আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_৩৪ ( ১ম অংশ) #Esrat_Ety [১ম অংশ]

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৪ ( ১ম অংশ)
#Esrat_Ety

[১ম অংশ]

ইন্স’পে’ক্টর দীপঙ্কর রাওনাফের নীরবতা দেখে উঠে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি আসছি। খোজ নেবো আবার।”

জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ায়। দীপঙ্কর কনস্টেবল নিয়ে চলে যেতেই জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী মিতা আর আশিকের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে। তারা দুজন এসে নাবিল শায়মীকে টেনে মেঝে থেকে উঠিয়ে নেয়। মেঝে থেকে তাদের তুলে বেঞ্চিতে এনে বসিয়ে মিতা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

লামিয়া রাওনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে গিয়ে মেঝেতে রাওনাফের পাশে বসে পরে। রাওনাফ মাথা তুলে সরাসরি উর্বীর দিকে তাকায়। ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি উর্বীর পেটের দিকে এসে থেমে যায়। উর্বী পেটে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকেই দৃষ্টি দিয়ে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে নীরবতা ভেঙে নিস্তেজ কন্ঠে লামিয়াকে বলে,”ওর একটা ইউএসজি করো। কেবিনে নিয়ে যাও।”

লামিয়া বলে,”করেছি। বেবি ঠিক আছে। কেবিনে থাকতে চাইছে না। থাকুক না এখানে। ফার্স্ট এইড করা হয়েছে। তুমি শান্ত হও। এতো দিকের চিন্তা তোমার করতে হবে না। আমরা আছি তো!”

রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়,কাতর কন্ঠে বলতে থাকে,”কোন পাপের শাস্তি পেলাম লামিয়া।”

_সব ঠিক হয়ে যাবে রাওনাফ। ভেঙে পরো না এভাবে,শায়মী নাবিল ভয় পাচ্ছে তোমাকে দেখে।

রাওনাফ চুপ করে থাকে। খানিকবাদে মাথা ঘুরিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বীও একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আড়াই ঘণ্টার সার্জারি শেষ করে ডক্টর নাজমুল হুদা ও.টি. থেকে বেরিয়ে আসে। তার পিছু পিছু ট্রলিতে করে শর্মীকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করে দুজন সিস্টার। তাদের পেছনে ডক্টর শুভাশীষ রায় এবং তারিন মাহমুদা বেরিয়ে আসে।

রাওনাফ উঠে ছুটে যায় সেদিকে, শুভাশীষ এসে রাওনাফের হাত ধরে আটকে দেয়। নরম গলায় বলে,”যেও না রাওনাফ। যাস্ট রিল্যাক্স। ইনজুরিটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”

নাবিল শায়মী গিয়ে তাদের পাপাকে পেছন থেকে ধরে। লামিয়া শুভাশীষ রায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আর কোনো চিন্তার….”

_এখনও নিশ্চিত করে আমরা কিছু বলছি না। তবে কোমায় যাওয়ার কোনো আশংকা নেই,স্টেবল হতে যতটুকু সময় লাগে আরকি!

উর্বী শুভাশীষ রায়ের মুখের দিকে ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
তারিন মাহমুদা ওয়েটিং রুমের সবার দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনাদের বুঝতে হবে এটা হসপিটাল। প্লিজ। কান্নাকাটি বন্ধ করুন।”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে পোস্ট অপারেটিভ রুমের দিকে। শর্মীকে একটা আলাদা কেবিনে রাখা হয়েছে, সম্পূর্ণ সাবধানতার সাথে। রাওনাফ ধীরপায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে, জাহাঙ্গীর রাওনাফকে টেনে ধরে। রাওনাফ কাতর কন্ঠে বলে,”ছাড় আমাকে! দেখবো মেয়েটাকে। দূর থেকে।”

_সুস্থ হলে দেখবি। আয় এদিকে।
রাওনাফকে জোর করে টেনে এনে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দেয় জাহাঙ্গীর। তারিন মাহমুদা উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আপনিও যে আহত ‌। এখানে দাঁড়িয়ে কেনো! কেবিনে যান, বিশ্রাম করুন।”

উর্বী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর আজমেরী,রুমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তোরা এভাবে ভে’ঙে পরলে ওদের কিভাবে সামলাবি? রাওনাফের এই অবস্থা। চাচী আম্মার অবস্থা ভালো নেই,উর্বী ঠিক নেই। নাবিল শায়মীকে নিয়ে বাড়িতে যা। হসপিটালে এতো লোক থাকার প্রয়োজন নেই। যা বলছি।”

