আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৩৮ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৮
#Esrat_Ety

অন্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উর্বী। চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। উর্বী হাতরে হাতরে হাঁটছে। উঁচু নিচু পথে আন্দাজ করে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। কর্ণ গহীনে পৌঁছায় নাকি কান্নার আওয়াজ,শিশুসুলভ আদুরে কন্ঠে কেউ তাকে ডাকছে,”মা। মা। এসো তাড়াতাড়ি। মা।”

উর্বীর পায়ের গতি বেড়ে যায়। অস্থির হয়ে ছুটতে থাকে, চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,”এই তো জাদু। আমি আসছি।”

বাচ্চাটার কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। উর্বী ছ’ট’ফ’ট করে,দৌড়াতে থাকে দ্রুত। কানে আসে মৃদু আওয়াজ,”মা ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে মা।”

সামনে পা বাড়াতেই দেখে সামনে উঁচু প্রাচীর। কান্নার শব্দ দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে। উর্বী জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। ধাক্কা দিতে থাকে দেয়ালে। এতো উঁচু দেয়াল টপকানোর সামর্থ্য যে তার নেই!

দু’চোখ খুলে লাফিয়ে উঠে বসে উর্বী। এসির মধ্যেও তার শরীরটা কুলকুল করে ঘামছে। বেশ শব্দ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে সে। রাওনাফ তৎক্ষণাৎ উঠে বসে। উর্বীর দিকে তাকিয়ে তার দিকে কিছুটা এগিয়ে বসে। এমনটা গত তিনদিন ধরে হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে লাফিয়ে ওঠে, তারপর সারারাত নির্ঘুম কাটায়। ছ’ট’ফ’ট করে।

উর্বী হাপাচ্ছে। দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রাখে কিছুক্ষণ, তারপর হাত সরিয়ে নেয়। রাওনাফ উর্বীর পিঠে একটা হাত রেখে বলে,”রিল্যাক্স! স্বপ্ন ছিলো ওটা।”

উর্বী জানে ওটা স্বপ্ন ছিলো,যা তাকে রোজ বিরক্ত করে। তার ফিরে পাওয়া জীবনের নতুন অস্বস্তির কারণ। সে শাড়ির আঁচল টেনে মুখ মুছে নিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তাকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে , তারপর উঠে গিয়ে একগ্লাস পানি আনে। পানিটা নিজে খাইয়ে দেয় উর্বীকে। তারপর গম্ভীর হয়েই বলে,”ফার্স্ট টাইমিস্টারে কিছু হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারনে কিছু চেঞ্জ আসে মায়েদের। একটু বিষন্ন লাগে,কান্না পায় ক্ষণে ক্ষণে,কারনে অকারণে, পুরো প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডেই হতে থাকবে এসব। ডিপ্রেসড লাগবে। আর তুমি তো এমনিও দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকা মহারানী দুঃখেন্নেছা উর্বী, তোমার আরো বেশি লাগবে।”

উর্বী হাঁপাতে হাঁপাতে রাওনাফের দিকে তাকায়। খুব সুক্ষ্মভাবে খোঁচা দিয়েছে উর্বীকে, ইদানিং সুযোগ পেয়ে ভীষণ কথা শোনাচ্ছে। উর্বী পাত্তা না দিলে যেন আরো বেশি শোনাচ্ছে।
রাওনাফ উর্বীর দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘড়ির দিকে তাকায়, তারপর বলে,”সময়ে অসময়ে বেশি খারাপ লাগলে নফল নামাজ আদায় করে নেবে। অস্থিরতা কেটে যাবে।”

