#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৪ (২য় অংশ)
#Esrat_Ety
[২য় অংশ]
১ম অংশ পোস্ট করা হয়েছে। লিংক কমেন্ট বক্সে।
উর্বীকে পুলিশের সহায়তায় সিটি মেডিকেয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। তার জ্ঞান এখনও ফেরেনি। রাওনাফ উর্বীর বিছানার পাশে একটি চেয়ারে বসে আছে। সে দুহাত মুঠি করে তার কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে।
উর্বীকে দেখছে লামিয়া। উর্বী চেক আপ শেষে বলে,”স্ট্রেস বেশি হয়ে গিয়েছিলো। সামলাতে পারেনি। জ্ঞান ফিরবে দ্রুতই। মা আর বাচ্চা দুজনেই সেইফ। তবে এরকম হলে সমস্যা হবে রাওনাফ,ওর হেল্থ কন্ডিশন তো জানোই। মি’স’ক্যারেজের সম্ভাবনা আছে।”
রাওনাফ মাথা তুলে লামিয়ার মুখের দিকে তাকায়। তারপর চোখ ঘুরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়।
লামিয়া বলে,”ওর জ্ঞান ফিরলে আমিও তোমাদের সাথে তোমাদের বাড়িতে যাবো। চাচী মাকে দেখবো। সেদিনের পর আর যাওয়া হয়নি তোমাদের বাড়িতে।”
****
উর্বীকে ধরে আছে লামিয়া। উর্বীর গায়ে জোর নেই। লামিয়া তাকে ধরে ধরে সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢোকাচ্ছে। রাওনাফ পাশেই।
লামিয়া উর্বীকে একা সামলাতে পারছিলো না, রাওনাফ গিয়ে উর্বীকে ধরে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তার দিকে তাকায় না। সে সোজা হাটছে।
অন্দরমহলে পা রাখতেই নাবিলের গলা শোনা যায়,”ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও। আর ঢুকতে হবে না।”
রাওনাফ তার ছেলের দিকে তাকায়। নাবিল অগ্নিমুর্তি ধারন করেছে।
উর্বীর কোনো ভাবান্তর নেই। সে একদৃষ্টে নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল এগিয়ে আসে, রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি যাস্ট অবাক হচ্ছি পাপা। তোমার মেয়েটা প্রায় মৃত হয়ে পরে আছে হসপিটালে আর তার এই অবস্থা যার জন্য হয়েছে সেই মহিলাকে তুমি হাত ধরে বাড়িতে ঢুকাচ্ছো? শেম অন ইউ পাপা।”
উর্বীর চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে উঠেছে। তার শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে।
সোফাতে সবাই বসে আছে বাড়ির। উর্বীর ভাই ভাবী এসেছে। তারা দেখছে তাদের বোনকে। তাদের মন ছোটো হয়ে আছে। তাদের বোনের জীবনটা আবার ওলটপালট হয়ে যাবে নাতো?
নাবিল এসে উর্বীর থেকে রাওনাফের হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলতে থাকে,”আমি বলতাম আমার পাপা ওয়ার্ল্ডস বেস্ট পাপা। কিন্তু না, তুমি কখনও ভালো পাপা ছিলেই না।”
রাওনাফ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল বলতে থাকে,
“তুমি ওনাকে এক্ষুনি বের করে দাও পাপা, এক্ষুনি। নয়তো আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
লিভিং রুমে বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে নাবিলের কথা শোনে। রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”নাবিল স্টপ ইট। এখন এসব করো না প্লিজ। আমার মন মেজাজ ভালো নেই। আমি ক্লান্ত খুব।”
নাবিল উর্বীকে বলে,”শান্তি হয়েছে আপনার? হয়েছে না আমার ফুলের মতো বোনটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে? আমি আপনাকে শুরুতে খারাপ ভাবতাম,পরে ধীরে ধীরে মনে হলো আপনি ভালো, হয়তো আমিই ভুল, কিন্তু না, আপনি একটা জ’ঘন্য মহিলা।
আচ্ছা আপনার লজ্জা হচ্ছে না? চলে কেনো যাচ্ছেন না আমাদের লাইফ থেকে? আপনার বাড়ির লোক এসেছে,তাদের সাথে আপনি চলে যান। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না।”
উর্বী দুলছে। মনে হচ্ছে সে আবারও পরে যাবে। রাওনাফ গিয়ে উর্বীকে ধরে।
নাবিল চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
“ছাড়ো তুমি ওনাকে। ছাড়ো পাপা। নাটক করছে উনি।”
নাবিল উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,”এইজন্য এতো ভালোমানুষী? নিজের প্রেমিকের সাথে মিলে আমার বোনটাকে শেষ করতে চেয়েছিলেন! আচ্ছা এরপর কে? আমি নাকি শায়মী? নাকি পাপা? কাকে খাবেন আপনি?”