_আমরা কোথাও যাবো না,আমরা পাপার সাথে এখানেই থাকবো। এখানেই।

নাবিল শায়মী চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে।
লামিয়া তাদের বোঝাতে থাকে। রাওনাফ চুপ করে আছে। এক পর্যায়ে লামিয়া অনেক বুঝিয়ে,জোর করে শায়মী নাবিলকে আজমেরী আর রুমার সাথে পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে।

প্রায় সকাল হয়ে এসেছে তখন। উর্বীর জীবনের কাল রাত এখনও কাটেনি,তা উর্বী জানে। সে নির্লিপ্ত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা হাত তার পেটে।
মানুষ আসছে, মানুষ চলে যাচ্ছে,সবাই কাঁদছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না উর্বী।

আগামী আটচল্লিশ ঘন্টা না পেরোলে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিধ্বস্ত, শংকিত একটা মন নিয়ে বসে আছে একজন বাবা। অপেক্ষায় আছে ভাইবোন, অপেক্ষায় আছে ফুপি,খালারা, আত্মীয়স্বজন। অপেক্ষায় আছে আরো একজন, যার সাথে শর্মীর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।

সুমনা এগিয়ে যায় রাওনাফের কাছে। মনটাকে শক্ত করে রাওনাফকে ডাকে,”দুলাভাই!”

রাওনাফ মাথা তুলে তাকায় সুমনার দিকে। ধরা গলায় বলে,”তোমার আপার আমানত আমি অ’ক্ষত রাখতে পারিনি সুমনা। শিমালা মৃ’ত্যুর সময়েও মেয়েকে আঁকড়ে ধরে ছিলো যাতে মেয়েটা চো’ট না পায়। বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিলো। আর দেখো আজ,মেয়েটার কি অবস্থা করেছি আমি। সামান্য হাত কে’টে গেলেও মেয়েটা ঘা’ব’ড়ে যেতো। আর আজ! আমার মামনী কষ্ট পাচ্ছে,বাবা হয়ে আমি সেই কষ্টের ভাগ নিতে পারছি না।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে। তার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো।

ঝুমুর এগিয়ে এসে রাওনাফের কাঁধে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”কিচ্ছু হবে না দুলাভাই,আমাদের শর্মীর কিচ্ছু হবে না।”

****
উচ্ছাসের কেবিনের বাইরে পাহারা দিচ্ছে দুজন কনস্টেবল। শেফালী কাঁচ দিয়ে উকি দিয়ে দেখছে ছেলেকে। তার চোখের পানি শুকিয়ে গালের সাথে লেপ্টে আছে। শাখাওয়াত চৌধুরী দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সে দৃশ্য। আজ এই পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবে সে বুঝতে পারছে না। হসপিটালে আসা আগন্তুকেরা সবাই শাখাওয়াত চৌধুরীর দিকে সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে তাকায়। যে দৃষ্টি শাখাওয়াত চৌধুরীকে আরো ক্ষত বিক্ষত করে।

শেফালী ঘুরে স্বামীর দিকে তাকায়। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,”ও বেঁচে যাবে তো! শুধু প্রানে বেঁচে থাকুক। আর কখনও দেখতে চাইবো না ওকে। সারাজীবন জেলে থাকুক। কিন্তু শুধু প্রানে বেঁচে থাকুক।”

***
চুলগুলো এলোমেলো, গাঁয়ের পোশাক অগোছালো, সাদার ওপর ব্ল্যাক স্ট্রাইপের শার্টটা কুঁ’চ’কে আছে কলারের কাছটাতে, বিধ্বস্ত চেহারা, ক্লান্ত দুটো চোখ নিয়ে বসে আছে রাওনাফ। শর্মীকে আইসিইউতে শিফট করা হয়েছে। চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো রেসপন্স করেনি এখন অবধি মেয়েটা। হসপিটালে রাওনাফ একাই থাকছে রাতে। কেউ পারেনি তাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেতে। সামিউল, শাফিউল সবাই ঢাকায় এসে পৌঁছে গিয়েছে। তাদেরকেও থাকতে দেয়নি রাওনাফ। তার মেয়ের কাছে সে থাকবে। আর কেউ না।