উর্বীর হঠাৎ খেয়াল আসে। সে উঠে ওযু করে নামাজ আদায় করে নেয়। রাওনাফ উঠে বিছানা ভালো করে ঠিক করে দেয়। ডিউটি থেকে বাড়িতে ফিরে দেখেছে উর্বী বিছানায় অগোছালো হয়ে ঘুমিয়েছিলো,মাথার নিচের বালিশটা পর্যন্ত ঠিক ছিলো না। ইদানিং কাহিল হয়ে হুটহাট ঘুমিয়ে যায়,শুরু থেকেই ভদ্রমহিলা অগোছালো। তার জীবন অগোছালো,তার আচরণ অগোছালো।

উর্বী নামাজ আদায় করে উঠে দাঁড়াতেই রাওনাফ বিছানা থেকে একটা বই হাতে নিয়ে বইটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে,”এমন বই পড়ার প্রয়োজন নেই এই সময়টিতে, মস্তিস্কে চাপ পরে। মাইন্ড রিফ্রেশ হয় এমন বই পড়বে।”

উর্বীর ভালো লাগেনা রাওনাফের এমন গম্ভীর কথাবার্তা। রাওনাফ বলে,”রাতের ক্যাপসুলটা নিয়ম করে খাবে। ওটা বাধ্যতামূলক। আলসেমি করবে না। নাও এখন শুয়ে পরো।”

উর্বী ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ায়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে বলে,”কোথায় যাচ্ছো?”

উর্বী দাঁড়িয়ে বলে,”শর্মীর কাছে।”

_দেখে এসেছি আমি।

উর্বী তবুও পা বাড়ায় সামনে। রাওনাফ বলতে থাকে,”ঘুমাচ্ছে। দেখে এসেছি।”

উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”সেটা তো আপনি দেখে এসেছেন। আমি তো দেখিনি।”

বলা মাত্রই উর্বী দরজার বাইরে পা রাখতেই ডান হাতে টান অনুভব করে। মুহুর্তেই সে দেখলো রাওনাফ তাকে টানতে টানতে বিছানার কাছে নিয়ে যায়।

কোনো কথা না বলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসে।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাওনাফ এসে বিছানায় নিজের নির্দিষ্ট স্থানে শুয়ে দু’চোখ বন্ধ করে গম্ভীর কন্ঠে উর্বীকে বলে,”ঘুমাও। নিয়ম করে রাত জাগলে আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে!”

****
মোহনা শাফিউলের সাথে চট্টগ্রাম ফিরে গিয়েছে। অন্তরাও সামিউলের সাথে রাজশাহী ফিরে গিয়েছে। বাড়িতে অবশিষ্ট রাওনাফ করীম খান এবং তার মাতা,স্ত্রী এবং তিন ছানা। তিনছানা নয়, চার ছানা।

শর্মীকে বাড়িতে আনার দুদিন হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা সারাদিন ঘরে বসে থাকে,উর্বী যথেষ্ট চেষ্টা করে মেয়েটাকে একটু হাসিখুশি রাখতে। শর্মীর বেশি হাঁটাচলা করা বারণ,তাকে দুমাস বেড রেস্ট দিয়েছে ডক্টর। তাই সারাটাদিন কাটে বিষন্নতায়। কখনও কখনও বন্ধুরা এসে সঙ্গ দেয়, কখনো তার খালামনিরা। তবুও শর্মীর মনটা ছটফট করে বাইরের দুনিয়ায় যেতে না পেরে।

উর্বীর দিনগুলো কাটছে ব্যাস্ততায়। শারীরিক ভাবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছে যদিও তবুও নিজেকে এ কাজে,সে কাজে ব্যাস্ত রাখে।

এরমাঝে রেজাউল কবির এসে বোনকে দেখে গিয়েছেন দুবার। নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিছুদিনের জন্যে যদিও,উর্বী যায়নি।

সারাদিনে তিনবেলা উর্বী নিচতলায় নামে,নয়তো তার সারাটাদিন রওশান মঞ্জিলের দোতলায় কেটে যায়। বাড়ির কাজের ধারেকাছে যাওয়ার তো দুঃসাহসও করে না সে। আরো একজন খালা রাখা হয়েছে সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজের তদারকি করার জন্য।

