আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৪ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৪
#Esrat_Ety
[বড় পর্ব! সবাই মেইন ফেসবুক দিয়ে পড়বেন]

তহুরা ভিজিয়ে রাখা ডাল শিল নোড়ায় বাটছে। আজ তার মে’জাজ ঠিক নেই। সারাদিনে বিদ্যুৎ নেই,পানি শেষ। বালতিতে করে যেটুকু পানি তুলে রেখেছিলো তাও শেষের পথে। এই এলাকায় আজকাল ঘন ঘন লোডশেডিং এর সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বরিশাল এদিক দিয়ে ভালো আছে। লোডশেডিং খুব কম হয় বরিশালে।
রেজাউল কবির এসে রান্না ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ায়। তহুরা তার উপস্থিতি টের পেয়েই বলে,”কে ফোন করেছিলো? উর্বীর শশুর বাড়ি থেকে?”
_হু।
উত্তর দেয় রেজাউল কবির।

_কি বললো? উর্বীর সাথে কথা হয়েছে?
_আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন, কাল বৌভাত। ওবাড়ির মেজো ছেলে বারবার করে বলে দিয়েছে যাতে আমরা সকলেই যাই।
ডাল বাটা থামিয়ে দেয় তহুরা।
বলে,
-তুমি গেলে যেয়ো। আমি পারবো না যেতে,আমি উর্বীর সামনে গিয়ে দাড়াতে পারবো না।

রেজাউল কবির দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। তার আদরের বোন, যাকে তিনি ছোট থেকে কখনো রাতে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতেও রাখেনি। সেই মেয়ে আজ দুদিন হবে বাড়িতে নেই। বাড়িটা মাতিয়ে রাখা মেয়েটা চলে যাবার পর বাড়িটা খালি খালি লাগছে। রেজাউল কবির তার হাতের দিকে তাকায়, তার ইচ্ছে করছে চুলায় ঢুকিয়ে তার হাত পু’ড়িয়ে ফেলতে। এই হাত দিয়ে সে তার আদরের বোনকে মে’রেছে।

তহুরা আবার জিগ্যেস করে,”উর্বীর সাথে কথা হয়েছে?”

-না।

-জানতাম,ওই মেয়ে আমাদের সাথে আর কথা বলবে না। আমরা ঠিক করিনি, ঠিক করিনি মেয়েটার সাথে।

আমি তোমাকে বারবার বলেছি,আরেকবার ভেবে দেখো। তুমি শোনোনি। তোমার কাছে তোমার মান সম্মান বড় হয়ে গিয়েছিলো।এখন বোঝো কেমন লাগে।

রেজাউল কবির অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি পৃথিবীর সবথেকে নি’কৃষ্ট বড় ভাই।

***
উর্বী দূরে দারিয়ে সামিউল আর অন্তরাকে দেখছে। মোহনা দুজনকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। তারা আজ সারাদিন না খেয়ে ছিলো। উর্বী অবাক হচ্ছে,এতকিছুর পরেও তার সামিউলের ওপর রা’গ হচ্ছে না। বরং সামিউল আর অন্তরাকে দেখতে তার বেশ ভালো লাগছে। দুজনকে ভালোই মানিয়েছে। সামিউল লম্বা, এবাড়ির সব ছেলেরাই লম্বা, তাদের পাশে লম্বা বৌকেই মানায়। মোহনা লম্বা,অন্তরাও লম্বা। উর্বী খাটো।

পেছন থেকে আজমেরী ডাক দেয়,”উর্বী।”
উর্বী ঘুরে তাকায়।
_তোমাকে মা ড্রয়িং রুমে ডাকছেন। কয়েকজন মহিলা এসেছেন তোমায় দেখতে। সম্পর্কে তারা তোমার ফুপু শাশুড়ি হয়। গিয়ে তাদের সালাম দেবে, পা ছুয়ে না। মুখে বলে সালাম দেবে।

“জি আপা।”
উর্বী বলে।

-মাথার ঘোমটা টা টেনে যাও, তারা পুরনো দিনের মানুষ তো।
উর্বী মাথায় ঘোমটা টানে। তার ব্যাপার গুলো কেন জানি বেশ ভালো লাগছে, জীবনটা কাছের মানুষের “ছিঃছিৎকারে” একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো। একটু নতুনত্বের গন্ধ পাচ্ছে!
আজমেরী উর্বীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কোথাও যেন বড় ভাবীর সাথে এই মেয়েটার মিল সে খুঁজে পায়।

আজমেরী বলে,
_তুমি যাও,আমি আমিরুন কে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। নিজের হাতে পরিবেশন করবে তাদের মাঝে।

উর্বী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।
আজমেরী বলে,”এখন যাও।”

উর্বী চলে যায়। আজমেরী ডাইনিং রুমে ঢোকে। রুমা তাকে দেখতে পেয়ে বলে বলে,”উর্বী মেয়েটা কি জা’দু জানে নাকি রে আপা! তার এক কথাতেই মা সামিউলদের এবাড়িতে থাকতে দিয়েছে!”