“নাবিল তুমি চুপ করো, তোমার আন্টি অসুস্থ।”
বলে রাওনাফ।
শায়মী মাথা নিচু করে সোফায় বসেছিলো রুমাকে জরিয়ে ধরে। সে একবারের জন্যও মুখ তুলে তাকায়নি উর্বীর দিকে।
নাবিল রাওনাফকে বলতে থাকে,”কি হয়েছে ওনার? এই মহিলা ভয়ংকর পাপা। তুমি জানো না! উনি নাটক করছে।”
পাশ থেকে আজমেরী বলে,”কি হয়েছে উর্বীর? ভাইয়া?”
রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে বলে,”উর্বী প্রেগন্যান্ট।”
বাড়ির সবাই তাকিয়ে থাকে। অন্য সময়ে হলে এই খবরটাতে তারা উন্মাদের মতো আনন্দ করতো। চেঁ’চি’য়ে উল্লাস করতো। কিন্তু এই সুখবরটা তাদের কাউকে আনন্দ দিতে পারছে না এই মুহূর্তে,কেউ অনুভব করতে পারছে না আনন্দ।
নাবিল উর্বী আর রাওনাফকে দেখে তাচ্ছিল্যর একটা হাসি দেয়। অস্ফুট স্বরে বলে,”গ্রেট!”
লামিয়া বলে ওঠে,”ওর একটু বিশ্রাম দরকার। ওকে কেউ ঘরে নিয়ে শুইয়ে দাও। প্লিজ। এখন সিনক্রিয়েট করার সময় না।”
আমীরুন এসে উর্বীকে ধরে। ছুটে আসে তহুরা,ছুটে আসে অন্তরা।
তারা ধরে ধরে উর্বীকে উপরে নিয়ে যায়।
বাড়ির সবাই চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
নাবিল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রুমা তাকে আটকাতে যায়। নাবিল কোনো কথা বলে না। রাওনাফ রুমার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি শর্মীর কাছে যাচ্ছি। এদিকটা দেখিস!”
****
আজ উনিশ রোজা। সে খবর এবাড়ির কেউ রাখেনি। শর্মীর জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু সবার মুখের দিকে । রাওনাফ দুদিন হলো চেম্বারে বসা শুরু করেছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই শর্মীর সাথে কাটায় সে। রাতে বাড়ি ফেরে। উর্বী তখন ঘুমিয়ে যায়। উর্বীর শরীরটা দিনকে দিন বেশ দুর্বল হয়ে পরেছে। অবশ্য রাওনাফ কখনো তার দায়িত্ব পালনে কোনো কার্পণ্য করে না। কোনো অভিযোগের যায়গা রাখেই না সে।
আজমেরী,রুমা যে যার শশুরবাড়িতে ফিরে গিয়েছে। শাফিউল চট্টগ্রাম, সামিউল রাজশাহী। মোহনা আর অন্তরা রওশান মঞ্জিলে থেকে গিয়েছে। মোহনা শাশুড়ির সেবাযত্নে ব্যাস্ত,অন্তরা উর্বীর দেখাশোনা করে।
এই সময়ে উর্বীকে এভাবে একা ফেলে যেতে তার মন সায় দেয়নি। সে যখন অসুস্থ ছিলো,উর্বী সারাদিন তার যত্ন নিতো,বড় বোনের মতো। এখন এই দায়িত্ব তার। সে এতোটাও অকৃতজ্ঞ নয়।
নাবিল ইদানিং ঘর থেকে বের হয়না। প্রয়োজন ব্যাতীত সে সবসময় নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখে। আসলে সে উর্বীর মুখটা দেখতে চায়না। উর্বী তা বোঝে,সে তাই নিজেই নিচে আসে না খুব একটা।
উর্বীর দিন কাটে চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে। সে এই ঘর থেকে বেরোয় না। শুধু দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব ইচ্ছে করে তার মেয়েটাকে ছুয়ে দেখতে। কিন্তু শরীর তাকে সাপোর্ট করছে না। তার হাঁটাচলা করা একেবারেই বারণ। পঙ্গুর মতো বসে থাকে বিছানায় সারাদিন। গতকাল শর্মীর ক্লাস টিচার এসে শর্মীর মিড-টার্মের রেজাল্ট কার্ড দিয়ে গিয়েছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবার শর্মী ফোর্থ হয়েছিলো। রেজাল্ট কার্ডটা আগলে ধরে রাওনাফ বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছিলো, তারপর ছুটে গিয়েছিলো হসপিটালে শর্মীকে দেখাতে।
উর্বী সে দৃশ্য দেখে কেঁদেছিলো সারাটাদিন। তারও যে মেয়েটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কবে ফিরবে তার মেয়ে তার কোলে,কবে আবার তাকে আন্টি বলে ডাকবে মেয়েটা!
