আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৩৫ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৫
#Esrat_Ety

“একটা কথা আপনি একেবারে ঠিক বলেছেন শর্মীর পাপা। আমি বরাবর আমার ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। বরাবর। আমি যে আপনার মতো স্বার্থহীন মানুষ নই,যে দুহাত ভরে অন্যকে শুধু দিয়েই যায়। আমি শুধু পেতে ভালোবাসি,যতটুকু পেলে একটা জীবন নিয়ে ভালো থাকা যায়। তাই যখন টের পেয়েছি একটা ভুল মানুষের সাথে জরিয়ে গিয়েছি আমি,যার সাথে আর যাই হোক একটা সুস্থ সম্পর্ক আসা করা যায়না। টের পাওয়া মাত্রই তার কাছ থেকে সরে আসতে চেয়েছি। শুধুমাত্র ভালো থাকার জন্যই। তারপর যখন ধ*র্ষিত হলাম, সুই’সা’ইড করার বদলে তখনও আমার মাথায় চলছিলো কিভাবে ভালো থাকা যায়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। যখন টের পেলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা, তখনও মরার কথা না ভেবে চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। ঐ পরিস্থিতিতে ভালো থাকার মানে ছিলো উচ্ছাসকে বিয়ে করে নেওয়া,বাচ্চাটাকে পিতৃপরিচয় দেওয়া। তাই ভালো থাকতে নিজের আত্মসম্মান দাফন করে একজন রে’পিস্টের কাছে গিয়েছিলাম তাকে বিয়ে করতে। কিন্তু ভালো থাকা তো আমার কপালে লেখা নেই। উচ্ছাসের জেল হলো। আমার উচিৎ ছিলো তখনই আ*ত্মহত্যা করা। কিন্তু আমি যে ভালো থাকার কাঙাল। তাই করলাম কি, পেটের বাচ্চাটাকে মারলাম,অথচ নিজে মরলাম না। কারন আমার ভালো থাকতে হবে। এই ভালো থাকার জন্য কি কি করেছি এই সাতটা বছর আপনি জানেন? আপনাকে বলা হয়নি। কিন্তু থাকিনি ভালো। কত লোকের গঞ্জনা সহ্য করেছি, লাঞ্ছনা সহ্য করেছি দীর্ঘ সাতটা বছর। সাত বছর শর্মীর পাপা। তারপরও আমি হেদিয়ে ম’রেছি একটু ভালো থাকার জন্য। এই পৃথিবীতে কে ভালো থাকতে না চায় বলুন তো? তারপর হঠাৎ করে কিভাবে কিভাবে যেনো একটা জ্যাকপট পেয়ে গেলাম,আমি আপনাকে পেয়ে গেলাম। এতো এতো দিলেন আমায় আপনি। আপনার পরিবার। আরো আরো ভালো থাকার লোভ পেয়ে বসলো আমাকে। এটাও সত্যি যেটুকু আমি সবার জন্য করেছি তাও আমার স্বার্থে, সবকিছুর মধ্যে আমি আমার ভালোথাকা খুজে নিয়েছি। আমি দেখতাম মায়ের যত্ন করলে আমি ভালো থাকছি,তাই মায়ের যত্ন করতাম, দেখতাম শর্মীকে আদর করলে আমি ভালো থাকছি তাই শর্মীকে আদর করতাম,আমি দেখতাম নাবিল শায়মীর মনে নিজের জন্য একটু যায়গা করতে পারলেই আমি ভালো থাকবো,তাই সেই চেষ্টা করতাম। সবকিছুই আমার নিজের ভালোথাকার জন্য। ঠিক বলেছেন আপনি,আমি চাইনি আমার নোংরা অতীত গণহারে সবাই জানুক,তাই উচ্ছাসকে সবার সামনে আসতে দিইনি। লুকিয়ে গিয়েছি। সবটাই ভালো থাকতে। খান বাড়ির সবার চোখে কি পরিমান অযাচিত ভালোবাসা আমি দেখেছি আমার জন্য,ঐ চোখ গুলোতে আমি আমার জন্য ঘৃণা না দেখার চেষ্টা করে গিয়েছি।
আমি চাইনি সাত বছরের ইতিহাসের আমার জীবনে পুনরাবৃত্তি হোক। আবারও দম আটকে রেখে দিন পার করি। ভীষণ দুর্বিষহ ছিলো ঐ দিন গুলো শর্মীর পাপা। গোটা জীবনটাই আমার কে’টেছে কিছু ভুল সিদ্ধান্তে। এখানে অন্য কারো কোনো দোষ নেই। ভুল গুলো করেছি শুধুমাত্র নিজে ভালো থাকতে। নিজের কথাই ভেবেছি শুধু। কিন্তু স্বার্থপরেরা যে ভালো থাকতে পারেনা শর্মীর পাপা।