রাত তখন দেড়টার কাছাকাছি। হসপিটাল নিস্তব্ধ হয়ে আছে পুরো। নিউরো বিভাগে পেশেন্ট কম থাকায় এই এরিয়াটা একটু বেশিই নিস্তব্ধ। রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়, তিনতলার নামাজের স্থানে গিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে নেয়, তারপর হেঁটে সোজা চলে যায় রওশান আরার কেবিনে। গিয়ে দেখতে পায় রওশান আরা ঘুমাচ্ছে। এখন অবধি জানতে পারেনি সে শর্মীর অ’পা’রেশনের ব্যাপারে। তাকে জানানো হয়নি। রাওনাফ কিছুক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কেবিন থেকে বের হয়। তারপর সোজা হেঁটে চারতলায় চলে যায়। উর্বীর কেবিন নাম্বার চারশো পাঁচ। ধীরে ধীরে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে উর্বী কেবিনে নেই। রাওনাফ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুতপায়ে তিনতলায় নেমে আসে। সোজা চলে যায় আইসিইউর সামনে। গিয়ে দেখে উর্বী দাড়িয়ে আছে দরজার কাচের ভেতরে দৃষ্টি দিয়ে। রাওনাফ সামনে এগিয়ে যায়। উর্বীর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,”কি করছো।”

উর্বী ঘুরে তাকায় রাওনাফের দিকে। রাওনাফ উর্বীর পা থেকে মাথা অবধি দেখে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”অসুস্থ তুমি। কেবিনে যাও। বিশ্রাম করো।”

উর্বী আবারও আইসিইউর ভেতরে তাকিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। উর্বী বলে ওঠে,”এখানে থাকি আমি! একা কেবিনে মনে হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে মেয়েটা আমাকে ডাকছে।”
উর্বীর কন্ঠে আকুতি। রাওনাফ উর্বীর পেটের দিকে একপলক তাকিয়ে তার মুখের দিকে তাকায়, তারপর বলে,”এমন শারীরিক অবস্থায় তুমি নেই। আমি আমার প্রতিটা সন্তানের সুস্থতা চাই।”

উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকায়। তারমানে লোকটা জানে উর্বী মা হতে চলেছে। উর্বী জানে না রাওনাফ কিভাবে জেনেছে,অথচ একদিন আগেও এই দিনটা নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা করে রেখেছিলো উর্বী।
রাওনাফের দিকে তাকিয়ে উর্বী অনুরোধ করে বলে ওঠে,”একটু থাকি!”

দুজন নার্স এসে দাঁড়ায়। রাওনাফ উর্বীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নার্স দুজনের দিকে তাকায়। নার্স দুজন মাথা নেড়ে উর্বীকে এসে ধরে। উর্বীকে অনুরোধ করে বলে,”প্লিজ ম্যাম চলুন কেবিনে। আপনাকে একটা স্যালাইন দিতে হবে।”

উর্বী যাবে না। রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উর্বীর হাত ধরে। তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায় কেবিনে। কোনো কথা না বলে উর্বীকে শুইয়ে দিয়ে নিজে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে একজন নার্সকে বসিয়ে রেখে উর্বীর কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। উর্বী একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

তিনতলায় নেমে রাওনাফ আবারও গিয়ে আইসিইউর সামনে চেয়ার টেনে বসে থাকে চুপচাপ।

***
“সিটি মেডিকেয়ার হসপিটালের চেয়ারম্যান ডক্টর রাওনাফ করীম খানের বাড়িতে স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ শাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলে শাহরিয়ার উচ্ছাস চৌধুরীর হাতে ডক্টর রাওনাফ করীম খানের ছোটো মেয়ে আহত। পুলিশের তদন্তে জানা গিয়েছে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ভিকটিমের অবস্থা গুরুতর।আসামীও পুলিশের গুলিতে আহত।”

গোটা শহরের জন্য খবরটা এরকম হলেও বাতাসে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে ডক্টর রাওনাফ করীম খানের ওয়াইফের সাথে আসামির পূর্বের প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে আসামি এই ঘটনা ঘটায়।

আত্মীয় স্বজন সবাই উর্বীকে আড়চোখে দেখছে। খবরটা রীতিমতো সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে আপাতত কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই খান বাড়ির লোকদের। তারা নিজেদের শোক কাটিয়ে উঠতে ব্যস্ত। শর্মীর জন্য উৎকণ্ঠায় সবাই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। তারা অন্য কোনো কিছুই শুনতে বা জানতে আগ্রহী নয়।

শর্মীর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। জ্ঞান ফেরা তো দূরে থাক, অবস্থার অবনতি হচ্ছে আরো। হসপিটালের আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে কষ্ট পাচ্ছে একটা ফুল,উর্বীর জীবনের ফুল।

উর্বীর শারীরিক অবস্থা আগের থেকেও খারাপ। তার প্রেগন্যান্সির খবরটা এখনও খান বাড়িতে জানানো হয়নি। সবাই যে এলোমেলো পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাওনাফ আজ তিন রাত্রি বাড়িতে যায়নি। সে হসপিটালে মেয়ের কাছেই ছিলো। রওশান আরাকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।

