক জটিলতায় ভু’গছে। কিছু টে’স্ট করাতে হবে।

উর্বীর মুখের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে রাওনাফ তাকিয়ে আছে। খুবই চমৎকার একটি মুখশ্রী। শিক্ষিতা একজন মহিলা। কিন্তু কেনো যেনো রাওনাফের কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না! এই স্তরের আর পাঁচজন মেয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মেয়েটি। কখনো যথেষ্ট ম্যাচিওর লাগে তো কখনও একেবারে বাচ্চা। আচরণ কিছুটা এলোমেলো।

সম্ভবত শীত লাগছে উর্বীর। পায়ের কাছ থেকে কমফোর্টার গায়ে টেনে দিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়।
বিড়বিড় করে নিজের মনে রাওনাফ বলে ওঠে,”সম্পর্কে বোঝাপড়ার কথা তো জানি না মৃদুলা উর্বী! তবে আমার মনে হচ্ছে এখন থেকে আমাকে তিন টা নয়, চার টা বাচ্চার দেখভাল করতে হবে!”

মশা মারার মেশিন অন করে দিয়ে বিছানায় এসে বসে। উর্বীকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।

বিছানায় উঠে বেড সাইডের টেবিল থেকে শিমালার ছবিটা হাতে তুলে নেয় রাওনাফ। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে ওঠে,”তোমার আমার এই অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে! রাগ হচ্ছে! দুঃখ হচ্ছে! হিংসা হচ্ছে! কোনটা হচ্ছে জানি না!
তবে আমার কিন্তু নিজের ওপর অনেক মায়া হচ্ছে শিমালা। সাথে এই মেয়েটির ওপরেও!”

চলমান…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here