আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন,১২ পর্ব,১৩
লেখা: জবরুল ইসলাম
১২ পর্ব
অন্তরার নিচের ঠোঁট ডিমওয়ালা মাছের মতন ফোলে আছে। সেদিন ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। তবুও চিৎকার করে কাঁদতে পারেনি৷ এক হাতে ঠোঁট চেপে গলাকাটা মুরগির মতন যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে ছটফট করেছে। হাত বেয়ে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল। যেন রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।
দিনটি ছিল শুক্রবার। রাশেদা বেগমের পাশের রুমে তখন ময়নুল সাহেব চেয়ারম্যানের সঙ্গে অন্তরার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন। সবকিছু শুনে চোখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছিল। অন্তরা রান্নাঘর থেকে কেবল জানে চাচার রুমে কে একজন এসেছে৷ কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে তার কিছুই সে জানে না। ময়নুল সাহেব তখন বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। অন্তরা না জেনে রান্নাঘর থেকে এসে রাশেদা বেগমকে ফিসফিস করে বলল,
— ‘চাচার কাছে কে এসেছে তার জন্য কি চা বসাবো চাচি?’
রাশেদা বেগম আচমকা অন্তরার চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে বিছানায় ফেলে সুপারি কাটনি দিয়ে আঘাত করে বললেন,
–‘খানকি মাগীর বেটি তোর খদ্দরের দালালকে চা দিবি তাই না? চা দিবি? তা খালি চা দিবি না-কি রুমে নিয়ে শুইতেও চাস? তোর মা তো জাত-ধর্ম ছাইড়া এক জামাইর মাথা খেয়ে তোরে রাইখা আরেকটার লগে চলে গেছে। তুই ভালা হইবি কেমনে?’
সুপারি কাটনি দিয়ে আঘাতটি যেন আঁধারেই করলেন রাশেদা বেগম। চোখে কিংবা নাকে লেগে বড় ধরণের দূর্ঘটনা হতে পারতো। অন্তরা প্রথমে কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিল না। রাশেদা বেগম তখন চুলের মুঠি ধরা। অন্তরা ভয়ার্ত নয়নে তাকিয়ে কি হচ্ছে বুঝার চেষ্টা করছিল। আচমকা ঠোঁটে লাগলো সুপারি কাটনির বাড়ি। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুল। দাঁত অনেকটা ঢুকে গেল ঠোঁটে। যন্ত্রণায় ‘ওমাগো’ করে উঠলো অন্তরা। সায়মা এলো ওর রুম থেকে। চেয়ারম্যান সাহেবও পাশের রুম থেকে এলেন দৌড়ে। এসেই বললেন,
–‘এই কি হচ্ছে এখানে?’
চাচাকে দেখে অন্তরা নিঃশব্দে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে।
রাশেদা বেগম তখন স্বামীর প্রতি আরও চড়াও হলেন,
–‘কি হচ্ছে মানে? এইটা কি বেশ্যাবাড়ি? মাস্টার এই মাগীরে দেখলো কীভাবে? বিয়ের আলাপ কি এমনি দিছে? ওর যোগাযোগ না থাকলে বিয়ে আলাপ দিব? বাবা উনি আমাকে আইসা বলতেছে পাশের রুমে কি চা দেব? আগেই তো সব জানে, বুঝি না এইসব? এই খানকির ঘরের খানকিরে বাড়ি থেকে বাইর কইরা দাও। আমার মেয়েরেও নষ্ট করবো।’
চেয়ারম্যান বউকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ল্যাংড়ি তর মুখ বন্ধ কর।’ তারপর অন্তরার পেছনে লাত্থি মেরে বললেন, –‘পড়তে গিয়া নাগর জুটিয়েছিস, যা এখান থেকে উইঠা। কান্নাকাটির আওয়াজ শুনলে বড় অসুবিধা হইব। যা উঠ।’
অন্তরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে৷ ঠোঁটের আঘাত যেন ব্রেইনে গিয়েও লেগেছ। তবুও সে কোনোভাবে রান্নাঘরে গিয়ে যন্ত্রণায় কেবল চাপা কান্না করতে থাকে।
সায়মা রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। চেয়ারম্যান সায়মার দিকেও চড়াও হলেন,
— ‘তুমিও কম না৷ তোমার জন্যই পড়তে দিয়েছিলাম। আজ থেকে সব বন্ধ। তোমারও পড়তে যাওয়ার দরকার নাই। মাস্টারের ব্যবস্থা আমি করতেছি।’ কথাটি বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
অন্তরা কিছুই বুঝতে পারেনি। ঠোঁটের যন্ত্রণায় কারো কথাও ঠিক খেয়াল করেনি। কেবল শনিবারে জানতে পারে স্যারের লজিং তাদের বাড়িতে আর নেই। তিনি চলে গেছেন। বুকের গহীনে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হল। এই ব্যথা কি বিশেষ মানুষের জন্য হয়? না-কি ছোটবেলায় বাড়িতে মেহমান এসে কয়েকদিন থাকার পর বিদায় বেলায় আমাদের শিশু মনে যে কষ্ট পেতাম সেরকম ব্যথা?