_থাকতে দিয়েছে শুধু। ওরা কাল থেকে আলাদা খাবে। উত্তরের দুটো কামরা ওদের জন্য খুলে পরিষ্কার করে দিতে বলিস। ওরা যেন ওদের জিনিসপত্র নিয়ে সেখানে ওঠে।
উত্তর দেয় আজমেরী।
মোহনা বলে,”উর্বী দরজা বন্ধ করে মাকে কি বললো ভাবছি! মা এই মেয়েকে অনেক পছন্দ করেছে। দেখলে না একদিনের আলাপেই এই মেয়েকে সামিউলের জন্য পছন্দ করে ফেলেছিলো।”
সামিউলের গলায় খাবার আটকে যায়। সে অনবরত কাশতে থাকে।
অন্তরা তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।

***
নাবিল এই মুহুর্তে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। তার কিছুটা সামনে বাচ্চারা খেলছে। নাবিলের থেকে কয়েক গজ দূরে একটা বেঞ্চে একজন মা তার ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে বসে আছে। নাবিল সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তার ছোটবেলার কথা মনে পরে যায়। তার মা রোজ বিকেলে তাকে আর শায়মীকে নিয়ে পার্কে আসতো।
হঠাৎ নাবিলের ফোন বেজে ওঠে। শায়মীর ফোন। নাবিল ফোন কে’টে দিতে গিয়েও দেয় না। ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরে। শায়মী বলে ওঠে,”হ্যালো! নাবিল তুই কোথায়?”

নাবিল কথা বলে না। শায়মী আবার বলে,”নাবিল চুপ করে আছিস কেনো। বল তুই কোথায়!”

নাবিল বলে,”আছি এক যায়গায়। ভালো আছি।”
_বাসায় ফিরবি না?
কোমল সুরে জানতে চায় শায়মী।

_ফিরবো না কেনো। আমার বাড়িতে আমি অবশ্যই ফিরবো।

-কখন ফিরবি?

-যখন মনে চাইবে তখন।

শায়মী চুপ করে শোনে। নাবিল বলে,”টেনশন করিস না। কোনো অঘটন ঘটাইনি এবার। আর মনে হয়না ঘটাবো। আমার মনটা খুব ভালো আজ।”
শায়মী বুঝতে পারে না কিছু। নাবিলের এতো স্বাভাবিক ব্যাবহার তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।
নাবিল বলে,”কিরে কথা বলছিস না যে।”

শায়মী বলে,”ছোটো চাচ্চু ফিরেছে বাড়িতে।”

_ভালো কথা। সেটা আমাকে বলছিস কেনো।

_সাথে অন্তরা ম্যাম। তারা বিয়ে করে নিয়েছে।

নাবিল বলে,”ও আচ্ছা। ভালোই তো, বাড়িতে শুধু বিয়ে আর বিয়ে।আমি ভাবছি আমিও একটা বিয়ে করবো। বিয়ে করে ডক্টর রাওনাফ করিম খান আর তার মা দ্যা গ্রেট রওশান আরাকে চমকে দেবো। কি বলিস! হাহাহাহাহা, ভালো হবে না বল?”

শায়মী কিছু বলে না। নাবিল বলে,”আজ আমার মনটা এতো ভালো কেনো জানতে চাইবি না?
শায়মী বলে,”বল,কেনো!”
_আজ দাদাবাড়ি গিয়েছিলাম,মাম্মার কবরের কাছে।

শায়মী চুপ করে থাকে।

নাবিল বলে,”আর কিছু বলবি?”

_তুই ফিরে আয় নাবিল। শর্মী কাঁদছে।

_দেখি।

নাবিল ফোন কেটে দেয়। মাগরিবের আজানের সময় হয়ে গেছে।পার্ক থেকে লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। নাবিলও উঠে দাঁড়ায়।

***
উর্বী মাগরিবের নামাজ আদায় করে ঘরে বসে আছে। বাচ্চা গুলি দরজার বাইরে থেকে উকি দিচ্ছে। কেউ ভেতরে আসছে না। উর্বী হাত দিয়ে তাদের ডাকে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে বড় সে ভেতরে ঢুকতেই অন্যরাও তার দেখাদেখি ভেতরে ঢোকে। উর্বী তাদের নিজের পাশে বসায়।
তারপর নাম জিগ্যেস করে। তাদের মধ্যে একজন দায়িত্ব নিয়ে একে একে নিজেদের নাম বলতে থাকে,”আমার নাম রনি,ওর নাম মিশফা,ওর নাম ইফতি, ওর নাম জারা আর ওর নাম রাকিন।”

ওদের মধ্যে সবচে যে ছোট,সে উর্বীকে বলে,”আর তোমার নাম “বড় মামী”?”
উর্বী হেসে ফেলে, সেই বাচ্চাটাকে নিজের কোলের কাছে টেনে বলে,” না বাবু,আমার নাম বড় মামী না,আমার নাম হচ্ছে উর্বী।”

দরজা ঠেলে রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। উর্বী খেয়াল করে যে কয়বার রাওনাফ উর্বী থাকা অবস্থায় এই রুমে ঢুকেছে, তার মুখ দেখে মনে হয় সে কোনো অন্যায় করে ফেলেছে এবং সে লজ্জিত। উর্বী ভেবে পায়না নিজের বাড়ি নিজের রুম তবু এতে এতো দ্বিধার কি আছে। এতো দ্বিধা থাকলে বিয়ে করার দরকার কি ছিলো!