দোতলার উত্তর পাশের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল উর্বী,তার উদ্দেশ্যে নিচতলা। উল্টোদিক হতে হেঁটে আসছিলো নাবিল। ধূসর রঙের একটা ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর একটা নেভি ব্লু রঙের ট্রাউজার। একহাত পকেটে গুজে আয়েশী ভঙ্গিতে হাঁটছে। মাথায় একটা লাল রঙের ক্যাপ ঘুরিয়ে পরেছে। উর্বীকে দেখে তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়। কপাল কুঁচকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বীকে দ্রুত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সে। উর্বী নাবিলকে দেখে নিজেই গুটিয়ে যায়, সচারচর সে নাবিলের আশেপাশে প্রয়োজন ব্যতীত এমনিতেই তার অস্তিত্ব পৌঁছায় না।

বারান্দার দুপাশে সাজিয়ে রাখা আগের আমলের কিছু বড় বড় পিতলের ফুলদানি। এক একটার উচ্চতা প্রায় তিনফুট। নাবিলকে আসতে দেখে উর্বী একপাশে সরে হাঁটতে গেলে বেখেয়ালে গায়ের ধাক্কা লেগে একটা ফুলদানি এলিয়ে পরে তার গায়ে।

ঘটনাটা নাবিলের চোখের সামনেই ঘটেছে। সে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উর্বীর দিকে ছুটে যাওয়ার আগেই উর্বী ফুলদানি সহ সামলে নেয় নিজেকে।

নাবিল ঘুরে যায় তৎক্ষণাৎ। উর্বী মাথা তুলে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে হাঁটতে থাকে। পরে যায়নি, ঠিক আছে,ধরতে না গেলেও হবে। কোথাও লেগেছে কিনা এই প্রশ্ন করে এতো আন্তরিকতা দেখানোর তো কিছু নেই,চোখ কপালে তুলে হাঁটলে তো এমন হবেই! এমনিতেও যতটা ঘৃণা করা উচিৎ এই মহিলাকে নাবিল করতে পারেনি কোনো এক অজানা কারনে, এই মহিলার চোখে তার পাপার জন্য ভালোবাসা, উৎকণ্ঠা দেখে সে, শর্মীকেও সে যেটা দেয় তাতে নাবিল ইদানিং কোনো নাটক খুঁজে পায়না। সেই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে পুরোপুরি ঘৃণা নাবিলের আসেনা। তবে এতো আন্তরিকতা দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এমনিতেও উর্বীকে নিয়ে নাচার জন্য এ বাড়িতে অনেক মানুষ আছে।

হন্তদন্ত হয়ে নাবিল গিয়ে তার পাপার স্টাডি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় ধপপ করে। উর্বী সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দোতলার সিঁড়ির কাছে যায়।

খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। দুজন মানুষ শুধু সকালের নাস্তা করতে বসেছে। রাওনাফ এবং উর্বী। বাকিরা সবাই সকাল সকাল করে নিয়েছে। রাওনাফ গিয়েছিলো কিছু প্রতিবেশী বন্ধুকে নিয়ে লেক পার্ক সংলগ্ন এরিয়ায় জগিং করতে। আজ সে সকাল এগারোটা পর্যন্ত বাড়িতে থাকবে।

উর্বী বসে চুপচাপ বাদাম গুলো খাচ্ছিলো। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছে না। রাওনাফ একটা নেভি ব্লু রঙের পোলো টি-শার্ট গায়ে চাপিয়েছে। মাথায় ছেলের মতোই একটা ক্যাপ পরেছে,তবে রংটা কালো। ফরসা মুখটায় মানিয়েছে বেশ।
রাওনাফ নিউজপেপার থেকে চোখ সরিয়ে আমীরুনকে ডাকে, আমীরুন কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে রাওনাফের সামনে দাঁড়ায়। রাওনাফ একটা গ্লাস উঠিয়ে আমীরুনের হাতে তুলে দিয়ে বলে,”শর্মীকে দিয়ে আয়। না খেতে চাইলে একটা লম্বা ধ’ম’ক দিবি।”