কাঁদলে উর্বীর শরীরটা খারাপ হয়ে যায়। তাই কাঁদতেও পারে না ইচ্ছে করলে। গুমরে মরে।
অন্তরা কিছু ফল নিয়ে ঘরে ঢোকে।
_ভাবী আসবো?
_এসো।
উর্বী অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়।
_মা পাঠিয়েছে। আপনাকে খেয়ে নিতে বললো।
উর্বীর বুকটা হুহু করে ওঠে। তার শাশুড়ি মা আগের মতো তার কাছে আসে না। সে গর্ভবতী, সেজন্য যতটুকু দায়িত্ব তার রয়েছে শাশুড়ি হিসেবে সে সেটুকু করে দূর থেকে। অবশ্য এসব তো হবারই ছিলো। কেনো উর্বী কষ্ট পাচ্ছে!
অন্তরা বলে,”কিছু লাগলে আমায় ডাকবেন ভাবি।”
শর্মীর ঘরে শর্মীর ময়না পাখিটা শর্মী শর্মী করে ডাকতে থাকে। উর্বী কান চেপে ধরে।
অন্তরা বলে,”কি হয়েছে ভাবি? ”
উর্বী কাঁদছে। মেয়েটা কতো চাইতো পাখিটা তাকে ডাকুক।
সে অন্তরাকে বলে,
“তুমি ওটাকে প্লিজ ওই ঘর থেকে সরিয়ে নাও। আমার খুব কষ্ট হয় ওর ডাক শুনলে।”
এমন সময় রাওনাফ ঘরে ঢোকে। অন্তরা ভাসুরকে দেখে চলে যায়।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ সারাদিন অন্যমনষ্ক হয়ে থাকে যেনো উর্বীকে সে দেখতে পায় না, উর্বী যেনো তার সামনে নেই। অথচ ঠিকই টাইম টু টাইম উর্বীর যত্ন নেয়, সবকিছু করে দেয় উর্বীর। কিন্তু উর্বী বুঝতে পারে, রাওনাফ এগুলো করে তার দায়িত্ব থেকে। তার প্রতি রাওনাফের আগের মতো অনূভুতি অবশিষ্ট নেই।
রাওনাফ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে বলে,” খাচ্ছো না কেনো? খাও ফলগুলো। সকালে ভাইটামিনস ক্যাপসুল নিয়েছিলে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
“নিও মনে করে। আমি তো সবসময় বাড়িতে থাকি না।”
উর্বীর চোখ মুখ শুকনো দেখে রাওনাফ উর্বীর পাশে গিয়ে বসে।
উর্বীকে বলে,”খাওয়া দাওয়া করো ঠিক মতো। তুমি অত্যন্ত দুর্বল।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”জানেন মা না আগের মতো আমাকে ডাকে না। আমার ঘরে আসে না।”
রাওনাফ বলে,”মা বুড়ো হয়েছে,মন মেজাজও ভালো নেই। তাই হয়তো। ”
উর্বীর চোখ দিয়ে পানি পরছে। রাওনাফ বলে,” কাঁদছো কেনো? এই শরীরে এতো চিন্তা মাথায় নেওয়ার প্রয়োজন তো আমি দেখছি না।”
উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। মানুষটা তার সাথে কেমন ছাড়াছাড়া কথা বলছে।
রাওনাফ ফলের প্লেটটি নিয়ে একটা টুকরো উঠিয়ে উর্বীর সামনে ধরে,”নাও,এটা খাও।”
উর্বী রাওনাফের হাত সরিয়ে দেয়।
রাওনাফ ফলে,” সমস্যা কোথায় হচ্ছে? ”
উর্বী তার উত্তর দেয়না। শর্মীর ঘরে তুলতুল
শর্মী শর্মী বলে চেঁচাচ্ছে ।
রাওনাফ উঠে চলে যায় সেদিকে। আজ এটাকে সে বাইরে ছেড়ে দেবে।
উর্বী দেয়ালে শর্মী,রাওনাফ আর তার সেই সেলফি টার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বীর চোখ বেয়ে টুপ টুপ পানি পরে। হঠাৎ তার পেটে ব্যাথা অনুভব হয়। সে পেটে হাত দেয়।
***
রাওনাফ তুলতুলকে ছেড়ে দেয় না। সে খাচাটা নিয়ে নিচের বারান্দায় রেখে আসে। তুলতুল একনাগাড়ে শর্মী বলে চেচিয়েই যাচ্ছে।
রাওনাফ ঘরে ঢুকে দেখে উর্বী মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদছে। একটু পরপর তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাওনাফ দ্রুত উর্বীকে গিয়ে ধরে,”কি হয়েছে? এমন করছো কেনো? শরীর খারাপ করবে তো।”
উর্বী থামেনা। চোখ বন্ধ করে কাঁদছে।
রাওনাফ আবার বলে,”কি হয়েছে বলবে তো! না বললে আমি বুঝবো কি করে?”