অন্তরা নিজেও বুঝতে পারে না। তবে সবকিছু মরা বাড়ির মতো লাগছে। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টাই যেন অলস দুপুর কিংবা বিয়ের উৎসবের পরের নীরবতা।
অন্তরার রাতে শরীর কাঁপানো জ্বর এলো। জ্বরের সঙ্গে সর্দি কাশি। মাঝ রাতে বারংবার কাশি দেওয়ায় সায়মার ঘুম ভেঙে গেল৷ রাগে মাঝ পিঠে লাত্থি মেরে ফেলল খাট থেকে।
— ‘চিলানের ঘরের চিলান তুই আমার কাছে ঘুমাতে আসিস না। যা এখান থেকে।’
পরেরদিন জ্বর নিয়েও সারাদিন কাজ করতে হল অন্তরার। রাশেদা বেগমের প্যানপ্যানানি আরও বেড়েছে। সেই কখন বললাম গোসল করবো পানি গরম করে দিতে৷ বান্দির এখনও হল না। কাজে তো মন নাই৷ পানি গরম হবে কেমনে।
সাময়ার আচরণে কিছুদিন যে পরিবর্তন লক্ষণীয় ছিল তা যেন আচমকা খসে পড়ে আগের মতোই হয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার আগে কাপড় একগাদা দিয়ে বলল, ‘এগুলো ধুয়ে দিছ।’
জ্বর, কাশি আর ঠোঁটের ব্যথায় বিকেলের দিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল অন্তরা।
চেয়ারম্যান বক্কর আলীকে পাঠিয়ে পিয়াসের ফার্মেসি থেকে ঔষুধ আনালেন। পরেরদিনই অল্প একটু সেরে উঠলো সে।
ভোরে চা বসিয়েছে। তখন বক্কর আলী খাট এনে পাশে বসল। চা খেয়ে সে গরু নিয়ে যাবে।
অন্তরা স্যারের ব্যাপারটা আবছা আঁচ করতে পারছে। তবুও পুরোপুরি ক্লিয়ার হওয়ার জন্য অন্তরা বক্কর আলীকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
— ‘আচ্ছা স্যারের লজিং চেঞ্জ হল কেন বক্কর ভাই?’