আমীরুন হেসে মাথা নেড়ে চলে যায়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী প্লেটের ডিম দু’টোর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তারপর একটা ডিম নিয়ে একটা কামড় বসাতেই চোখমুখ খিচিয়ে ফেলে। তার রীতিমতো বমি পাচ্ছে। তবুও সে জোর করে খেতে থাকে।

রাওনাফ নিউজপেপারে দৃষ্টি রেখেই বলতে থাকে,”যতটুকু খেতে পারবে ততটুকুই খাবে। কিছুক্ষণ পর পর খাওয়ার চেষ্টা করবে। আমাকে দেখানোর জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাওয়ার প্রয়োজন নেই।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। সবকিছু নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলতেই হবে?

রাওনাফ উর্বীর দিকে একটা গ্লাস ঠেলে দিয়ে বলে,”এটা খেয়ে নাও। ডিম রাখো। কাউকে দেখিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন নেই, যেটুকু পেট নিতে চাইবে ততটুকু খাবে,পেট তোমার।”

উর্বী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”পেটের মধ্যে বাচ্চাটা তো আপনার! পরে বলবেন আপনার বাচ্চার পুষ্টি হচ্ছে না।”

কথাটা বলে উর্বী খুব দ্রুত ডিমটা শেষ করে,গ্লাসের জুসটুকু শেষ করে উঠে চলে যায়।

রাওনাফ টেবিলে বসে একা একা মুচকি হেসে কফির মগে চুমুক বসায়। শাস্তি তো কিছুই পাচ্ছে না যতখানি পাওয়ার কথা ছিলো,অথচ তাতেই এতো অস্থিরতা!

****
ঘরে ঢুকে রাওনাফ আশেপাশে তাকিয়ে উর্বীর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। রুমে নেই উর্বী। রাওনাফ সোজা হেঁটে বারান্দায় চলে যায়, সেখানেও কেউ নেই। পা বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সে শর্মীর রুমে গিয়ে উর্বীর খোজ করেও পায়না। রাওনাফ কপাল কুঁচকে ফেলে। যে ধরনের ইমোশনাল মহিলা তাতে রাওনাফের খাপছাড়া আচরণে শিক্ষা হওয়া তো দূর উল্টো হিতে বিপরীত হয়ে কেঁদে কেটে অস্থির না হয় আড়ালে আবডালে। সেটা রাওনাফের মোটেও কাম্য নয়। সে তো উপলব্ধি করাতে চাইছে উর্বীকে জীবনের মানে, তার উদ্দেশ্য এই অবস্থায় স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া নয়। কিন্তু এই মেয়েটা রাওনাফের অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা না করে উল্টো নিজের অভিমানের দেয়াল তুলছে। এটা আজীবনের মাথামোটাই থেকে যাবে।
রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে থাকে। সে জানে উর্বী ওখানেই থাকতে পারে।

রাওনাফের ধারণা ঠিক,উর্বী ছাদেই ছিলো।
ছাদের রেলিং ধরে উর্বীকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাওনাফ নিশ্চিন্ত হয়। আর যাই হোক,মন খারাপ করে নেই। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে দেখছে। দূর থেকে উর্বীকে অবলোকন করে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই উর্বীর চোখে পরে যায় রাওনাফ।

উর্বী ঘুরে দাঁড়িয়ে রাওনাফকে এভাবে ছাদে দেখে বলে ওঠে,”হাওয়া খেতে এসেছিলাম।”

রাওনাফ গম্ভীর হয়ে বলে,”হ্যা। তোমার ইচ্ছে। আমাকে বলছো কেনো? এটা তো আমাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।”