আপনি ভাবতে পারেন যে চরিত্র ত্রিশেও উন্নত হয়না তার আর কি হবে?
আমার ম’রতে বরাবর ভীষণ ভয় হতো, আজ হঠাৎ নিজেকে খুব সাহসী লাগছে। সাথে আনন্দও হচ্ছে, আমার জীবনের ভুল গুলো আমার জীবনের ফুলগুলোর কষ্টের কারণ হবেনা আর। কারন আমি তো আমি। আমায় ঘৃণা করুন শর্মীর পাপা,আমি চাই আপনি করুন।”

রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে থাকা কাগজটায় চোখ বুলিয়ে রাওনাফ কাগজটা দলা পাকিয়ে হাতের মুঠোয় নেয়। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। পাশের এরিয়াতে একটা শপিং মল নির্মাণাধীন। নির্মাণ কাজের শব্দে রাওনাফ বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। তার রীতিমতো মাথা ব্যাথা করছে শব্দে।

“স্যার আসবো?”

রাওনাফ হাতের কাগজটা বিনে ছুঁড়ে ফেলে মাথা ঘুরিয়ে হেড নার্সের দিকে তাকায়,ম্লান হেসে বলে,”এসো।”

আফরিন হাতের ফাইলগুলো রাওনাফের টেবিলের ওপর রেখে বলে,”স্যার রিপোর্ট গুলো।”

রাওনাফ হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট গুলো দেখতে থাকে। নার্স আড়চোখে রাওনাফকে দেখছে। তারপর নিচুস্বরে বলে,”স্যার আজ ও.টি. করবেন?”

_হু,কেনো নয়।
রিপোর্টে চোখ বোলাতে বোলাতে বলে রাওনাফ।

_না মানে স্যার,এই পরিস্থিতিতে…

_আফরিন রোগীর জীবন আগে। তারপর সবকিছু।
দৃঢ়ভাবে জবাব দেয় রাওনাফ।

আফরিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
_আপনার খুব ধৈর্য্য স্যার।

রাওনাফ মৃদু হাসে,বলতে থাকে,”আফরিন জানো,আমার বাচ্চাগুলোকে আমি কখনো ডাক্তারি পড়াবো না। এই পেশাটা একজন মানুষকে মানুষ থাকতে দেয়না,পাথর বানিয়ে দেয়। একটা স্টোন।”

আফরিন চুপ করে থাকে, তারপর বলে ওঠে,”স্যার কফি পাঠাবো?”

_হ্যা,সেটাও জিজ্ঞেস করছো? কড়া করে। যাও নিয়ে এসো।

আফরিন চলে যেতেই লামিয়া ভেতরে ঢোকে। রাওনাফ হেসে বলে,”গুড মর্নিং! কোথা থেকে এলো! আজ তো তোমার ও.টি নেই সকালে।”

লামিয়া বসতে বসতে বলে,”এলাম। তোমার হালচাল দেখতে। হসপিটালটা তো পুরো পারিবারিক হসপিটাল বানিয়ে ফেললে।”

রাওনাফ জবাব দেয়না। লামিয়া বলে,”শর্মীর কেবিন থেকে এলাম। তোমার দুই শ্যালিকার কাছে নালিশ করছে তাকে ন্যাড়া কেনো করা হয়েছে। তার লম্বা লম্বা চুল গুলোর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।”

রাওনাফ হাসে। লামিয়া বলে,”মেয়েটাকে একটু সুস্থ দেখতে কি যে শান্তি লাগছে রাওনাফ। গত পনেরো টা দিন আমি ঘুমাতে পারিনি ঠিকভাবে তুমি জানো!”