উর্বী কান্না থামিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। তারপর বলে,”কেনো অনূভুতি চেপে রেখে আপনি গুমরে মরছেন? অভিযোগ তোলার হলে তুলছেন না কেন! আমার দোষের শাস্তি আমি মাথা পেতে নেব।
আপনিও ভাবতে শুরু করেছেন যে আমি আপনার জীবনে না আসলে আপনার মেয়েটাকে কষ্ট পেতে হতো না তাইনা? সেটা বলে নিজেকে হালকা করুন শর্মীর পাপা। একবার বলুন আপনার ভুল হয়েছে আমাকে জীবনে জড়ানো। আমি কিছু মনে করবো না। বরং শান্তি পাবো!”
রাওনাফ এবার নিজের মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। ধ’ম’কে ওঠে,”আচ্ছা দু দন্ড শান্তি কি আমি ডিজার্ভ করি না? আমারো দমবন্ধ লাগে তুমি বোঝো? আমি কিরকম মুডে থাকবো,কি রকমের রিয়াক্ট করবো তা তোমরা ডিসাইড করে দেবে? এখন কি চাও বাড়ি আসাই বন্ধ করে দেই? অন্য কোথাও গিয়ে নিজের বাচ্চাদের জন্য দুশ্চিন্তা করি? হসপিটালে মেয়েটা আধমরা হয়ে পরে আছে,তোমার পেটে যে আছে তার জীবনের ঝুঁকি আছে। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি কিন্তু তোমার নাটক থামছে না। চালিয়ে যাচ্ছো তো চালিয়েই যাচ্ছো।”
উর্বী অবাক চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উর্বীর হাত দুটো ধরে, তারপর নরম গলায় বলে,”উর্বী এখন বন্ধ করো এসব। উর্বী তোমাকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে নেওয়া আমার ভুল না। আমি কোনো ভুল করিনি। তবে ভুল একটা ছিলো, তোমার ভুল ছিলো উর্বী । আমাকে সত্যিটা না জানানো ভুল ছিলো তোমার। সব সত্যি জানলে আমি কি আমার স্ত্রী সন্তানের নিরাপত্তা দিতে পারতাম না উর্বী? তোমার কি মনে হয়?
উর্বী তাকিয়ে আছে, রাওনাফ বলতে থাকে,”যে উর্বী কথার জালে পেঁচিয়ে রুপাকে মিথ্যা প্রমাণ করলো সেই উর্বীই এতো বড় একটা বোকামি করলো? কি ভেবেছিলে? উচ্ছাসের নাম বেরিয়ে আসলে কিংবা ওকে নিয়ে ঝামেলা বাঁধলে তোমার অতীত দুনিয়ার মানুষের সামনে খোলসা হয়ে যাবে? লাঞ্চিত হবে তুমি আবারও। এটা ভেবেছিলে? এখন কি হলো উর্বী? এখন কি সেসবের বাকি কিছু আছে? উল্টো শর্মীর এই অবস্থার জন্য তোমাকে দুষছে সবাই। যদি একটাবার বলতে উর্বী,আমি একটা স্টেপ নিতে পারতাম। আর দুনিয়ার লোকের কথাই বলো,আমি কি পারতাম না তোমার হয়ে তাদের ফেস করতে? আমাকে ভরসা করে এতোকিছু বলতে পারলে,আরেকটু ভরসা করতে পারলে না রাওনাফ করীম খানকে?