ছোট বাচ্চাটা, যার নাম মিশফা। সে আবার বলে,”মা বলেছে,তোমাকে যেন আমরা বড়মামী ডাকি। তুমি আমাদের বড় মামার বউ।”
উর্বী আর রাওনাফ দুজনেই বিব্রত বোধ করে।

বাচ্চাগুলো রাওনাফকে ঘিরে ধরে। রনি বলে,”বড় মামা,তুমি আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলে,আমরা ঘুরতে যাবো না?”
_হ্যা যাবো তো মামা,আজ আমাকে হসপিটাল যেতে হবে,কাল সব্বাইকে নিয়ে যাবো ঘুরতে।
_আর বড়মামীও যাবে আমাদের সাথে?

রাওনাফ কিছু বলে না। তড়িঘড়ি করে তার পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। তাকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে হসপিটাল যেতে হবে।

উর্বীকে মোহনা ডাকতে আসে। প্রতিবেশীরা নতুন বউ দেখতে এসেছে। উর্বী উঠে নিচে চলে যায়। বাচ্চাগুলোও তাকে অনুসরণ করে।

***
আমীরুন বাইরে থেকে দরজায় টোকা দেয়। ওপাশ থেকে সামিউল বলে,”কে?!!”
_আমি আমিরুন ছুডো ভাইজান। দরজা খুলেন।

দরজা খোলে অন্তরা। আমিরুনের হাতে একটা মশারি। সে মশারি টা বিছানায় রাখতে রাখতে বলে,”বড় আপায় পাঠাইছে। অনেক মশা।”

সামিউল বলে,”ঠিকাছে,তোমাকে ধন্যবাদ।”

আমিরুন খুশি হয়,সে অন্তরাকে দেখে বলে,”তুমারে সত্যই নতুন বৌদের মতো লাগতাচে গানের আপা।”
অন্তরা মুচকি হাসে।

আমীরুন বলে,”বড় আপায় জিগাইতে কইছে,আপনেগো আর কিছু লাগবে কি না।”
-না,আপাতত আর কিছু লাগবে না।
সামিউল বলে।

আমিরুন মশারি টাঙিয়ে দিয়ে বলে,”নেন,আপনেরা বিশ্রাম করেন।কাইল বাড়িতে বৌভাত,মেলা কাম আছে,আমি যাই গা। গিয়া ঘুমাই।”

_আচ্ছা, উর্বীর সাথে বড় ভাইয়ার বিয়েটা কিভাবে হলো আমীরুন?
সামিউলের এমন প্রশ্নে অন্তরা তার দিকে তাকায়।

আমিরুন বলে,”এইসব অহন হুইনা কি আর করবেন ভাইজান।এইসব অহন হুনোনের কোনো দরকার আছে? তয় ছুডো মুখে একখান কতা কই ভাইজান। আপনি কাজটা ভালা করেন নাই। বিয়া যখন না করনেরই আছিলো তয় বিয়ায় রাজি হইয়া আম্মারে আশা দিছিলেন ক্যান। আপনার অন্যায় হইছে ভাইজান।”

আমীরুন চলে যায়। সামিউল সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
অন্তরা দরজা বন্ধ করতে করতে বলে,”অনু’শোচনা হচ্ছে?”
_কিসের অনুশোচনা?
_এইযে বিয়ের আংটি পরিয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে না করার।

সামিউল খাটে শুতে শুতে বলে,”হ্যা,সেরকম অপরাধবোধ তো একটু হচ্ছেই। মাকে ঠান্ডা রাখতে আংটি পরিয়ে রাখার সম্মতি দিয়েছিলাম। আমার উর্বীর সামনে পরলেই ভিষন লজ্জিত লাগছে।”

অন্তরা এসে সামিউলের পাশে শোয়। তার এখন শান্তি শান্তি লাগছে।সে বিশ্বাস ই করতে পারছে না সামিউল তার স্বামী।
কত ঝড় ঝাপটা পেড়িয়ে তারা দুজন এক হতে পেরেছে।
সামিউল অন্তরার হাতের ওপর একটা হাত রাখে। অন্তরা সেদিকে তাকায়। সামিউল বলে,”তোমার বাড়ির কথা মনে পরছে?”
_না।
অন্তরা বলে,”বাড়ির কথা মনে পরলেও এখন আর কিচ্ছু হবার নেই।সবাইকে ত্যাগ করে এসেছি। ”

অন্তরা দুদিন আগেও ভাবতে পারেনি তার কপালে এই সুখ লেখা আছে। অন্তরা ভাবে, সময় মানুষের জীবনে কত কি বদলে দেয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে তার জীবনের অনেকটা বদলে গেছে। এই তো কদিন আগে, অন্তরা যখন এ বাড়িতে পা রাখে তখনকার কথা।কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিয়েছিলো উষ্কখুষ্ক চুলের এক সুদর্শন পুরুষ। অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,”কাকে চাই?”