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়, ম্লান হেসে মৃদু স্বরে বলে,”জানি। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে আমি চিনি।”

_কোথাও যাচ্ছো তুমি?
লামিয়া রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে। রাওনাফ বলে,”হু। চারশো একে।”

লামিয়া সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। বলে,”আমিও যাবো।”

_না। আমি একাই যেতে চাচ্ছি লামিয়া।

লামিয়া দাঁড়িয়ে যায়। রাওনাফ বলে,”আগে আমার বোঝাপড়া করা দরকার। তোমরা পরে যেও‌।”

লামিয়া মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”আফরিন এলে তাকে কফি নিয়ে চারশো একে পাঠিয়ে দিও। আমি আসছি।”

****
মেডিসিনের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছে। গন্ধটা সহ্য করা যাচ্ছে না। উর্বী চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না সে কোথায়। তার কি হয়েছিলো।‌ সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে লম্বা সময়ের একটা ঘুমের মতো লাগছে। সে কি ঘুমিয়েছিলো?
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চোখ খুলে সিলিংয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে এটা তার রুম নয়। তার ঘরের দেয়ালের পেইন্ট ধবধবে সাদা,আকাশী নয়।

উর্বী নড়চড়ে উঠে ডান পাশে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। দেখতে পায় রাওনাফকে। রাওনাফ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওদিকে ফিরে কফি খাচ্ছে সম্ভবত।
উর্বী চিন্তিত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকায়। সে কি হসপিটালে? এটা কোন রুম! দরজা খোলা। জানালা থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে দরজার সাদা রঙের ফিনফিনে পাতলা পর্দা সমান তালে নড়ছে,উড়ছে।
উর্বী উঠে বসতে যায়। বাম হাতে ভর করে উঠতে গিয়ে হঠাৎ বাম হাতের কব্জিতে প্র’চন্ড ব্যাথা অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে তার বাম হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ। তৎক্ষণাৎ উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়।

রাওনাফ এক পলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে আবারও ঘুরে জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে কফির মগে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে, “আমি তোমার সাহস দেখে ইম্প্রেসড। সত্যিই মৃদুলা উর্বী,আ’ম রিয়ালি ইম্প্রেসড!
ইউ আর আ জিনিয়াস! না মানে,সুই’সাই’ড করার এতো এতো আরামদায়ক পদ্ধতি থাকতে তুমি র’ক্তার’ক্তির পথ বেঁছে নিলে।

স্লিপিং পিলস খেতে পারতে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ম’রে যেতে। কিন্তু তুমি যে প্রোডাক্টিভ তা বোঝাতে চেয়েছো। আর হাতটাও কেটেছো দারুন ভাবে। একেবারে সোজা করে। আমি স্কেল দিয়ে মেপেছি। দেড় ইঞ্চি। না কম না বেশি! হাউ পারফেক্ট! রিয়ালি ইম্প্রেসিভ!”

উর্বী ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। রাওনাফ ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নিজের পেটে হাত দেয়।

রাওনাফ সেদিকে তাকিয়ে বলে,”ও ঠিক আছে। আর খবরদার ! ওর কথা তোমার ভাবতে হবে না। ওর জন্য আমি আছি।”

রাওনাফের এই কথাতে উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। রাওনাফের এই কথাটিতে তীব্র অভিমান নয়তো ঘৃণা মিশে আছে যা উর্বী টের পাচ্ছে।

উর্বী মাথা নিচু করে বসে থাকে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”ও আমার বাচ্চা। তোমার কাছে ওর কোনো মূল্য না থাকতে পারে। আমার কাছে আছে।‌‌”