****
একটা দূর্ঘটনায় জীবনের কোনো কিছুই থেমে থাকে না,জীবন নদীর শ্রোতের মতোই বহমান। কিন্তু এবাড়ির মানুষদের থেমে আছে।‌ খাওয়া দাওয়া নেই, ঘুম নেই। শুধু হাহাকার। অন্তরা ঘুরে ঘুরে সবাইকে খাওয়ানোর জন্য মানানোর চেষ্টা করছে। কেউ সাড়া দেয়না। সবাই যেন নির্জীব হয়ে আছে।

উর্বীর শরীরটা খুবই দুর্বল হয়ে পরেছে। সে শুধু বসে থাকে শূন্যে তাকিয়ে। শর্মীর কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করে কিন্তু যেতে পারছে না। তাকিয়ে থাকে দেয়ালের ছবিটার দিকে। রাওনাফ-শর্মী-উর্বীর একটা সেলফি। যেটা রোজার আগে শর্মী তুলেছিলো এবং বাঁধিয়েও এনেছিলো।

রাওনাফ বাড়িতে এসে ঘন্টাখানেকের মতো থেকে চলে যায়। আজকেই তার ব্যাতিক্রম হয়েছে। রোজা রেখে এতো ধকল সামলাতে সামলাতে সেও কিছুটা ক্লান্ত, শাফিউল আর মোহনা হসপিটালে তাই খুব ভোরে বাড়িতে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলো কিছুসময়ের জন্য।

বাড়িতে আবারও পুলিশ এসেছে। বাড়ির সবাই লিভিং রুমে আসে। রাওনাফ আমীরুনের কাছে খবরটা পেয়ে নিচে নামে। উর্বীও ধীরে ধীরে হেঁটে লিভিং রুমের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের লোকগুলো এবাড়ির লোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদেরও খারাপ লাগছে।

রাওনাফ দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ,”তোমরা! দেখো আমি বলেছি ঐ স্কা’উন্ড্রেলের সর্বোচ্চ শা’স্তি আমি দেখতে চাই। ও গুলি খেয়ে পরে থাক আর যাই করুক। আমার মেয়ে,আমার মা এবং ওয়াইফ যতটুকু কষ্ট পেয়েছে তার সবটা উসুল করবো আমি দীপঙ্কর।”

দীপঙ্কর রাওনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
_আমরা এসেছি অন্য একটি ব্যাপারে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। চার মাস আগে সেন্টমার্টিনে যে মা’র্ডার টা হয়েছে তার ব্যাপারে।

রাওনাফ বলে,”তোমার মনে হয় দীপঙ্কর এখন ওসব নিয়ে কথা বলার পরিস্থিতিতে আমরা আছি? আমার মেয়েটা হসপিটালে পরে আছে। একটা স্বস্তির খবর পাইনি এখন অবধি।”

_কারন রাওনাফ এটা গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে যে মা’র্ডারটা হয়েছে সেটা শাহরিয়ার উচ্ছাস করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে,আর তাদের তথ্য অনুযায়ী তার একমাত্র সাক্ষী ছিলো তোমার ওয়াইফ।

রাওনাফ অবাক হয়ে দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে থাকে,তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায়। উর্বী তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে সামনে আসে। দীপঙ্কর বলে ওঠে,
“তোমার স্ত্রীকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে রাওনাফ। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।”

সামিউল বলে ওঠে,”দীপঙ্কর ভাই আপনি অন্তত বুঝুন এখন এসবে আমরা জড়াতে চাই না। আমাদের বাড়ির পরিস্থিতি সেরকম নেই।”

রাওনাফ শুধু উর্বীর দিকে তাকিয়েই থাকে। উর্বী বলে ওঠে,”আমি যেতে চাই। চলুন।”

দীপঙ্কর বলতে থাকে,”আমি বুঝতে পেরেছি রাওনাফ। কিন্তু এটুকু করতেই হবে। কিছু সময়ের ব্যাপার। তোমার স্ত্রীকে আমাদের সাথে যেতে হবে। তুমিও আসতে পারো চাইলে।”

***
উর্বী বসে আছে। তার সামনে বসে আছে দীপঙ্কর এবং আরো একজন পুলিশ অফিসার। মাঝখানে এক টেবিল দূরত্ব। রাওনাফ কিছুটা দূরে একটা চেয়ারে বসে আছে।

পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর উর্বীকে জিজ্ঞেস করে,”সেন্টমার্টিনে যে মা’র্ডার টা হয়েছিলো আপনি তার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী,এটা কি ঠিক?”