_আমি অন্তরা। আপনাদের বাড়ি থেকে আমায় ফোন করা হয়েছিলো। শর্মিকে গান শেখানো আর ইংলিশ পড়ানোর জন্য।

_ও আচ্ছা আচ্ছা,তাই বুঝি। আমি আসলে জানিনা। ভেতরে আসুন।

অন্তরা ভেতরে ঢোকে। সামিউল তাকে সোফায় বসতে বলে।

অন্তরা সোফায় বসতে বসতে বলে,”শর্মী কোথায়?”
_শর্মী তো বাড়িতে নেই,আসলে আজ কেউ বাসায় নেই। আজ শর্মীর বড়বোন আর বড়ভাই দুজনের জন্মদিন। সবাই রেস্তোরায় খেতে গিয়েছে।
অন্তরা অবাক হয়। এই কথাটা আগে বলে দিলেই তো পারতো উনি। নিশ্চই বাড়িতে একা। এই মুহুর্তে একটা অচেনা মেয়েকে বাড়িতে ঢুকিয়ে সোফায় বসতে দেওয়াটা যতোটা না ভদ্রতা তার চেয়েও কেমন একটা জানি। অন্তরা সরু চোখে তাকায়।
সামিউল অন্তরার সেই চাহনী বুঝতে পেরে যায়। সে ভাবতে পারেনি এই সামান্য ব্যাপারে এই মেয়েটা মাইন্ড করবে। তখন দরজা খুলে মেয়েটাকে দেখে মনে হয়েছিলো মেয়েটা অনেকটা পথ হেটে এসেছে,একটু বসতে চায়। সে বিব্রত হয়ে বলে ,”আপনি কাল বরং আসুন এই সময়ে।”
অন্তরা উঠে পালিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায়।

পরেরদিন অন্তরা আবার এসে কলিং বেল বাজায়, সামিউল দরজা খোলে। অন্তরাকে বলে,”আপনাকে ফোনে জানানো হয়নি তাই দুঃখিত আজকেও শর্মী বাড়িতে নেই। সে বাড়ির সবার সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছে।”
অন্তরার মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টি পরছে। সে ভাবতেই পারেনি এই অসময়ে বৃষ্টি হতে পারে। ছাতা নেই সাথে। এখন এখান থেকে বের হলে নির্ঘাত বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যাবে।ইতিমধ্যে বৃষ্টি তাকে পেয়ে বসেছিল তখন সে দৌড়ে রওশান মঞ্জিলে ঢোকে।
অন্তরা চিন্তায় পরে যায়। সে কখনোই এই বাড়িতে বসে অপেক্ষা করবে না বৃষ্টি থামার। আবার বৃষ্টিতে ভিজলেও তার খুব করুনদশা হয়। তার ঠান্ডা লাগার অভ্যেস। আগেরবার শখ করে বৃষ্টিতে ভিজে সে একমাস নিউমোনিয়া বাধিয়ে বিছানা নিয়েছিলো। অন্তরা অসহায়ের মতো চারদিকে তাকায়।
সামিউল বলে,”আপনি চাইলে এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারেন,ভেতরে ঢুকতে হবে না। বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন।”

অন্তরা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিউল দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষন পর আবার দরজা খোলার শব্দ পেয়ে অন্তরা সেদিক তাকায়। সামিউলেরর হাতে একটা মগ। সে বলে,”বাড়িতে কোনো ছাতা খুজে পাচ্ছি না। নয়তো আপনাকে দিতাম। তবে আপনি চাইলে এই কফিটা খেতে পারেন।”
অন্তরা কফিটা না নিয়েই বলে,”ধন্যবাদ। আমি কফি খাই না।”
সামিউল ভেতরে যায়। কিছুক্ষন পরে সে আবার আসে। হাতে একটা ছাতা। সে বলে,”নিন এটা,অনেক খুজে পেলাম। এটা নিয়ে বাড়ি যান। কাল নিয়ে আসবেন।”
অন্তরা হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নেয়।

এইতো কদিন আগের কাহিনী এটা। তারপর গোটা ন’মাস কেটে গেলো। কতকিছু যে হয়ে গেলো। রওশান আরা সব জানতে পেরে তাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এইতো কদিন আগেরই কাহিনী যেনো সব।
সামিউল অন্তরার মুখের উপরে থাকা এক গোছা চুল আঙুল দিয়ে কানে গুজে দিতে দিতে বলে,”এই অন্তু। কি ভাবছো?”
_কিছু না।

অস্ফুট স্বরে বলে চুপ হয়ে যায় তারপর আবার বলে,”জানো তোমাদের বাড়িতে অনেকটা শান্তি শান্তি লাগছে। কাল শিউলিদের বাড়িতে আমি সারারাত ছটফট করেছি। তুমি তো নাক ডেকে ঘুমিয়েছিলে। আমি একটুকুও ঘুমাতে পারি নি।”