বক্কর আলীর চেহারায় বেদনার ছাপ দেখা গেল। সে একটু ইতস্তত করে বলল,
— ‘ময়নুল মাস্টারকে দিয়ে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। এরপরই চেয়ারম্যান আর লজিংয়ে রাখলেন না।’
জিসানের প্রতি বেশ রাগই হল অন্তরার৷ ভালোই তো ছিল সে। মাঝপথে এসে সবার চোখের বিষ বানিয়ে দিয়ে চলে গেল। পড়াশোনার সামান্য পথটাও বাড়াবাড়ির কারণে রুদ্ধ হল।
— ‘চাচা বিদায় করে ভালোই করেছেন। লোকটা বাড়াবাড়ি একটু বেশিই করেছে।’
— ‘তোমরা বড় লোকের কারবার বুঝি না বইন। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া বাড়াবাড়ির কিছু না। চেয়ারম্যান সাব তোমারে বিয়ে দিতে চায় না এটাই আসল কথা।’
অন্তরা কিছুই বলল না। অবশ্য যতদূর বুঝতে পারে তারও মনে হয় বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই চাচার।
জিসানের থাকার ব্যবস্থা সভাপতির বাড়িতেও হয়নি। সেখানে একদিন থাকার পর সভাপতি প্রিন্সিপালকে জানালেন উনার বাড়িতে রঙের কাজ করাতে হচ্ছে। তাই আপাতত লজিং দেওয়া সম্ভব না। কোনো উপায় না দেখে ময়নুল সাহেব প্রিন্সিপালকে বললেন,
–‘আমার বাড়িতেই দেন। যদিও থাকার তেমন ভালো সুবিধা নেই। তবুও আপাতত একটা আশ্রয় দরকার।’
জিসান গিয়ে দেখল সত্যিই থাকার ব্যবস্থা নেই। তাকে দেওয়া হয়েছে একটা টিনের ঘরে। পাশের ঘরেই গরু-ছাগল থাকে। সেখান থেকে কটু গন্ধ আসছে।
বাড়ির উত্তর পাশে সবজি ক্ষেত। পশ্চিমদিকে হাফওায়াল টিনের ঘরে ময়নুল সাহেব পরিবার নিয়ে থাকেন।
সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে উঠোন ভর্তি হাঁস মুরগি। সেতারা বেগম আগলিয়ে ঘরে নিচ্ছেন।
জিসানের ঘরের উত্তর দিকে একটা জানালা। খাটে বসলে সবজি ক্ষেত দেখা যায়। সে আনমনে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খোলার শব্দে জিসান তাকাল।
(যারা গল্প পড়ছেন আজ কমেন্ট করে যাবেন। পেইজে রিচ কম। তাছাড়া যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি না। দেখি কারা সঙ্গে আছেন)
–চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম
আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
১৩ পর্ব
.
উঠোন ভর্তি হাঁস-মুরগী। সেতারা বেগম আগলিয়ে ঘরে নিচ্ছেন।
জিসানের রুমের উত্তর দিকে ছোট্ট একটি জানালা। খাটে বসলে সবজি ক্ষেত দেখা যায়। সে আনমনে তাকিয়ে আছে লাল টকটকে একটি টমেটোর দিকে। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খোলার শব্দে জিসান তাকাল।
ছিপছিপে গড়নের একটি ছেলে। গায়ের রঙ শ্যামলা। বিনয়ী চেহারা। মাথা ঠাসা চুল। দরজা খুলেই সালাম দিল,
— ‘আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন স্যার? হারিকেন নিয়ে আসলাম।’
— ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, ভালো আছি। তুমি বোধহয় ময়নুল স্যারের ছেলে পিয়াস, তাই না?’
— ‘জ্বি স্যার।’
— ‘তোমার বাবা কোথায়, দেখছি না যে?’
— ‘আমার ফুপু অসুস্থ৷ উনার আবার সন্তানও নাই। ফুপাও বয়স্ক মানুষ। তাই আব্বা গেছেন হসপিটাল নিয়া।’
— ‘ও আচ্ছা। তুমি শুনলাম ফার্মেসি দিয়েছো? কেমন চলছে?’
— ‘ভালোই চলছে স্যার। ধীরে ধীরে পুরো এলাকার মানুষ জানছে। গতকাল আপনার লজিং বাড়ির মেয়ের জন্য ওষুধ নিতে এসেছিল বক্কর আলী। চেয়ারম্যানের ভাতিজি না-কি অসুস্থ। তারমানে আমার ফার্মেসির কথা পূব পাড়ার মানুষও জেনে গেছে। আল্লা পাকের রহমতে ব্যবসা আরও জমবে।’
চেয়ারম্যানের ভাতিজির অসুখ শুনে জিসানের মনে হল কেউ তার কলিজা শক্ত করে হাতের মুঠোয় নিয়ে ডান-বামে একটা মোচড় দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বিস্ময়ে বলল,
— ‘চেয়ারম্যানের ভাতিজির অসুখ মানে, কি অসুখ?’