উর্বী কয়েক মুহূর্ত রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনো লুকোচুরি না থাকুক। আবার নাহলে কথা শোনাবেন,এটা কেন লুকিয়েছো,ওটা কেনো লুকিয়েছো। তাই সব বলবো এখন থেকে। আমি এখানে ছাদে হাওয়া খেতে এসেছি। গোপনে দুঃখবিলাস করতে নয়। তাই চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই। আমি দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটছি না আর আপনার বাচ্চার ওপরেও কোনো প্রভাব পরছে না।”

একনাগাড়ে বলে উর্বী শেষ করে। রাওনাফ হাসি চেপে রেখে গম্ভীর হয়ে বলে,”ড্রামা খুব ভালোই করতে পারো!”

উর্বী কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিচে চলে যায় চুপচাপ। রাওনাফ ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আশেপাশের প্রকৃতি দেখতে থাকে।

****
আজ ২৯শে জুন। নাবিলের মায়ের এগারো তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রত্যেক বছর এই দিনটায় রাওনাফ বাড়িতে ডেকে এনে মাদ্রাসার পাঁচশো এতিম খাইয়ে দেয়।
নাবিলের ফুপিরা এবং খালামনিরা প্রত্যেক বছর এই দিনটাতে রওশান মঞ্জিলে আসে। শিমালার মৃত্যু বার্ষিকীতে এতিমদের জন্য রান্নাবান্না করে বাড়ির লোকজন নিজ হাতেই পরিবেশন করে খাওয়ায়।

বাগানের খোলা যায়গাটিতে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়েছিলো আর উত্তর পাশের বড় আমগাছটার নিচে তাবু খাটিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবারের স্থান তৈরি করা হয়েছে।

উর্বী আঁচল কোমরে গুঁজে প্লেট এগিয়ে দিচ্ছে। সবার বারণ সত্তেও সে কাজ করছে। উর্বী খেয়াল করে বাচ্চাদের জন্য কাজ করতে তার
একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং সে সুস্থ বোধ করছে।

রাওনাফ পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে বাচ্চা গুলোর প্লেটে মাংস দিয়ে যাচ্ছে। আমীরুন এবং সুমনা তাঁদের সাহায্য করছে।

বাচ্চারা সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।

শর্মীকে নিচে আনা হয়নি। নাবিল শায়মীও পাপার সাথে কাজের তদারকি করছে।

সবাই কাজের ব্যস্ততায় উর্বীর দিকে কেউ খেয়াল করেনি। সে ছুটে কোথাও যাচ্ছিলো হঠাৎ।

শায়মী তা দেখে চেঁ’চি’য়ে ওঠে।
“আন্টি কি হয়েছে! আন্টি!”

রাওনাফ ঘুরে তাকায়। সবাই সেদিকে তাকায়। উর্বী মুখে হাত চেপে ছুটছে । রাওনাফ তার হাতের মাংসের বাটি আমীরুনের হাতে দিয়ে সেদিকে যায়।
বাড়ির সবাই তার পিছু পিছু যায়। উর্বী গিয়ে কিচেন সংলগ্ন বেসিনে বমি করতে থাকে। রাওনাফ গিয়ে পেছন থেকে উর্বীকে ধরে।

বাড়ির সবাই থমকে দাঁড়ায় লিভিং রুমে। তারা ভেবেছিলো অন্য কোনো অসুবিধা হয়েছে হয়তো। তাই সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে ছুটে এসেছে।
রাওনাফ উর্বীকে ধরে রেখেছে। নিচুস্বরে কি কি যেনো বলছে। এখান থেকে তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।

বাড়ির সবাই সেদিকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে। এই যে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যত্নশীলতার যে দৃশ্যটি। এটি হয়তোবা পৃথিবীর অন্যতম অদ্ভুত সুন্দর একটি দৃশ্য। যা দেখলে সবার মন ভরে‌ যায়।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সবাই পুনরায় বাইরে তাঁবুর কাছে চলে যায়।