_আজ রাতেও পারবে না।
সামিউল খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে।

অন্তরার গাল দুটো লজ্জায় লাল হতে চায়। সে কিছু একটা বলতে যাবে, সামিউল সে সুযোগ দেয় না। সে তার বৌকে পরম আদরে কাছে টেনে নেয়।

***
ড্রয়িং রুমের বাতি এখনো জ্বলছে। কেউ জেগে আছে। আজমেরী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। রওশান আরা সোফাতে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার চোখ বোজা অবস্থায়। আজমেরী তার মায়ের কাধে হাত রাখে। রওশান আরা তার দিকে তাকায়।

_কিরে তুই এখনো জেগে আছিস যে?
_পানি খেতে উঠেছিলাম আম্মা। দেখলাম বসার ঘরের বাতি জ্বলছে।তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো না কেনো?
_রাওনাফের জন্য বসে আছি। ওর হসপিটাল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। তাছাড়া ঘুম আসছিলো না। আজকাল রাতে খুব একটা ঘুম আসে না।
আজমেরী মায়ের পাশে বসে। রওশান আরা বলে,”কিছু বলবি?”
_মা উর্বী আর বড়ভাইজানের বিয়েটা দিয়ে তোমার কোনো অনুশোচনা হচ্ছে নাতো?

_না তো! কিসের অনুশোচনা? ওদের একটু সময়ের দরকার শুধু।বয়স কোনো ব্যাপার না,আমার রাওনাফ কি হেলা ফেলা নাকি।এখনো আমার ছেলেকে রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগে।

আজমেরী হাসে। বলে,”একটু আগে আমি বড় ভাইয়ার রুমে গিয়েছিলাম মা। যদিও আমার অন্যায় হয়েছে। তুমি রাগ কোরো না দয়া করে। দরজা খোলা ছিলো দেখে ঢুকলাম। দেখি উর্বী সোফাতে ঘুমিয়ে আছে।”
রওশান আরা আজমেরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কলিং বেল বাজছে।আজমেরী উঠে গিয়ে দরজা খোলে।

রাওনাফ বাড়িতে ঢোকে। বসার ঘরে মাকে দেখতে পেয়ে সে বলে,”এখনো জেগে আছো কেনো মা,তোমায় না বলেছি টাইমলি শুয়ে পরবে। ওষুধ খেয়েছো?”
_খেয়েছি। তুই একটু আমার কাছে বোস বাবা তোর সাথে কথা আছে।
রাওনাফ তার মায়ের কাছে গিয়ে বসে। বলে,”তোমায় এরকম চিন্তিত দেখাচ্ছে কেনো মা? সামিউলের ব্যাপারে চিন্তা করছো?”

রওশান আরা দৃঢ় ভাবে উত্তর দেয়,”না। ওর কথা আমি ভাবছি না।আর ভাবতেও চাই না। আমি তোর কথা ভাবছি। আচ্ছা বাবা তুই আমাকে একটা কথা বল,আমি কি তোর উপর অন্যায় করেছি বিয়ে করতে জোর করে?”
_এরকম কথা বোলছো কেনো মা,এইসব কথা থাক।
উত্তর দেয় রাওনাফ।

রওশান আরা উত্তেজিত হয়ে পরে। বলে,”না,আগে বল। এ বাড়ির সবার চোখে আমি অপরাধী হয়ে গেছি। তোর ছেলেমেয়েরা আমার সাথে কথা বলে না। তুই বল,আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছি?আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ?”

রাওনাফ তার মায়ের হাত মুঠো করে ধরে রাখে। বলে,”তুমি কোনো অন্যায় করোনি মা, তুমি তো আমাদের ভালোই চাও। ”

আজমেরী বলে,”মা,এইসব কথা থাক। ভাইয়া অনেক পরিশ্রম করে এসেছে,তাকে ঘুমাতে যেতে দাও। তুমি এসো আমার সাথে,ঘুমাবে।”

রওশন আরা উঠে দাঁড়ায়,রাওনাফকে বলে,”তোর সেদিনের পিচ্চি জেদী ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে, নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। আসার পর থেকে কারো সাথে কথা বলে নি।”
আজমেরী মাকে নিয়ে রুমে চলে যায়, রাওনাফ নিচতলায় নাবিলের রুমের দিকে তাকায়।

***
ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। দরজার বাইরে থেকে আসা আলোতে সে দেখতে পায় উর্বী সোফায় ঘুমাচ্ছে। রাওনাফ চুপচাপ হাতের ঘড়িটা খুলে রেখে ওয়াশরুমে ঢোকে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। এতো সামান্য আলোতে সে টাওয়াল খুজে পাচ্ছে না। এখন লাইট অন করলে যদি উর্বীর ঘুম ভেঙে যায় তাই সে ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করে টাওয়াল খুঁজতে থাকে। হঠাত তার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে।
উর্বী ধড়িফড়িয়ে উঠে বসে। সে ভিষন ভয় পেয়ে গিয়েছে।
রাওনাফ বিব্রতভাব নিয়ে ফোন রিসিভ করে, হসপিটাল থেকে কল এসেছে। সে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বলে। রাওনাফ উত্তর দেয়,”ঠিকাছে তুমি পেশেন্টের প্রেশার চেক করে আমায় মেসেজ করবে।”
উর্বী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। তার বুক ধুকপুক করছে।এমনিতেও সে অচেনা যায়গায় একা ঘুমাতে পারে না। এতো বড় রুমে তার ভিষন ভয় করে। সে ভয় নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলো সোফায়।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়, বলে,”দুঃখিত। আমি ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছিলাম।”