কি সম্মান দিয়েছো আমাদের এই সম্পর্ককে তুমি? কি দিয়েছো? উর্বী তুমি শুধু নিজের মতো করে এই সম্পর্কটাকে দিয়েছো,পুরোটা ঢেলে দাওনি নিজের। না কখনো ভরসা করেছো আমাকে না করেছো সম্মান,শুধু নিজে ভালো থাকতে এই সম্পর্ককে ব্যবহার করেছো তুমি, আমাদের ভালো রাখতে নয়। নিজের যন্ত্রনা ভুলতে আমাকে ব্যাবহার করেছো,আমাকে দিয়েছো নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী। এটা আমার কথা নয় উর্বী,এটা তোমার আচরণে তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছো। আমি ব্যার্থ উর্বী। আমিই ব্যার্থ,তোমার স্বামী হতে পারলেও তোমার ভরসার যায়গাটা হতে পারিনি। আর আজ সেজন্য আমার মেয়েটা…..”
থেমে যায় রাওনাফ।
উর্বী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাওনাফের দিকে, অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আপনি……”
রাওনাফ উর্বীকে কিছু বলতে না দিয়ে বলে,”দয়া করো। দয়া করে নিজেও সুস্থ থাকো,আমাকেও সুস্থ থাকতে দাও। আমি ক্লান্ত উর্বী।”
উর্বী আর কিছু বলে না। রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,উঠে খুব দ্রুতই শার্ট পালটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাওনাফকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামতে দেখে অন্তরা আর মোহনা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
গাড়িতে চাবি দিয়ে রাওনাফ বসে আছে। নিজের প্রতি নিজের প্রচন্ড রাগ হয় তার। দুহাতে চুল গুলো পেছনে ঠেলে সজোরে গাড়ির দরজায় একটা ঘুষি মেরে দেয়। হাতের আঙ্গুল ফেটে রক্ত বের হবার উপক্রম। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। মুখের সামনে উর্বীর মায়াবী মুখশ্রীটা ভেসে ওঠে। আর ঐ কথাগুলো কানের কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়,”যেদিন আপনার চোখে আমি আমার জন্য বিতৃষ্ণা দেখবো শর্মীর পাপা সেদিন আমি বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলবো।”
রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে রওশান মঞ্জিলের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি দোতলার উত্তর পাশের জানালায় নিবদ্ধ।
চোখ সরিয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকায় ,তার এতো অস্থির লাগছে কেনো সে বুঝতে পারছে না। বুকে অসহনীয় যন্ত্রনা হচ্ছে,কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয় তার গলা টিপে ধরছে। আচমকা গাড়ির দরজা ঠেলে নেমে পরে রাওনাফ। তারপর দৌড়াতে থাকে রওশান মঞ্জিলের দিকে।
রওশান আরা লিভিং রুমে বসেছিলো। রাওনাফকে হন্তদন্ত হয়ে উপরে যেতে দেখে মোহনা দাঁড়িয়ে পরে।
“কি হয়েছে ভাইয়া ছুটছেন কেন? ”
রাওনাফ কিছু বলছে না। সে ছুটতে থাকে।
অন্তরা আর মোহনা তাদের ভাসুর কে এভাবে ছুটতে দেখে নিজেরাও তার পিছু পিছু যায়।
রাওনাফ গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পরে। সে যে ভয়টা পেয়েছিলো,সেটাই হয়েছে। তার শরীর কাঁপছে।
সে উর্বীকে না ডেকে সরাসরি দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে।
এরপর সে সজোরে একটা লাথি বসায় দরজাতে। দরজার সিটকিনি ভেঙে দরজা খুলে যায়।
রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। তার পিছু পিছু ঢোকে অন্তরা আর মোহনা।
উর্বী বিছানায় পরে আছে। দুচোখ বন্ধ তার। তার বাম হাত থেকে গলগল করে রক্ত ঝ’রছে। সাদা রঙের বিছানার চাদরে লাল রঙের রক্ত মিশে একটা নকশা তৈরি হয়েছে যেন। উর্বীর অন্যহাতে একটি সার্জিক্যাল ব্লেড মুঠি করে ধরে আছে। মায়া মায়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রাওনাফের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। উর্বীর চোখের পানি দু গালে লেপ্টে আছে। হয়তো তখনও কেঁদেছে। কান্না ছাড়া আর কিছু নেই এই মেয়ের জীবনে।
রাওনাফ ধপ করে বসে পরে। মোহনা বিকট একটা চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে,”ভাবী!”
অন্তরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। মানুষ এতো অদ্ভুত কেনো!
রাওনাফ উঠে ছুটে যায় উর্বীর কাছে,উর্বীর মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে চেঁচাতে থাকে,”উর্বী ওটা বিতৃষ্ণা ছিলো না। উর্বী প্লিজ চোখ খুলে দেখো। তাকাও উর্বী,বোকা মেয়ে। দয়া করো আমাকে। দয়া করো! দয়া করো প্লিজ দয়া করো।”
চলমান……