নাবিল আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে,তার পাপা নতুন বেবিটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড সে শুধু সেটাই দেখতে পাচ্ছে। তার সঠিক অনূভুতি সে ধরতে পারছে না। তার কি পাপার ওপর রাগ হওয়া উচিত? নাকি শর্মী শায়মীর মতো ভাই-বোন আসার খুশিতে আনন্দিত হওয়া উচিত! তার কি করা উচিৎ! দোটানায় কাটছে তার দিন। সে চোখ সরিয়ে উর্বীর দিকে তাকাতেই পুনরায় বিরক্তি ছেয়ে যায় চোখে মুখে তার। সোজা হেঁটে সে বাইরে চলে যায়।

উর্বীর দৃষ্টি ঝাপসা। ভীষণ গা গুলিয়ে উঠছে তার। রাওনাফ আগলে নিয়ে উর্বীর গালে হাত রেখে ডাকতে থাকে তাকে। উর্বী কোনো মতে বলে ওঠে,”একটু ঘরে দিয়ে আসবেন আমাকে। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে।”

একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে রাওনাফ বলতে থাকে,”কে বলেছিলো নিচে যেতে? যা করার প্রয়োজন নেই সেটা আগ বাড়িয়ে করতে যাও,যা করার প্রয়োজন সেটা করতে চাও না।”

উর্বীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় রাওনাফ। উর্বী অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,”কি করা প্রয়োজন আমার?”

রাওনাফ কথা বলে না। চুপচাপ সিড়ি ভাঙতে থাকে। উর্বী পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যদিও উর্বীর গাঁয়ের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম তবুও সিড়ি ভাঙতে বেশ কষ্ট হচ্ছে লোকটার। গলার এড্যাম এপেল ওঠানামা করছে দ্রুত। উর্বী ছুঁয়ে দিতে গিয়েও দেয়না। সে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়,কতদিন পরে এভাবে মিশে আছে সে লোকটার সাথে। সেই পরিচিত গন্ধের সাথে মিশে আছে।

বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাওনাফ উর্বীর ব্লাড প্রেশার চেক করে। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ধিমি আওয়াজে বলছে,”আপনি নিচে যান। নাবিল কষ্ট পাবে ওর মায়ের নামে মিলাদের দিনে আপনি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। আমি এটা ইচ্ছে করে করিনি। খুব চেষ্টা করেছি সুস্থ থাকার, হঠাৎ যে কি হলো!”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর জানালার পর্দা গুলো টেনে দিয়ে,এসির পাওয়ার কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,”খাবার পাঠিয়ে দিলে চুপচাপ খেয়ে শুয়ে থাকবে।”

রাওনাফ চলে যায়। উর্বী দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দু’চোখ বন্ধ করে হিসেব মেলাতে থাকে। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করতে গেলে উর্বী দেখতে পায় তার না পাওয়ার চেয়ে পাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

****
গভীর রাত। নিস্তব্ধ পুরো কলোনি। এমনিতেও এই এরিয়া সবসময় কোলাহল মুক্ত। তার ওপর কিছু কুকুর মাঝে মাঝে শব্দ করে ডেকে উঠে রাতের সময় বুঝিয়ে দিচ্ছে।

রাওনাফ শর্মী আর শায়মীর ঘরে ছিলো। আজ অনেক দিন পরে মেয়ে দুটোকে কিছুটা সময় দিতে পেরেছে সে। আজ তাদের মাম্মার মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো,মন খারাপের কথা তো পাপাকেই শোনাবে তারা।