এই প্রথম রাওনাফ উর্বীকে কিছু বলেছে। উর্বী কিছু বলে না। তার পানির পিপাসা পেয়েছে। আধো অন্ধকারে সে পানির জগ খুজতে থাকে।
রাওনাফ অনুমান করতে পেরে, তার হাতের কাছে থাকা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে উর্বীর দিকে এগিয়ে দেয়। উর্বী হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নেয়। এরপর পুরো গ্লাসের পানি ঢকঢক করে পান করে।
রাওনাফ বিছানা থেকে একটা চাদর নিতে নিতে বলে,”তোমার সোফায় ঘুমানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি বিছানায় ঘুমাতে পারো। সোফায় আমি ঘুমাচ্ছি।”

_না না,তা কেনো। আপনি কাল সোফায় রাতে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেন নি। জরোসড়ো হয়ে ছিলেন। আপনি আপনার বিছানায় ঘুমান। আমি খাটো মানুষ, আমার সোফায় ঘুমাতে অসুবিধা হবে না।

উত্তর দেয় উর্বী। রাওনাফ একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,”প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড বাট তোমার আসল বয়স ত্রিশ?”

উর্বী নিচুস্বরে বলে,”হ্যা।”

রাওনাফ বেশ অবাক হয়। এই মেয়েটার বয়স কখনো ত্রিশ হতেই পারেনা। আরো কম মনে হয়। হয়তোবা মেয়েটির উচ্চতা এবং স্বাস্থ্যের জন্য এমন লাগছে। অনেক রোগা মেয়েটি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাওনাফ বলে,”তুমি জীবনের পরিস্থিতি বিশ্বাস করো উর্বী?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। পরিস্থিতির একটার পর একটা উদাহরণ তার জীবনের মতো কারো জীবনে নেই।

রাওনাফ বলতে থাকে,”আমিও করি। আর আজ আমরা দুজন, সম্পূর্ণ আলাদা দুজন মানুষ ঐ জিনিসটার স্বীকার। তোমার কাছে হাস্যকর লাগতে পারে, কিংবা এই একটা সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে বোকা মনে হতে পারে। কিন্তু এমনটা নয়,আমি ভেবে চিন্তে ডিসিশন নিই বরাবর। আমি খুবই ঠাণ্ডা মাথার লোক।”

উর্বী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না লোকটা ঠিক কি বলতে চাইছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”প্রতিটা সম্পর্ককে আমি খুবই রেসপেক্টের সাথে দেখি। সেটা রক্তের হোক কিংবা আইনের। বিয়ে জিনিসটা আমার কাছে হেলা ফেলা কিছুনা। আমার আচরণ দেখে সেটা ভেবো না। তবে আমি এটাও মনে করি সম্পর্ক মানে নিজের চাওয়া পাওয়া সরিয়ে রেখে কম্প্রোমাইজ করা না। ওটা জু’লুম।”

এটুকু বলে রাওনাফ থামে তারপর বলতে থাকে,”যদি ভেবে থাকো কবুল বলেছো বলে আমাকে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও মানতেই হবে সেটা ভাববার প্রয়োজন নেই,
যদি মনে হয় আমার তিনটা বাচ্চা, যাদের সাথে তোমার কোনো ধরণের সম্পর্ক নেই, তবুও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ফরমালিটি দেখাতে হবে তাহলে আমি বলে দিচ্ছি তোমার এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের ভালোলাগা,মন্দলাগা অনুযায়ী চলার। বিয়েটা পরিস্থিতির জন্য বলে সবকিছুকে পরিস্থিতি ভেবে নিতে হবে এমন নয়। তোমাকে দেখে যথেষ্ট আত্মনির্ভরশীল মনে হয়। এটা তোমাদের মফস্বল নয় যে মানুষ কি বলবে। এখানে মানুষ কিছুই বলবে না। তাই অসহায় অসহায় বাধ্য বাধ্য ভাব করার প্রয়োজন নেই।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আই রিপিট। সম্পর্কে কম্প্রোমাইজ, অসহায়ত্ব,বাধ্যতা বলে কিছু থাকে না। যেটা একটা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যায় সেটি হলো বোঝাপড়া। যেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তোমার সময় তুমি নাও। এবং যদি মনে হয় না তুমি পারবে না তাহলে দ্যাটস টোটালি ফাইন। আই উইল হেল্প ইউ দেন!”