— ‘জ্বর-কাশি। ঠোঁটও কীভাবে জানি কেটে গেছে বলল। ব্যথার ঔষুধ দিয়ে দিছি।’
পিয়াস হারিকেন আঙটায় রেখে রুম ত্যাগ করে। জিসানের মনটা ছটফট করতে শুরু হল। অন্তরার জ্বর-কাশি? ঠোঁটও আবার কীভাবে কাটলো? কি করবে এখন সে? লজিং থেকে আসার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। আসার সময় বলে আসতেও পারেনি। কেমন আছে অন্তরা। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ভেজা চোখের সহজ সরল গোলগাল একটি মুখ। বুক থেকে মাথা অবধি কালো ওড়না পেঁচিয়ে রাখা আরবীয় কোনো সুন্দরী রমনী। জিসানের শরীরের লোম যেন দাঁড়িয়ে গেল। ক’দিন থেকে এরকমই হয়। অন্তরার কথা ভাবলেই হাতের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে এই মেয়েটি কি তাকে সম্পূর্ণ দখল করে নিয়েছে? নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে জিসানের। ক্রমশ একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে সে। মেয়েটিকে কি ভালোবেসে ফেলেছে? ঠিক বুঝতে পারে না। কেবল মায়া লাগে৷ ওর জন্য কষ্ট হয়। দেখতে ইচ্ছে করে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টানতে লাগল। কেমন অস্থিরতা। দরজা খুলে বাইরে বেরুল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। গ্রামে সন্ধ্যার পর পরই যেন নেমে আসে ঘন আঁধারে ঢাকা গভীর রাত। ঝি ঝি পোকারা পেছনে বাতি জ্বালিয়ে উড়াউড়ি করছে। নাম না জানা অসংখ্য পোকার ‘খেউ-খিউ’ ডাক শোনা যাচ্ছে। জিসান পায়চারী করে সিগারেট টেনে নানান ভাবনায় ডুবে গেল। চেয়ারম্যান বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল কেন? তাকেই বা লজিং থেকে বের করে দিল কেন? বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া কি এতোটাই বড় অপরাধ? সেই অপরাধের শাস্তি অন্তরাকেও পেতে হচ্ছে কি-না কে জানে!
ওর খোঁজখবরই বা কীভাবে জানবে সে? দেখতেও যে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷ এসব ভাবতে ভাবতে নিজের মাথার চুল ধরে টানছিল। কিছুই ভালো লাগছে না৷
যতদূর জানে বাড়ির পেছনে বাইরের চুলোয় রান্নাবান্না করে অন্তরা৷ উপরে শুধু টিন। চারদিক খোলা। কিন্তু সেখানে যাওয়াটাই বিপজ্জনক। বাড়ির উত্তরে উঁচু দেয়াল। দক্ষিণে কবরস্থান৷ পূবদিকে উঠোন। পশ্চিমে বাড়ির পেছনে বিশাল একটা বিল। লুকিয়ে দেখা করার একটাই সময়, সেটা সন্ধ্যা। আর একটাই পথ সেটি বিল দিয়ে কবরস্থানে যাওয়া। কিন্তু তার দ্বারা সেদিকেও যাওয়া সম্ভব মনে হচ্ছে না। হাওরের রাস্তাঘাট সে চিনে না। কোনদিকে কীভাবে সে বিলের পাড়ে যাবে তাও জানে না। তাছাড়া এতো বিশাল বিল সে সাঁতার কেটে পাড়ি দিবেই বা কি করে? কারো সহযোগিতা দরকার। ময়নুল সাহেবের মতো মধ্য বয়স্ক পুরুষ কি তাকে একটা মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করার জন্য সহযোগীতা করবেন? এদিকে মোবাইলও অফ হয়ে আছে। ময়নুল সাহেব মোবাইল কোথায় চার্জ দেন কে জানে। পিয়াসকে বলে চার্জের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাতের খাবার টিফিনে করে রুমে এনেই দেওয়া হল ৷ জিসান ভেবেছিল বলবে,
–‘আমি আপনাদের ঘরে গিয়েই খাব। এখানে পাশের ঘর থেকে বাজে গন্ধ আসছে।’ শেষমেশ বলতে পারলো না৷ বলা ঠিক হবে কি-না ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। পারফিউম থাকলে হয়ে যেত। এখন সেটাও নেই। কোনোভাবে খাবারটা খেয়ে সে শুয়ে গেল। খানিকবাদেই গভীর ঘুম চোখে নেমে এসে পাতা বুঁজে দিল। হঠাৎ করে স্বপ্নে দেখলো সে আর অন্তরা একটি স্কুলের মাঠে হাঁটছে৷ ওর হাত ভর্তি বাচ্চাদের রঙিন চুড়ি। খোলা চুল। পরনে নরম সুতোর খয়েরী রঙের শাড়ি। টাকনু অবধি বৃষ্টির চপচপে পানি জমেছে মাঠে। হাত ধরে দু’জন শব্দ তুলে হাঁটছে। হালকা ঠান্ডা বাতাস। অন্তরার শাড়ির আঁচল উড়ছে। উড়ছে কাক কালো চুলও। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে যেয়ে পেছনে তাকিয়ে জিসান বারংবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অন্তরা হাতে হালকা টান দিয়ে বলছে, ‘কি হল? দাঁড়িয়ে যাচ্ছ কেন বারবার?’