দু’জনে ভীষণ কাঁদে এই দিনটাতে পাপাকে জরিয়ে ধরে। মেয়েদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাদের মাম্মার স্মৃতিচারণ করে রাওনাফ, তাঁদেরকে শোনায় শিমালার চঞ্চলতার গল্প। যখন তারা মাম্মার গল্প শোনে, দু’চোখ তাদের চকচক করে আনন্দে। শর্মীর একেবারেই মনে নেই তাদের মাম্মার কথা,শায়মীর স্মৃতিতে কিছুটা ভেসে ওঠে মাম্মার সাথে কাটানো দিনগুলো।

নাবিল কখনও তাদের সাথে অংশ নেয়না। এই দিনটিতে সে একা একাই মাকে নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে। রাওনাফও তাকে বিরক্ত করে না।

দু’টো মেয়ে পাপার বুকে মাথা ঠেকিয়ে নাক টানে। রাওনাফ মেয়ে দু’টোকে নিজের থেকে আলগা করে বলে,”চোখ মোছো।”

দুইবোন চোখ মোছে। রাওনাফ উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দেড়টা বেজে গিয়েছে। মেয়েদের সাথে কথা বলতে বলতে খেয়ালই করেনি সে। দুবোনকে গুডনাইট বলে সে ঘরের দরজা টেনে বেরিয়ে যায়।

আজ সারাদিনে উর্বীর শরীরের খোঁজ নেওয়া হয়নি। মূলত সন্ধ্যা অবধি ঘরেই ঢোকেনি রাওনাফ। আমীরুনের থেকে জেনে নিয়েছে উর্বী খেয়েছে। আর সন্ধ্যার পরে তো মেয়েদের সাথেই ছিলো। রাতের খাবারটাও উর্বীর জন্য ঘরে পাঠিয়েছিলো রাওনাফ।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে খোলা চুলে, অসম্ভব সুন্দর এই রমনীকে ঘুমন্ত অবস্থায় তিনগুণ বেশি সুন্দর লাগে, আর ইদানিং মুখটা একটু ফোলা ফোলা লাগে, চেহারায় একটা মায়েদের মতো ছাপ পরছে।

এক হাত উর্বী পেটের উপর দিয়ে রেখেছে। অন্যহাত কপালে রেখে ঘুমাচ্ছে।

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে পাঞ্জাবি পাল্টে টি-শার্ট পরে নেয়। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে তোয়ালেটা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে ধীরপায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। বিছানায় না উঠে যে পাশটাতে উর্বী শুয়েছে সেই পাশটাতে বসে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়।
গাঁয়ের রং বরাবর নজরকাড়া ভদ্রমহিলার,কিন্তু এই সময়টিতে যেন আরো বেশি মোহনীয় লাগছে তাকে।
চোখ ঘুরিয়ে উর্বীর কপাল থেকে বাম হাত টেনে হাতের কব্জিতে নজর বোলায় রাওনাফ। ক্ষ’তটা সেরে উঠছে ধীরে ধীরে। কিন্তু দাগটা চোখে লাগার মতো থেকে যাবে সারাজীবন। থাকুক, যতবার ভদ্রমহিলা দেখবে ততবার যেনো তার বুক কেঁপে ওঠে ঐ ভয়ংকর দিনটির কথা মনে করে। এটাও একটি শাস্তি।

এমনিতেই শাস্তি অনেক কম দেওয়া হচ্ছে। রাওনাফ কি করবে? রাওনাফ পারেনা, তার মায়া লাগে।

কপালের কাছে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে। তারপর হঠাৎ করেই উর্বীর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় রাওনাফ।

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আরো কিছুক্ষণ উর্বীকে দেখে রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। তারও এখন শুয়ে পরতে হবে। রাওনাফ ঘুরে দাঁড়ায়। হঠাৎ তার হাতে টান অনুভব করে সে। কিছুটা চ’ম’কে উঠে মাথা ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকাতেই দেখে উর্বী শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাওনাফ মুখভঙ্গি গম্ভীর করার চেষ্টা করে। কিন্তু উর্বী তা পাত্তা না দিয়ে নিচু স্বরে বলে,”আরেকটা দিন।”

চলমান……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here