উর্বী তখনও চুপচাপ। রাওনাফ আর কিছু বলে না, সে চাদর হাতে সোফার দিকে এগিয়ে যায়। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়না সে উর্বীর কথা শুনবে, সে-ই সোফাতে ঘুমাবে।
উর্বী বিরক্ত হয়। রাওনাফ সোফায় শুয়ে পরে। কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে। কাল রাতে আসলেই তার ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়েছে।কিন্তু সে কখনোই নিজে বিছানায় আরামে ঘুমিয়ে একজন মেয়ে মানুষকে সোফায় ঘুমাতে দিতে পারে না। সে একজন ভদ্রলোক।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,এভাবে চলতে পারে না। তাকে একটা উপায় বের করতে হবে। অন্য রুমে গিয়ে যে ঘুমাবে সেটা অসম্ভব। রাওনাফ গিয়ে আলমারি খোলে,আলমারির ভেতর থেকে আরো একটা চাদর বের করে আনে।
উর্বী রাওনাফের কর্মকান্ড দেখতে থাকে। রাওনাফ চাদরটা মেঝেতে বিছিয়ে দেয়। উর্বী অবাক হয়ে বলে,”এটা কি করছেন? আপনি মেঝেতে শোবেন?”
_হ্যা। সমস্যা নেই। আমার মেঝেতে শোবার অভ্যেস আছে। ব্যাচেলর লাইফে একবছর এভাবেই শুয়েছি। এটা সোফার থেকে বেটার। যাই হোক,হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানো যাবে।

_সেরকম হলে আমি মেঝেতে ঘুমাবো। আপনি আপনার বিছানায় থাকুন।
উর্বী অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে।
রাওনাফ কোনো উত্তর দেয়না। উর্বী বুঝতে পারে এই লোক তার কথা মানবে না। সে হতাশ হয়ে চারদিকে তাকায়।
হঠাত রাওনাফকে বলে,”আমার কাছে অন্য একটা অপশন আছে।”
রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায়।”

***
রাত তিনটা ২৬ মিনিট। যখন রওশান মঞ্জিলের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাওনাফের ঘরে তখনও বাতি জ্বলছে। রাওনাফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি উর্বীর দিকে। উর্বী কিছু একটা বানানোর চেষ্টায় আছে। সে আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে এনেছিলো। সেই চাদরটা দিয়েই কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করছে উর্বী।
রাওনাফ ভেবে পায়না উর্বী কি করছে। উর্বী চাদরটাকে খাটের লম্বালম্বি মাঝ বরাবর টাঙিয়ে দেয়।
রাওনাফ অবাক হয়ে জিগ্যেস করে,”এটা দিয়ে কি হবে?”

উর্বী বলে,”আপনার খাট টা অনেক বড়। খাট টাকে ভাগ করে নিলাম। আপনি ওই পাশটাতে থাকতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।”
রাওনাফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হতভম্ব ভাব নিয়ে বলে,”আর ইউ শিওর?”

উর্বী মনে মনে হাসে। তারপর মাথা নাড়ায়,তার কোনো অসুবিধা নেই।

রাওনাফ মেঝে থেকে চাদর আর বালিশ তুলে নিয়ে তার পাশটাতে রাখে। তার চোখে মুখে সংকোচ।
উর্বীও তার পাশ টাতে শুয়ে পরে। তার খুব ঘুম পাচ্ছে।

জানালার ফাঁক দিয়ে কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে হলো পুর্নিমার চাঁদ। সে রাতের পাখিদের কাছে প্রশ্ন করছে,এই পর্দাটুকু কতখানি মজবুত? অনেক বেশি মজবুত? দুজন ভিন্ন সময়ের মানুষ, সম্পূর্ন ভিন্ন মতের, ভিন্ন চিন্তাধারার, ভিন্ন তাদের চাওয়া পাওয়া।দুটো আলাদা সময়ের মানুষকে নিয়তি একটা সময়ে এসে বেধে ফেলেছে। এদের সময় এখন থেকে একসাথে চলবে। আচ্ছা এরা কখনো এই পর্দা সরিয়ে ফেলতে পারবে? রাতের পাখিরা উত্তর দিতে পারে না।

***

পায়ের উপর পা তুলে মেয়েটা খুবই কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে আছে।

উচ্ছাস কিছুটা টলছে। মিলি উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি কপাল তোমার। জামিন হবার কোনো চান্সই ছিলো না,হুট করে হয়ে গেলো, তবে জামিন আর দু’রাত আগে হলে কি হতো! আমার ভীষণ আফসোস হচ্ছে। জামিন দুদিন আগে হলে উর্বী এতক্ষণে তোমার বুকে থাকতো!”
উচ্ছাস দুলছে। সামনের সবকিছু তার কাছে ঘোলাটে লাগছে।

মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। অতিরঞ্জিত হাসি। উচ্ছাস সে দিকে তাকায়। তার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা উর্বী। উর্বী তাকে ডাকছে।এইতো উর্বী হাসছে।
উচ্ছাস এগিয়ে যায়। তার চোখ দেখছে উর্বী হেসেই যাচ্ছে। উচ্ছাস তার কাল্পনিক উর্বীর কাছে যায়। উর্বীর গাল দুটো হাত দিয়ে ধরে।বিড়বিড় করে বলে,”উর্বী। আমি তোমাকে বিয়ে করব। আমি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করবো।”
মেয়েটা উচ্ছাসকে ধাক্কা দেয়।
-এইই! কে উর্বী? আরে আমি মিলি। ভুলে গেলে? তোমাদের বন্ধু! উর্বীকে মাথা থেকে বের করতে পারছো না।?