উর্বী মাথা তুলে ফুঁপিয়ে ওঠে, আটকে আটকে বলে,”আমি…আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। আমি আবারও অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি শর্মীর পাপা।”

উর্বীর কান্না রাওনাফকে বিচলিত করে না। সে গিয়ে কেবিনের দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়। তারপর এসে উর্বীর বেডে,উর্বীর মুখোমুখি বসে। উর্বী চোখের পানি মুছে বলে,”ভুল করেছি আমি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”এখন যে কাজটা করতে চাচ্ছি তাতে পরে অনুশোচনা হয়তো করবো , অ’প’রা’ধ বোধে হয়তো ভুগবো মৃদুলা উর্বী, কিন্তু বর্তমানে আমার মানসিক শান্তির জন্য কাজটা করতেই হচ্ছে আমাকে। তাই আগেই সরি বলে নিচ্ছি।”

উর্বী ঝাপসা চোখে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”কি!”

উর্বী শব্দটা বলে শেষ করার আগেই রাওনাফ সজোরে তার ডান গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব উর্বী নিজের ডানগালে হাত চেপে ধরে মাথা ঘুরিয়ে অবাক চোখে রাওনাফের দিকে তাকাতেই রাওনাফ তার বাম গালে আরেকটা চ’ড় মারে, সজোরে।
উর্বী দুইগালে হাত চেপে রাওনাফের চোখের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার গাল দুটো ব্যাথায় টনটন করছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাওনাফ ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,”হাত নামাও গাল থেকে। কিছুই হয়নি তোমার। এতো বড় একটা ব্লান্ডার করেও এখানে নির্লজ্জের মতো বসে আছো জীবিত,সুস্থ শরীরে, তার এই দু’টো থাপ্পড়ে কিছুই হয়নি। হাত নামাও।”

কিছুসময় রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বী মাথা নিচু করে ফেলে। রাওনাফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
_ভুল? এটা তোমার কাছে ভুল ছিলো? নি’র্দয় মহিলা!

উর্বী গাল থেকে হাত সরায় না, না রাওনাফের দিকে তাকায়। চোখ বেয়ে আপনা আপনি পানি ঝরছে তার। রাওনাফ এগিয়ে গিয়ে উর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে তুলে ক্ষ্যাপা কন্ঠে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”স্টপ। আই সেইড স্টপ! এসব ফালতু আবেগ আমার সামনে ঝরিয়ে আর পার পাবে না তুমি! আই সেইড স্টপ।”

উর্বী পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠে, আটকে আটকে বলে,”ভুল করেছি!’

রাওনাফ সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকে,”তুমি স্ত্রী হিসেবে কতটা অযোগ্য তা তো প্রমাণ করেই দিয়েছো। আর আজ প্রমাণ করে দিয়েছো মা হবারও তোমার কোনো যোগ্যতা নেই। তুমি একজন অযোগ্য মানুষ। একটা অপাত্র তুমি। কত বড় সাহস! কত বড় ধৃষ্টতা! তোমার মধ্যে যে আছে সে তোমার একার নয়, আমারও অংশ। কতবড় ধৃষ্টতা তুমি দেখিয়েছো হার্টলেস কোথাকার।”

চেঁচাতে থাকে রাওনাফ।

উর্বী নিজের পেটে হাত রাখে। রাওনাফ উর্বীর হাতটা তার পেট থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে চেঁ’চি’য়ে বলে,”খবরদার বলেছি তো। ওর কথা আর মাথায়ই আনতে হবে না তোমার। তোমার এই ফেক কনসার্ন তুমি ভুলেও আর দেখাবে না। না আমার প্রতি,না আমার বাচ্চার প্রতি। দেখাবে না তোমার এই ফেক কনসার্ন ।”

ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে রাওনাফ বলতে থাকে,”কি শত্রুতা তোমার আমার সাথে? আজ আমাকে একেবারে সন্তান হারাই করে দিতে চাইলে! বলো কি শত্রুতা!”

উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলতে থাকে,”আমার কি হয়ে গিয়েছিলো আমি জানিনা শর্মীর পাপা….”

_কি হয়ে গিয়েছিলো জানোনা? কচি খুকি তুমি! অথচ ঠান্ডা মাথায় বিশ লাইনের একটা চিঠি লিখে ফেললে!

উর্বী হাপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”শুধু মনে হচ্ছিলো ঐযে দরজার বাইরে পা রেখে চলে গেলেন। ঐ চলে যাওয়াটাই একেবারের জন্য দূরে যাওয়া, আমার থেকে, আমার বাচ্চার থেকে।”

রাওনাফ বেডের একপাশে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পরে,উর্বীর সে কথার উত্তর না দিয়ে বলতে থাকে,”একটা উপকার করবে দয়া করে।”

_কি।
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে। রাওনাফ নিস্তেজ হয়ে বলতে থাকে,”এই বাচ্চাটিকে আমাকে দাও। সে অবধি কষ্ট করে থাকো। তারপর তোমার এই সব “মনে হওয়া” আবেগ অনুভূতি নিয়ে জা’হা’ন্নামে যাও। শুধু দয়া করে আমার বাচ্চাটাকে মেরো না। আমার এটা মনে হয়,আমার ওটা মনে হয়, এসব মনে হওয়া তুমি তোমার কাছেই রেখো!”

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”কি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম যেদিন হসপিটালে রেডিওলজি বিভাগের প্রধানের থেকে জানলাম আমি বাবা হতে যাচ্ছি আবারও। আমি চাইতাম আমার আর তোমার ভালোবাসায় কেউ জন্মাক। যার কাছ থেকে তুমি মা ডাক শুনতে পারো। একটু সময় নিতে চাচ্ছিলাম যাতে তুমি শারীরিক ভাবে একটু ফিট হও। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছে ছিলো তাই আগেই দিয়েছেন। আল্লাহর এই উপহার আমি অতি সানন্দে গ্রহণ করেছিলাম উর্বী। আর তোমার কাছে সে এতটাই তুচ্ছ হয়ে গেলো!
আরে আমি কাকে কি বলছি! একজন পাষন্ডী নাটকবাজ মহিলাকে,যার কাছে দুনিয়ার লোকজন তাকে কি দিলো, কি বেশি দিলো কি কম দিলো ,সে কার কাছ থেকে কি পেলো শুধু সেটাই ম্যাটার করে আর সে অন্যকে কি দিলো না দিলো তা নিয়ে কখনো ভাবেই না।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাওনাফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে, রাওনাফ এবার সরাসরি উর্বীর চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলে,”দয়া করে বাচ্চাটা জন্মানো পর্যন্ত অপেক্ষা করো কষ্ট করে। তারপর আমি সম্মানের সাথে তোমার সব বর্বরতাকে মেনে নেবো।

তারপর ভুলে যাবো আরেকটিবার আমার জীবনে কেউ এসেছিলো।”

উর্বী রাওনাফকে জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার চোখের পানিতে রাওনাফের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে থাকে,”কতটা নিঃস্ব লাগছিলো নিজেকে। আমি তো এই মেয়েটিকে আকরে ধরিনি উর্বী। আমি আকরে ধরেছিলাম কোমল হৃদয়ের একজন নারীকে। এই মেয়েটিকে নয়, যার আমার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। আমাদের বাচ্চার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। যে শুধু নিজের ভালো থাকাটাকে প্রাধান্য দেয়।”

একটু থেমে রাওনাফ আবারও বলে,”একজন স্ত্রীর ভুল হোক বা অন্যায় হোক, একজন স্বামী অভিযোগ তুলবে না? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এটাও একটা অধিকার! তুমি জানো? তুমি তো আমাকে সেই অধিকারও দিলে না। ভাবতাম তুমি আমাকে সম্মান করোনি,কিন্তু না ভুল আমি। তুমি আমাকে স্বামী বলেই স্বীকার করোনি।”

উর্বী কেঁদে যাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”প্রথমে শিমালা এসে চলে গেলো! তারপর তুমি এই স্টেপ নিলে। তোমরা জীবনে আসো কেন বলো তো!”