জিসান আবার হাঁটে। স্বপ্নের ভেতর তার ওইদিনের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। আচমকা দাঁড়িয়ে বলে, ‘ক’দিন আগে স্বপ্নে দেখলাম আমাদের বাসর রাত বাইরে কাটাচ্ছি৷ একটা সবুজ গরু এবং মানুষও দেখেছি। স্বপ্নে তোমার শাড়ি পরনে ছিল। বাস্তবে আজ প্রথম দেখলাম। হালকা স্বাস্থবতী মেয়েদের শাড়িতে দারুণ লাগে।’
অন্তরা ফিক করে হেঁসে বলে,
–‘সবুজ গরু, সবুজ মানুষ। হা-হা-হা। কি অদ্ভুত স্বপ্ন তোমার।’
আবার তারা হাঁটে। খানিক এগুতেই অন্তরা বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো ‘জোক জোক’ বলে চিৎকার শুরু করে দেয়।
জিসান ঠান্ডা মাথায় বলল,
— ‘সমস্যা নাই আমি দেখছি। লাফাবে না দাঁড়াও।’
অন্তরা তাকে ধাক্কা দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— ‘তুমি পারবে না, প্লিজ অন্য কাউকে ডেকে আনো।’
জিসান চারদিকে তাকিয়ে দেখলো সে ছাড়া অন্তরাকে জোক থেকে বাঁচানোর মতো আশেপাশে কেউ নেই৷ তখনই কেঁপে উঠলো ঘুম থেকে। পাশের ঘরের টিনে বোধহয় গরু লাত্থি কিংবা লেজের আঁচড় মারল। এরপর সারারাত চোখে ঘুম এলো না। এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটে গেল। দূর দূরান্ত থেকে মুয়াজ্জিনের মধুর সুরে ভেসে এলো, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান-নাউম।’
তার কাছে সুরটা কেমন অপার্থিব লাগছে। ভেতর নাড়া দেওয়ার মতন সুর। অন্তরা এখন কি নামাজ পড়বে? এক ইশ্বরের ইবাদতে এখন মাথা নত করবে সে? কি মনে করে জিসান উঠলো। দরজা খুলে বাইরে পা রাখতেই ভোরের শীতল হাওয়া ভিজিয়ে দিল শরীর। চারপাশ মেঘাচ্ছন্ন।
এখনও পুরোপুরি ভোরের আলো ফোটেনি। সবজি ক্ষেতের সামনে খানিক্ষণ পায়চারী করলো সে। বদ্ধঘর থেকে সমস্ত নীরবতাকে ফালাফালা করে কাঁপিয়ে তুলছে মুরগীর ডাক। ভোর হলে চিৎকার করে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া তাদের অঘোষিত দায়িত্ব। সবজি ক্ষেতের পশ্চিম পাশে বাঁশ বাগানের মাথা থেকে হঠাৎ কিছু সাদা বগ উড়ে যেতে দেখা গেল। আরেক দিকে কাকের ‘কা কা’ ডাক। সবকিছু জিসানের কাছে কেমন অপার্থিব লাগছে। চাপাকলের দিকে পা বাড়াল নামাজের জন্য অযু করতে। সেখানে গিয়ে কি এক দ্বিধাদ্বন্দে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর অযু না করেই ফিরে এলো নিজগৃহে।
–চলবে…