উর্বী মাথা নাড়ায়।

_আপনি ভি’কটিমকে চিনতেন?

_জি না।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় উর্বী।

_আসামি?

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী মাথা তুলে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বলে,”জি।”

_শাহরিয়ার উচ্ছাস চৌধুরী?

_জি।

রাওনাফ তাকিয়েই থাকে উর্বীর দিকে। দীপঙ্কর বলে ওঠে,”তো টেকনাফ মডেল থানার ওসির কাছে আপনি জবানবন্দি দিয়েছিলেন আপনি ভি’কটিম বা আ’সামি কাউকে চেনেন না। আপনি জানেন আপনার নামে এখন তথ্য গোপন করার কেস ফাইল হতে পারে?”

উর্বী দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”জানি।”

দীপঙ্কর বলে,”সেদিন কি ঘটেছিল? খু’নটা কেন হয়েছিলো? এতে কি আপনার হাত আছে?”

উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমার ওপর এটাক করেছিলো ভি’কটিম,আমাকে বাঁচাতে…”

দীপঙ্কর আরেকজন পুলিশ অফিসারের সাথে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রাওনাফ একদৃষ্টে দেখতে থাকে উর্বীকে। দীপঙ্কর বলে ওঠে,”যে আপনাকে সেদিন বাঁচাতে একটা খু’ন করলো আর গত পরশু সে নিজেই আপনার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়েছিলো। কি অদ্ভুত!”

পাশের পুলিশ অফিসার বলে ওঠে,”আপনাকে এখানে আনা হয়েছে সত্যতা যাচাই করতে। টেকনাফ মডেল থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত করে বের করেছে আসামি কে। তবে এই কাজ টা আপনি একদম ঠিক করেননি মিসেস খান,এভাবে অপরাধীর সম্পর্কে তথ্য লুকিয়ে আপনি তাকে আরো অপরাধ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। যার প্রমান আপনি পেয়েছেন। আপনি, আপনার শাশুড়ি,ডক্টর খানের ছোটো মেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছেন।”

উর্বী চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। রাওনাফ চুপচাপ উর্বীকে দেখতে থাকে। তার সবকিছু এলোমেলো ঠেকছে।

পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর বলতে থাকে,”আপনি সন্তানসম্ভবা। তাই আপনার ভালোর জন্য,যাতে আপনাকে ডেইলি ডেইলি কোর্টে চক্কর দিতে না হয় সেজন্য ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। লিখিত বয়ান দেবেন।”

উর্বী বয়ান লিখে দিতে থাকে। দীপঙ্কর বলতে থাকে,”উচ্ছাসের সাথে আপনার কি সম্পর্ক ছিলো?”

উর্বী কোনো কথা বলে না। দীপঙ্কর বলে ওঠে,”ওকেহ আই আন্ডারস্ট্যান্ড! উচ্ছাস আপনাকে বিরক্ত করতো? হুমকি দিতো কোনো?”

উর্বী দীপঙ্করের দিকে তাকায়,মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”জি।”

রাওনাফ চেয়ারের হাতলের ওপর হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দীপঙ্কর বলতে থাকে,”তবু কেন স্টেপ নেননি?”

উর্বী চুপ করে থাকে। পাশের পুলিশ অফিসার বলে,”আজ আপনার এতো ভোগান্তি আপনার নিজের জন্য ম্যাম। যাই হোক,উচ্ছাস প্রাণে বেঁচে গিয়েছে,ওর উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই দেওয়া হবে,তার জন্য আপনার একটা স্বচ্ছ এবং পোক্ত বয়ান দরকার। আশাকরি আগের মতো আইনকে ধোঁয়াশায় রাখবেন না। আর হ্যা,যদিও শাখাওয়াত চৌধুরীকে আমরা চিনি। তিনি কোনো অন্যায় করবেন না তবুও যদি আপনাকে বা আপনার পরিবারকে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করে ক্ষমতার বলে তাহলে অবশ্যই আইনকে জানাবেন।”

উর্বী বয়ান লিখে সই করে দিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়।

দীপঙ্কর বলতে থাকে,”আমরা আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি তাই অনুগ্রহ………..ম্যাম আর ইউ ওকে!”

কথা থামিয়ে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে দীপঙ্কর। উর্বীর থেকে কোনো জবাব নেই। চোখের পলকেই রাওনাফ দেখতে পায় মেঝেতে লুটিয়ে পরেছে সে।

চলমান……

নোট: এই পর্বের ২য় অংশও পোস্ট করা হয়েছে। লিংক কমেন্ট বক্সে পেয়ে যাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here