কথাটা বলতে গিয়ে রাওনাফের গলা কেঁপে ওঠে। উর্বী মাথাটা ঠেকিয়েই রাখে দুহাতে খামচে ধরে মোচরাতে থাকে রাওনাফের শার্ট। রাওনাফ বলতে থাকে,”শর্মী, শুধু বলে যাচ্ছে আন্টি কোথায়। আন্টি কেনো আসছে না। আন্টি ঠিক আছে তো! তুমি একটিবার ওর কথাও ভাবলে না, তোমাকে স্বার্থপর বললেও তো কম বলা হয় উর্বী।”

উর্বী কাঁপছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আমি বলেছি আমার প্রতিটা সন্তানের সুস্থতা চাই আমি। আর তুমি! কত বড় দুঃসাহস দেখিয়েছো একজন বাবার থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তুমি বি’কৃত মস্তিষ্কের মহিলা। যে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ডিজার্ভই করে না। তোমার উপযুক্ত স্থান পাগলা গারদ।”

উর্বী নিশ্চুপ। রাওনাফ বলে,”ভুল হয়ে গিয়েছে। সত্যিই ভুল হয়ে গিয়েছে। অন্ধের শহরে আয়না বিক্রি করেছি আমি এতদিন। ভুল করেছি। আর তার মাশুল গুনছি আমি।”

একটু থেমে আবারও বলে,”এতটাই ব্যার্থ আমি উর্বী?”

উর্বী রাওনাফের চোখে চোখ রাখে, রাওনাফ কন্ঠে পুনরায় কাঠিন্যতা এনে বলতে থাকে,”কি ভেবেছিলে! আমার সাথে একটার পর একটা অন্যায় করে ভিক্টিম কার্ড প্লে করে পার পেয়ে যাবে? এই ইনোসেন্ট চেহারা,এই চোখের পানি এগুলো দিয়ে কাজ হবেনা উর্বী। আমার তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে। তার আগে কোথাও পালাতে পারবে না তুমি। অনেক হয়েছে তোমার ভালো থাকা না থাকার হিসাব। এখন তুমি আমাকে হিসেব দাও। তুমি জীবনে যতটুকু ভালো থাকোনি,তুমি অন্যকে কি রেখেছো? হিসেব দাও আমাকে।”

উর্বী চোখের পানি মোছে। রাওনাফ উর্বীর থুতনি উপরে তুলে বলতে থাকে,”কি চাই তোমার? একটা জীবনে ভালো থাকতে, মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে আর কি চাই? জানি বলতে পারবে না। কারন তুমি পাগল,ব্রেইনলেস মহিলা। তোমার ইনটেনশনই হচ্ছে তুমি তোমার দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকবে। কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে গেলে তাকে বলবে,”আরেকটু থাকি!”

তুমি কি চাও তুমি নিজেও জানো না। তবে আমি জানি আমি কি চাই। আমি আমার সন্তান চাই উর্বী। আমি হাতজোড় করছি তোমার কাছে! আমার প্রতি এতোটা নির্দয় হয়ো না।‌
ওটাই প্রথম,ওটাই শেষ। আর কখনো কোনো অধিকারের ভিত্তিতে তোমার প্রতি অভিযোগ তুলবো না,কথা শোনাবো না, নিজের অনুভূতি জানাবো না, খারাপ লাগা ভালো লাগা শেয়ার করবো না এবং আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে একজন স্বার্থপর স্ত্রীকে তার নিজের মতো করে ছেড়ে দেওয়ার। শুধু বিনিময়ে আমি আমার সন্তানের সুস্থতা চাচ্ছি। একজন বাবা তোমাকে রিকোয়েস্ট করছে,আমার বাচ্চার ক্ষতি করার চেষ্টাও করবে না তুমি।”

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here