উচ্ছাস মেয়েটার দিকে তাকায়। এই মেয়ে তো উর্বী না। উচ্ছাস হাসে। বলে,”হ্যা। তুই তো উর্বী না। তুই তো একটা বাজে মেয়ে।আমার উর্বী কখনো তোর মতো লোকের সাথে শু*য়ে বেড়ায় না।

মিলির রাগ হয়। তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলে,”তোমার সতী উর্বী এখন রোজ তার বরের বুকে শুয়ে আদর খাবে।”
মিলি উচ্চসরে হাসতে থাকে।
সেই হাসি উচ্ছাস সহ্য করতে পারে না। মিলির চুলের মুঠি ধরে বলে,”চুপপ!!একদম চুপ। একদম হাসবি না।”
মিলি হাসি থামায় না। উচ্ছাসের র’ক্ত গ’রম হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করে মিলির গলায় ছু’ড়ি চালিয়ে দিতে। সে হাত দিয়ে ছু’ড়ি খুজে পায়না। মিলির গলা চে’পে ধরে।
মিলি অনেক কষ্টে উচ্ছাসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তার কাশি উঠে গিয়েছে। সে চিৎকার দিয়ে বলে,”রাত দুপুরে ডেকে এনে ফাজলামি হচ্ছে!”
তোর দেবদাস গিরি আমি ঘুচিয়ে দেবো জানোয়ার।

মিলি হোটেলের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।
উচ্ছাস উবু হয়ে পরে থাকে। তার নেশা কাটছে না। সে কল্পনা করে উর্বীকে একটা লোক ছু’তে এগিয়ে যাচ্ছে, উর্বী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাকে বাধা দিচ্ছে না। লোকটা উর্বীর কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। উর্বীর বুক থেকে শাড়ীর আচল সরিয়ে ফেলছে।

উচ্ছাস “না” বলে চিৎকার দেয়। সে আর কিচ্ছু কল্পনা করতে চায় না। সে বিছানার চাদর খামছে ধরে। তার চোখ বেয়ে পানি পরে অঝোর ধারায়।

***
শায়মী নাবিলের মাথার কাছে বসে আছে। নাবিল ঘুমাচ্ছে।
শায়মীর ইচ্ছে করছে না নাবিলকে ডাকতে। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
বাড়িতে হৈহৈ পরে গিয়েছে। আজ বাড়িতে বৌভাত। কত আদিখ্যেতা!
শায়মী আজ সারাদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে কাটাবে কিংবা খালামনির বাড়িতে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। সে নাবিলকে সেটাই বলতে এসেছে।
নাবিলের ঘুম ভাঙছে না। হয়তো এতো তাড়াতাড়ি ভাঙবেও না।বাড়িতে বেশি লোকজন আসার আগে শায়মীকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। শায়মী উঠে দাঁড়ায়। নাবিল তখন উঠে পরে।শায়মীকে বলে,”কিছু বলতে এসেছিলি?”

_হ্যা আমি একটু বেরোচ্ছি। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরবো। ওরা সবাই ঘুরতে যাবে ওদের সাথে যাবো। তুই যাবি?
শায়মী আবার বিছানায় বসতে বসতে বলে।

_না। আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান দেখছিস না। কতো কাজ,আমি গিয়ে মেজো চাচ্চুর হাতে হাতে এগিয়ে দেই, যাই।

শায়মী অবাক হয়ে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল বলে,”এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো,আরে আমাদের বাড়িতে আমাদের ছোটমা এসেছে। আমরা এরকম করলে চলবে?”
নাবিলের মুখ হাসিহাসি।

শায়মী বুঝতে পারে নাবিল স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। শায়মী বলে,”নাবিল পাপার উপর রাগ করে থাকিস না।”

_আমি পাপার উপর রাগ করে নেই শায়মী। এই একটা লোকের উপর আমি কিছুতেই রাগ করে থাকতে পারি না। জানিস কাল রাতে পাপা আমার রুমে এসেছিলো।

_তোর সাথে পাপার কথা হয়েছিলো?

_না, পাপা ভেবেছিলো আমি ঘুমিয়ে আছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে। পাপার উপর আমার কোনো রাগ নেই।

_তুই কি আমার সাথে সত্যিই যাবি না। সত্যিই এই অনুষ্ঠানে থাকবি?

_হ্যা,আমার একটা বিশেষ কাজ আছে।
শায়মী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
নাবিল বলে,”অতো জেনে কাজ নেই তোর। তুই যা তোর কাজে যা,Have fun!

চলমান…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here